Featured Post
ধারাবাহিক উপন্যাস ।। তিতলির বিশ্বভ্রমণ ।। অরুণ চট্টোপাধ্যায়
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
তিতলির বিশ্বভ্রমণ
অরুণ চট্টোপাধ্যায়
প্রথম পর্ব - বঙ্গভ্রমণ
পাঁচ
সরসরে সরীসৃপ
সোদরবন একটু অপরিচিত বটে হাতিদাদার। সে তো এই জঙ্গলের পশু নয়। সে থাকে উত্তরের জঙ্গলে। জলদাপাড়া, ডুয়ার্স, কাজিরাঙা এইসব জঙ্গলে। তাই এদেশে একেবারে নতুন বলতে গেলে। অচেনা পথঘাট। তবে সঙ্গে তিতলি পুচকি বোন আছে আর আছে দাদুর মত অভিজ্ঞ লোক। তাছাড়া বাঘুমামারা কত সাহায্য করে। তিতলি পুচকিদের জন্যে বাঘ এখন হাতির খুব বন্ধু।
এই পাশে লোকজন একেবারেই নেই। কারণ বাঘের আবাসের ধারেকাছে মানুষ তো থাকতে পারে না। আসলে দুজনেই দুজনকে ভয় করে। কেউ কাউকে ঘাঁটাতে চায় না। কেউ কারোর এলাকায় পা রাখতে চায় না অকারণে।
হাতিদাদা এখন বেশ সাহসী আর সড়গড় হয়ে গেছে এই বনে। দিব্বি তিতলি পুচকি আর দাদুকে পিঠে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় জঙ্গলের এদিক সেদিক। বানরেরা গাছের ডালে ডালে খেলা করে। সে খেলায় বেশ মজা আসে এদের। আবার রোজ তারা পাকা কলা এনে দেয় তাদের। সেই মিষ্টি কলা পেট ভরে খায় এরা তিনজনে। হাতিদাদা অবশ্য এদের এনে দেওয়া কলা খায় না। তার জন্যে কলাবাগান নির্দিষ্ট করা আছে। সেখানে গিয়ে মনের সুখে কলা আর কলা গাছ খায় সে।
মাঝে মাঝে তারা দেখতে পায় সুন্দরী হরিণেরা ছুটে আর নেচে বেড়াচ্ছে। হাতিদাদাকে থামতে বলে তাদের নাচ দেখায়। ওদের গায়ের সোনালী রঙ আর সুন্দর ছোপ সেই সঙ্গে বাহারী শিঙের কারিকুরি চোখ জুড়িয়ে দেয়।
আরও কত জন্তু দেখে নিত্য। এ জঙ্গলে বাঘ, হরিণ আর বানরই হল প্রধান। তবে বুনো গরু। বনবেড়াল এসব পাওয়া যায়। কচ্ছপ, কুমীর, শুশুক, গিরগিটি আর গোসাপ। আর কত অদ্ভুত রকমের গাছপালা। কি সুন্দর সুন্দর পাতা তাদের। প্রধান গাছ সুন্দরী ছাড়াও আছে গরান, গোলপাতা, হোগলা। হাতিদাদার তো খুব আনন্দ। খুব বড় বড় ঘাস আছে। দারুণ মিষ্টি।
বাঘুমামা বলেছে, এই সোদরবন নাকি সমুদ্রের একেবারে কাছে। এখানের জল খুব নোনতা। আর সেই নোনতা জলে বাংলার অন্য অঞ্চলের মত গাছপালা হয় না। নোনা জলে খেয়ে বাঁচে এমন গাছ হয়। বড় বড় ঘাস ছাড়াও শন, নলখাগড়া এইসব।
সেদিন বেড়াতে বেশ কিছুদূর চলে গিয়েছিল তারা। একেবারে নদীর কিনারে। হাতিদাদাকে দাদু বলল, হাতিদাদু তুমি নাহয় একটু বসে জিরিয়ে নাও। আমরা একটু নদীর ধারে ঘুরে বেড়িয়ে পাগুলোকে ছাড়িয়ে নিই।
হাতিদাদা শুয়ে পড়তেই ওরা পিঠ থেকে নেমে পড়ল। বালির পাড় বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখল কেমন করে গাছে গাছে বানররা নেচে বেড়াচ্ছে। ছোট ছোট সব বানর। হঠাৎ বেশ কয়েকজন নেমে পড়তেই এরা বেশ ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু বানররা সব হেসে কিচকিচ করে বলল, ভয় পেয়ো না দিদিরা। আমরা কিছু করব না। আমাদের রাজামশায়ের কাছে শুনেছি তোমরা নাকি রাজার অতিথি। তোমরা নিশ্চিন্তে হেঁটে বেড়াতে পার।
হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুটা চলে এসেছিল। এমন সময় ঘাসের মধ্যে দিয়ে সর সর করে শব্দ। তিতলিরা বেশ ভয় পেল। পুচকিও। কিন্তু একমাত্র দাদুই ভয় পায় নি। হাসি হাসি মুখ করে বলল, এ শব্দ আমার চেনা।
তিতলি পুচকি অবাক হল। উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইল দাদুর মুখের দিকে। কিন্তু কোনও উত্তর না দিয়ে দাদু আঙ্গুল দেখাল সামনে। বিরাট একটা টিকটিকির মত প্রাণী সরসর করে ঘাসের মধ্যে দিয়ে নেমে যাচ্ছে জলে।
পুচকি ভয়ে ভয়ে বলে উঠল, কু কু-
তিতলি বলল, আর বলতে হবে না বুঝেছি। কিন্তু এত কাছ থেকে দেখতে পাব ভাবতে পারি নি। এরা কিন্তু ঠিক টিকটিকির মত দেখতে দাদু।
পুচকি বলল, টিকটিকি গিরগিটি আর কুমীর সব এক রকম দেখতে কেন গো দাদু?
দাদু হাসল। বলল, দেখ এই জগতে বেশ কিছু প্রাণী আছে এরা এক প্রজাতির হয়। যেমন ধর বাঘ, বেড়াল। তেমনি এদেরও মিল পাওয়া যায় টিকটিকির সঙ্গে গিরিগিটির। এদের সরীসৃপ বলে।
-মানে সেই যারা বুকে ভর দিয়ে হাঁটে? পুচকি বলে উঠল।
-হ্যাঁ তাই। সাপ, কেঁচো এরা বুকে ভর দিয়ে হাঁটে এদের পা নেই। তবে টিকটিকি, গিরগিটি, গোসাপ, কুমীর এরা সব পা থাকতেও বুকে হেঁটে চলে।
জলে নেমে যেন জলের সঙ্গে মিশিয়ে গেল কুমীরটা। দাদু বলল, এদের স্বভাবই এই। জলের মধ্যে সারা শরীর ডুবিয়ে নাকটা শুধু জাগিয়ে রাখে। জলের মধ্যে দিয়ে তাদের গতিবিধি বোঝা ভার।
তিতলি প্রশ্ন করল, জলে এরা নামে কেন দাদু?
পুচকি বলল, কেন আবার। মনে হয় মজা করে সাঁতার কাটবে বলে।
দাদু আবার হাসল, না শুধু শুধু সাঁতার কেটে কি হবে পুচকি দিদি? এরা তো আর সুইমিং কম্পিটিশনে নাম দেবে না?
পুচকি বেশ একটু লজ্জা পেল। তিতলি ভাবতে লাগল জুৎসই উত্তরটা কি হতে পারে।
দাদু আবার বলল, জলে নামে মাছ শিকার করতে। মাছ আর জলের ছোট ছোট প্রাণীদের। এদের তো খেয়ে বেঁচে থাকতে হবে গো দিদিভায়েরা।
হঠাৎ একটা উদ্ভট আওয়াজ। একটু দূরে কাছে বিরাট ঝটাপটি। জলের মধ্যে সাংঘাতিক তোলপাড়। জল ছিটিয়ে উঠে যাচ্ছে যেন সেই আকাশ পর্যন্ত। আবার জলের ঢেউ পাড়ের দিকে তিতলিদের পায়ের কাছে পর্যন্ত এসে গেছে। ছলাৎ ছলাৎ কল কল কত রকম শব্দ মিশিয়ে এক অদ্ভুত শব্দ তৈরি করছে।
গ্রামের পুকুরে নেমে সাঁতার কেটে চান করতে খুব ভালবাসে তিতলি। ভালবাসে পুচকিও। কিন্তু পুচকির বাড়ির কাছাকাছি তেমন পুকুর না থাকায় রোজ চান করা হয় না সাঁতার কেটে। মাঝে মাঝে বাবার সঙ্গে সাইকেলে করে গিয়ে দূরের পুকুরটায় সাঁতার কাটে প্রাণ ভরে। আর সে যখন ডিমাপুরে আসে তো তিতলির সঙ্গে সাঁতার কাটে। জল ছিটিয়ে আর জল তোলপাড় করে। খুব লাফালাফি করে দুজন। খুব মজা হয়।
এখানেও তাদের মনে হলজলের মধ্যে যেন কারা লাফালাফি করছে। কিন্তু মজা করে লাফালাফি তো তাদের পুকুরে হয়। এই বিচ্ছিরি জলা-জঙ্গলে কারা আর জলের মধ্যে মনের সুখে লাফালাফি খেলতে আসবে? বিশেষ এই ঘোলা নোংরা জলে।
নিশ্চয় কোনও বিপদ। তিতলিদের মুখ ভয়ে নীল। দাদুও আর সাহস দিতে পারছে না। তবু দুই হাতে দুজনকে টানতে টানতে নিয়ে এল জলের থেকে অনেক দূরে পাড়ের ভেতর। একটু পরেই বেশ বোঝা গেল ব্যাপারটা। জলের ভেতরে এখন বাঘটাকে দেখা যাচ্ছে। চলছে বাঘে-কুমীরে লড়াই। কি বিষম লড়াই বাপ রে!
পুচকি চেঁচিয়ে উঠল, দাদু দাদু বাঘ! বাঘ!
তিতলি জোরে তার হাত চেপে ধরল পুচকির মুখে।
-চুপ চুপ পুচু চুপ। আমাদের সামনে খুব বিপদ। শুধু বাঘ নয় কুমীরটাও আছে। তুই দেখতে পাস নি। বলে সে চাইল দাদুর মুখের দিকে। দাদুর মুখে এবার আর তেমন হাসি নেই। বলল, হ্যাঁ বিপদ তো বটেই। দুই মহা শক্তিধর লড়াই করছে আমাদের চোখের সামনে। প্রায় সমানে সমানে লড়াই বলতে গেলে। আমাদের চুপ করে দেখে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। আমরা আপাতত নীরব দর্শক।
বেশ কিছুক্ষণ ধরে চলল লড়াই। মনে হয় বাঘটা ওপারের দ্বীপ থেকে সাঁতরে আসছিল এপারে। আবার জলের ভেতর বড় বড় মাছগুলোকে শিকার করার তালেও ছিল। এদিকে জলে নেমেছে কুমীর তো একই উদ্দেশ্যে। তাই লড়াই বেধেছে দুজনে। শিকার নিয়ে না হলেও লড়াই অবশ্য এমনিতেই হত। সামনা সামনি দেখলে এই মহা শক্তিধর প্রাণী একে অন্যকে ছেড়ে দেবে তা কি হতে পারে কখনও?
লড়াই এক সময় থেমে গেল। বাঘ বিরাট এক লাফ দিয়ে পড়ল নদীর গভীর দিকে। তারপর সাঁতার কাটতে লাগল অনেক দূর দিয়ে। কুমীর নাগাল পেল না অথবা লড়াইতে ক্লান্তি আসার জন্যে আর পিছু ধাওয়া করল না।
এত কাছ থেকে বাঘকে সাঁতার কাটতে কখনও দেখে নি তারা। দেখে নি বাঘে-কুমীরে লড়াইও। ভেতরে ভেতরে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চে ফুটছে তারা। মানে দুই বোন। যেমন হয়েছে আনন্দ, অজানার এক সুখ- কিন্তু তার থেকেও বেশি হয়েছে ভয়। বাঘ আর কুমীর-দূর থেকে দেখতেই আনন্দ। কাছ থেকে কখনও না।
জল অনেকটা শান্ত হয়ে এসেছে। দাদু বলল, যা দেখলে তা তোমাদের মনে থাকবে তো দিদিভায়েরা?
দাদুর গলাও কাঁপছে। দাদু বয়েসে অনেক বড় এটা ঠিক। কিন্তু শক্তিতে বাঘ বা কুমীরের থেকে বড় তো কোনও অংশে নয়।
তিতলি চোখ বড় বড় করে বলল, চোখের সামনে ঘটল দাদু। এ কি কখনও ভুলতে পারি?
পুচকি একটা জোরে শ্বাস টেনে বলল, বাবারে বাবা। এ কি কখনও ভোলা যায়?
অনেকক্ষণ এরা দাঁড়িয়ে আছে। জলের মধ্যে আর তেমন কোনও সাড়াশব্দ নেই। এদিকে কুমীরটা কখন গুটি গুটি পায়ে উঠে আসছে পাড়ের দিকে এদের তেমন খেয়ালও নেই। এমনিতেই কুমীরের চালচলন খুব নিঃশব্দ। এরা যখন টের পেল কুমীর তখন তাদের ঠিক দেখে নিয়েছে। বিরাট হাঁ করে তাকাল তাদের দিকে। তারপর আসতে লাগল পুচকিদের দিকেই। আর বেশ জোরে।
মুহূর্তে বিপদ বুঝে দাদু দিয়েছে হাঁক। পালাও পালাও দিদিভাই। যত জোরে পার ছোট। কুমীর ধরলে কিন্তু সবাইকে পেটে পুরবে। দৌড় লাগাও। কুমীর কিন্তু খুব জোরে দৌড়তে পারে।
সবাই জোরসে ছুটছে। বালি আর কাদায় ভর্তি জায়গাটা। আচমকা পা মচকে পড়ে গেল পুচকি। পেছনে তাকিয়ে লক্ষ পড়ল কুমীরের বড় হাঁ টা। দাদু আর তিতলি তাদের পেছনে হলেও কুমীরের থেকে অনেক দূরে। কুমীর সোজা আসছে পুচকির দিকেই।
-দাদু গো! বলে সে চোখ বুজল।
কিন্তু বিপদে চোখ বুজে থাকলেও বিপদ নাকি তাকে ছেড়ে দেয় না। দাদু বলেছে এ কথা। কথাটা পুচকির মনে পড়ে গেল। দাদু বলেছে বিপদে চোখ খোলা রাখলে বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার একটা চেষ্টা অন্তত করা যেতে পারে। কিন্তু প্রচন্ড ভয় যে তাকে চোখ খুলতে দিচ্ছে না কিছুতেই।
এমন সময় মনে হল কার যেন খড়মড়ে লোমশ হাত তাকে তুলে ধরেছে ওপরে। আর তাকে নিয়ে দৌড়চ্ছে। তবে কি কুমীরটাই? কুমীরের হাত থাকে বটে তবে তা দিয়ে কি কাউকে বয়ে নিয়ে যাওয়া যায়?
তাকে নিয়ে যে কি হচ্ছে তা ভাবতে আর ইচ্ছে করছে না পুচকির। যেন একটা ঘুম তাকে পেয়ে বসেছে। ঘুমোলে নাকি মানুষের মনে আর কোনও ভয় কাজ করে না। অতএব ঘুমোনই ভাল।
এ কার কীর্তি?
এক একবার এক এক রকম কথা মনে আসছে। একবার মনে হল কুমীর তাকে পেটে পুরে দিয়েছে। কারোর পেটের ভেতর দিকটা যেমন গরম হয় তেমন গরম মনে হচ্ছে। কুমীরের পেটের ভেতরটা হয়ত খড়খড়ে। তাই কেমন খসখসে কিছু ঘষে যাওয়ার মত মনে হচ্ছে সারা গায়ে। আবার কেমন যেন নখের বসে যাওয়ার মত মনে হচ্ছে গায়ে। হতে পারে একটু আগেই তো কুমীরটা একগাদা মাছ খেয়েছে। সেই মাছ তো এখনও হজম হয় নি। সেগুলোই বিঁধছে পুচকির গায়ে। তার মানে এবার আর রক্ষে নেই। হায় হায় মা পিসিমা কেউ জানতেই হয়ত পারবে না এ কথা। তিতলিদিদি রে তোর মুখটাও আর দেখতে পাব না। দেখতে পাব না দাদুকে। দেখতে পাব না হাতিদাদাকেও।
মাঝে মাঝে সে যেন দুলে দুলে উঠছে। তাকে নিয়ে কেউ যেন লাফাচ্ছে। হয়ত ভূত। তবে তিতলি যে বলে ভূত বলে কিছু নেই? কিন্তু কিছু যদি নাই থাকবে তবে তাকে নিয়ে এমন ভাবে লোফালুফি খেলবে কে? ভূত ছাড়া আর কে হতে পারে? তিতলিদিদি তো ছোট। সে তাকে এমন ভাবে উঁচুতে তুলতেই পারবে না। পারে একমাত্র দাদু। আর দাদু তো অনেক দূরে। জলের কাছে। হয়ত তাকেও আর একটা কুমীর ধরেছে। শুনেছে সুন্দরবনে কুমীরের নাকি অভাব নেই। শুধু কুমীর আর বাঘে ভর্তি জায়গাটা।
একটু পরেই অবাক কান্ড। কুমীরের পেটের বদলে নরম ঘাসের মধ্যে কে যেন বসিয়ে দিল পুচকিকে। পুচকি চোখ বুজে তখনও ভাবছে এ বুঝি আবার নতুন কোনও একটা স্বপ্ন। কিংবা কুমীরের পেটে মাছের কাঁটা কুটি ছেড়ে এখন নরম মাংসের ভেতরে ঢুকে গেছে। অর্ধেকটা বোধহয় হজম হয়েই গেল।
এমন সময় তার চারপাশে কিচ কিচ কিচ কিচ আওয়াজ। আবার মানুষের গলায় কে যেন ডাকল, এই পুচকি চোখ খোল।
তিতলিদিদির গলাই তো মনে হচ্ছে। আবার পেল দাদুর গলাও। দাদু খুব মিষ্টি করে ডাকছে, পুচকি দিদিভাই ওঠো। ওঠো। আর ভয় নেই। চোখ খোল।
দাদুর গলা। ভরসা পেল খুব। পুচকি চোখ খুলতেই দেখে এক অবাক কান্ড। নদীর থেকে অনেক দূরে তারা। চারপাশে ঘন জঙ্গলের মাঝে একটা ঘাসের মাঠে বসে আছে সে। লম্বা লম্বা নরম ঘাস। চারিপাশে সবুজ জঙ্গল।
সামনে তিতলি আর দাদু একভাবে তার দিকে তাকিয়ে দেখছে। দাদু বলল, বড্ড ভয় পেয়েছে দিদিভাই। আহা ভয় পাবারই তো কথা।
তিতলিও জিজ্ঞেস করল, ভয় পেয়েছিস নাকি পুচু?
লজ্জা পেল পুচকি। লুকিয়ে ফেলল নিজের মনের ভাব। বলল, না রে দিদি। কেমন যেন ঘুম এসে গিয়েছিল।
আর সবচেয়ে অবাক কান্ড তাদের চারপাশ ঘিরে অজস্র বানর গিজগিজ করছে। কিচকিচ করছে আর তার দিকে উদ্বিগ্ন হয়ে চেয়ে আছে। এখন সে চোখ মেলতে আনন্দে নেচে উঠল। একজন আর একজনকে জড়িয়ে ধরে ভীষণ আনন্দটা প্রকাশ করতে লাগল। যেন তাদের খুব কাছের এক মানুষ সদ্য বিপন্মুক্ত হয়েছে।
দাদু বলল, আজ বানুভাই আমাদের বাঁচিয়েছে পুচকি।
তিতলি বলল, সত্যি রে পুচু। বানুভাই না থাকলে যে কি হত।
বানুভাই এসে কিচকিচ করে বলল, আমরা সব গাছের ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে খেলছিলুম। দেখেছিলুম হাতিদাদার পিঠ থেকে নেমে তোমরা নদীর ধারে গেলে। দূর থেকে আমরা সবাই কুমীরটাকে দেখে খুব সাবধান হয়ে নজরে রাখছিলুম। তারপর যখন কুমীরের সঙ্গে বাঘের লড়াই হয় তখন গাছ থেকে নেমে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকি। ঠিক করেই নিয়েছিলুম তোমাদের উদ্ধার করে নিয়ে যেতেই হবে। তোমরা হলে আমাদের রাজার অতিথি। আমাদের চোখের সামনে তোমাদের কিছু হলে আমাদের যে লজ্জার সীমা থাকত না দিদিরা। তাই আমরা সব ধরাধরি করে তোমাকে নিয়ে চলে আসি এখানে। চল চল এখন এই জায়গা নিরাপদ নয়।
পুচকি আর তিতলিকে দুটো বানর খপ খপ করে তুলে গাছের ডালে ডালে লাফিয়ে লাফিয়ে এই মাঠে এসে পড়েছে। আর দাদুর হাত ধরে চার চারটে বানর টানতে টানতে এনেছে। দাদুর চোখে জল। বলল, আমার বানুভায়েরা, তোমরা না থাকলে আমার দিদিভাইদের বাবা মাকে কি উত্তর দিতুম বল? যত যাই হোক তারা আমার ওপর কত ভরসা করে পাঠিয়েছে বল?
বানুভাই বলল, তাই কি হতে পারে দাদু? তোমরা হলে রাজার অতিথি। আর তোমার এই দুই নাতনি সব পশুপাখীদের খুব প্রিয়। শুধু আমরা নয় সারা জগৎ একদিন চিনবে ওদের।
আপাতত ইতি
বাঘুমামার খুব মন খারাপ। মুখটা চুন করে বলল, এখন তবে ফিরে যাবে তোমরা?
দাদু বলল, হ্যাঁ সাত সাতটা দিন তো কেটে গেল।
মুখে বলল বটে, তবে মনে মনে ভাবল সাত সাতটা দিন নয় যেন সাত সাতটা মিনিট। কত তাড়াতাড়ি যাবার কথা ভাবতে হচ্ছে। কিন্তু উপায় কি নাতনিদের পড়াশোনা তো আছে।
বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগের কোনও অসুবিধে হয় নি তিতলি পুচকির। দাদুর খুব দামি স্মার্ট ফোন আছে। সেই দিয়ে ভিডিও আলাপ হয় তাদের বাড়ির সঙ্গে। হাতির পিঠে চেপে তারা ঘুরছে আর দুই বাঘুমামা তাদের সামনে সামনে জঙ্গল দেখাচ্ছে এটা দেখে তাদের বাড়ির সকলে তো একেবারে হাঁ। বাবা, মা, জেঠু সব একেবারে তাজ্জব।
আর বাঘুমামা তো স্বয়ং সোদরবনের রাজা বলে কথা। তিতলি গর্বের সঙ্গে সবাইকে বলেছে সে কথা। বলেছে, আমরা কিন্তু রাজবাড়িতে রাজার অতিথি। মামারা আমাকে আর পুচকিকে কত আদর করে জান?
ভিডিওতে সে আদরের ঘটা দেখে ভয়ে কাঁটা হয়েছে সবাই। দাদু সবাইকে আশ্বস্ত করে বলেছে, চিন্তার কিছু নেই। থাবার ভেতরে নখ লুকোন আছে ওদের। বিড়াল জাতীয় পশুদের এটাই নিয়ম। আক্রমণ করার সময় ছাড়া ওরা নখ বার করে না।
এবার বিদায়ের দিন এসে গেছে। বাঘুমামারা তাদের দুটো জিনিসে পোঁটলা বোঝাই করে দিয়েছে। সেগুলো হল টাটকা মধু যা হাতিদাদা নিজে পেড়েছে গাছ থেকে। দাদু নিজে চাক ভেঙ্গে মধু বার করে শিশিতে ভরেছে।
আর দুই হল বড় বড় চিংড়ি মাছ আর কাঁকড়া। দুই মামা নিজে ধরেছে নদী থেকে। এখানে অনেক নদী আছে। দাদু বলেছে তাদের নাম। পাঁচটা বড় বড় নদীর নাম তারা মুখস্ত করে নিয়েছে। মাতলা, গোসাবা, বিদ্যাধরী, ঠাকুরানী আর হেরোভাঙ্গা।
এখানে অনেক নদীর মত আছে অনেক ছোটবড় দ্বীপ। বাঘুমামার পাঠানো সেই ভেসেলে চড়ে তারা সব দ্বীপে ঘুরে বেড়িয়েছে। এমনকি হাতিদাদা সমেত।
--আমার খুব মজা লাগছে। হাতিদাদা বলল, কত বড় বড় নদী, দ্বীপ আর সমুদ্র দেখলাম। তবে—
--তবে কি গো হাতিদাদা? উৎসাহের চোটে তাড়াতাড়ি বলে ওঠে তিতলি।
--দেখ সমুদ্র যদি দেখবে তো চল আমার দেশ কেরলে। কী সুন্দর নীল সমুদ্র, হলুদ বালিয়াড়ির বিচ। আর সাদা ফেনায় ভরা ঢেউ।
--চল চল আমাদের নিয়ে চল হাতিদাদা তোমাদের দেশে। তিতলি আর পুচকির খুব উৎসাহ।
--চল কেরল চল। ধুয়ো তুলল দাদুও।
বাঘুমামাই বা কম যায় কেন। বলল, আমাদের এক বোন থাকে নন্দনে। তোমরা একটু দেখা করে যেয়ো না প্লিজ।
তিতলি জানে নন্দন মানে হল নন্দন কানন। উড়িষ্যার ভুবনেশ্বরে এই বিশাল উন্মুক্ত অরণ্য মধ্যপ্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত। সেখানে অনেক বাঘ থাকে। আর বাঘ দেখতে তিতলিদের খুব ভাল লাগে।
--ও চিন্তা কর না মামা। হাতিদাদা বলল, কেরলে আমার দেশে যাওয়ার পথে নন্দন কাননে তোমাদের বোন মানে আমাদের মাসির সঙ্গে দেখা করেই যাব।
এমন সময় দাদুর মোবাইলে একটা মেসেজ এল টিং করে। পড়ে তো দাদুর মুখ ভার। কোনও দুঃসংবাদ নাকি? তিতলি আর পুচকি তাকিয়ে আছে দাদুর মুখের দিকে। এমন কি হাতিদাদা ছোট আর বড় বাঘমামা পর্যন্ত।
হ্যাঁ দুঃসংবাদ তো বটেই। জেঠু লিখেছে স্কুলে বড়দিনের ছুটি শেষ। নতুন বছরের গোড়ায় শুরু হবে নতুন ক্লাস। অতএব তিতলিদের বিশ্বভ্রমণ এই পর্যন্ত স্থগিদ রাখতেই হবে।
মুখ ভার দুই বোনকে সান্ত্বনা দিল হাতিদাদা, মন খারাপ কর না দিদিরা। পড়াশোনা তো সবার আগে। সেটা হলে তো সব হবে। তাই আসুক না গরমের ছুটি। চলে যাব আমার দেশ কেরলে। সেখান থেকে শুরু হবে বিশ্বভ্রমণের দ্বিতীয় পর্যায়।
[প্রথম পর্ব সমাপ্ত]
______________________________
DR. ARUN CHATTOPADHYAY
181/44 G.T.ROAD (GANTIR BAGAN)
P.O. BAIDYABATI
DIST. HOOGHLY (PIN 712222)
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন