শিশুদের প্রাণ শিশু উদ্যান
মিঠুন মুখার্জী
ছোট্ট অলিভিয়া তার বাবা রাকেশ চৌধুরীকে বলেছিল-- "বাবা, আমার কোন বন্ধু নেই। আমার সাথে কেউ খেলে না। আমি কাদের সাথে খেলব? আমাকে কেউ পছন্দ করেনা।" আট বছরের মেয়ের মুখে এই আক্ষেপের কথাগুলি শুনে খুবই খারাপ লেগেছিল রাকেশের। তিনি মেয়েকে বলেছিলেন---"বেশি বন্ধু না থাকাই ভালো বাবা। একা একা খেলার চেষ্টা করো। আর আমাকে তোমার বন্ধু মনে করো। সঙ্গদোষে এখনকার বেশিরভাগ ছেলে- মেয়ে খারাপ হয়ে যাচ্ছে।" বাবার কথাতে চিড়ে ভেজে নি। খেলার জন্য পাগল প্রায় হয়ে উঠেছিল অলিভিয়া। রাকেশ আর সামলাতে না পেরে তাদের পাড়াতে থাকা একটা শিশু উদ্যানে অলিভিয়াকে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। সঙ্গে সঙ্গে অলিভিয়া রাজি হয়ে যায়। মার কাছ থেকে একটা জামা পরে বাবার হাত ধরে পায়ে হেঁটে শিশু উদ্যানে যায়।
শিশু উদ্যানটি অলিভিয়াদের বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে মিনিট পাঁচেক লাগে। 'আমরা সবাই' ক্লাবের মাঠের পাশেই এই শিশু উদ্যানটি। তখন বিকেল পাঁচটা বাজে। শিশু উদ্যানে প্রবেশ করে অলিভিয়া প্রথমেই ছোট্ট দোলনাতে গিয়ে বসে দোল খায়। একা একা অসুবিধা হওয়ায় বাবাকে পেছন থেকে ঠেলে দেওয়ার জন্য বলে। বাবাও পেছন থেকে মিনিট দশেকের মত তাকে ঠেলে দেন। খুব মজা পায় সে। আরও দশটি শিশু তাদের অভিভাবক ও অভিভাবিকাদের নিয়ে শিশু উদ্যানে এসেছিল। শিশু উদ্যানের একটা জায়গায় বসে বসে অলিভিয়ার বাবা লক্ষ করছিলেন শিশু উদ্যানের প্রতিটি জিনিস ও প্রত্যেককে। একটু অসাবধানবশত বিপদ হতে পারে। তাই নজরটা তীক্ষ্ণ হওয়া প্রয়োজন।
শিশু উদ্যানটি পৌরসভার পক্ষ থেকে জনগণের হিতার্থে স্থাপন করা হয়েছে। পৌরসভা পরিচর্যার জন্য লোক রেখেছে। কিন্তু বর্তমান দশা দেখে রাকেশের খুবই খারাপ লেগেছিল। চারিদিকে বড় বড় ঘাস হয়ে রয়েছে। জায়গায় জায়গায় গর্ত ও কাদা। যত্নের অভাবে নষ্ট হচ্ছে সব। কিন্তু খারাপ লাগলেও কিছু করার নেই। একা প্রতিবাদ করে কিছুই হবে না। সব কিছুই মানুষের গা সওয়া হয়ে গেছে। রাতে এখানে অসামাজিক কাজকর্ম হয় বলে শুনেছেন তিনি। কেউই তদারকি করেন না। দিনের বেলা অবশ্য সাহস পায় না কেউ। এই শিশু উদ্যানটিতে রয়েছে একটা স্লিপ, একটা দোলনা, একটা বাচ্চাদের চড়ার ছোট নাগরদোলা ও একটি লাফানোর যন্ত্র। শিশু উদ্যানটির চারপাশে রয়েছে ছটি বসার জায়গা। সেগুলি কংক্রিট দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। তাছাড়া নোংরা ফেলার জন্য কয়েকটি ডাস্টবিন জায়গায় জায়গায় বসানো। কিন্তু অসচেতন শিশুরা ও তাদের অভিভাবক-অভিভাবিকারা সেগুলো ব্যবহার কম করেন। শিশু উদ্যানটির একেবারে মাঝে রয়েছে একটি জলের ফোয়ারা। তার মধ্যিখানে একটি মৎস্যকন্যার স্ট্যাচু। শিশু উদ্যানটিতে ঢোকার গেটটি অসাধারণ নকশা করে নির্মাণ করা হয়েছে। তাছাড়া শিশু উদ্যানের মধ্যেই রয়েছে বিশাল লম্বা একটি লাইট পোস্ট। ছটি মেটাল লাইট চারিদিকে ঘুরিয়ে এমন ভাবে লাগানো, তার আলোয় সমগ্র শিশু উদ্যানটি সন্ধ্যা বেলা থেকে আলোকিত হয়ে যায়। তবে সবগুলোই পরিচর্যার অভাবে ভগ্নপ্রায়। শিশু উদ্যানটা আয়তক্ষেত্র মাপের। সামনের গেট বন্ধ থাকলেও পাঁচিল ডিঙিয়ে ভেতরে প্রবেশ করা যায়।
আলিভিয়ার বাবা বসে বসে দেখেন, একজন মা তার পাঁচ-ছয় বছরের একটি ছেলেকে নিয়ে শিশু উদ্যানে এসেছেন। শিশুর মনোরঞ্জনের জন্য একজন পিতা তার ছয়-সাত বছরের একটি ছেলেকে স্কুটিতে করে শিশু উদ্যানটিতে নিয়ে এসেছেন। তিনি দেখলেন, শিশুটিকে খেলতে দিয়ে তার বাবা বড় বড় ঘাসগুলিকে হাত দিয়ে টেনে টেনে তুলে একটা পাশে জড়ো করছেন। তিনি বুঝতে পারলেন মানুষটি খুবই সচেতন ও পরোপকারী। আবার তিনি দেখলেন, একজন মা তার দুই মেয়েকে ও বোনকে নিয়ে শিশু উদ্যানটিতে এসেছেন। তার বড় মেয়েটির বয়স বছর এগারো-বার । সে শিশুদের চড়ার সমস্ত কিছুতে প্রথম প্রথম উঠতে লজ্জা পাচ্ছিল। তাছাড়া মেয়েটি একটু হেলদি বা মোটা ছিল। মা ছিলেন অস্বাভাবিক মোটা। অথচ বোন ও ছোট মেয়েটি ছিল একেবারেই রোগা। মায়ের সাথে ছোট মেয়ের কোন মিলই খুঁজে পাওয়া যায় না। ছোট মেয়েটিও প্রথমেই অলিভিয়ার মত দোলনাটিতে দুলছিল। তখন অলিভিয়া স্লিপ চড়ছিল। একজন দাদু- ঠাকুমা তাদের ছোট্ট নাতনিকে নিয়ে শিশু উদ্যানটিতে এসেছিলেন। ঠাকুমা কিছুটা দূরে বসে ছিলেন আর দাদু নাতনিকে ধরে ধরে সবকিছুই চড়াচ্ছিলেন। সেও খুবই মজা পাচ্ছিল। অলিভিয়ার ছোট ছোট করে চুল ছাটা দেখে প্রথমে ওই ছোট্ট মেয়েটি তাকে ছেলে বলে মনে করে। অলিভিয়া যখন দোলনা চড়ছিল, তখন ঐ ছোট্ট মেয়েটি তাকে বলে--- "ও দাদা, একটু নামোনা। আমি একটু দোলনা চড়বো। আমার খুবই চড়তে ইচ্ছা করছে।" অলিভিয়া তার কথা শুনে হেসে দেয়। বলে--- "আমি দাদা নই, আমি দিদি।" বাবাকে বলে--- "ও বাবা দেখো, ও আমাকে দাদা বলছে। আমি দিদি না?" রাকেশ তখন ওই ছোট্ট মেয়েটিকে বুঝিয়ে বলেন---"বাবা, ও দাদা না, ও দিদি।" তবুও ছোট্ট মেয়েটি বিশ্বাস করেনি যে, অলিভিয়া মেয়ে।
অলিভিয়ার বাবা তার দিকেও খুবই নজর রাখছিলেন। বারবার দেখছিলেন সে কি করছে। কোথায় যাচ্ছে। মানুষের সঙ্গে খুব সহজেই মিশে যেতে পারে সে। যদিও শিশুদের এটা একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু কিছু কিছু শিশুরা সকলের সঙ্গে মিশতে ও কথা বলতে চায় না। নাক সিটকায়। যদিও ছোটবেলা থেকে তারা সেভাবেই বড় হয়। অভিভাবক-অভিভাবিকারা তাদের সন্তানদের ওই ভাবেই শিক্ষা দিয়ে থাকেন। এতে শিশুর ক্ষতি হয়। সে বাইরের মানুষদের সঙ্গে একটা বয়সে গিয়ে মিশতে পারে না। অলিভিয়ার স্বতঃস্ফূর্ততা দেখে পিতা রাকেশ মনে মনে খুবই আনন্দ পেয়েছিলেন। কারো সাথে কথা বলতে ও একবিন্দু দ্বিধা করছে না। সবকিছুই আনন্দের সহিত করছে এবং খুব মজা নিচ্ছে। শিশুগুলোকে দেখে রাকেশের ও অন্যান্য অভিভাবক- অভিভাবিকাদের মনে হয়েছিল --- "তারা অনেক দিন ধরেই একে অপরকে চেনে-জানে। জীবনের কোনো জটিলতা-ভেদাভেদ তাদেরকে এখনো স্পর্শ করেনি।"
শিশু উদ্যানের চারিপাশ থেকে লাগানো গাছগুলো দেখে রাকেশের খুবই আনন্দ হয়। কারণ, মানুষ যে এখনো গাছ লাগানোর চিন্তা করে, এটা দেখে তা বোঝা যায়। সব মিলিয়ে না হলেও এই ছোট্ট একটু শিশু উদ্যানে পঞ্চাশটির মতো গাছ আছে। বিচিত্র তাদের নাম। কিছু ফুলের গাছও সেখানে রয়েছে। তবে শত মানা সত্ত্বেও ছোট ছোট শিশুরা সেই সকল গাছ থেকে ফুল তোলে। অলিভিয়া ও কয়েকটি ছোট ছোট শিশু গাছগুলি থেকে ফুল তুলছে দেখে রাকেশ তাদের বারণ করেন। তিনি বলেন---"ফুল গাছে তোমরা হাত দিও না। ফুলগুলি শিশু উদ্যানটির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করছে।" তার কথা শুনে শিশুরা আবার যে যার মত শিশু উদ্যানটির আনন্দ নিতে ব্যস্ত হয়ে যায়। হঠাৎ করে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে বৃষ্টি শুরু হয়। কোনো কোনো অভিভাবক- অভিভাবিকা তাদের শিশুকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভেজার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পাশের 'আমরা সবাই' ক্লাবে আশ্রয় নেন। রাকেশ অলিভিয়াকে নিয়ে স্লিপের নিচে গিয়ে আশ্রয় নেন। কিন্তু এলপাথারি বৃষ্টি হওয়ায় তারা দুজনেই ভিজে যায়। অলিভিয়া বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আবার শিশু উদ্যানের ভিতরে আনন্দ উপভোগ করে। দোলায় চড়ে, আস্তে আস্তে স্লিপ চড়ে। সারা শিশু উদ্যানটি জুড়ে দৌড়ায় আর আনন্দে চিৎকার করে। মেয়ের আনন্দ দেখে বাবাও খুব আনন্দ পান। মনে মনে ভাবেন--- "একটি শিশু উদ্যান কত শিশুকে আনন্দ দান করে। শৈশবের একাকীত্বকে নিমেষে দূর করে দেয়। শিশুদের জীবনে শিশু উদ্যানের গুরুত্বকে কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না। বর্তমানের বোকাবাক্স ও ফোন সর্বস্ব জীবন থেকে শিশুকে উন্মুক্ত জীবন দান করে এই শিশু উদ্যান। তারা আজ খেলার মাঠকে কেড়ে নিয়েছে। শিশুদের নেশা ধরিয়েছে। পড়াশুনোর উপরও এদের প্রভাব পড়ছে। প্রতিটি ঘরের শিশুদের তাদের অভিভাবক-অভিভাবিকা যদি শিশু উদ্যানমুখী করে তোলে, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আরো উন্নত হবে।"
রাকেশ বুঝতে পারেন, এই বৃষ্টির জল গায়ে লেগে মেয়ের শরীর খারাপ হতে পারে। তবুও মেয়েকে আনন্দে বাধা দেননি। মনে মনে ঠিক করেই রেখেছেন, বাড়িতে গিয়ে কলের জলে ভালো করে অলিভিয়াকে স্নান করিয়ে দেবেন এবং নিজেও স্নান করবেন। তাহলে শরীর খারাপ হবে না। এরপর মেয়ে অলিভিয়ার হাত ধরে বৃষ্টির মধ্যেই বাড়ির দিকে পা বাড়ান রাকেশ।
______________________________________________________________________________________
মিঠুন মুখার্জী
C/o -- গোবিন্দ মুখার্জী
গ্ৰাম -- নবজীবন পল্লী
পোস্ট + থানা -- গোবরডাঙা
জেলা -- উত্তর ২৪ পরগনা
[ছবি: ইন্টারনেট মাধ্যম থেকে সংগৃহীত]
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন