শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশে করোনাভাইরাস বা কোভিড ১৯-এর প্রভাব
ঊষা মল্লিক
মায়ের জরায়ু তে থাকা অবস্থাতেই আমরা পৃথিবীতে আগত শিশুর মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার বিষয়ে চিন্তিত থাকি। শরীরের সঙ্গে সঙ্গে শিশুর মানসিক বিকাশ ও খুব গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর মানসিক বিকাশ শুরু হয় তার বাবা, মা এবং বাড়ির বিভিন্ন সদস্য বা সদস্যাদের হাত ধরে। তারপর ধীরে ধীরে প্রতিবেশী ও তার চারদিকের পরিবেশের উপরেও তার মানসিক বিকাশ নির্ভরশীল হয়ে যায়। শিশুরা একটু বড় হতে না হতেই তারা খেলার মাঠে, স্কুলে যেতে শুরু করে। স্কুলে এবং খেলার মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে থাকতে থাকতেও শিশুদের অনেক মানসিক ও শারীরিক বিকাশ হয়ে থাকে। নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন জিনিসের, জ্ঞানের আদান প্রদানের মাধ্যমেও শিশুদের মানসিক বিকাশ হয়ে থাকে। শিশুরা বাড়ীতে পড়াশোনা করতে না চাইলেও স্কুলে অবশ্যই উপস্থিত হতো। খেলার মাঠে আসার জন্য ভীষণ ব্যস্ত থাকত। কারন এই স্কুল বা খেলার মাঠ তাদেরকে অনেক প্রানচঞ্চল করে রাখতো। বন্ধুদের সঙ্গে টিফিন, খেলনা ভাগ করার মধ্যে দিয়ে শিশুরা নিজেদের মধ্যে আনন্দ খুঁজে নিত।সবসময় শিশুরা চনমনে থাকতো। খেলাধূলার মধ্যে দিয়ে শারীরিক গঠনের উন্নতি হতো। মানসিক ও শারীরিক ভাবে শিশুরা সুস্থ থাকতো।
কিন্তু ২০২০এর মার্চ মাস থেকে পৃথিবীর চিত্র টা পুরো বদলে গেল। করোনাভাইরাস এর সংক্রমণে সারা পৃথিবী যেন অন্য এক গ্রহ তে পরিনত হয়েছে। যেখানে মানুষের সংগে মানুষের মেলা মেশা বন্ধ। যেখানে শিশুরা ঘরবন্দি। নেই কোনো স্কুল যাওয়া, নেই কোনো বন্ধু, নেই যে কোনো খেলা ধূলা। সারাদিন শিশুদের কাটছে একদম বাড়ীতে। আজকাল আবার বেশিরভাগই পরিবার গুলো একক পরিবার। আবার প্রত্যেক পরিবারে এখন একজন করে শিশু। তাই ঘরে ঘরে শিশুরা আজ বড় একা। না আছে শিশুদের মধ্যে আজ কোনো শিক্ষার কোনো আদান প্রদান, না আছে মাঠে দলবদ্ধ ভাবে কোনো খেলা।
তাই শিশুরা সবাই খুব আজ অসহায়। মানসিক ও শারীরিক ভাবে ক্লান্ত ও অবসন্ন। আজ তাদের মাথা, মন সব যেন যান্ত্রিক হয়ে গেছে। সকাল থেকে শুরু হয় অনলাইনে ক্লাস। অনলাইনে টিউশন, অনলাইনে গানের, নাচের, গিটারের ক্লাস, সব কিছুই উন্নত যান্ত্রিক বিদ্যার মধ্যে দিয়ে চলছে । অথচ বন্ধুদের সঙ্গে এইসব সশরীরে করতে পারলে শিশুদের অনেক বেশী মানসিক ও শারীরিক উন্নতি হতে পারত। মানুষের মানবিকতা, ইমোশন, আবেগ এর কোনো ছোঁয়া নেই। শিশুদের কোনো মানসিক বিকাশ নেই। সারাদিন তারা অনলাইনে গেমে ব্যস্ত। নেই সেখানে কোনো বন্ধু দের সঙ্গে যোগাযোগ, নেই কোনো ভালো আলোচনা, নেই কোনো উন্নত মানের খেলা। বাড়ীতে সারাদিন অনলাইনে ব্যস্ত থেকে শিশুদের দৈনন্দিন চলাফেরার মধ্যে অনেক শিথিলতা এসেছে। শিশুরা ভীষণ অলস হয়ে যাচ্ছে। দৌড়ঝাঁপ করতে তারা আর ভালো বাসে না। সারাদিন বাড়ীতে বসে থাকার জন্য শিশুরা এখন বেশির ভাগ অতিরিক্ত ওজনের শিকার হচ্ছে। এই ওজন বৃদ্ধির ফলে অনেক শিশুরা অনেক মারন রোগের( ডায়াবেটিস, হার্টের রোগের) শিকার হচ্ছে । ভবিষ্যতে শিশুদের অনেক বেশি ক্ষতি হবার আশঙ্কা থাকছে । সারাদিন অনলাইনে পড়াশোনা বা মোবাইল গেমের জন্য শিশুদের চোখের উপরে খুব প্রভাব পড়ছে আর এতে ভীষণ ভাবে চোখের ক্ষতি হচ্ছে।
বাড়ীতে সারাদিন শিশুরা থাকছে, একদিকে যেমন তারা অনেক টা সময় বাবা,মা , দাদুঠাকুমার সঙ্গে থাকতে পারছে, তাদের মনে আনন্দ জাগছে, তেমনি তারা সারা দিন বাড়ীতে থাকার জন্য বাড়ীর অনেক ঝামেলা, বাবা মার মধ্যে হওয়া অনেক ঝামেলা ও নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করছে, সেসব ঘটনা তাদের উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে। আর সেটার প্রভাব তাদের মানসিক বিকাশেও পড়ছে। একদিকে যেমন পরিবারের সবার সাথে থাকতে পারার আনন্দ, অন্যদিকে তেমনি তার সতীর্থ দের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা, শিশুদের মনে আর শরীরে অনেক প্রভাব ফেলেছে।
কোনো কোনো শিশু হয়তো বাড়ীতে থেকে বাবা মার কাছ থেকে অনেক ভালো খাবার পেয়েছে। আবার কোনো কোনো শিশু অনাহারে দিন কাটিয়েছে। তার বাবার হয়তো কাজ চলে গেছে। অতিরিক্ত খাওয়া বা অনাহার দুটোই খুব প্রভাব ফেলেছে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার উপরে ।
কোভিড ১৯ এর জন্য শিশুরাও সারাদিন মুখে মাস্ক পরে থাকছে। শিশুদের স্বাভাবিক জীবনের ছবিটা পুরো বদলে গেছে।
ক্রিকেট, ফুটবল সব কোচিং সেন্টার বন্ধ। গান, নাচ, আঁকা শেখার জায়গা গুলো বন্ধ। তাই শিশুদের এগুলোর উপর আর কোনো আকর্ষণ বা ইচ্ছা থাকছে না। ঘরবন্দি শিশুদের স্কুলে, মাঠে , রাস্তায় আর কোনো চাঞ্চল্যকর দৃশ্য চোখে পড়ে না। সমাজের সবাই আমরা আজ শিশুদের ভবিষ্যত নিয়ে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছি।
স্বাভাবিক জীবনে যত তাড়াতাড়ি ফেরা যায়, ততই মঙ্গল এই শিশুদের জন্য। সবমিলিয়ে আমরা শিশুদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরার অপেক্ষায় আছি যাতে করে শিশুরা মানসিক ও শারীরিক ভাবে সুস্থ জীবনে ফিরতে পারে।
======000======
ঊষা মল্লিক
বিভাগীয় প্রধান, নার্সিং বিভাগ, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন