কুর্চি আর লিলির গল্প
বনবীথি পাত্র
ওদের বাড়ির সামনের বাগানটা উচুঁ পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। তার ওপর আবার কাঁটাতার দেওয়া আছে। বাগানের গেটটাও সব সময় তালা দেওয়া থাকে। বাগানের মধ্যে বাইরের কেউ ভেতরে আসতেই পারে না। তাহলে ওই মেয়েটা বাগানে ঢুকল কী করে! কুর্চি প্রথমে ভেবেছিল ওর চোখের ভুল। কিন্তু সাহস করে আর একটু এগিয়ে যেতেই স্পষ্ট দেখতে পায়। ওই তো পাঁচিলের ধারে কাগজ ফুলের গাছটার নীচে বসে আছে মেয়েটা। কুর্চির থেকে বয়সে হয়ত একটু ছোটই হবে। পায়ে পায়ে কখন যেন মেয়েটার কাছে চলে এসেছে কুর্চি। রূপকথার বইতে যেমন সুন্দর সুন্দর মেয়েদের ছবি থাকে, মেয়েটা দেখতে ঠিক সেইরকম। অত সুন্দর দেখতে হলে কী হবে, মেয়েটা হাঁটু মুড়ে বসে বসে কাঁদছে। দু চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জলের ধারা। কেউ মনে হয় মেরেছে মেয়েটাকে। চুলগুলো এলোমেলো। মুখে, হাতে লাল লাল খামচে দেওয়ার মত দাগ। ওর গোলাপী জামাটাও ছিঁড়েখুঁড়ে যা তা অবস্থা। মেয়েটাকে দেখে ভীষণ মায়া হয় কুর্চির। সে নরম গলায় মেয়েটাকে জিজ্ঞাসা করে,
-এই মেয়ে তোমার এমন দশা কে করেছে?
কুর্চির কথায় চমকে ওঠে মেয়েটা। ওকে ভয়ে আরও জড়োসড়ো হয়ে যেতে দেখে কুর্চি বলে,
-তোমার কোন ভয় নেই। আমাকে বলো কে তোমাকে মেরেছে। আমি বাপীকে বলব তাকে খুব বকে দিতে, যাতে সে তোমাকে আর কখনও বিরক্ত না করে।
মেয়েটা তখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলেছে। ওকে ওইভাবে কাঁদতে দেখে কুর্চিরও কান্না পেয়ে যাচ্ছে। সে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,
-তোমাকে কাঁদতে দেখে আমারও কান্না পেয়ে যাচ্ছে। তুমি কেঁদো না বন্ধু। ইস্ এতক্ষণ কথা বলছি তোমার নামটাই তো জানা হয়নি।
হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে মেয়েটা বলে,
-আমার নাম লিলি। একটা দুষ্টু মেয়ে আমার ওপর এমন অত্যাচার করেছে।
খুশিতে কলকল করে ওঠে কুর্চি।
-তোমার নামও ফুলের নামে, আমার নামও তাই। আজ থেকে আমরা দুজন বন্ধু। তুমি একটু অপেক্ষা করো। আমি দৌড়ে গিয়ে বাপীকে ডেকে আনছি। বাপী ঠিক ওই দুষ্টু মেয়েটাকে খুঁজে বের করে খুব বকে দেবে।
বাগান থেকে ছুট্টে ঘরে এসে বাপীর হাত ধরে টানতে টানতে বাগানে নিয়ে যায়। যেতে যেতেই এতক্ষণের সব ঘটনা গড়গড় করে বলে ফেলে বাপীকে। কিন্তু লিলি কোথায় গেল! এইখানেই তো বসেছিল। কোথাও তো নেই লিলি। কাগজ ফুলের গাছটার নীচে লিলি ফুলের গাছগুলো কেমন ঘাড় নেতিয়ে পড়ে আছে। আজ দুপুরে বাগানে খেলা করার সময় একটা প্রজাপতিকে ধরতে গিয়ে লিলি গাছগুলোর ওপরেই পা দিয়ে ছুটোছুটি করেছে কুর্চি। সামনেই বর্ষা আসছে, সবে কুঁড়ি এসেছিল গাছগুলোতে। কদিন পরেই ফুল ফুটত। গাছগুলো নষ্ট করার জন্য মা খুব বকেছে। তখন মায়ের ওপর খুব রাগ হয়েছিল কুর্চির। কাঁদতে কাঁদতে দোতলার ঘরে এসে শুয়ে পড়েছিল। এতক্ষণ তাহলে সে স্বপ্ন দেখছিল!
হলেই বা স্বপ্ন! কুর্চির চোখে এখনও লিলির কান্নাভেজা মুখটা ভাসছে। লিলি আসলে ওই লিলি ফুলের গাছগুলোই ছিল। নিজের ভুলটা বুঝতে পারছে কুর্চি। আর কখনও সে কোন গাছকে কষ্ট দেবে না। বিছানা থেকে নেমে তড়বড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে। মায়ের পেটে মুখ গুঁজে বলে,
-সরি মা, আমি আর কোনদিনও কোন গাছকে কষ্ট দেব না।
মনের মধ্যে এখন আর কোন কষ্ট নেই কুর্চির। মণিদীপা ম্যাম ঠিকই বলেছিল, কোন অন্যায় করে ফেললেও সেটা সবসময় স্বীকার করে নিতে হয়, তাতে নিজের মনেই আনন্দ হয়।
_____________________________________________________________________________________
বনবীথি পাত্র
পাটুলি স্টেশন বাজার
পূর্ব বর্ধমান
পিন: ৭১৩৫১২
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন