Featured Post
ছোটগল্প ।। নতুন মাস্টার ।। কার্তিক চন্দ্র পাল
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
নতুন মাস্টার
কার্তিক চন্দ্র পাল
-লতুন মাস্টার এয়েছে গাঁয়ে। কোলকেতার মাস্টার।
খেন্তিকে শিবু খবরটা দিল।
-যা পালাঃ, খালি আগডুমবাগডুম বকিস্। কলমি ক'টা ধর দিকিনি, দুটো গুগলি পাই কিনা দেকি।
-দিদি, বেশি লাবিস না, শিকলবুড়ি টেনে লেবে। মরবি।
শিবু তার বুড়ি ঠানদির কাছে শুনেছে বড় দীঘির মাঝখানে শিকলবুড়ি থাকে। কেউ দীঘির মাঝখানে গেলেই বুড়ি তার পায়ে শিকল পরিয়ে টেনে নেয় জলের তলায়। তাই সে দিদির জন্য বেশ উদ্বিগ্ন। ভয়ার্ত মুখে পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে সে।
দিদির জন্য চিন্তাটা যেমন হচ্ছে শিবুর তেমনি গুগলি খাওয়ার লোভ টাও ছাড়তে পারছে না। বাপটা মারা যাওয়া ইস্তক কলমি কিংবা সজনে শাকই তাদের নিত্যদিনের খাবার। মাঝে মধ্যে গুগলি পাওয়া যায়। সেদিন শিবুর খুব আনন্দ। আজ কটা পাওয়া গেছে।
ফিরতি পথে নতুন মাস্টার আসার কথাটা বিশ্বাস করছিল না দিদি। বলছিলো - "কোলকেতা মেলা দূর বটে। জাহাজ, রেলগাড়ি কত কী চাপতে হয়। তা'বাদে, এই গাঁয়ে আসতেই বা যাবে কেনে। স্বপন দেকেছিস তুই।"
দুপুর বেলা ভাতটুকু আজ জুত করেই খেলে দু' ভাই-বোনে। ঝাল ঝাল গুগলি দিয়ে। খেয়েই বেরিয়ে পড়ল দুজনে সাইকেলের টায়ার ঠেঙ্গাতে ঠেঙ্গাতে। দুটো পাকা খেজুরের আশায়। কুলতলির ডাঙ্গাতে।
পথে ইস্কুল পেরিয়ে যেতে গিয়ে নতুন মাস্টারকে দেখতে পেল তারা। নিধু বামুনের ঘরে। বাড়িটা ভাড়া নিয়েছেন। একটা একতলা দুকামরা বারান্দা দেওয়া ঘর আর একটুকরো উঠোন। উঠোনের পাশে আমগাছের ছায়ায় একখানা মোড়াতে বসে কাগজ দেখছিলেন।
শিবু দিদির কানে কানে বলল- "দেখলি, আমি ঠিক দেকেছিনু। লতুন মাস্টার এয়েচে।"
দিদি প্রতিবাদে বলে উঠলো -"দুর, দেকগে যা। বামুনদাদুর কুনো কুটুম হবে। চল দিকিনি একুন।"
সাইকেলের টায়ার খানা ফিরে বাগিয়ে ধরতেই মাস্টার মশাইয়ের ডাক পেলো তারা - 'এই! তোরা এদিকে আয় তো একটু।'
ডাক শুনে একটু হকচকিয়ে গেল দুজনেই। শিবু তার দিদির দিকে যুগপৎ ভয় আর দ্বিধামিশ্রিত চোখে তাকাল। খেন্তি মাস্টারের দিকে এগিয়ে যেতে, শিবু একহাতে লাঠি-টায়ার আর অন্যহাতে দিদির জামার ফিতেটা ধরে পিছু পিছু গেল।
নাহ্। মাস্টার ভালো বটে। বকাঝকা কিছু করেনি, উল্টে নরম করে কথা বলেছে। এতেই তারা মাস্টারকে ভালো ঠাওরালো।
এই স্কুলে পড়ে কিনা জিজ্ঞেস করতেই ভাইবোনে দুদিকে মাথা নাড়ালো।
মাস্টার বুঝলো স্কুলের মিড ডে মিলের নতুন ব্যবস্থাটা এরা এখনো জানেনা।
-"কাল স্কুলে চলে আসিস, তোদের দুপুরবেলা ডিম ভাত খাওয়াবো। আর মুদিখানার দোকানটা একটু দেখিয়ে দে তো আমায়। চল তোদের সঙ্গেই যাই।"
মাস্টারমশাই এর কথা শুনে ওরা হাতে চাঁদ পেল। কেউ যে ওদের নেমতন্ন করতে পারে সেটাই বিশ্বাস হচ্ছিল না। তারা দুজনেই গর্বিত মুখে মাস্টারমশাইকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল আগে আগে।
মাস্টারমশাই এই গ্রামে এসেছেন নতুন চাকরী পেয়ে। জুনিয়র হাই স্কুল। তিনটি পোস্টের বাকি দুটিতে কেউ যোগদান করেন নি। তাই স্কুলের মাস্টার এখন মোটে একজনই। তাঁর সোনারপুরের বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব প্রায় দুশো মাইল। জীবনে প্রথম চাকরী। অগত্যা, এতদূরে অজ পাড়াগাঁয়ে আসা।
এখানকার প্রকৃতি ভারি মনোরম। নির্ভার সাদামাটা জীবনের জন্য কুঁদে কুঁদে মানুষ তৈরিতে ওস্তাদ এই গ্রাম। কিন্তু শহুরে জীবনের চাহিদা মেটানোর দায় এ গাঁয়ের নেই। সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়লেই গ্রামটিও ঘুমিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নেয়। বিদ্যুৎ আছে গ্রামে, কিন্তু তার ব্যবহার করার বিলাসিতা কেউ দেখায় না। সকলেই যেন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান এই তিন প্রাথমিক চাহিদাকে নিয়েই বিব্রত।
পরের দিন দুপুরে ভরপেট ডিম ভাত খেয়ে ভাইবোনে লাফাতে লাফাতে বাড়ি ফিরল। মায়ের কাছে মাস্টারের গল্প, খাওয়ার গল্প ফুরোতেই চায় না।
_ জানো মা, লতুন মাস্টার আমাদেরকে ইস্কুলে ভত্তি লিবে বলিচে। তাইলে পতিদিন খেতে দিবে। যাবো মা ইস্কুলে?
-যাবি। দৈনিক দিবে খেতে?
-মাষ্টার তো তাই বলিচে।
মা ও খানিকটা অবাক হয়েছে। ইস্কুলে আবার খেতেও দেয়! তায় প্রতিদিন? তা ভালো। যদি একবেলা ছেলেমেয়ে দুটো ভরপেট দুমুঠো খেতে পায়।
সেই শুরু। পড়াশোনা যে ঘরে বিলাসিতা ছিল, সেই ঘরে পেটের ভাত দিচ্ছে ইস্কুল। শিবু খেন্তির মাও ইস্কুলে যায় প্রতিদিন। মিড ডে মিল রান্না করে। ইস্কুলে ছেলে মেয়ে দুটোকে নিজের হাতে ভাত দেয় দুপুরে। বুকটা ভরে যায় মায়ের। স্কুলের সব ছেলেমেয়েরা খেয়ে গেলে বেড়ে থাকা খাবার দিয়ে রাতের ব্যবস্থাটাও হয়ে যায় প্রায়ই।
মাস্টার সত্যি খুব ভালো। সকালে ঘরের টুকটাক কাজ করতে করতে ছেলে মেয়ে দুটোকে দুলে দুলে পড়তে দেখে শিবুর মা।
'বড়নোক বাবুদের ছেলে-মেয়েদের মতন'- নিজের মনেই ভাবে সে। ভারি ভালো লাগে তার।
শিবু-খেন্তিকে খুব ভালোবাসেন নতুন মাস্টার। মোটে মাস কতকের ভিতরে তিনি ওদের বাড়ির পরিবেশটাই বদলে দিয়েছেন।
শিবু-খেন্তি দুজনেই মাস্টারের খুব ন্যাওটা হয়ে উঠেছে কদিনেই। তাঁর ঘরে ওদের দিনরাত আনাগোনা।
মাস্টারেরও তাদের ছাড়া চলে না। মুদিখানার বাজারই হোক বা তাঁর সাধের ফুলবাগানের কেয়ারি, সবেতেই শিবু-খেন্তি।
এইতো সেদিন। মাস্টারের ধুম জ্বর। কদিন শিবু-খেন্তি বাড়ি যায়নি। তাঁর ওষুধ-পথ্য, জলপটি, রান্না সব দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছিল শিবুরা সপরিবারে।
বস্তুত, অল্পে সন্তুষ্ট মানুষেরা সংবেদনশীল মানুষদের বড় সহজেই আপন করে নিতে পারে। বন্ধন সৃষ্টির আদি নিয়মই তাই। সে ইলেকট্রন হোক বা পার্থিব আদান-প্রদানের বিষয়, বন্ধনের রসায়ন সেই নিয়মেই চলে।
স্কুলের স্পোর্টস উপলক্ষে মাঠে ঘটা করে প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে। সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজানো। ফুল কিনতে হয়নি। শিবু-খেন্তি সব জোগাড় করেছে বাড়ি বাড়ি গিয়ে। মালা গেঁথে সাজিয়েছে তারাই। সাজাতে সাজাতে প্রায় সন্ধ্যা। বাইরের অতিথিরা আসবেন সব।
শিবুরাও নাম দিয়েছে খেলাতে। শিবু খুব জোরে দৌড়তে পারে, গাঁয়ের ছেলেরা তার সাথে পারে না। মাস্টার বলেছেন দৌড়ে ফার্স্ট হলে একজোড়া নতুন জুতো কিনে দেবে। কোলকাতায় নিয়ে যাবে খেলতে। ফার্স্ট হলে একখানা স্টিলের থালাও সে পাবে। ইস্কুল ঘরে দেখেছে সে প্রাইজগুলো।
নতুন মাস্টার পাড়ার ভজদাদার দোকান থেকে চপ কিনে মুড়ি খাইয়েছে দুই ভাই বোনকে। সঙ্গে কফি। জীবনে প্রথমবার এ পানীয়টির স্বাদ তারা নিল।
বাড়ি ফিরে মাকে এই 'কপি'-র কথা না বলা পর্যন্ত তাদের পেট যেন ফেঁপে উঠেছে।
বাড়ি ফিরেই মাকে 'কপি' খাওয়ার গল্প শোনালো। না, তাদের মাও ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি ভিন্ন অন্য 'কপি' কোনোদিন খায়নি।
কুপির আলোয় স্বপ্নময় মুখদুটি রাতের খাওয়া শেষ করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলল। কত অল্পে সন্তুষ্ট এরা। বিধাতা এদেরই যেন অল্পটুকু দিতেও কৃপণতা করেন।
রাতে আনন্দে ঘুম আসেনা শিবুর। প্রথম সে হবেই। ভোররাতে সে স্বপ্ন দেখে মাস্টারের দেওয়া নতুন জুতো পরে সে ছুটছে.. মাস্টার তাকে বলছে শিবু আরও জোরে ছোট.. ছুটতে ছুটতে সে দেখে মাস্টারের মুখটা ধীরে ধীরে বাবার মুখ হয়ে গেল...
[ছবি: ইন্টারনেট মাধ্যম থেকে সংগৃহীত]
______________________________________________
কার্তিক চন্দ্র পাল
রাজগঞ্জ, পূর্ব বর্ধমান।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন