Featured Post
গল্প ।। গুড়ের লোভে ।। অর্পিতা ঘোষ পালিত
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
গুড়ের লোভে
অর্পিতা ঘোষ পালিত
টাপুস আর টুপুস দুই ভাইবোন, টাপুস ক্লাস ফাইভ আর টুপুস ক্লাস থ্রী-তে পড়ে। স্কুলে এক সপ্তাহের জন্য ক্রিসমাসের ছুটি। ওদের বাড়ির কাছেই গির্জার পাসের মাঠে বড়দিনের মেলা বসে। বড়দিনের মেলা দেখতে ওদের পিসি ছেলে ডাবলুকে নিয়ে ওদের বাড়ি বেড়াতে এসেছে। ডাবলু টাপুসের বয়সী, ওরও স্কুল ছুটি। বড়দিনের মেলা দেখার অজুহাতে আপনজনের সাথে দেখাও হয়।
পিসি এসে বললো - একদিনের বেশি থাকতে পারবে না, বাড়িতে কাজ আছে । এবার বড়দিনের মেলা দেখতে আসা হতোনা, ডাবলু মামার বাড়ি আসার জন্য বায়না করছিল তাই আসা। তাছাড়া সবাইকে দেখার জন্য মন ছটফট করছিল, তাই চলে এলাম।
ডাবলু এসেছে দেখে টাপুস টুপুসের খুব আনন্দ হয়েছিল, ভেবেছিল তিনজনে মিলে বড়দিনের ছুটিতে খুব মজা করবে। পিসির কথা শুনে দু-ভাইবোনের মনখারাপ হয়ে গেল।
কতদিন পর ডাবলুর সাথে দেখা হলো, কদিন একটু আনন্দ করে তিনজনে খেলা করবো, থাকোনা পিসি … টাপুস টুপুস পিসির কাছে বায়না করতে লাগলো।
ওদের মনখারাপ দেখে পিসি টাপুস টুপুসের মাকে বললো– বৌদি তুমি আমাদের গ্রামে অনেকদিন যাওনি, টাপুস, টুপুসতো সেই ছোট্ট-বেলা গিয়েছে। ওদের এখন স্কুল ছুটি, ওদের নিয়ে কদিন আমার বাড়ি থেকে ঘুরে আসবে চলো। ডাবলুটাও খুব আনন্দ পাবে। রোজ সকালে খেজুরের টাটকা রস খাবে, আর খেজুরের গুড়তো আছেই।
একথা শুনে টাপুস, টুপুস মায়ের কাছে পিসির বাড়ি বেড়াতে যাবার জন্য বায়না করতে লাগলো।
সব শুনে বাবা বললো– তাহলে কদিনের জন্য ছেলেমেয়ে দুটোকে নিয়ে একটু ঘুরে এসো। গ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশ, নদী আর মন্দির দেখে ওদের খুব ভালো লাগবে।
টাপুস, টুপুস আর ডাবলুর খুব আনন্দ। পরদিন শিবনিবাসের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। পৌঁছতে পৌঁছতেই বিকেল হয়ে গেল। সন্ধ্যে হতেই জাঁকিয়ে ঠান্ডা।
ওরে বাবারে কি শীত রে, শীত লাগেনা তোদের ? …টাপুস জিজ্ঞাসা করলো ডাবলুকে।
– আমাদের এখানে এরকমই ঠান্ডা, অভ্যাস হয়ে গ্যাছে।
চারিদিক নিঃঝুম, তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লো সবাই। টাপুস, টুপুস আর ডাবলু তিনজন একটা ঘরে বড় খাটে শুয়েছে। নাইট লাম্প জ্বেলে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে গেল পিসি। তিনজন শুয়ে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে গেল।
সকাল হতে না হতেই পিসির ডাক– খেজুরের রস চলে এসেছে, উঠে পড়।
পিসির ডাক শুনে তড়াক করে উঠে পড়লো ডাবলু– এই তোরা কি শুয়ে থাকবি? পরে কিন্তু রস খেতে ভালো লাগবেনা।
টাপুস– ছুটির দিনে প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে এতো সকাল সকাল উঠবো?
– তাহলে খেজুরের রস খেতে হবেনা, শুয়ে থাক… এই বলে ডাবলু চলে গেল।
টুপুস– এই দাদা, আমাদের জন্য খেজুরের রস না রেখে যদি সব রস সবাই খেয়ে নেয়। কেমন খেতে কি-জানি, আমি তো কোনোদিন খায়নি। আমি খেতে যাচ্ছি, তুই তাহলে শুয়ে থাক।
টাপুস– চল্ আমিও যাচ্ছি, আমাদের শহরে তো এরকম টাটকা খেজুরের রস পাওয়া যাবে না। এসেছি যখন খেয়েই দেখি…
সারাদিন হৈ- হুল্লোড় করে কিভাবে যেন দিন শেষ হয়ে গেল। বিকেলে পিসি খেজুরের গুড় দিয়ে পিঠেপুলি বানাচ্ছিল, টাপুস, টুপুসের মা পিসিকে সাহায্য করছিল। রাতে নানারকম পিঠে খেয়েই ওদের পেট ভরে গেল।
রাতে বিছানায় শুয়ে তিনজন গল্প করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। কত রাত হবে জানেনা, টুপুসের ঘুম ভেঙে গেল। ধাক্কা দিয়ে ফিসফিস করে টাপুসকে ডাকলো।
ঘুমের ঘোরে টাপুস বললো– কি হলো ডাকছিস কেন? অনেক রাত এখন, ঘুমিয়ে পড়।
– এই দাদা ,শুনতে পাচ্ছিস?
–কি?
–চুপ করে শোন
–ওরে বাবারে, ডাকাত এসেছে মনে হচ্ছে
– আমারও তাই মনে হচ্ছে, ডাবলুদাকে ডাক
– এই ডাবলু, ডাবলু---
ডাবলু– অ্যা-আ সকাল হয়ে গ্যাছে, খেজুরের রস এসে গ্যাছে ?
টাপুস– এখনো সকাল হয়নি, চুপ করে শোন…
ডাবলু– কে যেন বাইরে ঠকঠক শব্দ করছে, একবার ঘরের পাশে, আবার দূরে সরে যাচ্ছে, ভূত-টুত নাতো?
টাপুস– ভূত, ভূত বলে কিছু আছে নাকি?
ডাবলু– আমাদের এদিকে অনেক ভূত আছে, কতজন দেখেছে।
টাপুস– তাই নাকি? পাশের ঘরে পিসেমশাইকে ডাকি, চল্
ডাবলু– জয় বাবা রক্ষা করো, আমি যাবনা তুই যা, জয় বাবা--- জয় বাবা ভোলানাথ…
টাপুস– আমি একা যাব, তুইও আমার সাথে চল্ না
ডাবলু– এই টুপুস, তুই টাপুসের সাথে যা
টুপুস– ওরে বাবারে, আমি যাবনা। যদি ভূত চেপে ধরে। দাদা তোর তো খুব সাহস, তুই একাই গিয়ে পিসেমশাইকে ডাক…
গাবলু- বাইরে থেকে তো কেউ ভেতরে ঢুকতে পারবে না, যা করছে উঠোনে। তুই একাই বাবার ঘরে যা
টুপুস পা টিপে টিপে পিসেমশাইয়ের ঘরের সামনে গেল, দরজা ভেজানোই ছিল ঘরে ঢুকে ভয়ে ফিসফিস করে ডাকলো। ওর ডাক শুনতে পেলো না পিসেমশাই। টাপুস তখন মা আর পিসি যে ঘরে শুয়ে ছিল সে ঘরে ভেজানো দরজা দিয়ে ঢুকে পিসিকে ধাক্কা দিয়ে ডাকলো।
পিসি– অ্যা…কে রে , ও টাপুস তুই, এতো রাতে অন্ধকারে কি করছিস বাবা? বাথরুমে যাবি… লাইট জ্বেলে যা …
টাপুস– পিসি বাড়িতে ভূত কিংবা ডাকাত এসেছে, আস্তে কথা বলো।
– অ্যা ভূত, কোথায়?
– চুপ করে শোনো
টাপুসের পিসি চুপ করে থাকার পর ঠকঠক শব্দ শুনতে পেলো।
পিসি – সত্যি তো, কে করছে শব্দ, তোর পিসেমশাইকে ডাকি।
কথার আওয়াজে টাপুসের মায়ের ঘুম ভেঙে গ্যাছে। পিসেমশাইকে পিসি ডাক দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে সব বলার পর পিসেমশাই বললো– আমাকে একটা বড় লাঠি দিতে পারবে? বাইরে গিয়ে দেখি কি ব্যাপার।
পিসি– ঘরের ভেতর লাঠি কোথায় পাবো? দাঁড়াও দেখছি…
পিসি খুঁজে গাবলুর দাদুর লাঠি, ঝুল ঝাড়ু, বঁটি এইসব নিয়ে এলো।
পিসেমশাই – এতো সব আনলে কেন?
পিসি– বা-রে, তুমি একা বের হবে নাকি, আমি বৌদি সবাই তোমার সাথে বাইরে যাব। বাইরে কি বিপদ ওৎ পেতে আছে কে জানে। তাইতো আমি বঁটিটা নিয়ে এলাম।
পিসেমশাই দরজা খুললো। বড়দের দেখে সাহস পেয়ে টাপুস টুপুস আর ডাবলুও পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। পিসি উঠোনের লাইট জ্বেলে দিয়েছে। পিসেমশাই এক হাতে টর্চলাইট জ্বালিয়ে অন্য হাতে দাদুর লাঠি নিয়ে বাইরে এলো। এখন শব্দটা আর শোনা যাচ্ছে না। পিসেমশাই টর্চলাইট দিয়ে চারিদিক দেখছে, পিসি বঁটিটা উঁচিয়ে চারিদিকে দেখছে।
পিসেমশাই– কাউকেই তো দেখা যাচ্ছে না, শব্দটাও আর হচ্ছে না।
মা – আমরা কি তাহলে ভুল শুনেছি? নিশ্চয় বাইরে কেউ শব্দ করছিল, আমাদের দেখে সরে পড়েছে।
ডাবলু মাকে জড়িয়ে ধরে বললো– ওরে বাবারে, এ নিশ্চয় ভূত, রাম… রাম,… রাম…
ডাবলুর কথা শুনে টাপুস টুপুস দৌঁড়ে ঘরে ঢুকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো। সবাই চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়ালো। হটাৎ আবার শব্দ হলো। শব্দের দিকে লক্ষ্য করে টাপুস দেখলো, একটা কুকুরের মুখ খেজুর গুড়ের হাঁড়ির ভেতরে ঢুকে গ্যাছে, আর কুকুরটা সেটা নিয়ে এদিক সেদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। দৌঁড়ানোর সময় হাঁড়ি মাটিতে ঠেকে ঠকঠক শব্দ হচ্ছে।
টাপুস চেঁচিয়ে বললো– আরে কুকুরটার মুখে হাঁড়িটা আটকালো কি করে?
পিসেমশাই– ওটা কুকুর না, শিয়াল। আজ পিঠেপুলি করার পর গুড়ের হাঁড়ি খালি হয়ে গিয়েছিল দেখে তোর পিসি ওটা উঠোনের এক কোনে রেখে দিয়েছিল। মনে হয় শিয়ালটা মুখ ঢুকিয়ে লেগে থাকা গুড় খেতে গিয়ে ওর মুখ ওটা আটকে যায়। শিয়ালটা হাঁড়িটাকে ছাড়ানোর জন্য ছুটোছুটি করছিল আর মাটিতে ঠেকে ঠকঠক শব্দ হচ্ছিল।
পিসি– ওর মুখ থেকে হাঁড়িটাকে কিভাবে বের করবে?
পিসেমশাই– আমি হাঁড়ির ওপর লাঠির একটা বারি দিই, তাহলে ভেঙে যাবে।
পিসেমশাই উঠোন থেকে ছোট মতো একটা বাঁশ নিয়ে শিয়ালটার পেছন পেছন দৌঁড়াতে লাগলো। শিয়ালটা একবার এদিকে তো আর একবার ওদিকে যাচ্ছে। কিছুতেই পিসেমশাই হাঁড়িটা ভাঙতে পারছে না। শিয়ালটা এবার তুলসী মঞ্চের পাশে দাঁড়ালো, পিসেমশাই পা টিপে টিপে গিয়ে হাঁড়ির ওপর এক বাঁশের বারি দিলো। হাঁড়ি ভেঙে চুরমার হয়ে গেল, আর শিয়ালটা চোঁ- চাঁ দৌঁড়।
ওর কান্ড দেখে সবাই হো- হো করে হেসে উঠলো।
-------------------------------------------
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন