ভুলুর ভুল
কার্ত্তিক চন্দ্র পাল
অন্যদিন হলে টুবলুর চাঁদি চমকে যেতো।
অলক্ষ্যে চাঁদির লক্ষ্যে তর্জনী আর মধ্যমাকে আংটার মত করে যে গতিতে নামিয়ে আনে ভুলু তাতে অন্য কেউ হলে অক্কা পেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই; কেবল টুবলুর টিকিই অমন টোকায় অভ্যস্ত। টুবলু আবার আরেক কাঠি উপরে; সে পাঁচ আঙুল শুদ্ধু গোটা মুষ্টিবদ্ধ হাতটাই নামিয়ে দেয় মুগুরের মত ভুলুর পিঠে।
কিন্তু আজ একদম অন্যরকম। ভুলু ভুলে গেছে টুবলুর টিকি, আর টুবলু যেন ভুলুর পিঠ চেনেই না।
কেউ হয়তো ভাববে অনেকদিন শত্রুতার পর ওদের বন্ধুত্ব গজিয়েছে। কিন্তু হাওয়া বইছে উল্টোদিকে। বা বলতে পারো একেবারে বইছেই না। ভীষণ গুমোট আবহাওয়া।
ব্যাপারটা তবে খুলেই বলি।
টুবলু আর ভুলু -এক চিমটে দুই বাহু। কোন কাজ দুজন ছাড়া করে না। কাজ না থাকলে দুই বাহু ঠোকাঠুকি করে কুশল জিজ্ঞাসা করে: ভুলুর গাঁট্টা বলে 'কেমন আছিস' টুবলু কিল ভুলুর পিঠে তাল দিয়ে বলে 'ভালো'।
দুজনেই একেবারে হরিহর আত্মা। তা সে সুকাজ হোক বা কুকাজ। তাদের গরিব সহপাঠী বেণুকে খাতা কলম কিনে, বই দিয়ে সাহায্য করা থেকে গণেশদের বাগানে আম চুরি করা সকল কাজেই এই দুজনে মুরুব্বি। ক্লাসেও প্রথম আর দ্বিতীয় স্থান এরা দুজনেই পালা করে অধিকার করে রাখে। শিশু শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণি অব্দি আজ পর্যন্ত এর অন্যথা হয়নি।
কিন্তু গতকাল যা হল তাতে মনে হচ্ছে চিমটের দুই বাহুর বেঁকে 'দ '; আর তা দিয়ে কোন কাজ হবে বলে বোধ হচ্ছে না।
আসলে ভুল ভুলোমনটাই এত দিনের বন্ধুত্ব ভুলিয়ে দিল। ভুলুর নামটাই তো সেই সুবাদে অর্জিত। দোকানে লঙ্কা আনতে বললে আনবে নুন কিংবা ডাল আনতে গিয়ে আনবে ডালমুট। একদিন সাইকেল নিয়ে দোকানে গিয়ে ফিরে এলো হেঁটে হেঁটে। সাইকেলের কথা সে বেমালুম ভুলে গেছে। সেই থেকে মা নাম দিল ভোলা, তা থেকে দিদির স্নেহে ভুলু আর সেই নাম কিভাবে রাষ্ট্র হয়ে গিয়ে আসল নামটাই ভুলুর মাহাত্ম্যে ভুলে গেল সকলে।
যাক সে ইতিহাস। আসল ব্যাপারটা হলো আগামীকাল স্কুলে যে প্রবন্ধ প্রতিযোগিতাটা হবে তাতে প্রতিবারের মত টুবলু ভুলু অংশগ্রহণ করেছে। প্রতিবার ওদের মধ্যেই কেউ প্রথম অথবা দ্বিতীয় হয়। এবার ভুলুর মামারবাড়ির প্রফেসর দাদু এসেছিল, প্রবন্ধটা দাদু ভালো করে লিখে দিয়েছে।
গতকাল টুবলুদের বাড়িতে নতুন ফোন এসেছে। গল্প হচ্ছিল টুবলু ফোনে অজানা কাদের বাড়িতে কি কথা বলেছে সেই নিয়ে। তখনই ভুলু প্রফেসর দাদুর লেখা প্রবন্ধের কথা উল্লেখ করলো। টুবলু সেটা দেখতে চাইলে ভুলু মনেই করতে পারল না সেটা কোথায় রেখেছে। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পেল না। বিকালে মাঠে টুবলু তাই রেগে গিয়ে বললো -"ঠিক আছে এবার না হয় আমি শার্লক হোমস পাবনা তবে তুই সত্যি কথা বললেই পারতিস যে দেবো না"। স্কুলের স্যার নাকি বলেছেন ফার্স্ট প্রাইজ শার্লক হোমস সমগ্র।
" আমি চেয়েছি বলেই তুই খুঁজে পাসনি" -বলেই টুবলু মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়।
এদিকে ভুলুর তো ভীষণ মন খারাপ। একে তো প্রবন্ধ লেখা কাগজটা পাচ্ছে না, তায় আবার টুবলুর দেওয়া বদনাম। পড়াশোনায় মন নেই। কাল সে আর প্রবন্ধ লিখবে না স্থির করেছে।
এবারের প্রথম পুরস্কার শার্লক হোমস পেয়েও টুবলু যেন বিশেষ খুশি নয়। টুবলু বুঝতে পারছেনা ভুলু প্রতিযোগিতার দিন কেন এলোনা সত্যিই সে প্রবন্ধের কাগজটা খুঁজে পায়নি নাকি তার উপর রাগ করেছে! মনটা সবসময় খচখচ করছে। নতুন বইয়ের গন্ধ পেয়েও বইটা পড়তে ইচ্ছে করছে না।
এদিকে ভুলু পরেরদিন খেলার মাঠে যায়নি, বাড়ি বসে একটা অংকের ভুল ধরার চেষ্টা করছে। ঘুরেফিরে একটা চাপা অভিমানের গুমোট ভাব চেপে বসেছে মনে।
খাটের তলা ঝাঁট দিতে গিয়ে একটা কাগজ পেয়ে মা ভুলুকে জিজ্ঞাসা করল- "দেখতো এটা কিসের কাগজ"
ভুলু দেখল এটাই সেই প্রবন্ধের পাতা। এই সেই আসামি যার জন্য বন্ধুত্ব বিলোপ। ভুলু রেগেমেগে ছিড়তে গিয়ে দেখে ওটাতে একটা ফোন নাম্বার লেখা। কাদের বাড়ির ফোন নাম্বার সেটা কিছুতেই মনে করতে পারে না ভুলু। এ তো যার তার ভুলে যাওয়া নয়, ভুলুর ভুলে যাওয়া!
মগজ খেলিয়ে ফোন করে নম্বরের মালিক কে তা ধরার চেষ্টা করল। কিন্তু খোঁড়ার পা খানাতেই পড়ে। নম্বরটা ছিল টুবলুর বাড়ির। প্রথম ফোন নেওয়ার দিনই ভুলু ওটা টুকে নিয়েছিল ওই কাগজের উপরে।
ফোন ধরেছেন টুবলুর বাবা। বললেন-" কি ব্যাপার রে ভুলু? দেখা সাক্ষাত নেই কেন? টুবলুর সঙ্গে কিছু হয়েছে বুঝি?"
- "না মানে তেমন কিছুনা ।"
"কিছু নয় মানে! দাঁড়া। ফোনটা ধর, টুবলুকে দিচ্ছি।"
তারপর?
তারপর আর কি, আবার যথা পূর্বং।
শুধু টুবলুকে তার শার্লক হোমস না পড়েই ভুলুকে দিতে হয়েছে, এই যা।
___________________________________________________________________________________________
কার্ত্তিক চন্দ্র পাল
রাজগঞ্জ, বর্ধমান।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন