Featured Post

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। ত্রয়োত্রিংশ সংখ্যা ।। জুন ২০২৪

ছবি
  প্রচ্ছদ-চিত্রঃ সুনীত নস্কর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। সম্পাদকীয় কেমন আছো ছোট্ট বন্ধুরা। গরমের ছুটি তো শেষ হয়ে এল। স্কুল খুলে যাচ্ছে। কিন্তু গরমের দাবদাহ কিন্তু এতটুকু কমেনি। এই গরমে  খুবই সাবধানে নিয়ম মেনে চলতে হবে তোমাদের। এখন তো আম, জাম কাঁঠালের সময়। এখন এইসব মৌসুমী ফল খেতে হবে। তাহলে শরীর সুস্থ থাকবে। শরীর সুস্থ থাকলে মন সুস্থ থাকবে। মন সুস্থ থাকলে পড়াশুনো ভালো হবে।           আশাকরি এতদিন বাড়িতে থেকেই মন দিয়ে পড়াশুনো করেছ। সঙ্গে অনলাইন কিশলয়ের পাতায় চোখও রেখেছ। পড়াশুনোর পাশাপাশি গল্প লেখা, ছবি আঁকা ইত্যাদির শখও মনের মধ্যে লালন পালন করতে হবে তোমাদের। পড়াশুনোর চাপে সব ছেড়ে দিলেও চলবে না কিন্তু। স্কুলের পড়া, বাড়ির পড়ার পাশাপাশি গল্প- কবিতা লেখা, প্রবন্ধ লেখা, ছবি আঁকা ইত্যাদি চালিয়ে যাও। তোমাদের প্রতিভার বিকাশ হোক। তোমাদের সৃজনীসত্ত্বার প্রকাশ হোক তোমাদের সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। আর সাথে সাথে তোমার সেই সৃষ্টি অনলাইন কিশলয়ে প্রকাশের জন্য পাঠিয়ে দাও। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাকি বন্ধুরাও জানুক তোমার সৃষ্টি সম্পর্কে। আর কী? সবাই সুস্থ থাকো, ভালো থাকো, আনন্দে থাকো।   শুভকামনাসহ-- প্রিয়ব্রত দত্ত ও কার্

গল্প ।। নিরঞ্জনের ডায়েরি ।। রণেশ রায়

[ছবি: ইন্টারনেট মাধ্যম থেকে সংগৃহীত]

নিরঞ্জনের ডায়েরি

রণেশ রায়


নিরঞ্জন বক্সী। একজন মুক্তমনা সাংবাদিক। উনি গ্রামে গঞ্জে ঘুরে বেড়িয়ে সেখানকার মানুষদের জীবন সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের চেষ্টা করেন। সেই অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে তাঁর সংবাদ পরিবেশন। সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিক বলে তাঁর পরিচয়। সাম্প্রতিককালে দিনকতক সুন্দরবনে থেকে বাড়ি ফেরার পর হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি হাসপাতালে মারা যান। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায় উনার করোনা পজিটিভ। উল্লেখযোগ্য যে সুন্দরবন থেকে ফিরে এলে উনাকে খুব বিমর্ষ থাকতে দেখা যায়। এত হাসিখুশি একটা মানুষ কেমন যেন গুম মেরে থাকতেন যা আমাদের সবাইকে পীড়িত করত। হাসপাতাল সূত্রে আরো জানা যায় উনি হয়তো কোন কারণে আতংক গ্রস্থ ছিলেন যার জন্য হৃদরোগের আক্রমণ। নিরঞ্জনববু তাঁর ডায়েরিতে তাঁর সাম্প্রতিক সুন্দরবনের একটা পরিবারের যে ইতিকথা তুলে ধরেন তা আমরা পরিবেশন করছি। এটা সাংবাদিকের এক অপ্রকাশিত গ্রন্থনা।


সুন্দরবনের একটা গ্রাম যার পরিচয় নেই বাইরের জগতে। বঙ্গোপসাগর থেকে নেমে আসা জলাশয়ের মধ্যে একটা ছোট্ট দ্বীপ। গরান ( Mangrove) আর সুন্দরী গাছে ঢাকা । পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সরু শাখা নদী যাকে খারি বলে। গ্রামটার নাম বিধবা পাড়া।বাজারের খবর ওখানে নিয়মিত বাঘের পেটে যায় মধুসংগ্রহ করতে আসা পরিবারের পুরুষ সদস্যরা আর তার ফলে তাদের স্ত্রীরা বিধবা হয়। তাই গ্রামটা বিধবা গ্রাম বলে পরিচিত। কিন্তু অনুসন্ধানে জানা যায় গাঁয়ের মানুষদের নদীতে কুমির আর ডাঙায় বাঘের সঙ্গে সহবাস। মধ্যে মধ্যে বাঘ বা কুমিরের উৎপাত যে নেই তা নয়। কখনও বাঘের আক্রমণ যথেষ্ট বিপদের সৃষ্টি করে। কিন্তু রোজই গ্রামের মহিলারা বিধবা হয় আর পুরুষরা হারিয়ে যায় ব্যাপারটা তা নয়।  তবে রুটি রুজির অভাবে খিদের উৎপাত বা রোগের উৎপাত ওদের জীবনে আরও বড় অভিঘাত। রোজের ব্যাপার। এছাড়া আছে ঝর তুফান বন্যা। আয়লা বা আমফান। এই গ্রামেই থাকে মন্টু সর্দার তাঁর পরিবার নিয়ে। দু কামরার কাঁচা বাড়ি। পেছনে সামান্য খালি জমি।তাদের  দুই ছেলে এক মেয়ে। মন্টু বাবু একজন সারেঙ্গী অর্থাৎ লঞ্চ চালক। বড় ছেলে ভিন প্রদেশে দিন মজুর যাকে পরিযায়ী শ্রমিক বলে। ছোট ছেলে আর মেয়ে ওপারে খারি পেরিয়ে একটা সমৃদ্ধ গ্রামের স্কুলে পড়ে। ছেলে মেয়ে দুজনেই লেখাপড়ায় ভালো। চোখে ভবিষ্যতের স্বপ্ন। ভালো ফল করে নিজেদের উপযুক্ত করে তুলবে। সংসারের অভাব দূর হবে। ছোট ছেলের সামনের বছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। মেয়েও পড়াশুনায় যত্নশীল। তার সঙ্গে গান চর্চা। আঞ্চলিক ভাষায় তার গান শুনে শহরের মানুষ মুগ্ধ। ও গ্রামের বাচ্চাদের পড়ানোর দায়িত্বে। ওই অঞ্চলে বহুদিনের একটা চলতি রীতি অনুযায়ী  উঁচু ক্লাসের দাদা দিদিরা  ছোটদের যারা পড়াশুনায় আগ্রহী তাদের পড়াবার দায়িত্ব নেয়। পয়সা খরচ করে গরিব মানুষকে দূরে কোচিং এ যেতে হয় না লেখাপড়ার প্রাথমিক পর্যায়ে। এতে নিরক্ষতা দূর হয়। আনুষ্ঠানিক ভাবে খুব শিক্ষিত না হলেও গ্রামের ছেলেমেয়েদের অক্ষর জ্ঞান হয় কিছু প্রাথমিক শিক্ষা সহ। ফলে ওই গ্রামে নিরক্ষরতার হার প্রায় শূন্য। বাড়ির কর্তা মন্টুবাবু লঞ্চ চালক বলে তাঁর বিভিন্ন পরবাসী মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে। জীবনে অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতার ব্যাপ্তি। আর প্রকৃতির গতি প্রকৃতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান। মেঘ দেখে বলে দিতে পারেন কোন মেঘে কখন বৃষ্টি হবে। বাতাসের গতি তাঁর কাছে আগাম বার্তা, ঝড়ের পূর্বাভাস।পরিবারটি খুবই নিরীহ। তাদের আঁচার আচরণ গ্রামের প্রতিটি মানুষকে আকৃষ্ট করে। পরিবারের প্রতিটি সদস্য গ্রামের মানুষের ভালো মন্দের সঙ্গে জড়িত।


ওদের দুজনের রোজগারে সংসার চলে যায় অভাবের মধ্যেই। অভাব তীব্রতা ধারণ করে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে বা অসুখ বিসুখে। তবে এবার আমফানের আক্রমণ আর তার সাথে করোনার আক্রমণে অভাবের তীব্রতা বেড়েছে সেটা বললে কম বলা হয়। জীবন জীবিকা একেবারেই বিপর্যস্ত। গ্রামে এখনও করোনা হানা না দিলেও ভারতে বিভিন্ন শহর ও আধা শহরে করনার  আক্রমণে জীবন জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে গেছে। বড় ছেলে ভিন প্রদেশে এক ঠিকাদারের অধীনে একটা গৃহ নির্মাণ কোম্পানিতে দিন মজুরের কাজ করত।দেশ জুড়ে লক ডাউনের জন্য বড় ছেলেকে কাজ খুইয়ে  সাত আটশো কি: মি: হেঁটে বাড়ি ফিরতে হয়েছে। জনজীবন স্তব্ধ হয়ে যাওয়ায় জলপথে লঞ্চের চলাচল প্রায় বন্ধ। শহর থেকে মানুষ সুন্দরবন বেড়াতে আর তেমন আসে না। তাই জলবিহারে বেড়াবার জন্য লঞ্চের চাহিদা তেমন নেই। মন্টুবাবুও ঘরে বসা। রোজগার বন্ধ। স্কুল কলেজ বন্ধ বলে ছেলেমেয়ের পড়াশুনা লাটে উঠেছে। আমফানের আক্রমণে ঘর দুয়ার বিধ্বস্ত। এরই মধ্যে সকলে মিলে অবস্থা কিছুটা  সামাল দিয়েছে। কিছুটা সরকারি কিছুটা স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনের সাহায্যে কোনমতে আধপেটা খেয়ে বেঁচে আছে। তাও নিজেদের ঘরে সামান্য জমিতে কিছু শাক সবজি হয় বলে বাঁচোয়া।


পরের সাহায্যে আর কতদিন চলে! আর করোনার ভয় কবে যাবে কবে কাজ কর্ম স্বাভাবিক হবে ঠিক নেই। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। বাড়ির সবার একই চিন্তা, কি করা যায়! এখন ছোট ছেলেও বুঝেছে করোনা আর জীবিকার অভাবের দ্বৈত আক্রমণের মুখে টিকে থাকা দায়। শুধু পেটের ক্ষিধেটা নিয়ে সমস্যা নয়, লেখা পড়া করে নিজেকে দাঁড় করানোটা একটা অলীক স্বপ্ন হয়ে দাঁড়ায়। এখনই কোন না কোন ভাবে কিছু একটা রোজগারের ব্যবস্থা করতে হয়। সে বেরোয় শহরে কাজের সন্ধানে। কিন্তু সবই তো শ্মশান। জনহীন রাস্তা। নীরব স্তব্ধতা সর্বত্র। একদিন ছোট ছেলে বুলু বাবাকে জানায় ও কলকাতায় গিয়ে বাড়ি বাড়ি সবজি বিক্রির ব্যবস্থা করবে। সেখানে মানুষজন বাইরে বেরোয় না। ঘরের সামনে যোগান দিতে পারলে বিক্রির সম্ভাবনা আছে। বাবা মায়ের অনুমতি নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে।


ছোট ছেলে এখন কলকাতায় একটা থাকার ব্যবস্থা করেছে বলে জানায়। মাঝে মাঝে আসে। বাড়িতে ওকে নিয়ে চিন্তা। কি জানি ওর এত ইচ্ছের পড়াশুনার ইতি ঘটলো কি না। আর শহরে ওকে দেখার কেউ নেই। কি খায় কেমন থাকে এই নিয়ে বুলুর মায়ের খুব চিন্তা। ও বাড়ির খুব আদরের ছেলে। পড়াশুনায় ভালো। চোখে কত স্বপ্ন। সবই আজ স্বপ্ন। পেটের ক্ষিধে সব গ্রাস করেছে। আর ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। শুধু সংসার টেনে নিয়ে যাওয়ার দায়। সব আশা আকাঙ্খা জলাঞ্জলি দিয়ে এই বয়সে স্বেচ্ছায় দায়টা কাঁধে তুলে নিয়েছে। দাদা নিলুর মধ্যে এক অপরাধ বোধ। ভাই দায়িত্ব নিয়েছে নিজের সব উৎসর্গ করে আর সে কিছুই করতে পারছে না। আর আজ কাজের হাহাকার। কাজ পাবে কোথায়! ভাইয়ের সঙ্গে গিয়ে তাকে সাহায্য করবে সেটাও ভাইয়ের আপত্তিতে সম্ভব হচ্ছে না। ভাইকে বললে বলে ওখানে থাকা খাওয়ার খুব খরচ। দুজনের জন্য সেই খরচ বহন করতে গেলে লাভের গুড় পিঁপড়ে খাবে। তাই সেটা সম্ভব নয়।


বুলু নিয়মিত টাকা পাঠায়। নিজে মধ্যে মধ্যে দিয়ে যায় নয়তো কাউকে দিয়ে পাঠায়। আসে পাশে গ্রাম থেকে অনেকেই কলকাতায় যায়, ওখানে থাকে। তাই টাকা পাঠাতে অসুবিধে হয় না। বুলু মধ্যে মধ্যে যে আসে তাতে দেখা যায় ও এখন অনেক চালাক চতুর। কথাবার্তায় অনেক চৌখস। তবে বাড়িতে না থাকলেও বাড়ির প্রতি টানে এতটুকুও খামতি নেই। যখন আসে তখন বোনের জন্য বাবা মা দাদার জন্য কিছু নিয়ে আসে। বাবাকে একটা মোবাইল কিনে দিয়েছে। মোবাইলে যোগাযোগ হয়। প্রথম প্রথম যা টাকা পাঠাত এখন তার থেকে বেশি পাঠায়। কখনও কখনও বেশ মোটা টাকা। ওর নাকি ব্যবসা বেড়েছে। টাকা বেশ কিছুটা জমে। বাড়ির অভাব মিটেছে। কিন্তু এখন তো সবাই ঘরে থাকে। খাওয়া দাওয়া ছাড়া খরচ নেই। সব বন্ধ বলে খরচের সুযোগ নেই।


সুন্দরবনে গাঁয়ের বাড়িতে করোনার প্রত্যক্ষ তান্ডব নেই তবে পরোক্ষ তান্ডব ভয়ঙ্কর কারণ রুটি রুজির সুযোগ বন্ধ। তবে বুলুর অবদানের দরুন মন্টুবাবুর পরিবারের ওপর এই পরোক্ষ তান্ডবের প্রভাব তেমন পরে নি। প্রথম পর্যায়ের করোনা তান্ডব কিছুটা কমেছে।  মন্টুবাবু ছোটছেলের পাঠানো টাকায় ঘর মেরামতির কাজটা সেরেছেন। অবস্থা আরেকটু ভালো হলে আবার তাঁর কাজের সুযোগ বাড়বে কারণ লঞ্চ ভাসাবার সুযোগ খুলবে। রিসোর্ট হোটেল খুলবে। আবার ভ্রমনযাত্রী সুন্দরবনে আসা সুরু করবে। তাঁরা এখন আসতে পারছে না এখানে করোনার জন্য নয় শহরে আধা শহরে মানুষজন গৃহবন্দী তাই। করোনা কমলে শহরের ঘরের দরজাও খুলে যাবে। আর তা যদি হয় মন্টুবাবু জীবিকা ফিরে পাবে, বড় ছেলে আবার কাজে যাবে। ছোট ছেলেকে ঘরে ফিরিয়ে নেবে। ওকে ওর পড়াশুনায় আবার মন দিতে বলবে। ওটাই যে ওর স্বপ্ন। মন্টুবাবু আশায় বুক বাঁধে।


এভাবে মাস কয়েক চলতে থাকে। মন্টুবাবু আর্থিক দিক থেকে সুখের মুখ দেখেন। কিন্তু হঠাৎ আবার সিঁদুরে মেঘ। করোনার নতুন ঢেউ ভারতে আছড়ে পড়ছে। সে তার তীব্রতা যেমন বাড়িয়েছে তেমনি গতিপথ বদলেছে। পশ্চিম থেকে পূবের দিকে ধাবমান। সে তার স্বরূপ বদলেছে। নতুন স্বরূপে সে ভারতীয় রূপ ধারণ করেছে। গোমূত্র থেকে বাজনা বাজানো সবরকম টোটকা অস্বীকার করে গ্রামে গঞ্জে যেমন ঢুকছে তেমনি বাচ্চা বুড়ো সবাইকে পাকড়াও করছে। এ এক সার্বজনীন চরিত্র ধারণ করেছে। আর টিকাকরণ একমাত্র বাঁচার বিধান বলে মনে করা হচ্ছে। ভারতে করোনা এক মহামারীর আকার নিয়েছে।রুটি রুজির অভাবের ঢেউ পাহাড় চূড়া ছুয়েছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। কাজকর্ম সব খোলার মুখে আবার বন্ধ হতে বসেছে। করোনার ঢেউয়ের সঙ্গে আতঙ্কের এক নতুন ঢেউ। দূরত্ব বজায় রেখে ঘরে বন্দী থাকার নিদান। সারাক্ষণ মুখে মুখোশ।সামাজিক দূরত্ব নতুন মাত্রা পেতে চলেছে। এর ফলে এক অস্পৃশ্যতার মহামারী। অক্সিজেনের আকাল ওষুধের কালোবাজারি হাসপাতালে বেডের অভাব। পথে ঘাটে শব পড়ে থাকছে গঙ্গায় ভাসছে। মন্টুবাবুর স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। আবার নদীতে ভাষার আকাঙ্খার বিসর্জন।ছেলেকে স্কুলে পাঠাবার ব্যর্থ ইচ্ছে।


দ্বিতীয় ঢেউয়ের সঙ্গে আমফান থেকেও বিপজ্জনক তুফান যা আবার সুন্দরবনে ঝাঁপিয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। মন্টুবাবুরা সন্ত্রস্ত। কি হয়। তবে বুলু মন্টু বাবুকে নিশ্চয়তা দিয়ে যাচ্ছে টাকা পাঠিয়ে যাচ্ছে যদিও নিজের আর তেমন আসা হয় না। ছেলে বিশেষ আসতে পারে না বলে পরিবারের সবাই বিমর্ষ। তবে মোবাইলে ওর খবর পাওয়া যায়। আর এখন তো আসাই সম্ভব নয়। কিছুদিন হয়তো আর বেশিদিন টাকা পাঠাতে পারবে না যোগাযোগের অভাবে। তবে ও যা টাকা পাঠিয়েছে তার থেকে কিছুটা জমানো গেছে। এখন তাদের যা অবস্থা বুলুর কল্যানে তাতে প্রয়োজনে ঋণ পেতে অসুবিধে হবে না।  তবে কলকাতায় যে ভয়ঙ্কর করোনা মহামারী তাতে বুলুর কিছু না হয়। ভেবে মন্টুবাবু আতঙ্কিত।


এই অনিশ্চয়তার মধ্যে গ্রামের সবার কাটতে থাকে। এতদিন গ্রামে করোনার ঢেউ পৌঁছয় নি। এখন খবর আসছে মূল অববাহিকার আসে পাশে গড়ে ওঠা আধা শহর আধা গ্রামে করোনা ছড়িয়েছে। তবে কয়েকদিনের মধ্যে বেশিরভাগ সবাই ভালো হয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও টিকাকরণ শুরু হয়েছে। মন্টুবাবুদের গ্রামে আতংক না  ছড়ালেও সকলে মাস্ক পড়া হাত ধোয়ার মত বিধিনিষেধ মেনে চলছে। সবার সহযোগিতায় এটা সম্ভব হচ্ছে। সবাই অনুভব করছে এই সংকটকালে সবাইকে একজোট থাকতে হয়। গ্রামের লোকেরা একজোট হয়ে একটা বাড়ি আলাদা করে রেখেছে যাতে করোনা হলে তাকে আলাদা করে রাখা যায়। প্রাথমিক চিকিৎসা হয়। আর করোনায় ওষুধের থেকে সাবধান হয়ে পরস্পর দূরত্ব বজায় রেখে চলাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ যাতে রোগ না ছড়ায়। অর্থাৎ পরস্পর মানসিক নৈকট্য রেখে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা। একে কোনভাবে সামাজিক দূরত্ব বলা চলে না।


জানা যাচ্ছে শহরে সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলোতে ডাকাতি বেড়েছে। কয়েকটা রিসোর্টে ডাকাতি হয়েছে। অর্থনীতির এই মন্দাকালে টাকা পয়সা তেমন না পেলেও জিনিসপত্র লুঠ হচ্ছে। চুরি চামারি বেড়েছে। আরও শোনা যাচ্ছে করোনার আতঙ্কে আত্মহত্যা বাড়ছে। কলকাতার মত শহরেও পরিবার শুদ্ধ আত্মহত্যা করছে। আর না খেতে পেয়ে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু তো আছেই। এই সংকটকালে বুলুর কয়েকদিন ধরে ফোন না পাওয়ায় মন্টুবাবু চিন্তাগ্রস্ত। কি জানি করোনা হলো কি না! ও তো এ ধরণের নয়। নিয়মিত বাড়ির খবর নেয় মোবাইলে। টাকা পাঠাতে পারছে না দুমাস ধরে সেটা এই অবস্থায় স্বাভাবিক। কিন্তু ফোনে খবর নেওয়া বন্ধ করল কেন। আরও চিন্তা ওকে ফোন করলে ওর ফোন সুইচ অফ থাকে। তবে কি হলো? মন্টুবাবু ভেবে পান না। স্ত্রী চিন্তা করবে ভেবে উনি স্ত্রীকে জানান ও ফোন করেছিল। কিন্তু এ ভাবে যে আর চলে না।


মন্টুবাবুর বাড়িতে যেন অনিশ্চিয়তার আঁধার নেমে আসে। বুলুর পাঠানো টাকায় টান পড়েছে। অভাবের কালো মেঘ ঘনীভূত। এভাবে চললে পেটে টান পড়বে। বাইরের সাহায্যের হাত ছোট হয়ে আসছে। তার ওপর বুলুর খবর নেই। এখন পরিবারের সবাই বুলু যে যোগাযোগ রাখে না ফোন করে না সেটা জেনে গেছে। বুলুর মা ওর চিন্তায় পাগল। দাদা বোন সবাই বিমর্ষ। মন্টুবাবু কি করবেন ভেবে পান না। পুলিশে খবর দেবেন কি না ভাবছেন। আর এই সংকটের সময় যেখানে সব যোগাযোগ বন্ধ সেখানে পুলিশিই বা কি করবে। আর বুলু  কোথায় থাকে সেটা তো কেউ জানে না। ওরা কি সূত্র পুলিশকে দেবে যা ধরে পুলিশ এগোবে। মন্টুবাবুর মাথায় দুশ্চিন্তা। করণীয় কি ভেবে পান না। এর মধ্যে খবর আসে গ্রামে পুলিশ এসেছে। গ্রামে পুলিশ কেন? এখানে তো কোন গোলমাল নেই। না আছে চুরি বাটপারি না মারামারি। ভাবতে ভাবতে মন্টু বাবু বেরিয়ে আসেন। আবার কার কি বিপদ হল। উনি জানেন আজকাল কোন ঘরে করোনা হলে পুলিশ খোঁজ নিতে আসে। তবে তেমন খবর থাকলে মন্টু বাবুতো জানতে পারতেন। ঘর থেকে বেরিয়ে একটু এগোতে উনি দেখেন গাঁয়ের দু চারজনকে নিয়ে পুলিশ এদিকে আসছে। মুখোমুখি হতে পুলিশ জিজ্ঞাসা করে: আপনিই কি মন্টু বাবু?

হ্যাঁ মন্টুবাবুর ছোট্ট উত্তর। মুখে ভয় আর বিস্ময়।

কি হলো! জীবনে তাকে পুলিশের মুখোমুখি হতে হয় নি। পুলিশ বলে : চলুন আপনার ঘরে যাব।

সবাই ঘরে আসে। পুলিশ জানতে চায় বুলু কোথায়। মন্টুবাবু জানায় ও কলকাতায় থাকে।সবজি বিক্রি করে। আজকে এই পরিস্থিতিতে বাড়ি আসতে পারছে না। উনারাও চিন্তিত। পুলিশে খবর দেবে ভাবছিল। তবে ও কোথায় থাকে জানা নেই বলে পুলিশের কাছে যে যেতে উনি সংকোচ করছেন। ইতিমধ্যে পুলিশ নিজেইএসেছে। মন্টুবাবু জানতে চান ওকে পুলিশ খুঁজছে কেন? পুলিশ জানায় ওদের কাছে খবর বিলু সবজির ব্যবসায় যুক্ত নয়। কলকাতাতেও থাকে না। সুন্দরবনেই কোথাও ডাকাত দলে নাম লিখিয়েছে।


এর পর পুলিশ বাড়ির সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তন্ন তন্ন করে বাড়ি সার্চ করে যদি কোন সূত্র পাওয়া যায় । পায় না। পুলিশও বুলু বাড়ি এলে যাতে পুলিশকে খবর দেওয়া হয় সে ব্যাপারে সাবধান বাণী রেখে ফিরে যায়। পুলিশ চলে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে বুলু ফোন করে। মন্টুবাবু জানায় বাড়িতে পুলিশ এসেছিল ওর খোঁজ করতে। ও যেন বাড়ি আসে পুলিশের সঙ্গে দেখা করে। বুলু যেন এর জন্য প্রস্তুত ছিল। ঠান্ডা মাথায় জানায় সেটা সম্ভব নয়। সব বুঝে শুনে মন্টুবাবু বোঝে পুলিশের অনুমান ঠিক। কিন্তু তাঁর কিছু করার নেই। এইজন্যই বুলু সংসারে এত টাকা দিতে পারত! আর তাদের ডাকাতির টাকায় সংসার চলতো। সে মরমে মরে। আবার ভাবে বুলুর এই সাহায্য ছাড়া ওদের না খেয়ে মরতে হত। নিজের জীবনের আশা আকাঙ্খা ছেড়ে পরিবারের মুখে খাবার তুলে দেবার জন্য ও এই অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। ওখান থেকে ফেরার উপায় নেই। সব জেনে বুলুর মা প্রায় উন্মাদ হয়ে যায়। একদিকে এক অপরাধবোধ আরেকদিকে পেটের টান, এক ভয়ংকর অনিশ্চয়তা। এখন মন্টুবাবু কি করবেন?


নিরঞ্জনবাবুর ডায়েরিতে এই সংবাদের সঙ্গে নিজের একটা ছোট্ট মন্তব্য;


একটা সম্ভাবনাময় ছেলের জীবনে কি ভয়ংকর বৈপরীত্য। কিন্তু কেন? গরিবমানুষের অভাব কাজের নিরাপত্তাহীনতা তার সঙ্গে প্রকৃতির রোষ। আজকের উন্নত প্রযুক্তির যুগে সভ্যতার বর্বরতা। তার নগ্ন রূপ। এই মন্তব্যের সঙ্গে বুলুর লেখা একটা ছোট্ট কবিতা যা তার সম্ভাবনার স্বাক্ষর। অঙ্কুরেই যা ধ্বংস হয়ে যায়:



শীত শেষে 


করোনার আক্রমণের মুখে 

শীত শেষে বনানী ধূসর 

জঠরের ক্ষুধা কেঁদে মরে

পাতা ঝরে পড়ে,

বিদীর্ণ এ সভ্যতা 

তবু এ মৃত্যুপুরীতে আশা জেগে থাকে 

ভবিষ্যত দ্রষ্টার বার্তা শোনা যায় 

শীত আসলে বসন্ত জাগ্রত দ্বারে

তার আর আসতে বিলম্ব কোথায় !

____________________________________________



 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

রণেশ রায় 


 

মন্তব্যসমূহ

সপ্তাহের পছন্দ

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। ত্রয়োত্রিংশ সংখ্যা ।। জুন ২০২৪

ছোটোদের আঁকা ।। মনামি মন্ডল, রায়সী চক্রবর্তী ও নিশান্তিকা নস্কর।

ছড়া ।। একটা খুশি ।। তীর্থঙ্কর সুমিত

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 32nd issue: May 2024

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় - ১২ ।। সেপ্টেম্বর ২০২২

ধারাবাহিক উপন্যাস ।। তিতলির বিশ্বভ্রমণ ।। ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়

ছড়া ।। ও জোনাকি ।। কান্তিলাল দাস

দুটি ছড়া ।। গোবিন্দ মোদক

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। আত্মপ্রকাশ সংখ্যা ।। অক্টোবর ২০২১

মাসের পছন্দ

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। ত্রয়োত্রিংশ সংখ্যা ।। জুন ২০২৪

কবিতা || মর্যাদা || অবশেষ দাস

ছোটোদের আঁকা ।। মনামি মন্ডল, রায়সী চক্রবর্তী ও নিশান্তিকা নস্কর।

নিবন্ধ ।। কোনারক মন্দিরের ভয়াবহতা ।। সুজয় সাহা

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 32nd issue: May 2024

ছোটর কলম ।। বইপড়া ।। উন্নীত কর্মকার

গল্প ।। রবীন্দ্রজয়ন্তী ।। কুহেলী ব্যানার্জী

ছড়া ।। একটা খুশি ।। তীর্থঙ্কর সুমিত

অণুগল্প ।। পুরস্কার ।। চন্দন দাশগুপ্ত

বছরের পছন্দ

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। ত্রয়োত্রিংশ সংখ্যা ।। জুন ২০২৪

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচীপত্র ।। 29th Issue: February

প্রচ্ছদ ও সূচীপত্র ।। 24th issue: September 2023

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 31st issue: April 2024

প্রচ্ছদ ও সূচীপত্র ।। 25th issue: October 2023

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 32nd issue: May 2024

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 30th issue : March 2024

প্রচ্ছদ ও সূচীপত্র ।। 23rd issue: August 2023

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচীপত্র ।। 26th issue: November 2023

অতি প্রিয়

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। আত্মপ্রকাশ সংখ্যা ।। অক্টোবর ২০২১

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। দ্বিতীয় সংখ্যা ।। নভেম্বর ২০২১

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 4th issue: January 2022,

নিবন্ধ ।। শিশু-কিশোর সাহিত্যবলয়ে শিশুরাই যেন ব্রাত‍্য না থাকে ।। অরবিন্দ পুরকাইত

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 7th issue: April 2022

নিবন্ধ ।। দেশীয় উদ্ভিদ কেন গুরুত্বপূর্ণ ? ।। ডঃ চিত্তরঞ্জন দাস

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় - ১০ ।। জুলাই ২০২২

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় - ১১ ।। আগস্ট ২০২২

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র : 8th issue: May 2022

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় - ১২ ।। সেপ্টেম্বর ২০২২