ভুবনমোহিনী ভুটান
জয়ন্ত দাস
ভারতের প্রতিবেশী ছোট্ট একটি পাহাড়ি দেশ ভুটান। জনসংখ্যায় পশ্চিমবঙ্গের একটি প্রান্তিক জেলার থেকেও ছোটো। কিন্তু শৃঙ্খলাবোধ, স্বচ্ছতা ও পরিবেশ সচেতনতায় রাজতন্ত্রের এই দেশটি পৃথিবীর অনেক প্রগতিশীল দেশের কাছেই দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারে। প্রকৃতি যেমন তার অপার সৌন্দর্যকে উজাড় করে দিয়েছে এখানে, তেমনি এদেশের মানুষজনও যেন প্রকৃতিরই অনন্য সৃষ্টি। সদাহাস্যমুখের মানুষগুলির অকৃত্রিম ব্যবহার আপনাকে মুগ্ধ করবেই।
ফুন্টশোলিং থেকে পারোর দুরত্ব ১৬০ কি.মি.। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথের চড়াই উতরাই পেরিয়ে কখনো ধূসর আবার কখনো সাদা পেঁজা তুলোর মত ভাসমান মেঘকে সাথী করে এগিয়ে চলল আমাদের টোয়াটো কোস্টার। আমাদের গাইড-কাম-ড্রাইভার গুরুং ভাই জানাল, সামনের রাস্তায় ধস থাকায় ঘুরপথে আরও বাইশ কি.মি. অতিরিক্ত পথ পরিক্রমা করতে হবে আমাদের। মাথার উপরে সূর্য মেঘেদের সাথে লুকোচুরি খেলায় ব্যস্ত। মাঝে ক্ষণিক বিরতি। চুখায় একটি রেস্তোরাঁয় দ্বিপ্রাহরিক আহারের ব্যবস্থা। অত্যন্ত সুস্বাদু খাবার। খাওয়া শেষ করে আবার পথচলা। অবশেষে সন্ধ্যা নামার প্রাক্-মুহূর্তে পারো পৌছনো গেল। দূর থেকে পারো বিমানবন্দরের অপরূপ সৌন্দর্য চোখের প্রশান্তি এনে দিল। রাত্রে হোটেলে বিশ্রাম নিয়ে পরদিন ভোর হতেই বেরিয়ে পরলাম ক্যামেরা হাতে। সঙ্গী হল সুজনভাই আর সুপর্ণা। গন্তব্য হোটেলের পাশ দিয়ে বয়ে চলা পারো চু (পারো নদী)। খরস্রোতা নদী যেন আমাদের স্বাগত জানানোর জন্য নব শৃঙ্গারে সেজে উঠছে। সময় যেন থমকে গেছে এখান এসে।
পারো চু (নদী)
বাটার টোস্ট অমলেট আর ফলের রস দিয়ে প্রাতরাশ সেরে হোটেল থেকে যখন বেরোনো গেল তখন ঘড়ির কাঁটা সকাল ন' টা ছুঁই ছুঁই। হালকা শীতের আমেজ আর নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক শোভায় মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে উঠল। শহর পারোকে পিছনে ফেলে গাড়ি ক্রমশ এগিয়ে চলল গ্রামীণ পারো উপত্যকার উদ্দেশ্যে। পারো চু (নদী)-কে সমান্তরালে রেখে দুপাশের সোনালী ধানের বিস্তীর্ণ ক্ষেতের পিছনে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকা সবুজ পাহাড়ের বুকে ব্যাজের মত সেঁটে থাকা মেঘেদের দুষ্টুমি দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পারো টাকস্যাং (যা টাইগারস নেস্ট নামে বিশ্ববিখ্যাত-এর উদ্দেশ্যে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩,১২০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এক সুবিশাল প্রস্তরখণ্ডের গা বেয়ে ঝুলে থাকা এই বৌদ্ধ বিহারকে ভুটানের অন্যতম আইকন হিসাবে গণ্য করা হয়। ১৬৯২ সালে নির্মিত এই মোনাস্ট্রি গুরু পদ্মসম্ভবা (যিনি ভুটানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তন করেন বলে ধরা হয়)-র গুহা মেডিটেশনের স্মারক হিসাবে সমগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র স্থান। লৌকিক বিশ্বাস অনুযায়ী গুরু পদ্মসম্ভবা বাঘের পিঠে চড়ে এই দুর্গম গুহায় উড়ে যান এবং সেখানে ৩ বছর, ৩ মাস, ৩ সপ্তাহ, ৩ দিন, ৩ ঘন্টা ধ্যানমগ্ন থাকেন। এই লৌকিক কাহিনিসুত্রেই এই স্থানের নাম 'টাইগারস নেস্ট' । আমার ভ্রমণসঙ্গীদের বশিরভাগই এই দুর্গম পথ ট্রেক করে যাওয়ার সাহস সঞ্চয় করতে না পেরে রণে ভঙ্গ দিল। কিন্তু এই অধম শুধুমাত্র কাছ থেকে ছবি তোলার বাসনায় নব্য যুবক পাপাইকে সঙ্গী করে দুর্গম পথের দিকে পা বাড়াল। হাতে দু'টো ক্যামেরা আর হার না মানা জেদ সম্বল করে উপরের দিকে উঠতে শুরু করলাম। উপর থেকে পারো উপত্যকার অপরূপ সৌন্দর্য যেন প্রানে আরও সাহস সঞ্চার করল। অবশেষে ক্যাফেটোরিয়া পর্যন্ত পৌছনো গেল। বেশ কিছু ছবি সংগ্রহ করে নিচে নেমে আসতে বাধ্য হলাম সঙ্গীদের উৎকণ্ঠার ফোন পেয়ে। পরের গন্তব্য 'কিছু লাখাং মন্দির'। পাহাড়ের কোলে এক নিভৃত শান্তির স্থল এই মন্দির। এর বর্ণময়তা আপনাকে মোহিত করবেই। মন্দির দর্শন করতে করতেই বেলা দুটো বেজে গেল। গুরুং ভাই জানিয়ে দিল হোটেল ফিরে যেতে হবে দুপুরের খাবার জন্য। সোনালী ক্ষেতের বুক চিরে এগিয়ে চলল গাড়ি।
পারো ট্যাকসাং বা টাইগার্স নেস্ট মোনাষ্ট্রি
কিছু লাখাং মন্দির
হোটেল কর্তৃপক্ষ দুপুরের আহারে এলাহি বন্দোবস্ত করেছিলেন, কিন্তু দিনের নির্দিষ্ট সফরের অবশিষ্ট অংশের প্রতি অমোঘ আকর্ষণে যত শীঘ্র সম্ভব খাওয়া শেষ করে দ্বিতীয়ার্ধের পরিদর্শনে বেড়িয়ে পড়তেই হ'ল। গুরুংভাই জানাল পরবর্তী গন্তব্য পারো মিউজিয়াম। পারো নদীর উপর কংক্রিটের সেতু পেরিয়ে সমতলকে পিছনে ফেলে গাড়ি ক্রমশ এগিয়ে চলল টা জং (ভুটানের জাতীয় সাংস্কৃতিক মিউজিয়ম)-এর দিকে। অতীতে এই টা জং(দুর্গ) আদপে রিনপাং জং (প্রধান প্রশাসনিক দুর্গ)-এর সুরক্ষার জন্য ওয়াচ টাওয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হত। মিউজিয়ামের অন্দরে প্রবেশ করে দেখা গেল সেখানে রয়েছে ভারত-ভুটান মৈত্রী সম্পর্কের স্মারক হিসাবে রক্ষিত নানা সময়ের ভারতের রাষ্ট্রনেতাদের ভুটান সফরের নানা আলোকচিত্র। এছাড়া রয়েছে ভুটানের লোক সংস্কৃতির নানান রেপ্লিকা। মিউজিয়ামের ভেতরে ছবি তোলার অনুমতি নেই। ২০১১ সালের বিধ্বংসী ভূমিকম্পে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ১৬৪৯ সালে নির্মিত এই দুর্গ আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে স্বমহিমায়। মিউজিয়াম পরিদর্শন সেরে যাওয়া হল রিনপাং জং-এ। ১৬৪৬ সালে পারোর স্থানীয় অধিবাসীবৃন্দের অনুরোধে তৎকালীন গভর্নর এই বৌদ্ধ বিহার তথা প্রশাসনিক দুর্গের স্থাপন করেন। এই দুর্গের স্থাপত্যরীতি সত্যিই অসাধারণ। নৈশালোকে এই দুই প্রাচীন স্থাপত্যের শোভা অত্যন্ত নয়নাভিরাম। সন্ধেবেলা ঘুরে দেখা যেতে পারে পারো মার্কেট এবং সংগ্রহ করা যেতে পারে ভুটানের নানাবিধ সামগ্রী, যা এই সুন্দর দেশটির সংস্কৃতি ও নিজস্বতাকে তুলে ধরে।
টা জং (পারো দুর্গ )
রিনপাং জং (প্রধান প্রশাসনিক দুর্গ, পারো)
সকাল সকাল প্রাতরাশ সেরে 'হোটেল সোনম ট্রফেল' থেকে বেরিয়ে পড়লাম ভুটানের রাজধানী থিম্পুর উদ্দেশ্যে। জাতীয় সড়ক ধরে পারো থেকে থিম্পুর দুরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার। পারো বিমানবন্দর আর হরিদ্রাভ পারো উপত্যকাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলল গাড়ি। এই দুদিনে সুন্দরী পারোর প্রতি এক অবিচ্ছেদ্য প্রেম জন্মে গেছে মনের গভীরে। তাকে ছেড়ে যেতে সত্যিই মনটা ভা্রাক্রান্ত হয়ে উঠল। গুরুংভাই হয়ত মনের এই বেদনাহত অবস্থার কথা বুঝতে পেরেছিল, তাই বিদায়বেলায় প্রেয়সীর সঙ্গে নিভৃতে সময় কাটানোর সুযোগ করে দিতে গাড়ি থামিয়ে অঙ্গুলিনির্দেশ করে বুঝিয়ে দিল শেষবারের মত পারো চু (নদী)র সান্নিধ্যে থেকে না-বলা কথাগুলো বলে নিতে। অষ্টাদশী কিশোরীর মতো চঞ্চল পারো নদী তার নবীন অনুরাগীদের কাছ পেয়ে যেন আরো উচ্ছল, উদ্দাম হয়ে উঠেছে। নানা আকৃতির অজস্র নুড়ি পাথর ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অসম-প্রেমের স্মারক হিসাবে দুয়েকটি পাথর কুড়িয়ে নিয়ে সংগ্রহে রাখা যেতেই পারে। জাতীয় সড়কের ধারে সস্ত্রীক রাজার বিশাল বিশাল হোর্ডিং যাত্রাপথে বৈচিত্র্য বৃদ্ধি করেছে। জাতীয় সড়কের দু-ধারে অজস্র রং-বেরঙের পাহাড়ি ফুল উপত্যকাকে বর্ণময় করে তুলেছে। এ-এক অপার্থিব সৌন্দর্য। ক্রমশ নগরায়ণের চিহ্ন প্রকট হতে লাগল। বেলা বারোটা নাগাদ গাড়ি পৌঁছল রাজধানী শহর থিম্পু। প্রথম গন্তব্যস্থল 'গ্রেট বুদ্ধ ডোরডেন্মা' (বুদ্ধ পয়েন্ট নামে যা অধিক পরিচিত)।
পারো এয়ারপোর্ট (বিমানবন্দর)
আঁকাবাঁকা সর্পিল পথে উপরে ওঠার সময় প্রায় দুই কিলোমিটার দূর থেকে গুরুংভাই সামনের পাহাড়ের দিকে আঙুল উঁচিয়ে দেখাল সোনালী রঙের দৈত্যাকার বুদ্ধমূর্তি। এত দূর থেকেও মূর্তির এই বিশালত্ব মনে এক অদ্ভুত কৌতূহলের উদ্রেক করে। জায়গাটির পোশাকি নাম "গ্রেট বুদ্ধ ডোরডেন্মা" হলেও পর্যটকদের কাছে তা 'বুদ্ধ পয়েন্ট' নামেই সমধিক পরিচিত। টেবিলের মত পাহাড়ের মাথায় বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে নির্মিত এই সুবিশাল বুদ্ধমূর্তি পৃথিবীর অন্যতম উচ্চতাসম্পন্ন মূর্তি। ২০০৬ সালে ভুটানের চতুর্থ রাজা জিগমে সিঙ্ঘে ওয়াংচু-র ৬০ তম জন্মদিবসের স্মারক হিসাবে চিন ও সিঙ্গাপুরের অর্থানুকূল্যে ১৭৭ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট এই স্বর্ণ-রঞ্জিত ব্রোঞ্জ মূর্তিটি নির্মাণ করা হয়। যে সু-উচ্চ মঞ্চের উপর শাক্যমুনি বুদ্ধের মুর্তিটি স্থাপন করা হয়েছে, তার অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে মনে হবে যেন আপনি দেবরাজ ইন্দ্রের স্বর্ণ-খচিত রাজসভায় প্রবেশ করেছেন। আট ইঞ্চি উচ্চতা বিশিষ্ট প্রায় এক লক্ষ এবং বারো ইঞ্চি উচ্চতা বিশিষ্ট প্রায় পঁচিশ হাজার সোনালি রঙের বুদ্ধমূর্তি সজ্জিত আছে নানা স্তরে। তবে মনুমেন্টের অভ্যন্তরে ফটোগ্রাফি নিষিদ্ধ। চোখ ও মনের তৃষ্ণা সম্পূর্ণরূপে নিবৃত্ত হলে পেটের খিদেটা বেশ জাঁকিয়ে বসল। গাড়ি এগিয়ে চলল রেস্তোরাঁর অভিমুখে দুপুরের আহারের জন্য।
'গ্রেট বুদ্ধ ডোরডেম্মা' বা 'বুদ্ধ পয়েন্ট' দুপুরের আহারের জন্য গুরুংভাই গাড়ি থামাল "কিবা'স কিচেন"-এ। একেবারে আদ্যান্ত এক ভুটানি রেস্তরাঁ। এর মালিকের কথা না বললে "ভুবনমোহিনী ভুটান"-এর কাহিনি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ভুটানের অনেক নামীদামী রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ অথবা ডিনারের সুযোগ হয়েছে, কিন্তু গোলগাল চেহারার সদা হাস্যমুখের কিবা সাহেবের উষ্ণ আতিথিয়তার কথা সারাজীবন মনে রাখার মত। ভদ্রলোক বেশ কিছুদিন হাওড়া শহরে কাটিয়েছিলেন, তাই বাঙালির রসনা তৃপ্তির বৈচিত্র্য সম্পর্কে তাঁর সম্যক ধারণা আছে দেখলাম। পরিবারের সমস্ত সদস্যরা মিলে এই ছোট্ট অথচ রুচিসম্মত রেস্তোরাঁটি পরিচালনা করেন। উষ্ণ অভ্যর্থনার সাথে গরম গরম সুস্বাদু খাবার নিজহাতে পরিবেশন করলেন কিবা সাহেব। হৃদয়ের উষ্ণতা স্পিরিট ল্যাম্পের উপর রাখা বুফে সেটের খাবারের উষ্ণতাকে সহজেই পরাস্ত করতে পারে। ভুটানের বিখ্যাত খাবার এমাদাসি (Emadatsi) (লঙ্কা আর চিজ দ্বারা প্রস্তুত), কেয়াদাসি (Keyadatsi) (আলু, চিজ ইত্যাদির সংমিশ্রণে প্রস্তুত), শামুদাসি (Shamudatsi) (মাশরুমের পদ) আর লঙ্কা ও পেঁয়াজের চাটনি। এছাড়া বাঙালি স্বাদের ভাত, ডাল, সবজি, স্যালাড এসব তো আছেই। খাওয়া সম্পন্ন করে বেরিয়ে পড়া হল দিনের নির্ধারিত সাইট সিয়িং-এ। খানিক দূরেই ভুটানিদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র তীর্থক্ষেত্র চাঙ্গাংখা লাখাং মন্দির। দ্বাদশ শতাব্দীতে নির্মিত এই প্রাচীন মন্দিরে ভুটানিরা তাঁদের সদ্যোজাত সন্তানের নামকরণের জন্য নিয়ে আসেন। এমন বেশকিছু সদ্যোজাতের সাথে আপনার দেখা হয়ে যেতেই পারে। পরবর্তী গন্তব্য মোতিথাং ন্যাশনাল টাকিন রিসার্ভ ফরেস্ট (মিনি চিরিয়াখানা)। টাকিন হল ভুটানের জাতীয় পশু। প্রায় সারে আট একর অঞ্চল জুড়ে প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে এই অভয়ারণ্য গড়ে উঠেছে। বিস্তীর্ণ তৃণভূমিতে অসংখ্য টাকিন আর বাহারি শিং এর হরিণের দল চড়ে বেড়ায় একই সাথে।
টাকিন (ভুটানের জাতীয় পশু) থিম্পুর সংসদ ভবন চত্বর তথা কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক চত্বরের একটি বিশেষত্ব আছে। অন্যান্য যে-কোনো দেশের রাজধানীর প্রশাসনিক চত্বর যেভাবে নিরাপত্তার বর্মে মুড়ে রাখা হয়, থিম্পুতে এ-ধরনের নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি একেবারেই চোখে পড়বে না। নিউ দিল্লির চার্চ রোড, দারা-সুজা রোড অথবা জনপথ রোডে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল হাতে চোয়াল শক্ত করে নিরাপত্তারক্ষীদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু ভুটানে এমন দৃশ্য একেবারেই বিরল। সংসদ ভবনের মূল প্রবেশদ্বারে দুজন নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন থাকলেও তাঁদের দেখে কখনওই মনে হবে না যে দেশ পরিচালনার প্রাণকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিয়ে তাঁদের বিন্দুমাত্র উদ্বেগ রয়েছে। তবে সবচেয়ে যে বিষয়টা মনের মধ্যে অপার বিস্ময়ের উদ্রেক করে তা হ'ল রয়্যাল ভুটানের রাজার বাসগৃহ বা রাজপ্রাসাদ। কর্মসূত্রে বর্ধমান রাজবাড়ি প্রতিনিয়ত কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করার সুবাদে মনের অভ্যন্তরে 'রাজ প্রাসাদ' সম্পর্কে যে ইমেজ লালিত পালিত হচ্ছিল দীর্ঘদিন ধরে, ভুটানের রাজ প্রাসাদ পরিদর্শন করে সেই ধারণার বেদিমূলে যেন কুঠারঘাত পড়ল। আমাদের দেশের একটি মফঃস্বল শহরের ছোটখাটো কাউন্সিলর এমন কি পঞ্চায়েত প্রধানরাও যেখানে পাঁচ বছর গদিতে বসেই প্রাসাদোপম অট্টালিকায় বসবাস করেন, সেখানে রাজতন্ত্রের একটি দেশের প্রাধান অত্যন্ত সাধারণ আয়তনের দেশীয় পরম্পরানুসারে তৈরি মাটির দেওয়ালের বাড়িতে বসবাস করেন। যাক সে কথা, একের পর এক প্রশাসনিক ভবন পেরিয়ে এগিয়ে চলতে থাকল গাড়ি। অদূরে সবুজ পাহাড়ের বুকে পড়ন্ত বিকেলের সোনালি আভা ঠিকরে পড়ছে মেঘের আড়াল থেকে। গাড়ি থামল এসে থিম্পুর 'ন্যাশনাল মিউজিয়ামের' সামনে। কিন্তু রবিবার থাকায় ভিতরে প্রবেশ করা গেল না। বাইরে থেকেই ছবি তুলে এগিয়ে যেতে হ'ল। দিনের শেষ দ্রষ্টব্য স্থান 'ন্যাশনাল মেমোরিয়াল চোরটেন'। রাজপুত্র জিগমে দোরজি ওয়াংচু-র মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে রাজমাতা ফুঁসো চডেন-এর অর্থানুকূল্যে এই স্তূপটি নির্মিত হয়। তিব্বতীয় গঠনশৈলী অনুসারে নির্মিত এই স্মৃতিসৌধের অভ্যন্তরে হিন্দু দেব-দেবীর অসাধারণ সব মূর্তি রয়েছে, যা সর্বধর্ম সমন্বয়ের বার্তা বহন করে। পাহাড়ের অপর পাড়ে অস্তমিত সূর্যের লাল আভা পুরোপুরি মিলিয়ে যাবার আগেই গাড়ি এগিয়ে চলল হোটেল 'স্যান্ড্রিলা রেসিডেন্সি'-র অভিমুখে।
ন্যাশনাল মেমোরিয়াল চোরটেন আগের দিন রবিবার থাকায় থিম্পুর ইমিগ্রেশন অফিস থেকে পুনাখার জন্য নির্দিষ্ট পারমিট পেতে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হল। গুরুংভাই সকাল থেকে তদ্বির করেও বেলা একটার আগে কিছুতেই পারমিট সংগ্রহ করতে পারলোনা। অগত্যা, থিম্পুর প্রশাসনিক চত্বর আর মিউজিয়াম সংলগ্ন ভুটানি আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফটের সারিবদ্ধ দোকানে ইতঃস্তত ঘুরে বেড়ানো ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে যখন পারমিট পাওয়া গেল তখন সূর্যিমামা মধ্য গগনে। কিবা'স কিচেন থেকে লাঞ্চ কন্টেনার গাড়িতে তুলে গাড়ি এগিয়ে চলল পুনাখার পথে। ক্রমশ চড়াই পেরিয়ে গাড়ি যত এগোতে থাকল, আবহাওয়ার অদ্ভুত পরিবর্তন ততই প্রকট হতে থাকল। সর্পিল পথের চারপাশের প্রকৃতি যেন কুয়াশা আর মেঘের চাদরে মুড়ে আরও রহস্যময় হয়ে উঠেছে। দু-এক পশলা মৃদু বৃষ্টিপাতকে সঙ্গী করে গাড়ি এসে থামল 'ডোচু লা পাস'-এ। গাড়ি থেকে নামতেই শীতের হিমেল পরশ সারা শরীরজুড়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দিল। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩,১৫০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত এই পার্বত্য গিরিপথ পেরিয়েই ভুটানের পূর্বতন রাজধানী পুনাখায় পৌঁছতে হয়। রহস্যাবৃত গহন অরণ্য আর কুয়াশার ঘেরাটোপে থাকা 'ডোচু লা পাস'-এ রাজমাতা আশী দোরজি ওয়াংগ্মো ওয়াংচু ১০৮ টি স্মৃতি-স্তূপ নির্মাণ করান। এছাড়াও এখানে রয়েছে একটি বৌদ্ধ মোনাস্ট্রি। সমগ্র অঞ্চলটি শীতকালে তুষারাবৃত থাকে।
'ডোচু লা পাস'
'ডোচু লা পাস'- এর হাড় হিম করা ঠান্ডায় জবুথুবু হয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি এবার নিচের দিকে নামতে শুরু করল। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে হাইওয়ের ধারে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে গুরুংভাই গাড়ি থামাল। এখানেই লাঞ্চ সেরে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে পুনাখার দিকে। কিবা সাহেবের রেস্তোরাঁ থেকে আনা খাবারের কন্টেনারের ঢাকনা খুলতেই ধোঁয়া ওঠা খাবারের মন মাতানো গন্ধ ভেসে এল নাকে। স্বাদ আর গন্ধে অতুলনীয় খাবার পেয়ে সহযাত্রীদের পাশাপাশি এই অধমও একপ্রকার ঝাঁপিয়ে পড়ল খাবারের প্লেটে। বাঙালিসুলভ অভ্যাসবশত সহযাত্রীদের কেউ কেউ খাবারের উচ্ছিষ্ট, পেপার ন্যাপকিনসহ বর্জ্য বস্তু যেখানে সেখানে ফেলে দিল। কিন্তু এটা যে পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতবর্ষ নয়, তার প্রমাণ পেলাম একটু পরেই। গুরুং ভাই কাউকে কিছু না বলেই নিজহাতে সেই বর্জ্য বস্তুসমূহ একটি পাত্রে সংগ্রহ করে দূরে একটি নির্দিষ্ট গর্তের মধ্যে ফেলে দিয়ে আমাদের মতো তথাকথিত শিক্ষিত শহুরে মানুষগুলির গালে যেন বিরাশি সিক্কার থাপ্পড় বসিয়ে দিল। আমরা মুখে যতই গালভরা 'স্বচ্ছ ভারত' অথবা 'নির্মল বাংলা'র কথা বলি না কেন, গুপ্ত আবর্জনা তো আসলে আমাদের চেতনায়। যাক সে কথা, বেশ কয়েকটি নাম না জানা পাহাড়ি গঞ্জ আর সবুজ-হলুদ উপত্যকা পেরিয়ে যখন আমরা 'পুনাখা জং'-র কাছে এসে পৌঁছলাম, সূর্য তখন প্রায় দিগন্তকে আলিঙ্গন করে ফেলেছে। ১৯৫৫ সালে রাজধানী থিম্পুতে স্থানান্তরিত হবার আগে রয়াল ভুটানের রাজধানী ছিল পুনাখা। পুনাখা-ওয়াংডু উপত্যকায় ফো চু (পিতা) এবং মো চু (মাতা)–এই দুই নদীর সঙ্গমস্থলে ১৬৩৭-৩৮ সাল নাগাদ এই প্রশাসনিক নির্মিত হয়। নির্ধারিত সময় (বিকাল ৪টা) উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ায় জং–এর ভিতরে প্রবেশ সম্ভব হয়নি। অনতিদূরে রয়েছে ভুটানের সবচেয়ে দীর্ঘ ঝুলন্ত সেতু পুনাখা সাস্পেনশন ব্রিজ। প্রচণ্ড হাওয়ায় দুলতে থাকা ঝুলন্ত ব্রিজ অতিক্রম করার রোমাঞ্চ নেওয়া যেতেই পারে।
'পুনাখা জং'
পুনাখার যে হোটেলে আমাদের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা হয়েছিল তাদের আতিথেয়তা সত্যিই অনবদ্য। হোটেলের অন্দরসজ্জা অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন। হোটেলের বিশাল ডাইনিং হল পেরিয়ে একটুখানি এগোলেই চোখে পড়বে রঙ-বেরঙের সুদৃশ্য বোতলে রাখা দেশি-বিদেশি নানান কোম্পানির সুরার সম্ভার। মদ্যপানে অভ্যস্ত না হওয়ায় সুরার স্বাদ গ্রহণে বঞ্চিত হলেও চোখে দেখার সুখানুভূতি অবশ্যই হল। অনেক নামীদামী হোটেলেই দেখেছি যে রান্নাশালে সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ। কিন্তু এখানে সম্পূর্ণ বিপরীত দৃশ্য দেখা গেল। অতিথিদের যে কেউ যখন খুশি কিচেনে প্রবেশ করতে পারেন। কিচেনের ভেতরকার পরিচ্ছন্নতা এবং অ্যাপ্রন ও দু-হাতে গ্লাভস পরিহিতা মহিলাদের হাসিমুখে কর্মচাঞ্চল্য দেখে আপনার মনটা নিদারুণ প্রশান্তিতে ভরে উঠবেই।
হোটেল পৌছতে রাত হয়ে যাওয়ায় আশপাশের পরিবেশ সম্পর্কে কোনো ধারণাই করা গেল না। তাই ঠিক করলাম, ভোরের আলো ফুটতেই বেরিয়ে পড়তে হবে। অতএব, ভোর হতেই যখন সহযাত্রীরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, সহধর্মিণীকে সঙ্গী করে বেরিয়ে পড়লাম হোটেল থেকে। সদ্য কুয়াশার চাদর সরিয়ে ভোরের আলো উঁকি দিতে শুরু করেছে। সাপের মতো আঁকাবাঁকা হাঁটা পথ নেমে গেছে একেবারে নিচে। সেই পথ বেঁয়ে নেমে যেতেই দেখা হল ফো চু-র সাথে। এখানে নদী অনেকটাই শান্ত। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে নদী থেকে বালি তোলা হচ্ছে। সবুজ-শীতল নদীর জলে পা ডুবিয়ে সঙ্গিনী গুনগুনিয়ে দু-এক কলি রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়ে উঠতেই একদল সাদা বালিহাঁস উড়ে গিয়ে বসল অদূরের টিলা পাহাড়ে। ফিরে আসার সময় 'রয়্যাল কোর্ট অব জাস্টিস' (ভুটানের লোয়ার কোর্ট) পাশে রেখে একটু এগিয়ে যেতেই ঢুকে পড়লাম এক 'বৌদ্ধ চর্চা কেন্দ্র'-র আঙিনায়। অনেকটা মাদ্রাসা শিক্ষার আদলে এই আবাসিক কেন্দ্রে খুদে বৌদ্ধদের 'ত্রিপিটক'-এর পাঠ দেওয়া হয়। সামনের বড় রাস্তা পেরিয়েই রয়েছে 'ওয়াংডু প্রাইমারি স্কুল'। প্রাইমারি হলেও তার পরিকাঠামো মাধ্যমিক স্তরের স্কুলের মতো। এখানকার পড়ুয়ারা মালবাহী ট্রাকের উপর হুড লাগানো গাড়িতে চড়ে দলবদ্ধভাবে স্কুলে আসে। পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকেও পড়ুয়ারা আসে পায়ে হেঁটে। লক্ষণীয় বিষয় হল প্রত্যেক পড়ুয়ার পিঠে ব্যাগ আর হাতে একটি করে বড়ো আকারের বিশেষ ধরনের লাঞ্চবক্স আর পরণের ইউনিফর্ম হল ভুটানের জাতীয় পোশাক। সে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য।
এবার ফেরার পালা। ভারাক্রান্ত মনে পুনাখা থেকে থিম্পু হয়ে হাসিমারার উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়া। ফিরে আসার সময় পাহাড়ি পথের সর্পিল বাঁকে কত নাম না জানা ফুলের সাথে যে মিতালি হোল, তার ইয়ত্তা নেই। স্মৃতির ঝাপসা আঁধার কখনোই এ মিত্রতাকে হৃদয় থেকে মুছে দিতে পারবেনা। ভালো থেকো ভুটান। তোমার সমস্ত অপার ঐশ্বর্য্য নিয়ে তোমার নিজের মতো করেই ভালো থেকো তুমি 'ভুবনমোহিনী ভুটান'।
-সমাপ্ত-
______________________________________________________________________________________
রচনা ও আলোকচিত্রঃ জয়ন্ত দাস,
রথতলা, পোঃ- কাঞ্চননগর, জেলা- পূর্ব বর্ধমান - ৭১৩১০২
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন