Featured Post

লেখা-আহ্বান : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫ সংখ্যার জন্য

ছবি
     মুদ্রিত  নবপ্রভাত  বইমেলা ২০২৫ সংখ্যার জন্য  লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি মুদ্রিত  নবপ্রভাত  বইমেলা ২০২৫ সংখ্যার জন্য  প্রবন্ধ-নিবন্ধ, মুক্তগদ্য, রম্যরচনা, ছোটগল্প, অণুগল্প, কবিতা ও ছড়া পাঠান।  যে-কোন বিষয়েই লেখা যাবে।  শব্দ বা লাইন সংখ্যার কোন বাঁধন  নেই। তবে ছোট লেখা পাঠানো ভালো (যেমন, কবিতা ১২-১৪ লাইনের মধ্যে, অণুগল্প কমবেশি ৩০০/৩৫০শব্দে)। তাতে অনেককেই সুযোগ দেওয়া যায়। সম্পূর্ণ অপ্রকাশিত লেখা পাঠাতে হবে। মনোনয়নের সুবিধার্থে একাধিক লেখা পাঠানো ভালো। তবে একই মেলেই দেবেন। একজন ব্যক্তি একান্ত প্রয়োজন ছাড়া একাধিক মেল করবেন না।  লেখা  মেলবডিতে টাইপ বা পেস্ট করে পাঠাবেন। word ফাইলে পাঠানো যেতে পারে। লেখার সঙ্গে দেবেন  নিজের নাম, ঠিকানা এবং ফোন ও whatsapp নম্বর। (ছবি দেওয়ার দরকার নেই।) ১) মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখবেন 'মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা সংখ্যা ২০২৫-এর জন্য'।  ২) বানানের দিকে বিশেষ নজর দেবেন। ৩) যতিচিহ্নের আগে স্পেস না দিয়ে পরে দেবেন। ৪) বিশেষ কোন চিহ্ন (যেমন @ # *) ব্যবহার করবেন না। ৫) লেখার নীচে একটি ঘোষণা দিন:  'লেখাটি স্বরচিত ও অপ্রকাশিত'। মেল আইডি :  printednabapravat@

ধারাবাহিক উপন্যাস ।। তিতলির বিশ্বভ্রমণ ।। ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়


তিতলির বিশ্বভ্রমণ

-ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়

প্রথম পর্ব - বঙ্গভ্রমণ

এক

পূর্বকথা—গল্পদাদুর সঙ্গে আলাপ

ডিমাপুরের তিতলিদিদি আর বহরমপুরের বোন পুচকির মধ্যে অগাধ ভালবাসা। এই ভালবাসা দেখে তাদের সঙ্গে ভালবাসায় জড়িয়ে পড়ল তাদের দাদু। দাদু তাদের কেউ নয় আবার বলতে গেলে সব। দাদুর তো কাজকর্ম নেই। কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। একটা নেশা আছে দাদুর। সেটা হল গল্প বলা। তিতলিদের দুই বোনেরও একটা নেশা আছে। সেটা হল গল্প শোনা। এই দুই নেশার মিল হল সেদিন বিকেলে। এক কালভার্টের প্রশস্ত চাতালে বসে পড়ল তিনজন।

ফাঁকা জায়গা, ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল হাওয়া বইছে। এমন সময় গরমা গরম মুচমুচে গল্প হল সবচেয়ে সুস্বাদু। ভাজা গল্প, তাজা গল্প, পোড়া গল্প বা সেঁকা গল্প—গল্পদাদুর আসরে গল্পের অভাব হয় না। গল্পরা সব লাইন দিয়ে হা পিত্যেশ করে পড়ে থাকে কখন তাদের সময় হবে শুরু। শুরুও হয় এক সময়। শুরু থেকে যতই এগোয় শেষের দিকে ততই তিতলি আর পুচকির চোখেমুখে ঝরে পড়ে বিস্ময়, আনন্দ আর তৃপ্তি। কখনও আবার ভয় আর ভালবাসা। নানা উপলব্ধির সুতোয় বাঁধা গল্পের এক একটা মালা উপহার দেয় যেন দাদু।

এই গল্পের আসরে ভিড় করে আরও কত কিছু। একটু দূরে একটা গাছ বেয়ে তরতরিয়ে উঠে যায় একটা কাঠবেড়ালি। আজ শুধু একদিন বলে নয়। অন্তত সাতদিন ধরে এই গাছের ডালে ডালে নেচে বেড়িয়েছে সে। তিতলির ঠোঙা থেকে ছিটকে পড়ে যাওয়া একটা চিনেবাদাম মাটি থেকে তুলে নিয়ে দুই পা তুলে লেজ ফুলিয়ে কুট কুট করে খেয়েছেখুব ভালবেসে তিতলি তার নাম রেখেছে কাঠুভাই

একটা সুন্দর বেড়াল তার থেকে একটু দূরে লুকিয়ে থেকে মাঝে মাঝে ডেকে ওঠে, মিউ মিউউউ!

পুচকি তার নাম দিয়েছে মিউরাণী। আর তারা দুজনে বলে, এই রাস্তায় আমরা কি আর দুধ মাছ নিয়ে বেরোতে পারি বল মিউরাণী?

মিউরাণী আবার ডেকে ওঠে, মিউ! ডাক তো নয় যেন অভিমানের কান্না।

তিতলি বলে, বেশ তবে আমাদের বাড়িতে যাস আজ দুপুরে। মাছভাত দেব।

পুচকি বলে, তবে তোর সুন্দর বাচ্চাগুলোকেও কিন্তু নিয়ে যাওয়া চাই। পড়া সেরে তাদের আদর করলে মা নিশ্চয় বকবে না।

এরপর আছে ঘৌদাদা। পাশে পাশে ঘোরে যে। পুচকির সঙ্গে ভারি আলাপ। একদিন খেলা সেরে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে গেছে। গলির মুখে একটা খুব দুষ্টু হোমড়ামুখো কুকুর তাড়া করল তাদের। দুই বোন পড়ল খুব মুশকিলে। একে তো বড়দের বকুনি খাবার ভয় তাতে আবার এই উৎপাত।

কোথা থেকে ছুটে এসেছে ঘৌ দাদা। সে কি ঝগড়া তার হোমড়ামুখো কুকুরের সঙ্গে। সে তো সারা রাস্তা তাদের পাশে পাশে থেকে গার্ড দিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিল। বাড়ি পৌঁছেই ঘৌদাদাকে তারা একঝুড়ি ধন্যবাদ আর দুটো বিস্কুট দিয়েছিল।

দাদু অনেক গল্প করে। তার গল্প ঘিরে থাকে এই সব বনের পশুপাখিরা। আর থাকে গাছপালা, ফলফুল আর প্রজাপতির দল। তাদের গল্প যেন তারাও শুনতে থাকে মহ আগ্রহে।

আপ্পু

আপ্পুকে তোমরা কি চেন? বোধহয় চেন না। তিতলি পুচকি এরাও কেউ চেনে না। মানে চিনতো না আর কিকি করে চিনবে বল? সে তো থাকে গভীর জঙ্গলে তার মায়ের সঙ্গে। কিন্তু মাঝে মাঝে মায়ের সঙ্গে আবার বেরিয়েও পড়ে। মা, বাবা, কাকা, কাকি, জেঠা, জেঠি, সবাই দল বেঁধে সার দিয়ে চলে আসে লোকালয়ে। মানে মানুষের পাড়ায়।

তোমরা হয়ত বলবে কেন? হাতিদের পক্ষে জঙ্গলই তো বেশ ভাল। জঙ্গলে কত গাছপালা আর হাতিরা গাছ বা তার পাতা খেতে খুব ভালবাসে। ওরা হল তৃণভোজী মানে গাছপালা খেয়ে বেঁচে থাকা প্রাণীবাঘ ভাল্লুকের মত মাংস খাওয়া নয়কিন্তু সমস্যা হল সব রকম গাছ তো হাতিরা খায় না। তাই কখনও কখনও জঙ্গলে তাদের খাবার শেষ হয়ে যায়। হাতিরা তখন দল বেঁধে লোকালয়ে চলে আসে খাবারের আশায়। মাঠের ধান, গম আর অন্য সব ফসল ধ্বংস করে। মানুষের বাড়ি বাড়িও নানা অত্যাচার করে।

এমনি একটা দল লোকালয় থেকে ফেরার পথে তাদের আপ্পুকে হারিয়ে ফেলে। আপ্পু হল বাচ্চা হাতি যাদের দাঁত এখন বের হয় নি। এদের করভ বা শরভ বলে। হাতির থেকেও হাতির বাচ্চাদের দেখতে খুব সুন্দর হয়।

পাশের মাঠে খুব কচি কচি ঘাস দেখে লোভে পড়ে গিয়েছিল আপ্পু। খাওয়া যখন শেষ হল, পেট আর মন দুইই যখন বেশ ভরে উঠেছে, তখন মাথা তুলে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে নতুন এক সমস্যা এসে হাজির হয়েছে। দেখল তাদের দলের চিহ্নমাত্র নেই। তখন আর কী করবে। ওইটুকু মাত্র বাচ্চা মায়ের কাছছাড়া হয়ে পড়ল মহা বিপদে। অনেক খুঁজল। মা ঠাকুমা, দাদু দিদিমা, কাকা কাকিমা বলে অনেক ডাকল তার মিনমিনে গলায়। কিন্তু কিচ্ছু হল না। চোখে তার জল এসে পড়লএবার কি করবে বেচারি?

তা তার ভাগ্যটা বেশ ভালই বলতে হবে। সেদিন ছিল ফ্রেন্ডশিপ ডে মানে পুরোন বন্ধুত্ব রাখা আর নতুন বন্ধুত্ব পাতানোর দিন।  তিতলি আর পুচকি মাঠে বেরিয়েছিল নতুন বন্ধুর সন্ধানে। গত বছরে ওরা একটা খরগোস, তিনটে কাঠবেড়ালি আর একটা টিয়াপাখির সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিল। এবার একটা রঙিন বাহারে পাখাওলা প্রজাপতিকে বন্ধু করবে বলে ভেবেছিল। কিন্তু যতবারই ধরতে যায় ততবারই ‘আমায় ধর না দেখি কেমন ধরতে পারিস’ বলে উড়ে উড়ে পালাচ্ছিল।

উড়ন্ত প্রজাপতির পেছন ধাওয়া করতে গিয়ে ওরা একটু জঙ্গলের ভেতরে চলে এসেছিল এমন সময় একটা ঝোপের গাছগুলো নড়ে উঠল। পুচকি খুব ভীতু। ভয়ে ভয়ে সে বলল, চল দিদি আর নয় এবার বাড়ি যাই।

কিন্তু ভয় জিনিসটা তিতলির মধ্যে নেই। আছে যেটা সবচেয়ে বেশি তা হল কৌতূহল। বলল, থাম না। ভয় কিসের? এ জঙ্গলে কি আর বাঘ ভালুক থাকে?

একটু এগিয়ে যেতেই লক্ষ পড়ল আপ্পুর ওপর। বেচারির দু’চোখ দিয়ে তখন জলের ধারা। চোখের এত কাছে যে এমন একটা জলজ্যান্ত হাতির বাচ্চা থাকবে তা ভাবতেই পারছে না তিতলি। ভাবছে স্বপ্ন না তো? পুচকিকে দিয়ে তার গায়ে জোরসে একটা চিমটি কাটিয়ে দেখল খুব লাগছে।

এগিয়ে গিয়ে তার শুঁড়ে হাত দিল। আপ্পু কিছু না বলে মুখ তুলে তাকালো। চোখে বইছে সেই জলের ধারা। তিতলি ভাবল হাতিরাও কাঁদে? কাঁদতেই পারে। বাচ্চা তো। যেমন সে কাঁদে, পুচকি কাঁদে। কিন্তু তাদের বাবা, মা, কাকা, কাকা, জেঠাজেঠিরা তো কাঁদে না।

জন্তু জানোয়ার হলেও ওদের মনে ভয়-ভাবনা কিছু তো থাকবেই। দলছাড়া হয়ে ঘুরছিল। আহা রে। তিতলির মনটা হঠাৎ খুব খারাপ লাগল। একবার কাঁদার সময় নিজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখেছে নিজেকে। দেখেছে দুঃখ পেলে কেমন লাগে। আপ্পুরও নিশ্চয় সেই রকমই লাগছে।

পুচকি দূর থেকে তখন হন্যে হয়ে ডাকছে, এই দিদি কী করছিস বাড়ি চল।

আবার আপ্পুর শুঁড়ে হাত বোলালো তিতলি। কিচ্ছু বলল না সে। বরং একটু মাথা নেড়ে যেন বলল তার বেশ পছন্দ হয়েছে তিতলিকেদূর থেকে চিৎকার করে পুচকিকে বলল তিতলি, একটা বন্ধু পেয়েছি রে পুচকি। ভাল বন্ধু। এখানে আয়।

পুচকি তো ভয়েই সারা। ওরে বাবা ও কেমন জন্তু রে। ওর আবার একটা লম্বা শুঁড় আছে। সেই শুঁড়ে জড়িয়ে ওরা নাকি মানুষকে আছড়ে আছড়ে মারে। সে দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই। নড়বার কোনও নাম নেই।

খানিক তার গায়ে হাত বুলিয়ে ফিরতে চাইল তিতলি। আর কী আশ্চর্য আপ্পুও তার পেছন পেছন আসে যে। 

--যাবি আমার সঙ্গে আমাদের বাড়ি? তিতলির কথায় শুঁড় নেড়ে নেড়ে এগিয়ে আসতে লাগল আপ্পু। এসেও পড়ল বেশ। ভাগ্যিস বাড়ির রাস্তায় লোক তেমন থাকে না নাহলে ওরা আপ্পুকে নির্ঘাত বিরক্ত করত।

বাড়ির সকলে তো একেবারে থ। বাড়ির দুই মেয়ের সঙ্গে একেবারে বনের হাতি? জেঠু অনেক শুনেটুনে বলল, মনে হচ্ছে হাতির দলছাড়া হয়ে গেছে বাচ্চাটা। এখন একে তো বাঁচানো মুশকিল।

মুশকিল? মুশকিল কিসের? মুশকিল আসান তিতলি আর পুচকি আছে না? নিত্য বোতলের দুধ, গাছপালা আর কচি কচি ঘাস দিয়ে শুরু হল তাদের হাতি-পরিচর্যা। তিতলির মা, কাকিমাকে দেখে খুব খুশি আপ্পু। চোখের জল মুছে গিয়ে মুখে এসেছিল আনন্দের জোয়ার। যেন একটা মাকে হারিয়ে অনেক মা পেয়েছে সে।  

পুচকি একবার যেন বলে ফেলেছিল, একে নিয়ে কী করবি রে দিদি? বড় হয়ে এ কি সার্কাসের খেলা দেখাবে?

একটা পেল্লায় বড় সাইজের চিমটি কেটেছিল তার গায়ে তিতলি। তিনঘণ্টা কথা বলে নি বোনের সঙ্গে। তারপর বলেছিল, আচ্ছা পুচকি তোকে নিয়ে গিয়ে জঙ্গলে হাতিরা যদি খেলা দেখায় তো তোর কেমন লাগবে? 

তিতলির বাবা বলল, বনদপ্তরকে খবর দিয়েছি। ওরা এসে পড়বে।

বনদপ্তর এসে বলল, বাঃ খুব ভাল কাজ করেছে বাচ্চারা। আমরা ওর মায়ের খোজ করছি। ততদিন না হয় আপনারাই একটু দেখাশোনা করুন

তিতলি আর পুচকি আবার লেগে পড়েছে তাদের নতুন বন্ধুর পরিচর্যা করতে। কিন্তু মনে ভয় কখন আবার বনদপ্তর এসে আপ্পুকে নিয়ে যায়।

রাইনোদাদার চোখে জল

সেই যে বাচ্চা হাতিটা সেবার দলছাড়া হয়ে কী মুশকিলে পড়েছিলভাগ্যিস তিতলির চোখে পড়েছিল বেচারি, তাই রক্ষা পেল সে যাত্রাআসলে, তিতলি খুব ভালবাসে পশুপাখিদের। তার ধারণা, তাদের মনের কথা বুঝতে পারে সে। আর, পশুপাখিরাও দিব্বি বোঝে তাকে। বোঝে, এই একটা মানুষ, যে অন্তত তাদের কোনও ক্ষতি করবে না। আর তার সঙ্গে থেকে থেকে পুচকিও এখন খুব পশুপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

সে আর পুচকি দুজনেই প্রায় একসঙ্গেই থাকে, একসঙ্গেই ঘোরে ফেরে। ভারি ভাব দুই বোনে। সেদিন মাঠে খেলতে খেলতে একটু সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিল। আবার ফেরার পথে পড়ে একটা ছোট জঙ্গলআবার সেই ছোট জঙ্গলটা, একটু পরেই ঘন জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে গেছে। মানে এই ছোট জঙ্গলে কেউ পথ হারিয়ে ফেললে তার বড় জঙ্গলে চলে যাবার সম্ভাবনা খুব। 

তিতলি বেশ তাড়াতাড়ি হাঁটছিল। আজ বড়দের কাছে বেশ বকুনি খেতে হবে। সত্যি এত দেরি হবে ভাবতে পারে নিআসলে ফিরছিল ঠিক সময়বাসনা তো এদের দুজনেরই বন্ধু। যাবার সময় বলল, আজ তোরা আমাদের বাড়ি একটু যাবি? আয় না মা ডেকেছে।

বাসনারা একটু গরিব। খুব ছোট একটা টালির বাড়িতে ওরা থাকে। ওর মা খুব ভালবাসে এদের দুজনকে। মাঝে মাঝে ওদের বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে গরম পরটা আর আলুর চচ্চড়ি খাওয়ায়। কখনও বা আলুর দম। আক্ষেপ করে বলে, আর তো বেশি কিছু দিতে পারি না মা তোদের। আমাদের অবস্থা তো তোরা জানিস।

--এমন বললে আর কিন্তু আসব নাতুমি আমাদের মাসিমা। মাসিমা আবার গরিব বড়লোক কি?তিতলি বলেছে।

বাসনার মা হেসে ফেলে। কাছে টেনে তাদের আদর করে। এই ব্যাপারটা তিতলির খুব ভাল লাগে। তার মনে হয়, ভালবাসা থাকলে টাকা পয়সা থাক বা না থাক, তারা সকলের আপন হয়। পুচকি সাধারণত হাসে না। কিন্তু আদরের চোটে সেদিন সে হেসে ফেলেছিল। খিলখিল করে হেসে উঠে বলেছিল, ছাড় না মাসি, আমার যে কাতুকুতু লাগছে।

বাসনার মা আজ তাদের জন্যে পায়েস করেছিল। সেটা খেতেই দেরি হয়ে গেল।

আলো তখনও তেমন করে চলে যায় নি। দূরে একটা বড় লোহার জালের বেড়া। মাঝে মধ্যে বড় জঙ্গল থেকে ছোট জঙ্গলে কিছু বড় বড় জন্তু চলে আসে। তাদের হাত থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্যেই এই বেড়া। সেই বেড়ার ওপারে এক টুকরো জমাট বাঁধা অন্ধকার। অন্ধকারটা আবার নড়াচড়া করছে বলে মনে হল তিতলির। সে তো এক পা এক পা করে এগিয়ে যেতে লাগল বেড়ার ধারে।

--এই দিদি, এই সন্ধ্যেবেলা বেড়ার ধারে যাস না। মাসিমা জানতে পারলে কিন্তু---

পুচকি দূর থেকে চেঁচিয়ে উঠল। মামাতো পিসতুতো বোন এরা। পুচকির মা তিতলির মামিমা। তবে বেশির ভাগ সময়ই পুচকিই আসে তিতলিদের বাড়ি। এই ডিমাপুরটা তার বেশ ভাল লাগে। কেমন সবুজ গাছপালা দিয়ে ঘেরা। 

তিতলি বিরক্ত হয়ে বলল, দাঁড়া না একটু। ব্যাপারটা যেন কেমন কেমন লাগছে।

তিতলিকে ওর মা একটা ছোট্ট টর্চ দিয়েছে। বলেছে যদি কখনও লাগে তো রেখে দে। দিয়েছে লুকিয়ে। কারণ, ছোটদের অন্ধকার করে বাড়ি ঢোকা নিষেধ। তাই তাদের আর টর্চ লাগবে কেন?

টর্চটা একটা ছোট্ট মোবাইলের মত। হাতের মুঠোয় থাকে। অনেকে মোবাইল বলে ভুল বুঝলে তিতলি বলে, এটা টর্চ। আমাদের বাড়িতে ছোটদের মোবাইল ব্যাবহারে মানা আছে।

পুট করে টর্চটা জ্বালতেই কী একটা জ্বলে উঠল অন্ধকারে। চোখটা একটু সয়ে যেতেই তিতলি দেখল বিশাল বড় মাপের একটা কীপুচকি তখনও দূর থেকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে তাকে সাবধান করছেতিতলির কৌতূহল একটু বেশি। এ জিনিসটা কী, সেটা না দেখে সে যাবে না। 

টর্চটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সে দেখতে লাগল। তার মনে হল একটা বিরাট কোনও জন্তু। কিন্তু এতবড় কালো রঙের কী জন্তু হতে পারে সে ভেবে পেল না। একবার মনে হল হাতি হবে হয়ত। তারপর আবার মনে হল হাতি হলে তার শুঁড় থাকে। আর হাতিরা কারণে অকারণে শুঁড় একবার নাড়বেই।

চেঁচিয়ে ডাকল পুচকিকে, এই পুচু, শোন একটু এদিকে।

পুচু ওরফে পুচকি, উপায় না দেখে এগিয়ে এল তার কাছে। তিতলি সেদিকে টর্চ ফেলে বলল, মনে হচ্ছে খুব বড় একটা জন্তু। আরে এ তো-

বেশ স্পষ্ট হয়েছে জন্তুটা। নাকের ওপর বসান বিশাল সাইজের ঐ খড়্গটা দেখেই বুঝে ফেলল তিতলি। আনন্দে চিৎকার করে উঠল, আরে এ তো আমাদের রাইনোদাদা। মানে গন্ডারদাদা।

গন্ডারকে ইংরেজিতে রাইনোসেরাস বলা হয়। কখনও বা ছোট করে রাইনো বলা হয়। অনেক ছবি দেখেছে তিতলিরা। অনেক কথা শুনেছে তারা। এ জন্তু বিশাল বড় মাপের হয়। কিন্তু এরা কেউ মাংসাশী নয়। এরা তৃণভোজী মানে ঘাস পাতা খেয়ে বেঁচে থাকে। এদের শরীর খুব বড় আর ভারি। মাটি থেকে এরা প্রায় পাঁচ ছফুট উঁচু হয়। এ জঙ্গলে রাইনোদের ঘোরাফেরা আছে বড়দের কাছ থেকে শুনেছে সে।

--এদের বড় ব্যাপার হল নাকের ওই বড় খাঁড়াটা। বুঝলি পুচু?

--ঐ জন্যেই তো আজ আমার এই বিপদ গো দিদি।

একি? পরিষ্কার মানুষের ভাষায় কথা বলছে কে যেন? অবাক কান্ড। তিতলি প্রথমে ভাবল, কাছাকাছি অন্য কোনও মানুষ হয়ত এসে পড়েছে। কিন্তু চারপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। এমন সময় মনে হল শব্দটা যেন রাইনোর কাছ থেকেই আসছে।

রাইনো আবার বলল, আমি বলছি গো তিতলিদিদি, আমি তোমার রাইনো দাদাআমি বড় বিপদে পড়েছি- 

রাইনোর মুখটা বেড়ার একেবারে ধারে। তিতলি বেড়ার ফাঁকে তার ছোট্ট হাতটা গলিয়ে দিয়ে হাত বোলাতে লাগল। রাইনো বলল, কাউকে কিছু বল না যে, আমি এখানে আছি। তাহলে ওরা আমায় মেরে ফেলবে। 

--না না আমি বলব না রাইনোদাদা। কিন্তু তোমার কী হয়েছে? কী বিপদ? কে মেরে ফেলতে চায় তোমাকে? তুমি তো নিজে থেকে কারোর কোনও ক্ষতি কর না।

--শিকারিরা আমার নাকের এই খড়্গটা চুরি করার জন্যে আমায় মেরে ফেলতে চায়। টপ টপ করে চোখের জল পড়তে লাগল রাইনোদাদার। টর্চের আলোয় চিকচিক করতে লাগল তার চোখদুটো। আর তেমন ভাবেই বলে যেতে লাগল তার দুঃখের কাহিনীও।

ও,  এই তবে সেই গন্ডারটা, যাকে চোরা শিকারিরা তাড়া করে বেড়াচ্ছে আজ কদিন ধরে? ভাবল তিতলি। বড়দের মুখে শুনেছে সে। রাইনোর গায়ে আর একবার তার কচি হাতটা বুলিয়ে পুচকিকে নিয়ে জোর পা লাগাল তিতলি ঘরের দিকে। এক্ষুনি বড়দের খবর দিতে হবে। ব্যাপার সুবিধের নয়। খবর পেয়ে বন দপ্তরের লোক এসে বলল, বেচারি ওদের অত্যাচারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘুরতে ঘুরতে লোকালয়ের কাছে এসে পড়েছে সবাই সাবধান।

--হ্যাঁ, রাইনোদাদা বলল ক’দিন ওর নাকি ভাল করে খাওয়া দাওয়া হয় নি। শুধু পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কথাটা বলেই জিভ কাড়ল তিতলিইস এটা বলা ঠিক হয় নি।

বন দপ্তরের লোক কিন্তু সে কথাটা লুফে নিয়ে বলল, মানে?

তিতলি লজ্জা পেয়ে সত্যি কথাটা বলে দিল। বলল, রাইনোদাদা কাঁদতে কাঁদতে বলল আমায় কাকু। বিশ্বাস কর।

বন দপ্তরের লোক হেসে বলল, তোমাদের মত পশুর বন্ধুরা আছ বলেই তো তবু এরা কিছু কিছু রক্ষা পায়। তোমাদের এই রাইনোদাদার মতই আমি তোমাদের খুব সাধুবাদ দিচ্ছি।

তিতলির জেঠুর দিকে তাকিয়ে বলল, পশুরা মুখে কথা বলতে না পারলেও ওদের মুখের ভাষা চোখে ফুটে ওঠে। আপনার এই ভাইঝি পশুদের চোখের ভাষা খুব পড়তে পারে। খুব ভাল মেয়ে।

পুচকি অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল বিশাল মাপের জন্তুটার দিকে। বলল, একে নিয়ে শিকারিরা কি করে? খেলা দেখায়?

--তোর শুধু খেলা দেখান আর খেলা দেখানতিতলি বিরক্ত হয়ে বলেএকে মেরে ফেলে রে পুচু ভাবতে পারিস এত বড় জন্তুকে মেরে ফেলে ওরা!

--কিন্তু কেনপুচু প্রশ্নটা করেই লজ্জিত হয়ে ভাবল প্রশ্নটা দিদিকে না করে বনদপ্তরের লোককে করলেই ভাল হতকিন্তু ওর তো ভারি লজ্জা

--গন্ডারের চামড়া খুব পুরু হয়আর খুব কাজে লাগে এই চামড়া। তিতলির জেঠু বললেন

--তবে সবচেয়ে কাজের হল নাকের ওপরের এই খড়্গটাবনদপ্তরের লোক বলল, কালোবাজারে কোটি কোটি টাকায় বিক্রি হয়ওষুধ তৈরি এমনকি গয়না তৈরির কাজেও লাগে

পুচকি বলল, সামান্য একটা খড়্গের জন্যে এদের মরতে হয়!

তিতলির বাবা বলল, সামান্য একটা দাঁতের জন্যে কত হাতিকে মরতে হয় জানিস? সামান্য নখ, চামড়া আর হাড়ের জন্যে বাঘেদের? আরও কত জন্তুকে মরতে হয় শুধু তাদের শরীরের এই মহামূল্যবান সম্পদের জন্যে।

আহা বেচারা। তিতলি হঠাৎচেঁচিয়ে বলে উঠল, শেম! শেম! উই শ্যাল সেভ অ্যানিম্যাল। প্রমিস!

ইচ্ছে করেই ইংরেজিতে বলল তিতলি। কিন্তু সে কতটা ভাল ইংরিজি শিখেছে তা জানানোর জন্যে নয়। বলল এই জন্যে যে, ইংরেজি হচ্ছে সারা পৃথিবীর একমাত্র যোগাযোগের ভাষা। এই ভাষাতে বললে সবার কানে পৌঁছে যাবে কথাটা। আর সে ছোট্ট হলেও বুঝেছে এই দামি কথাটা সবার কানে পৌঁছন দরকার।

পুচকিও সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠেছে, উই মাস্ট সেভ অ্যানিম্যাল। প্রমিশ। 

 

দুই

হাতিদাদার সঙ্গে আলাপ

তিতলির গল্পদাদু বেড়াতেও খুব ভালবাসে। একদিন দাদু সে আর বোন পুচকি ডিমাপুরের একটা ছোট জঙ্গলের পথে বেড়াচ্ছিল। গল্পের ঝুলি থেকে বেরোচ্ছিল নানা সাইজের আর নানা রকমের মুখরোচক সব গল্প। শুনতে শুনতে তারা দুই বোন তন্ময় হয়ে গিয়েছিল।

এমন সময় হাতির বিরাট হুংকার। এর আগে তারা হাতির ডাক কখনও শোনে নি। কিন্তু দাদু তো শুনেছে অনেক। দাদুই বলল ডাকটা নাকি হাতির। আর এটা যে সে ডাক নয়। রাগ দুঃখ সব মিলিয়ে একটা গর্জন। একটু পরেই হাতিটাকে দেখা গেল। চিৎকার করতে করতে হন্যে হয়ে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে।

দাদু তাদের সঙ্গে নিয়ে পাশের একটা ঝোপের ভেতরে লুকোল। হাতিটা তখন শুঁড় উঁচিয়ে ছুটতে ছুটতে আসছে। দাদু ভাল করে দেখে বলল, মনে হচ্ছে হাতিটা ওর বাচ্চাকে খুঁজে পাচ্ছে না। এই সময় সামনে কাউকে পেলে শুঁড়ে তুলে আছড়ে দেবে। খুব সাবধান।

তিতলি তার পাশে থাকা পুচকিকে কানে কানে ফিসফিস করে বলল, আপ্পুর কথাটা মনে আছে তো?

পুচকিও ফিসফিস করে জবাব দিল, হ্যাঁ রে দিদি। আহা আপ্পুর মত আর একটা বাচ্চা কোথায় গিয়ে পড়েছে কে জানে।

ঠিক এই সময় পুচকির পায়ে কি একটা পোকা উঠতেই সে ভয়ে চিৎকার করে উঠল। আর  হাতি তো তাদের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল। থমকে হয়ত ভাবল এই তিনজনই তার বাচ্চাকে গুম করেছে। সে তো শুঁড় পাকিয়ে পুচকিকে তুলে নেয় আর কীতিনজন তো ভয়ে কাঁটা।

তিতলির উপস্থিত বুদ্ধি খুব জোরাল। সে খুব সুন্দর করে কেঁদে বলল, হাতিদাদা ও হাতিদাদা আমার বোনকে শুঁড়ে করে ছুঁড়ে ফেল না প্লিজ। আমার বোন কি তোমার বোন নয় বল?

মুহূর্তে অবাক কান্ড। হাতি এক মুহূর্তের জন্যে চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। একভাবে দেখতে লাগল তিতলিকে। তার হয়ত মনে হল এও তো তার আপ্পুর মতই বাচ্চা। বলল, তোমরা কে? এখানে কী করছ?

--আমরা দুই বোন বেড়াতে বেরিয়েছি গো দাদুর সঙ্গেদাদু অনেক গল্প জানে। তুমি ইচ্ছে হলে শুনতে পার। তার আগে বল এমন ভাবে ছুটছ কেন?

হাতিটা আবার প্রচন্ড চিৎকার করতে লাগল। সে কী ভীষণ চিৎকার। কানে তালা লাগার উপক্রম। দাদু বলল, হাতিদাদা কাঁদছে মনে হয়। কিছু হারিয়েছে সে।

হাতিদাদা বলল, আমি আমার বৌ আর আমাদের বাচ্চা আপ্পু ঘাস খেয়ে বেড়াচ্ছিলাম জঙ্গলের পথে। এমন সময় আমাদের আপ্পুকে আর দেখতে পেলাম না। আপ্পুর মা ও দিকটা খুঁজছে আমি এদিকটা।

একটু থেমে সে বলল, তোমার কথা তো আমি জানি তিতলিদিদি। সেবার তো তুমিই আমার আপ্পুকে বাঁচিয়ে ছিলে। তাকে ক’দিন ধরে নিজেদের বাড়িতে রেখে যত্ন আত্তি করেছিলে। তারপর বন দপ্তরকে দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছিলে আমার কাছে। লক্ষ্মীটি দিদি এবার তুমিই উদ্ধার কর আমাকে।

তার চোখে জল দেখে তিতলি তাড়াতাড়ি বলল, ও হাতিদাদা শান্ত হও। আমার কাছে বাইনোকুলার আছে। আমি ঠিক খুঁজে বার করব তোমার আপ্পুকে।

যেমন বলা তেমনি কাজ। আপ্পুকে পাওয়া গেল একটু দূরেই। হাতিদাদা তো কেঁদে ফেলল। বলল, তিতলিদিদি আজ থেকে তোমরা তিনজন আমার পরম বন্ধু। যেখানে যেতে চাও আমার পিঠে চেপে যেতে পার।

দাদু বলল, বা তাহলে তো দিব্বি হয়। হাতির পিঠে ঘুরতে ঘুরতে গল্প ভালই জমবে।

তিতলি আর পুচকি ‘হুররে’ বলে হাততালি দিয়ে উঠল।

 

শক্তি নয়, চাই সাহস আর বুদ্ধি

বহরমপুর থেকে পুচকি সব সময় তো আর আসতে পারে না ডিমাপুরে। তখন দাদুকে নিয়ে একাই ঘুরতে হয় তিতলিকে। এমনি একদিন ঘুরতে ঘুরতে বনের মধ্যে পাকা সড়ক দিয়ে হাঁটছে। তখন সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। আবছা অন্ধকারে দাদুর গল্প শুনতে শুনতে দিব্বি রাস্তা হাঁটছিল তিতলি। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এমন পাকা সড়ক থাকে যেখান দিয়ে দূরপাল্লার গাড়িগুলো যাতায়াত করে খুব দ্রুতগতিতে। আবার হাতি, গন্ডার এমন কী চিতাও বনের ভেতর থেকে এসে পড়ে রাস্তায়। তারা বনের এক অংশ থেকে অন্য অংশে যায় এই পাকা সড়ক পার হয়ে।

সেই পাকা সড়কে সেদিন দেখা হয়ে গেল এক সিংহীর সঙ্গে। আবছা অন্ধকারে রাস্তার মাঝখানে কি যেন একাটা বসে থাকতে দেখা গেল। বাঘ নাকি? হাতি-গন্ডার হলে এত ছোট হত না। খানিকটা বাঘের মত।

একটু এগিয়ে এল এরা তবে খুব সাবধানে। বাঘ নয়। সে হল মা সিংহ। সে সবে আফ্রিকা থেকে এসেছেসিংহী খুব গর্জন করছিল রাগে। মাঝে মাঝে কান্নাকাটিও। দাদু তো ভয় পেয়ে একটা ঝোপটোপ খুঁজছিল। কিন্তু ভয় পেল না তিতলি। বলল, জান দাদু, এই সিংহীমাসির নিশ্চয় কিছু হয়েছে। আহা কেমন মনমরা দেখেছ? আবার মাঝে মাঝে কেঁদে উঠছে?

সাহসের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, সিংহীমাসি তোমার কি হয়েছে গো? কাঁদছ কেন কিছু হারিয়েছে নাকি?

তিতলির সুন্দর ভালবাসা মাখানো কথায় সিংহী তো গলে একেবারে জল। যে এতক্ষণ রাগে ফোঁস ফোঁস করছিল সে এখন ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, আর কি বলি বোনঝি। আমার সঙ্গে ছিল আমার ছোট্ট ছানাটা। কিন্তু বনের মধ্যে কোথায় যে হারিয়ে গেল খুঁজে পাচ্ছি না। এদিকে আমার ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে। এবার আমি কী করি?  এদেশে তো আর তোমরা থাকতে দেবে না। ছানাকে না নিয়ে দেশে ফিরব কী করে?

তিতলি শুনেছিল যে সব লোক সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেড়ায় তাদের একটা করে পাসপোর্ট আবার তার সঙ্গে ভিসা লাগে। পাসপোর্ট হল নিজের দেশ থেকে অন্য দেশে যাবার ছাড়পত্র আর ভিসা হল অন্য দেশে থাকার অনুমতি পত্র যার একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ আছে। সত্যি তো মাসির এখন খুব বিপদ।

তিতলি খুব শান্তভাবে বলল, ও তুমি কিছু চিন্তা কর না মাসি। আমার কাছে বাইনোকুলার আছে যার সাহায্যে আমি দূরের জিনিস স্পষ্ট দেখতে পাই। আমি ঠিক খুঁজে দেব তোমার মিষ্টি ছানাকে। সেবার আমি এই দিয়েই আমার হাতিদাদার ছেলে আপ্পুকে খুঁজে দিয়েছিলাম।

দাদু বলল, এই অন্ধকারে তোর বাইনোকুলার কি কাজ করবে দিদি?

--কেন করবে না দাদু? অন্ধকার এখন এমন কিছু গাঢ় হয় নি। আমি ঠিক দেখতে পাব।

দাদুকে নিয়ে সিংহীমাসির সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে লাগল তিতলি।

কিছুক্ষণ পরে মাসি বলল, দেখ বোনঝি, এই ছোট্ট ছোট্ট পায়ে বনের পথে চলতে তোর খুব কষ্ট হবে। তার চে তুই বরং আমার পিঠে বস। আমি কি আর পিঠ থেকে ফেলে দিতে পারি তোকে? কিচ্ছু ভয় নেই মা।

তিতলির ভয় কেটে গেল। ফিক করে হেসে বলল, তবে তো বেশ মজা হয়। ও দাদু তুমি তবে আমাদের সঙ্গে পাশে পাশে এস।

দাদু হেসে বলল, বাঃ তোকে তো একেবারে মা দুর্গার মত লাগছে। একেবারে সিংহবাহিনী।

--সিংহবাহিনী নয় সিংহীবাহিনী। সংশোধন করে দিল তিতলি। বেশ গর্বের সঙ্গে হেসে চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে আশপাশ দেখতে দেখতে চলল।

এমন সময় পাশের একটা ঘন ঝোপের মধ্যে থেকে নিজের বাচ্চার আওয়াজ কানে আসতেই মা সিংহ কান খাড়া করল। ভাল করে শুনে নিয়ে বলল, মনে হচ্ছে আমার বাচ্চাই ডাকছে। তিতলি বোনঝি, তোমার বাইনোকুলারের ফ্ল্যাশ লাইটটা জ্বেলে একবার ঝোপে ফেলবে? ওখানে বড় অন্ধকার।

সিংহরা এত বোকা হয় নাকি? মনে মনে হেসে উঠল তিতলি। বলল, তুমি কি জান বাইনোকুলারে কোনও ফ্ল্যাশ থাকে না? কেন থাকবে বল তো মাসি বাইনোকুলার দিয়ে কি ছবি তোলা যায়?

কথাটা অত কানে গেল না মা সিংহসে তখন আঁকুপাকু করছে তার বাচ্চার জন্যে। কান খাড়া করে সে শুনছে তার বাচ্চার গোঙানী।

সড়াৎ করে সিংহীর পিঠ থেকে নেমে ছুটে গেল তিতলি ঝোপের দিকে। পেছন পেছন দাদুও। দেখা গেল কচি কচি পায়ে সরু সরু শক্ত লতা আটকে ঝোপের মধ্যে পড়ে কাতরাচ্ছে ছানাটা। দাদু এখন বেশ সাহসী হয়েছে। এটা বোধহয় তিতলির জন্যেই। কেননা নাতনি সাহসী হলে দাদুকে তো হতেই হয়। নাহলে লজ্জার একশেষ। তাছাড়া তিতলিকে সব পশুপাখীরাই খুব ভালবাসে। ওর ক্ষতি কেউ করবে না। ওর সুবাদে ওর দাদুও নিশ্চিন্ত।

দাদু গিয়ে লতাগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে উদ্ধার করল ছানাটাকে। মা সিংহ তো খুব খুশি। জিভ দিয়ে চেটে চেটে নিজের বাচ্চাকে আদর করতে লাগল। খুশি তিতলিও। আর তার দাদুও।

বাচ্চাকে আদর করার পর সিংহীমাসি লেজ দিয়ে বারবার তিতলির গায়ে বুলিয়ে তাকে আদর করে বলল, আমার ছোনামোনা তিতলি সোনাবেঁচে থাক মা চিরকাল। আর আমাদের মত দুর্ভাগা প্রাণীদের উপকার করে যা।

দাদুকে বলল, ভাগ্য করে একটা নাতনি পেয়েছিলে বটে কাকাবাবু। সে না থাকলে কি আর আজ ছানাটা উদ্ধার পেত আমার? তোমাকেও অনেক ধন্যবাদ।

আনন্দে কেঁদে ফেলল বেচারি। তারপর বলল, দাদুকে নিয়ে আমার দেশ মানে আফ্রিকায় যাবার আমন্ত্রণ রইল তিতলি সোনা।

তিতলি তো একপায়ে খাড়া। একেবারে আফ্রিকা। বাঘ, সিংহ, হাতি গন্ডারের দেশ। তারপর সেই গরিলা শিম্পাঞ্জি? ওরাং ওটাং আর জলহস্তি? ও সে যা হবে না!শুধু পুচকিকে একবার খবরটা দিতে পারলে হয়।

ফুটকি মাসির কথা

সেই গল্প শুনেছিল অবশ্য পুচকি। সে তো টেলিফোনে। আরও ভাল করে শোনার জন্যে চলেই এসেছে ডিমাপুরে। দুই বোনে আবার হাসি আনন্দ আর ঘুরে বেড়ানো। পড়াশোনাটা অবশ্য বাদ যায় নি এক মুহূর্তের জন্যে। জেঠু ওদের দুজনকেই বলেছে লেখাপড়া কিন্তু সবার আগে। লেখাপড়া হলে বাকি সব আসবে এর পিছু পিছু। তাই লেখাপড়ায় কিন্তু ফাঁকি দেয় না এরা কেউ।

আজ ছুটির দিন। বসন্ত এসে গেছে। কি সুন্দর মিঠে হাওয়া বইছে। মাঠে মাঠে গাছে গাছে পলাশ শিমুল আর কৃষ্ণচূড়ারা লালে লাল করে রেখেছে। তিতলি কান খাড়া করল। পুচকি প্রশ্ন করল, কি হল রে দিদি থামলি কেন?

তিতলি কথা না বলে আবার কান খাড়া করে শুনতেই লাগল। এবার কিন্তু উদগ্রীব হল পুচকিও। কোথা থেকে একটা মিঠে আওয়াজ আসছে, কু-উ-উ-

পুচকি চঞ্চল হয়ে বলল, চল না রে দিদি কোকিলটা কোথা থেকে ডাকছে দেখি।

-দূর সে কি আর দেখা যায় নাকি?

-কেন দেখা যাবে না?

-আরে ওরা খুব ভীতু হয়। ওরা গাছপাতার আড়াল থেকে ডাকে কেউ দেখতে পায় না।

কিন্তু পুচকি অস্থির করে তুলল তিতলিকে। দুজনে তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগল কোথা থেকে কোকিলের আওয়াজ আসছে তা দেখার। কাছাকাছি এসেছে এমন সময় কোকিলটা ডানা মেলে ফর ফর করে উড়ে পালালো। পুচকি বলল, এই যাঃ উড়ে পালাল যে।

তিতলি বলল, আমাদের পায়ের শব্দ শুনেছে তাই।

আবার অনেক দূর থেকে কোকিলের আওয়াজ ভেসে এল। দুজনেই থেমে পড়ল। তন্ময় হয়ে শুনতে লাগল। পুচকি জিজ্ঞেস করল, কোকিলগুলো ভারি দুষ্টু তো। আমাদের দেখা দেয় না কেন রে দিদি?

-কি করে দেখা দেবে বল পুচু? ওরা যে খুব কালো দেখতে হয়। আমরা কি কালো জিনিস দেখতে ভালবাসি? এই দেখ না কুচকুচে কালো কাককে আমরা কেমন তাড়িয়ে দিই।

পুচকি একটু ভাবল। ভেবে বলল, তাও বটে। তবে দেখ দিদি কাক কাল হলেও আমাদের কত ভাল কাজ করে। কত নোংরা আবর্জনা পচা আর মরা জন্তু জানোয়ার খেয়ে সাফ করে।

তিতলি বলল, জেঠু তাই বলেছে কারোর ওপরটা দেখ না। দেখতে হবে তার ভেতরে। এই যে কোকিল কত কাল। বিচ্ছিরি দেখতে কিন্তু তবু সে কেমন সুরে গান করে বল তো?

এই সময় কোকিলটা আবার ডেকে উঠল। মৃদু মন্দ বাতাস আবার বইতে শুরু করল। লাল কৃষ্ণচূড়ার ডালগুলো আবার দোল খেতে লাগল। তিতলি বলল, দেখ পুচু দেখ-

-কি দেখব রে দিদি?

-দেখ না কৃষ্ণচূড়ার ডালগুলো কেমন দোল খাচ্ছে। যেন কোকিলের ডাকে তাল দিচ্ছে।

পুচকির মুখ ভর্তি হাসি। সবুজের বনে লাল ফুল তালে তালে দোল খাচ্ছে। গায়ের ওপর দিয়ে বাতাস যেন সুড়সুড়ি দিয়ে যাচ্ছে। তার ফ্রকের প্রান্ত উড়ে যাচ্ছে যেন নৌকোর পালের মত। সে যে কত খুশি তা ঠিকমত বোঝাতেও পারছে না তার দিদিকে।

কিন্তু এই আনন্দ উপভোগেও বাধা এল একটা। তিতলির হঠাৎ হল কি? সে যেন চোখ কুঁচকে বহু দূরের কিছু একমনে দেখছে। কিন্তু পুচকি তো কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। ভীষণ কৌতূহল হল তার। বলে উঠল, কি দেখছিস রে দিদি অমন করে?

ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে তিতলি মুখ দিয়ে একটা হুস করে আওয়াজ করল। তার মানে পুচকি যেন চুপ করে থাকে। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে চলল সামনের দিকে। পুচকি আর কি করে। দিদির পেছনেই সে চলতে থাকে পা টিপে টিপে। কথা বলতে একদম বারণ করেছে তিতলি। তাই চুপ করে তো থাকতেই হবে।

তখন দিনের বেলা। এটা তেমন কিছু বনের গভীর নয়। তবু জিনিসটা দেখে মুগ্ধ হবে কি ভয়ে দিশেহারা হয়ে বাড়ির দিকে ছুট দেবে ভেবে পাল না তিতলি। পুচকিও মুগ্ধ হয়ে গেল একেবারে। এমন জিনিস সে আগে কখনও দেখে নি। বাঘের মতই দেখতে বটে তবে পুরোটা নয়।

মুখটা তার ওপাশে। তাই সে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু তিতলিরা দেখতে পাচ্ছে। এত কাছ থেকে দেখে একেবারে মোহিত হয়ে গেল। সারা গায়ের বাদামী রঙে কালো কালো ফুটকি। আনন্দের চোটে তিতলি লাফিয়ে বলে উঠল, আমাদের চিতারাণী!

সেই আওয়াজে জন্তুটা এপাশে ফিরল। তার চোখের মণি উজ্জ্বল কালো রঙের। পুচকির মন নেচে উঠল আনন্দে। কিন্তু আবার একটা ভয়ও যে পেয়ে বসেছে। জন্তুটা খানিকটা বাঘের মতই দেখতে। বাঘের মত যদি কামড়ে দেয়?

সে ফিসফিস করে বলল, দিদি আর যাব না।

সে কথাটা শুনল না তিতলি। সাবধানী পায়ে সে এগিয়েই চলল। অগত্যা তার পিছু পিছু বেশ একটু ব্যবধান রেখে এগিয়ে চলতেই হল পুচকিকে।

জন্তুটা নড়ে উঠল। কটকটে চোখে তাকাল তিতলির দিকে। তিতলি মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করল, আরে ফুটকি মাসি! তুমি আমাদের ফুটকি মাসি নয়?

আসলে গা ভরতি বড় বড় সুন্দর ফুটকি দেখে এই নামটাই হঠাৎ মনে এসে গিয়েছিল তিতলির। নিজের দেওয়া নামটায় নিজেই বড় খুশি ছিল সে। পুচকির মনের ভয় কিন্তু আর যায় না। জন্তুটা যদি কিছু করে বসে? অতটা কাছে যাওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে তিতলির? কিছু হলে পিসেমশাই যদি পুচকিকে বকে দিদিকে বারণ না করার জন্যে? তখন তাঁকে কি করে বোঝাবে সে যে তিতলিকে অনেক করে বারণ করেছিল। আসলে তিতলির যা স্বভাব। খুব সাহস আর একগুঁয়ে।

পুচকিকে অবাক করে দিয়ে জন্তুটা বলে উঠল, ঠিক ধরেছ বোনঝি। আমি তোমাদের ফুটকি মাসিই বটে।

সে খুব খুশি হয়েছে তিতলির আচরণে। এমন করে অচেনাকে চেনা করতে জুড়ি নেই যে তিতলির। তাছাড়া বনে বনে গাছের ডালে ডালে আর পাতায় পাতায় তিতলির কথা যে ঘুরে বেড়িয়েছে বহুদিন ধরে। পশুপাখী গাছপালা এখন সবাই বোধহয় জেনে গেছে এই দুই বোনের কথা। বনের চিতা ওরফে তিতলির ফুটকি মাসিও জানে। কিন্তু স্বচক্ষে দেখাটা তার আজ এইমাত্র হল।

-কিন্তু তুমি এখানে কেন মাসি? এ তো তোমার দেশ নয়?

-না গো বাছারা। এ আমার দেশ নয়। আমার দেশ হল বাংলার ডুয়ার্স জঙ্গল। ঘুরতে ঘুরতে এখানে চলে এসেছি। আর পথ হারিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। দেশে রয়েছে আমার ছানারা। আহা এতদিন তারা আমায় না দেখে কাঁদছে। খাচ্ছে কি খাচ্ছে না কে জানে। 

চোখ দিয়ে জল ঝরতে লাগল প্রাণীটার। তিতলি বলল, তুমি কেঁদ না মাসি। আমি গিয়ে জেঠুকে বলছি সব। দেখবে না জেঠু যদি বনদপ্তরে একবার ফোন করে তবে এক্ষুণি ছুটে আসবে তারা। আর গাড়ি করে পৌঁছে দেবে তোমার দেশে। আর এতটা হাঁটতে হবে না।

এই শুনে বেশ মিষ্টি করে সারা মুখ খুলে পেল্লায় এক হাসি হেসে দিল ফুটকি মাসি। কি সাংঘাতিক বড় বড় দাঁত। কিন্তু এখন আর ভয় পাচ্ছে না পুচকি। ভাল করে হাসতে গেলে দাঁত তো বেরোবেই। পুচকিরও বেরোয়। আয়নার সামনে হেসে দেখেছে কতবার। তাই বলে পুচকি কি কামড়ে দিয়েছে কাউকে কখনও?

বন্দপ্তরের গাড়ি এল। সে গাড়িতে কাউকে ঠেলাঠেলি করে তুলতে হল না ফুটকি মাসিকে। মাসি যেন নিজেই উঠল। পুচকি আর তিতলির দিকে চেয়ে মিষ্টি করে হেসে বলল, আমি আসি তবে বোনঝিরা। তোমরা ভাল থেক। আর যদি পার তো ডুয়ার্সের জঙ্গলে বেড়াতে যেয়ো। ঠিক দেখা হয়ে যাবে আমার আর আমার ছানাদের সঙ্গে।

হাত নাড়ল এরা দুজন। বনদপ্তরের লোকেরা বুঝতে পারল না কেন হাত নাড়ল তারা। আসলে এদের কথাবার্তা তো তারা কিছুই শুনতে পায় নি। মনের কথা শুধু এদের মনের মধ্যেই ঘোরাফেরা করেছে। বনদপ্তর টের পাবে কি করে?

 


তিন

সোদরবনের ডাক

সুন্দরবন তো সব মানুষের স্বপ্ন। কেননা এখানেই থাকে ভারতের জাতীয় পশু বাঘ। ইংরেজীতে বলে ‘দি রয়াল বেঙ্গল টাইগার।‘ যেমন দেখতে সুন্দর তেমনি তার যাতায়াতের ছন্দে এক বীরত্বের প্রকাশ। বহু দূর দূর থেকে মানুষ সুন্দরবনে যায় শুধুমাত্র তাদের স্বপ্নের সুন্দর প্রাণীটিকে একবার চোখের দেখা দেখতে।

আজকাল বাঘের সংখ্যা খুব কমে যাচ্ছে। অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটা হল চোরা শিকারির উৎপাত। বাঘেরা খাবারের আর মিষ্টি জলেরখোঁজে অনেক সময় এই লোকালয়ে এসে উৎপাত করে। আর স্থানীয় বাসিন্দারা ভয় পেয়ে অনেক সময় তাদের পিটিয়ে মেরে ফেলে।

যদিও এখন আইন অনেক কড়া হয়েছে। অনেক বাধা বিপত্তি আর নিষেধের বেড়াজালে সুরক্ষিত করার চেষ্টা হয়েছে বন্য পশুদের। তবু চোর তো চোরই হয়। আর দুর্জনের কখনও ছলের অভাব হয় না। নানা ছলছাতুরি খেলিয়ে বাঘ হত্যা করে চলেছে চোরা শিকারির দল।

কাগজে অনেক ছবি দেখেছে বাঘের। তাছাড়া সিনেমা টিভি কার্টুন চ্যানেল কত কিছুতে। তিতলির ফেভারিট মানে প্রিয় মানুষ হল কার্টুন চরিত্র ছোটা ভীম আর পশুদের মধ্যে বাঘ। পুচকির পছন্দের তালিকায় রয়েছে মানুষের মধ্যে বেতাল বা অরণ্যদেব। আর পশুর মধ্যে হরিণ। এমন নিরীহ আর সুন্দর প্রাণী যে দেখলেই গায়ে হাত দিয়ে আদর করতে ইচ্ছে হয়।

জেঠুকে কতবার বলেছে তিতলি সুন্দরবনে নিয়ে গিয়ে বাঘ দেখাতে। কিন্তু জেঠু বড় ব্যাস্ত মানুষ। বলেছে, এবারটি ছেড়ে দে মা পরের বার নিশ্চয় যাব।

বাবা বলেছে, হ্যাঁ হ্যাঁ এবার তো তোদের নিয়ে যেতেই হবে।

বলেছে বটে তবে গত তিন বছরে সময় হয় নি কারো। আশা ছেড়ে দিয়েছে তিতলি। পুচকিকে বলেছে তার দুঃখের কথা। প্রাণের বন্ধু পুচকি গুগল থেকে ভাল ভাল বাঘের ছবি ডাউনলোড করে পাঠায় তাকে। আবার সেও পুচকিকে পাঠায় ভাল ভাল হরিণের ছবি সব।

কিন্তু এমন সময় একদিন ডাক এল সুদূর সোদরবন থেকে। সুন্দরবনকে তিতলি আদর করে বলে সোদরবন। ওখানে তার আদরের বাঘুমামা থাকে যে। আর পুচকিরও হরিণসোনাএকটা ছবি পুচকি সেদিন পাঠিয়েছিল তাকে যাতে তার বাঘুমামা পুচকির হরিণদিদিকে গা চেটে দিয়ে আদর করছেপশুর জগতে এমনও তবে হয়! ছবিটা চব্বিশ বার চুমু খেয়েছিল সে। একেবারে গুণে গুণে।

তা সেই সোদরবনের ডাক পেল তিতলি। আর সেই ডাক এল স্বয়ং সোদরবনের রাজা তার অতিপ্রিয় বাঘুমামার মারফতমোবাইলে পেল একটি এস-এম-এসঃ

ভালবাসার তিতলি,

ভাগ্নি আমার,

আমি জানি তুমি সোদরবনে এসে আমার সঙ্গে দেখা করার জন্যে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছ। আমি টেলিপ্যাথিতে জানতে পেরেছি। আরও জানি যে তোমার বাবা আর জেঠু দুজনেই এত ব্যস্ত যে কেউ তোমাকে আমার দেশে বেড়াতে নিয়ে আসতে পারছেন না। তা সে যাই হোক। তুমি একাই আসতে পার। মানে পুচকি আর তোমার দাদুকে সঙ্গে নিয়ে। দাদু থাকলে তো আর তোমাদের ভয়ের কিছু রইল না?

ইতি তোমার সোদরবনের বাঘুমামা।

আনন্দে লাফিয়ে লাফিয়ে তিতলি গিয়ে হাজির হল একেবারে তার জেঠুর কাছে।

-জেঠু জেঠু। বল না টেলিপ্যাথি জিনিসটা কি?

জেঠুর মত ভাল আর কে বাসে তিতলিকে। জেঠু বলল, যে তোমাকে খুব ভালবাসে সে তোমার সব কথা তার মনের মধ্যে ঠিক টের পেয়ে যায়। এই যেমন ধর তোমার কি দরকার না দরকার আমি ঠিক টের পেয়ে যাই তেমন। এটাই হল টেলিপ্যাথি।

তিতলির আনন্দ আর ধরে না। বাঘুমামা সত্যি তাকে এত ভালবাসে যে টেলিপ্যাথিতে পর্যন্ত তার সব খবর পায়? তবে শুধু হাতিদাদা, রাইনোদাদা, ঘৌ দাদা মিউরাণীই নয়। বাঘুমামাও তার খুব সুন্দর বন্ধু। মনের আনন্দে সে তো জেঠুকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমুই খেয়ে ফেলল।

ইদানিং বাঘেরাও মোবাইল ব্যবহার করছে জেনে তিতলি তো একেবারে আকাশ থেকে পড়েছিল। কিন্তু তার এক বন্ধু নাকি তার বাবার থেকে জেনেছে। সে বলল, জানিস তিতলি, এখন তো বাঘের গলায় ঘন্টা মানে মাইক্রোচিপস না কি, বেঁধে দেয় তো বনদপ্তর তাঁদের খোঁজ খবর রাখার জন্যে। সেই মাইক্রোচিপস তো একটা ডিজিট্যাল ব্যবস্থা। আর সেখান থেকে মানে সেটা দিয়েই বাঘেরা মোবাইলের কাজ চালায় আর কীমানে আমার মনে হয়।

সে যাই হোক। মামার কাছ থেকে ডাক পাওয়া গেছে এই যথেষ্ট। বাবা জেঠু সকলেই খুব খুশি। বললেন, যেতে পার তবে দাদু যদি যায় তবেই। দাদু শুনে খুশি হয়ে বলল, আরে আমি তো যাবই। কিন্তু—

কোথা থেকে হাতিদাদা খবরটা পেয়ে গেছে। হয়ত টেলিপ্যাথিতেই। লাফাতে লাফাতে এসে বলল, তোমরা নাকি সোদরবনে যাচ্ছ? আমাকে নেবে সঙ্গে?

বাঘে বাঘে কোলাকুলি

দাদু তো যেন হাতে চাঁদ পেলবলল, এই তো আমাদের টিম তৈরি হয়ে গেল। পুচকি, তিতলিকে নিয়ে আমি পিঠে চড়ব হাতিদাদার। আর পিঠে থাকবে খাবার আর জল। কি হাতিদাদা, আমাদের এতটা পিঠে করে নিয়ে যেতে পারবে তো?

হাতিদাদা সানন্দে রাজি। তিনদিন তিন রাত্তির পরে তাদের ঢুকতে হবে সোদরবনের গভীর জঙ্গলে। কিন্তু এতটা কি হাতিদাদা হাঁটতে পারে? এ যে একেবারে অসম্ভব ব্যাপার। তিতলি তাকাল জেঠুর দিকে। জেঠুর কাছে সমাধান আছে বৈকি। জেঠু কত মান্যগন্যি লোক এ তো জানে এ তল্লাটের সবাই।

জেঠুর জানাশোনা ঝোঁটন সিং-এর একটা বিশাল ট্রাক আছে। সেটাতে করে সে ইঁট, পাথর, বালি, কাঠ এসব বয়ে বেড়ায় দূর থেকে দূরান্তরে। কদিন নাহয় ভাড়া খাটবে না। জেঠু তাকে পুষিয়ে দিলেই তো হল?

ট্রাকের ওপর মহা উৎসাহে উঠে পড়ল তাদের হাতিদাদা। তার পিঠে একেবারে পেছনে বসল দাদু। একেবারে সামনে বসল তিতলি। মাঝে দাদু আর দিদির আদরের ফাঁকে জায়গা হল তাদের আদরের বোন পুচকির। পিঠে নেওয়া হল খাবার দাবার জল আর নানা জিনিস।

সোদরবনে ঢুকতে গেলে অনেক নদী পেরোতে হয়। হাতিদাদা তো আর উড়তে পারে না, তাই বাঘুমামা খবর পেয়েই একটা ভেসেল মানে চওড়া নৌকো পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেই ভেসেলে সবাইকে পিঠে নিয়ে উঠে পড়ল হাতিদাদা। সে এক ভারি মজার দৃশ্য। তবে সেই ঘাটটা ছিল বনের মধ্যে আর তাই কেউ দেখতে পায় নি সে দৃশ্য। দেখতে পেলে ভীড় লেগে যেত। আর হত নানা ঝামেলা। তাই বাঘুমামা বুদ্ধি করে এমন নির্জন ঘাটেই ভেসেলটা পাঠিয়েছে।

ঘাটে উপস্থিত ছিল বাঘুমামা স্বয়ং। সে সটাং স্যালুট ঠুকে দিতেই হাতিদাদা ভাবল স্যালুট তাকে উদ্দেশ্য করেই। সে খুব খুশি। তিতলি আর পুচকি ভাবল এই স্যালুট দাদুর উদ্দেশ্যে। সেই তো সবার থেকে বড়। তাই তারা হাসিমুখে পেছন ফিরে দাদুকে দেখে নিল। দাদু কিন্তু মনে মনে খুব হাসছে। আসলে সে জানে বাঘুমামার এই স্যালুট তিতলির উদ্দেশ্যেই। আসলে সেই যে দাদুর গল্পের নায়িকা কিনা।

সুন্দরবনে নদী, হেতাল আর সুন্দরী গাছের জঙ্গল, খাঁড়ি আর চিংড়ির চাষ দেখে দেখে বেশ ভাল লাগছিল তাদের। নদীর পাড়ে বালির ওপর শুয়ে থাকা কুমীর আর গাছের ডালে ডালে কিচ কিচ করতে থাকা অসংখ্য ছোট ছোট বানর তাদের মন ভুলিয়ে দিচ্ছিল।

হাতিদাদার পিঠে চেপে সোদরবনের গ্রামেগঞ্জে ঘুরে বেড়াতে বেশ ভালই লাগছিল। বেশ অবাক হতে হচ্ছিল সুন্দরবন দেখে। আরও বেশী অবাক হতে হল আর একটা জিনিস দেখে। তিতলির দুই মামাকে দেখা গেল কোলাকুলি করতে। মামা মানে তার দুই বাঘুমামা। একজন বড় আর একজন ছোট। দুজনের মিলন দেখে ভারি ভাল লাগল তিতলি পুচকি দুজনেরই।

বড়মামা তো স্টেটসে থাকে। মানে আমেরিকায়। স্টেটসের এক অভয়ারণ্যে ছোটভায়ের জন্যে মন খারাপ হলে চলে আসে কার্গো প্লেনে চড়ে। কার্গো প্লেন হল এমন এক উড়োজাহাজ যাতে যাত্রী থাকে না। থাকে শুধু মালপত্তর।ছোটমামা দেশেই থাকে। মানে এই সোদরবনে। হাতিদাদার পিঠে খাবারের বিরাট স্টক। সব তিতলির সৌজন্যে মানে তার আবদারে তার মা কাকিমার করা।

বনভ্রমণ আর বনভোজন

বাঘুমামা নাকি কৃষ্ণনগরের সরভাজা খেতে খুব ভালবাসে। তিতলি গল্পের বই থেকে এমন একটা দারুন গল্প শুনিয়েছে পুচকিকে। এক বাঘ নাকি খিদেতে কাতর হয়ে বন থেকে বেরিয়ে একজনের বাড়িতে ঢুকেছিল। গভীর রাতে সব দরজা জানলা বন্ধ। গরু ছাগল আর মুরগীর খোঁয়াড় বন্ধ। খুঁজতে খুঁজতে রান্নাঘরে ঢুকেছে বাঘটা। আর সেখানে ছিল একরাশ কৃষ্ণনগরের সরভাজা। খুব খুশি হয়েছেল সেটা খেয়ে। পরের রাতে আবার এসেছিল সেই লোভে। আর ধরা পড়ে গিয়ে সে এক ঝামেলা। বনদপ্তর এসে তাকে বাঁচিয়ে আবার ফেরত পাঠিয়েছিল বনে।

দিদির মুখে শোনামাত্র সেটি সংগ্রহ করেছে বোন পুচকি। বাঘুমামা তো খেয়েছে চেটেপুটে। আবার স্টেটস থেকে সদ্য আসা বড়মামা তো খেয়ে দেয়ে আনন্দের চোটে পুচকির পিঠে দিয়ে দিল গদাম করে চাপড়ে। না না ভয় পাবার কিছু নেই। স্নেহের চাপড় তো তাই বড় আলগা। তাছাড়া বেড়ালরা যেমন আক্রমণ করার সময় ছাড়া নখ থাবার নিজে লুকিয়ে রাখে আদরের চাপড় মারার সময় বড়মামা তেমনি নিজের নখ নিজের থাবার মধ্যেই লুকিয়ে রেখেছিল। বাঘ আর বেড়াল নাকি এই রকমই করে থাকে।  একই ধরণের প্রাণী নাকি এরা।

খাবার দাবার তো তিতলিরা সঙ্গেই এনেছিল। না হলে জঙ্গলে আর মানুষের খাবার পাবে কী করে। তবে হাতিদাদার খুব আনন্দ। এত গাছের এত পাতা। খুব ভাল লাগছে তার। তাছাড়া মাঝে মাঝে বানরগুলো গাছ থেকে তার পিঠে লাফিয়ে পড়ে বেশ ম্যাসাজ করে দিচ্ছে। ভারি আরাম তার। আরামে চোখ বুজে যাচ্ছে।

বাঘুমামা জিজ্ঞেস করল, ভাগ্নি তোমরা থাকবে কোথায়? মানে রাত্তিরে শুতে তো হবে? বিশ্রাম তো চাই? সোদরবনে জন্তু জানোয়ার আর পোকামাকড়ের বাস। তাছাড়া মশাও আছে ঢের।

স্টেটসের বড়মামা বলল, তা তো বটেই। আমরা তো এখানে হেতাল ঝোপে থাকি। কিন্তু তোমরা তো তা পারবে নাআমাদের চামড়া মোটা। মশা আমাদের কিছুই করতে পারে না। হাতিদাদা সোৎসাহে বলে উঠল, ওর জন্যে ভেব না গো মামারাদেখ না আমি কি করি।

সবাই অবাক হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখে। হাতিদাদা গাছের বড় বড় গুঁড়ি আর ডালপাতা দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি একটা সুন্দর মাচা বেঁধে দিল। চারপাশটা ঢেকে দিল সুঁদরি পাতা দিয়ে। তার মাথায় আবার গোল পাতার ছাউনি। পুচকি হাততালি দিয়ে বলে উঠল, ওমা কি সুন্দর মাচার ওপরে ঘর।

তিতলিও খুব খুশি। কিন্তু অত ওপরে উঠবে কি করে? দাদু তাকাল হাতিদাদার দিকে। হাতিদাদা হেসে বলল, এটুকু করতে পারব না তো আমি কিসের দাদা গো তোমাদের?

পাকানো শুঁড়ের ওপর বসল তিতলি আর পুচকি। দুজন সে ঘরে ঢোকার পরে দাদুকে তুলে দিল হাতিদাদা। ঘরের ভেতরে সুঁদরি পাতার স্তূপের ওপরে চাদর বিছিয়ে দিব্বি শোওয়া যাবে।

বাঘুমামা বলল, তিতলি ভাগ্নী, জানিস এখানে খুব ভাল মধু হয়। সোদরবনের মধু ভারি মিষ্টি আর সুস্বাদু। খুব নাম আর দাম এই মধুর।

শুনেই পুচকি বায়না ধরল, আমি মধু খাব।

দাদু বলল, কিন্তু---

লাফিয়ে পড়ে হাতিদাদা বলল, আমি থাকতে তুমি এত চিন্তা কর কেন দাদু?

আধঘন্টার মধ্যে কোথা থেকে একটা মধুর চাক এনে হাজির। বলল, এতে একেবারে টাটকা মধু আছে। খাও খাও। মামা গো তোমরাও খাও। তোমরা তো খেতে কত ভালবাস।

সে এক সুন্দর দিন। মানুষ আর পশু মিলে যে এত সুন্দর একটা মিলনোৎসব হতে পারে তা ভাবতেই খুব ভাল লাগল তিতলির। কেন যে কিছু দুষ্টু মানুষ হাতি, গন্ডার, বাঘ সিংহ এদের মেরে ফেলে সেটা বুঝতে পারল না।

খেতে খেতে বাঘুমামা বলল, আসলে কি জান ভাগ্নী। জঙ্গলে যখন আমাদের সব খাবার ফুরিয়ে যায় তখন আমরা যাই তোমাদের পাড়ায়। ছাগলটা, গরুটা চুরি করতে। কী করি বল পেটে খিদেটা তো আছে নাকি?

তিতলি দেখল আর বলতে পারল না মামা। গলা ধরে এসেছে। গলা খাঁকারি দিয়ে একটু পরেই আবার বলল, কিন্ত মানুষ আমাদের অনেক সময় আমাদের লাঠি বাঁশ এসব দিয়ে পিটিয়ে মেরে দেয়। এমন কী আত্মরক্ষার জন্যে জলে নেমে সাঁতার কেটে নদী পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকে যাবার সময়ও ওরা তাড়া করে আমাদের। পালাতে না পারলে জলেই পিটিয়ে মেরে দেয়। স্বীকার করি তোমাদের চেয়ে গায়ের জোর আমাদের বেশি অনেক। কিন্তু সাহস বড় কম ভাগ্নী। মানুষের বুদ্ধির কাছে আমাদের বুদ্ধি তুচ্ছ। কিন্তু এমন ভাবে—

বলতে বলতে কান্নায় গলা বুজে এল বাঘুমামার।

পুচকি কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। তিতলি সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ভেব না মামা।দুঃখ পেয়ো না। দিন এমন থাকবে না। দেখবে এমন একদিন আসবে যেদিন পশু আর মানুষে খুব ভাব হয়ে যাবে। কেউ আর কাউকে ভুল বুঝবে না।

দাদু একটু কম কথাই বলে। এতক্ষণে শুধু বলল, আমাদের মানে মানুষদেরও চেতনা বাড়ছে। মানুষ আর অকারণে পশুদের ওপর অত্যাচার করতে চায় না। মানুষ আর পশুদের মধ্যে একটা মিটমাট হয়ত হয়ে যাবে একদিন। বিশেষ আমাদের তিতলিদিদি আর পুচকিদিদির মত পশুপ্রেমী মানুষের দল সংখ্যায় বাড়ছে গো বাঘু ভাইপোরা

সুঁদরি গাছের ঝোপে নিজেদের চোখ মুছে নিল তিতলির দুই মামা। বাঘুমামা হেসে বলল, আমাদের এই দুই ভাগ্নিকে নিয়ে আমাদেরও খুব গর্ব কাকাবাবু। কিন্তু ওরা সকলের গর্ব হোক এই আমরা চাই।  

ছটফটে বানুভাই

সোদরবনে দিব্বি আছে তারা। এখন আর বাঘুমামাকে সব সময় থাকতে হয় না সঙ্গে। কিছুদিন দুই মামা তাদের সঙ্গে নিয়ে বেড়িয়েছিল। পথঘাট সব দেখিয়ে দিয়েছে ভাল করে। এ তো শহর বা গ্রাম নয়। বনের মধ্যে রাস্তা চেনা খুব একটা সহজ নয়। যেখানেই তাকাও সুঁদরি আর হেতাল ঝোপ। আরও আছে গোলপাতা আর নানা রকম অজানা পাতা যাদের নাম জানে না অথবা বাঘুমামার মুখে শুনেও মনে রাখতে পারে নি।

এখন এই বনে চলতে ফিরতে হাতিদাদা বেশ দড় হয়ে উঠেছে। একা একাই তাদের পিঠে করে নিয়ে যায়। একমাত্র যখন বুনো লতা পায়ে আটকে যায় বা শুঁড়ে কিংবা দাঁতে আর নিজে চেষ্টা করেও ছাড়াতে পারে না তখন সে দাদুকে বলে লতাটা কেটে দিতে। দাদু নীচে চলে যায় লতা ছাড়াতে চেষ্টা করে। পুচকি আক্ষেপ করে বলে, ইস একটা যদি ছুরি সঙ্গে থাকত তো কেমন ঘ্যাচাং করে কেটে দেওয়া যেত চট করে।

অমনি হাঁ হাঁ করে ওঠে তিতলি, না না  কেটে দিলে লতারা কষ্ট পায় দাদু বলেছে। গাছেদেরও প্রাণ আছে তুই কি ভুলে গেছিস রে পুচকি?

তা ঠিক। পুচকির মনে ছিল না। সে জিভ কাড়ে। লতা ছাড়িয়ে দাদু আবার হাতিদাদার পিঠে উঠে পড়ে দাদু প্রশংসার দৃষ্টিতে তিতলির দিকে তাকিয়ে বলে, ঠিক বলেছ। গাছপালাদের অযথা কষ্ট দিতে নেই। পশু, পাখী, গাছপালা আর মানুষ এই নিয়েই আমাদের জগতটা সুন্দর হয়ে থাক।

হাতিদাদার পিঠে বেশ আয়েস করে তিনজন যাচ্ছিল। জঙ্গলে কত কি আছে। কত লতা। কত পাতা। কত গাছ, কত পাখী আর কত পোকামাকড়। বাঁদরেরা কিচকিচ করে একটা গাছে লাফিয়ে লাফিয়ে খেলছিল। একসঙ্গে অনেক বাঁদর। যাকে বলে এক দঙ্গল। পুচকির তো খুব ভয় করছিল। বাঁদররা নাকি খুব অসভ্য হয়। লাফিয়ে গাছ থেকে নেমে এসে হাত থেকে খাবার দাবার কেড়ে খায়। আবার মুখ ভ্যাঙ্গায়। 

পুচকি ভয়ে ভয়ে তিতলিকে জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁরে দিদি—

তিতলি বলল, কি?

--দেখেছিস কত বাঁদর? যদি—

দাদুও একটু চিন্তিত ছিল এতগুলো মানে গাছভর্তি বাঁদরের লাফালাফি দেখে। বলল, হ্যাঁ গো হাতিদাদু, এরা আবার—

মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে হাতিদাদা বলল, ও তুমি কিচ্ছুটি চিন্তা কর না গো দাদু। তোমাদেরও  কিচ্ছু চিন্তার নেই দিদিরা। চুপটি করে বস।

বলে সে শুঁড় তুলে তার বিকট গলায় চীৎকার করতে বাঁদরের সব চুপ করে তার দিকে চেয়ে শুনতে লাগল। হাতি তার নিজের ভাষায় কি বলল কয়েকবার। বাঁদরেরাও কিচ কিচ করে কি সব বলতে লাগল।

মাঝখানের যে সর্দার বাঁদর ছিল সে এগিয়ে এসে একেবারে চড়ে বসল হাতির পিঠে তিতলির পাশে। পুচকি তো ভয়ে একেবারে কাঠ। বাঁদর শেষে মানুষের ভাষায় তিতলিকে বলল, হাই তিতলিদিদি। হাই পুচকি সোনা। হাই দাদু। তোমরা ভয় পেয়ো না। আমরা তোমাদের কিচ্ছুটি করব না।

পুচকি তো অবাক। বাঁদরেরা মানুষের ভাষায় কথা বলছে। আবার ভেবে দেখল, ঠিক তো। বাঘুমামা, হাতিদাদা, রাইনোদাদা এরা সবাই তো মানুষের ভাষায় কথা বলতে পারে।

বাঁদর সর্দার পুচকির মুখে দেখেই তার মনের কথা বুঝে গিয়েছিল। কিচকিচ করে হেসে বলল, আমাদের পশু জগতে এখন তিতলিদিদিকে সবাই চেনে। আমাদের এখানেও এখন এক রকম ইন্টারনেট চালু হয়ে গেছে। এতেও কোনও তার লাগে না। হাওয়াতে ভর করে খবর এক জায়গা থেকে  আর এক জায়গায় যায়। তিতলিদিদি, পুচকি সোনা আর দাদুকে এখন বনের সব পশুরা চেনে। আসলে তোমরা তিনজন যে পশুপাখীদের আপন জন।

বেশ খুশি হল পুচকি। দাদু মুচকি মুচকি হাসতে লাগল আর তিতলি তার চুলের বেণী দুলিয়ে দুলিয়ে নাচতে লাগল বেজায় আনন্দে।

বাঁদর সর্দার আরও বলে যাচ্ছে, আর কে না জানে এই সোদরবনে তোমরা হলে আমাদের রাজা বাঘুমামার অতিথি। শোন দিদিরা এই বনে কেউ তোমাদের কোনও ক্ষতি করবে না। এমন কি ছোট্ট একটা কীটও নয়। বাঘুমামার পরিষ্কার নির্দেশ আছে। অমান্য করলেই বনছাড়া করবে।

হাতিদাদা তো দাঁড়িয়ে গেছে। বাঁদররা সব নীচে নেমে পড়ে কিচকিচ করছে। পুচকি তিতলির কোলে ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে খেলেছে। ওদের তো খুব মজা। দাদুর শুধু দেখে দেখে মিটিমিটি হেসে যাচ্ছে। হাতদাদা ঘন ঘন আনন্দে মাথা নাড়ছে। সে এক দারুণ আনন্দের যজ্ঞ যেন।

সর্দার বাঁদর বলল, বল দিদি তোমাদের কি দোব? কি খাবে তোমরা?

তিতলি বলল, আমাদের তো সব কিছু আছে বানুভাই। আর কিছু লাগবে না।

বানুভাই মানে সর্দার বাঁদরের মন খুব খারাপ হয়ে গেল। বলল, তা হতে পারে না। কিছু তো একটা নিতেই হয়। বলে কিচকিচ করে তার সেনাদের কি নির্দেশ দিল। পাঁচ মিনিটও গেল না তারা এনে হাজির তিনটে কলার কাঁদি। পাকা টুকটুক করছে। বেশ খুশি সবাই। হাতিদাদাকে সাবধান করে দিল বানুভাই, হাতিদাদা তুমি কিন্তু এদের পাকা কলার ওপর লোভ দিও না।

হাতিদাদার তো খুব অভিমান। ঘন ঘন মাথা নাড়তে লাগল।

--আচ্ছা বেশ বেশ। যাওয়ার সময় আমাদের একটা বড় কলাবাগান পড়বে। তোমার যত খুশি খেয়ে নিয়ো।      

                                                                                           ( ক্রমশ...)

_______________________________________________________________________________

 

 

 

(ডাঃ) অরুণ চট্টোপাধ্যায়

DR. ARUN CHATTOPADHYAY

181/44 G.T.ROAD (GANTIR BAGAN)

P.O. BAIDYABATI

DIST. HOOGHLY (PIN 712222)


চিত্রঃ  সোহম দত্ত
অষ্টম শ্রেণি
বর্ধমান সি.এম.এস হাইস্কুল

মন্তব্যসমূহ

সপ্তাহের পছন্দ

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 32nd issue: May 2024

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচীপত্র ।। 28th issue: January 2024

ছড়া ।। তোর ।। বিবেকানন্দ নস্কর

লেখা-আহ্বান : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫ সংখ্যার জন্য

প্রচ্ছদ ও সূচীপত্র ।। 25th issue: October 2023

ছড়া ।। সবুজ ঘাসেতে প্রাণ খুঁজে পাই ।। জয়শ্রী সরকার

অনুবাদ ।। কথা না-বলা টিয়া ।। সুস্মিতা পাল

প্রচ্ছদ ও সূচীপত্র ।। 23rd issue: August 2023

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। ষড়ত্রিংশ সংখ্যা ।। সেপ্টেম্বর ২০২৪

মাসের পছন্দ

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। ষড়ত্রিংশ সংখ্যা ।। সেপ্টেম্বর ২০২৪

ছড়া ।। খোকাবাবু ।। মেশকাতুন নাহার

কবিতা ।। মাটির কাছে যায় ।। অবশেষ দাস

ছড়া ।। তোর ।। বিবেকানন্দ নস্কর

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 32nd issue: May 2024

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচীপত্র ।। 28th issue: January 2024

ছড়া ।। বর্ষার উৎসবে ।। আরতি মিত্র

ছড়া ।। পুজোর খুশী ।। আরতি মিত্র

কবিতা ।। ব্যাঘ্রমশাই ।। দীনেশ সরকার

বছরের পছন্দ

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। ত্রয়োত্রিংশ সংখ্যা ।। জুন ২০২৪

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচীপত্র ।। 29th Issue: February

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। চতুর্ত্রিংশ সংখ্যা ।। জুলাই ২০২৪

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 31st issue: April 2024

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 32nd issue: May 2024

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 30th issue : March 2024

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। পঞ্চত্রিংশ সংখ্যা ।। আগষ্ট ২০২৪

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। ষড়ত্রিংশ সংখ্যা ।। সেপ্টেম্বর ২০২৪

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচীপত্র ।। 26th issue: November 2023

অতি প্রিয়

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। আত্মপ্রকাশ সংখ্যা ।। অক্টোবর ২০২১

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। দ্বিতীয় সংখ্যা ।। নভেম্বর ২০২১

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 4th issue: January 2022,

নিবন্ধ ।। শিশু-কিশোর সাহিত্যবলয়ে শিশুরাই যেন ব্রাত‍্য না থাকে ।। অরবিন্দ পুরকাইত

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 7th issue: April 2022

নিবন্ধ ।। দেশীয় উদ্ভিদ কেন গুরুত্বপূর্ণ ? ।। ডঃ চিত্তরঞ্জন দাস

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় - ১০ ।। জুলাই ২০২২

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় - ১১ ।। আগস্ট ২০২২

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র : 8th issue: May 2022

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 5th issue: February 2022