রূপসা মন্ডল চক্রবর্তী
ছোট্ট স্টেশনটায় 'রূপসী বাংলা' ট্রেনটা এসে থামলো। স্টেশনে বেশী লোকজন নেই। লাল ইট বাঁধানো প্ল্যাটফর্ম। স্টেশনটার নাম বাউরিয়া। ছোট ছোট টিনের চালার কয়েকটা দোকান। নেমেই দেখলাম, মালতী দাঁড়িয়ে আছে। মালতী আমার বন্ধু। একই স্কুলে দু'জনে পড়ি- কলকাতায়। ও বোর্ডিংএ থাকে। গরমের ছুটিতে ওর বাড়িতে বেড়াতে এসেছি আমি। স্টেশন থেকে বেরিয়ে লাল মাটির রাস্তা ধরে মালতীর সাইকেলের কেরিয়ারে বসে চলে এলাম ওদের বাড়িতে। ছোট্ট বাড়িটার সামনে এক ফালি একটা বাগান। মালতী আর ওর মা এখানে থাকে। মালতীর বাবা নেই। মা 'ননীবালা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়'এ পড়ান। স্কুলটা বাড়ির কাছেই।
দুপুরে একটু বিশ্রাম করে নিয়ে বিকেলবেলা বেরোলাম ওদের গ্রাম দেখতে। মালতীদের বাড়ির কাছেই একটা মস্ত ঝিল আছে। সেখানে গিয়ে দেখলাম, চারিদিকে ঘন জঙ্গলের মতো গাছপালা আর গাছে গাছে অজস্র পাখি। দূরে দূরে দু-একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। নিরিবিলি এই পরিবেশ আমার খুব ভালো লাগলো। হঠাৎ চমকে উঠলাম একটা গোলমাল শুনে। দেখলাম, একজন মহিলা একটা ছোট মেয়েকে খুব বকছে। মেয়েটার কোলে একটা বাচ্চা কুকুর। মহিলাটি মেয়েটার মা হবে মনে হয়। সে মেয়েটিকে বলছে,
- কেন এনেছিস এটাকে?
- ওর যে খুব শরীর খারাপ, মা।
- শরীর খারাপ তো তুই কি করবি?
- ওর খুব খিদেও পেয়েছে যে!
- আচ্ছা, আমি কি করবো? ওর খাবার কোত্থেকে আসবে, শুনি?
- ও তো খুব অল্প খাবে...
- না। ওকে যেখানে পারিস রেখে দিয়ে, তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এসো।
এই বলে মেয়েটির মা রাগে কাঁপতে কাঁপতে হনহন করে হেঁটে চলে গেলো। আমি মালতীকে জিজ্ঞেস করলাম,
- মেয়েটা কে রে?
- ও তো আলো। অরু মাসির মেয়ে।
- ওকে ওর মা এতো বকলো কেন, বলতো?
- কি আর করবে, বল? আলোর বাবা অনেক দিন ধরে নিরুদ্দেশ। আলো আর ওর ভাই অরুণকে নিয়ে অরু মাসির দুঃখের শেষ নেই। নানারকম কাজ করে, কোনো রকমে ওদের দুজনকে মানুষ করছে। অর্ধেক দিন অরু মাসির নিজেরই খাওয়া জোটে না। কুকুরকে কিভাবে খাওয়াবে?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মালতী আবার বললো,
- জানিস, আলো মেয়েটা ভীষণ ভালো। ও না সবাইকে খুব ভালোবাসে।
আমি এতক্ষণে ভালো করে দেখলাম মেয়েটাকে। সাত-আট বছর মাত্র বয়স। একটা ফ্রক পড়া- সেটারও আবার পিঠের দিকের বোতাম ছেঁড়া। ফর্সা রঙ অযত্নে তামাটে হয়ে গেছে। হাঁটু অবধি লাল ধূলো লেগে রয়েছে। কাঁধ পর্যন্ত উস্কোখুস্কো চুল। এখনো সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে কুকুরটাকে কোলে নিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে। আমি ওর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
- কুকুরটাকে খাওয়াবে?
আলো মাথা নীচু করে দুদিকে মাথা নাড়লো। আমার খুব কষ্ট হতে লাগলো। মনে হলো, ও যেন আমারই ছোট বোন। কাছেই একটা দোকান ছিল। সেখান থেকে বিস্কুট কিনে, ঠোঙাটা আলোর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে আমি বললাম,
- নাও। ওকে খাইয়ে দাও।
কুকুরটাকে বিস্কুট দিতেই সে তো লেজ নাড়তে নাড়তে নিমেষেই খেয়ে নিল সেগুলো। এতক্ষণে হাসি ফুটলো আলোর মুখে। আমাকে বললো,
- দিদি, তুমি না খুব ভালো।
আলোর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। অনেক কথাও হলো ওর সঙ্গে। ফেরার সময় আমি ওকে বললাম,
- আমি মালতী দিদির বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। তুই ওখানে আসিস, কেমন?
- দিদিমনির বাড়ি?
- হ্যাঁ।
- আসবো।
ঘাড় নেড়ে বললো ও। আমি বললাম,
- আলো, তুই পড়াশোনা করিস?
আলো মাথা নীচু করে চুপ করে রইল। দেখলাম ওর চোখ দুটো ছলছল করছে। বললো,
- না গো। আমরা যে খুব গরীব। তবে, স্কুলে যেতে, পড়াশোনা করতে আমার খুব ইচ্ছে করে।
খুব কষ্ট হলো ওর জন্য। একটু চুপ করে থেকে বললাম,
- আমি যে কয়েকদিন আছি, তুই আমার কাছে পড়বি?
- তুমি পড়াবে?
- হ্যাঁ। তুই আসবি তো?
এবার মেঘের মধ্যে আলোর রেখার মতো হাসি ফুটে উঠলো ওর মুখে। হালকা ভাবে মাথা নেড়ে ও বললো,
- হ্যাঁ, পড়বো।
**
এখন সাড়ে তিনটে বাজে। জানলা দিয়ে বাইরের মেঘলা আকাশ দেখছিলাম। বাইরে থেকে মৃদু ফুলের গন্ধ আসছে। হঠাৎ শুনলাম,
- দিদি!
তাকিয়ে দেখি, দরজায় আলো দাঁড়িয়ে আছে। সেই বোতাম ছেঁড়া ফ্রক, ধূলো মাখা পা। একগাল হেসে বললো,
- দিদি, পড়াবে না আমাকে?
- পড়াবো তো। আয় বোস।
ওকে 'অ' আর 'আ' লিখতে শেখালাম। সহজেই শিখে গেলো। জিজ্ঞেস করলাম,
- আলো, তোর কুকুর কেমন আছে?
- খুব ভালো।
- আচ্ছা, কাল আবার আসবি। আবার আমরা পড়বো।
দশ-বারো দিনের মধ্যেই আলো অ-আ, ক-খ লিখতে মোটামুটি শিখেছে। এর মধ্যে আমাদের বন্ধুত্ব আরো গভীর হয়েছে। আমি ওকে একটা শ্লেট উপহার দিয়েছি। ও সেটা পেয়ে ভীষণ খুশী। খুব অল্পতেই খুশী হয় মেয়েটা। তবু, সেই অল্পই জোটে না ওর। কয়েকদিন পর হঠাৎ করেই একদিন আলো পড়তে এলো না। মালতীকে ওর কথা জিজ্ঞেস করলাম। মালতী খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো যে, আলোর ভাইয়ের ডিসেন্ট্রি হয়েছে। মা না থাকলে আলো ওর ভাইয়ের দেখাশোনা করে। তাই এখানে আসতে পারছে না। সেদিন বিকেলবেলা আমি আর মালতী দুজনে মিলে আলোর বাড়িতে গেলাম। ভাঙাচোরা মাটির বাড়ি। খড়ের চালা। সামনে ছোট্ট একটা নিকোনো উঠোন। দেখলাম, একটা মাত্র ঘরে ভাইয়ের পাশে বসে আছে আলো। ওদের মা বাড়িতে নেই। আমাকে দেখে আলো অবাক হয়ে গেলো। বলে উঠলো,
- অনুভূতি দিদি, তুমি?
- হ্যা৺, আমিই তো। তোর মা কোথায়?
- কাজে বেরিয়েছে।
- ভাইকে ওষুধ দিয়েছিস?
- স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দিদিরা এসে ওষুধ দিয়ে গেছে।
- এখন ভাই কেমন আছে?
- ওই একই রকম।
বাচ্চাটাকে দেখে মনে হলো, যেন কতদিনের অসুখ। চোখে জল আসছিলো আমার। আলো যেন ছোট্ট মায়ের মতো আগলে রেখেছে ভাইটাকে। দেখলাম ওর কোলের ওপর আমার দেওয়া শ্লেটটা। আমি মনে মনে ভাবছিলাম, আচ্ছা, ওদের এতো কষ্ট কেন? কেন আলো ওর ছোটবেলাটা পেলো না? কেন?
**
বাইরে বেশ গরম। এই ক'দিন টো টো করে ঘুরে বেড়িয়ে একটু জ্বর জ্বর হয়েছে আমার। কলকাতা থেকে বাবা-মা ঘন ঘন ফোন করছে। সবাইকে বেশ চিন্তায় ফেলে দিয়েছি। একটু ভালো হলেই ফিরে যেতে হবে। এদিকে মালতীর মায়েরও শরীরটা হঠাৎ একটু খারাপ হয়েছে। মালতী তাই কাকিমাকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গেছে। আমি অগত্যা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের 'অদ্ভুতুড়ে' সিরিজ নিয়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছি। এমন সময় আলো এলো।
- দিদি, তোমার জ্বর হয়েছে?
- হয়েছিলো একটু। এখন ভালো আছি। তোর ভাই কেমন আছে, আলো?
- একটু ভালো। তুমি কাল ফাংশন দেখতে যেতে পারবে তো?
- কিসের ফাংশন রে?
- রবীন্দ্র জয়ন্তী। দিদিমনি আমাদের নিয়ে করছে, জানো না? আমি নাচ করবো তো!
- তুই নাচ করবি?
আমি উঠে বসলাম। জিজ্ঞেস করলাম,
- কে শেখালো তোকে নাচ?
- মালতী দিদি।
- বাঃ। দারুণ খবর। নিশ্চয়ই যাবো।
ঝিলের ধারে পড়ন্ত বিকেলের আলোয় কাকিমা মানে মালতীর মা রবীন্দ্র জয়ন্তীর আয়োজন করেছে। শঙ্খ বাজিয়ে, উদ্বোধনী সঙ্গীত গেয়ে শুরু হলো অনুষ্ঠান। আমি এতো সুন্দর রবীন্দ্র জয়ন্তী আগে কখনো দেখিনি। সকলের সঙ্গে আলোও নাচ করলো। সবারই খুব ভালো লাগলো ওর নাচ। যে কেউ বলবে যে, ওর মধ্যে নাচের প্রতিভা রয়েছে। আর সেই প্রতিভা কখনোই নষ্ট করা উচিত নয়। দর্শকদের মধ্যে এক কোণে বসেছিলো আলোর মা, ওর ভাইকে পাশে নিয়ে। নাচ শেষ হয়ে গেলে সবাই যখন হাততালি দিচ্ছিল, কে জানে তখন ওর মায়ের চোখ দুটো চিকচিক করে উঠেছিলো কি না!
**
আমি আর মালতী ঠিক করলাম, যে করেই হোক, আলো কে নাচ শেখাতেই হবে। কিন্তু অরু মাসির পক্ষে আলো কে নাচ শেখানোর খরচ চালানো একেবারেই অসম্ভব। তাই শেষ পর্যন্ত আমার মায়ের শরণাপন্ন হতে হলো আমাদের। অনেক খোঁজ খবর নিয়ে সরস্বতী নৃত্য একাডেমীর কথা জানা গেলো। এই একাডেমী সত্যিকারের প্রতিভার অন্বেষণ করে আর প্রয়োজনে গরীব ছাত্র-ছাত্রীদের স্কলারশিপ দেয়। সেখানে সুযোগ পেলে আলোর নাচ শেখার খরচ অরু মাসিকে আর দিতে হবে না। নিজের যোগ্যতা দিয়েই আলো গড়ে নিতে পারবে নিজের ভবিষ্যত। আলো কে সেখানে পাঠানোর জন্য এবার উদ্যোগ নিলো মালতীর মা। বহু কষ্টে কাকিমা রাজী করালেন আলোর মা'কে। কোনো টাকা খরচ করতে হবে না, বরং ভালো ফল করতে পারলে আলোই বৃত্তি পাবে সেখান থেকে- এটা বুঝতে পেরে শেষ পর্যন্ত আলো কে ছাড়তে রাজী হলো ওর মা। আর আলো? একটা রঙীন প্রজাপতির মতো খুশীতে মেতে উঠে নেচে বেড়াতে লাগলো সারাদিন ধরে।
সব প্রস্তুতি শেষ। আলোর একাডেমীতে যেতে আর মাত্র দু'দিন বাকি। আমারও ছুটি শেষ। আমিও বাড়ি ফিরব এবার। সকলে বারান্দায় আমি আর মালতী বসে আছি। পাখি ডাকছে চারিদিকে। রোদ এসে পড়েছে টবের গাছগুলোর ওপর। নানা কথা মাথায় আসছে। আর ক'দিন পরেই মা'কে দেখতে পাবো- তাই খুব আনন্দ হচ্ছে। আবার এখান থেকে চলে যেতে হবে- তার জন্য কষ্টও হচ্ছে। হঠাৎ বারান্দার গ্রীলের সামনে একটা ছায়া পড়লো। দেখলাম আলো এসে দাঁড়িয়েছে। মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে ওর। গালে চোখের জলের শুকনো দাগ। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
- কি হয়েছে রে, আলো?
- দিদি, আমি নাচ শিখতে যাবো না।
- কি বলছিস তুই? কেন বলছিস এরকম?
- দিদি, আমি যেতে পারব না। মায়ের খুব শরীর খারাপ।
- কি হয়েছে?
- কাজ করতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছিলো মা। কাজের বাড়ির দাদারা মা'কে ডাক্তার খানায় নিয়ে গেছে। অনেক দিন ধরেই মায়ের বুকে খুব ব্যথা হয়। মা আর কাজ করতে পারবে না। আমাকেই এখন কাজ করতে হবে। আমি কেমন করে চলে যাবো? আমার নাচ শেখা আর হবে না গো।
- তুই এতটুকু মেয়ে, কি কাজ করবি?
- জানি না, দিদি। কিন্তু কাজ করতে তো হবেই। মা আর ভাইয়ের দেখাশোনা এখন থেকে আমাকেই তো করতে হবে। আমাদের যে আর কেউ নেই, দিদি।
কথাগুলো বলে কাঁদতে কাঁদতে পেছন ফিরে দৌড়ে চলে গেলো আলো। মালতীদের বাগান, বড়ো রাস্তা- সব পেরিয়ে চলে গেলো। কোথায় চলে গেলো? অসুস্থ মা আর ছোট্ট ভাইটার কাছে? নাকি কোথাও কাজ খুঁজে নিতে? জানিনা। জানতে পারিনি আমি। শুধু মনে মনে ভেবেছি, শেষ পর্যন্ত হয়তো জীবনের অন্ধকারেই হারিয়ে গেলো আলো!
______________________________________________
রূপসা মন্ডল চক্রবর্তী
দ্বাদশ শ্রেণী
বয়স: সতেরো বছর
কল্যাণী পাবলিক স্কুল, বারাসাত।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন