ইচ্ছে
সুদামকৃষ্ণ মন্ডল
হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ানো কিশোর জয়দেবকে কে নাইবা চেনে? পড়শীর লোকেরা ছাড়াও প্রতিবেশী গ্রামের লোকেরাও চেনে । কারণ জয়দেবের গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল না । পাশের গ্রামে যেতে হতো প্রত্যহ সহপাঠীদের সাথে । সেই শৈশব যেন আজও স্থির অনুশাসন করে তাকে । স্মৃতির স্বর্ণরেখায় জ্বলজ্বল করছে -- মুছে ফেলতে কেউ পারবেনা ।
গরিবের ঘরে জন্ম শুধু নয় ভাই-বোন মিলে কতগুলো খাবারের থালা মাকে প্রস্তুত করে দিতে হয় । বাবাই একমাত্র রোজগার করেন । দাদারা সবেমাত্র লেখাপড়ার ঘাড় ভেঙে অভাব অনটনের সংসারে বাবাকে সাহায্য সহযোগিতা করে। বড় ও মেজো দাদা ধনী জমিদারের বাড়িতে রাখালবৃত্তির কাজ নিয়েছে । পেটে ভাতে শ্রম করে বিনিময়ে বছরে দশ -বিশ টাকাও দেয় অনেক অশ্রাব্য গালিগালাজ করে। দিদিরাও পরের বাড়ি ঝি-গিরির কাজে যোগ দিয়েছে । ফলে পরিবারের সদস্য সংখ্যা এখন কম হলেও জয়দেবের খাবার থালায় বসে পেট ভরেনা। এদিকওদিক ঘুরে বেড়ায় । গৃহস্থকে না বলে আড়ালে আবডালে ফলপাকুড় লুকিয়ে পেড়ে খায় । পড়শীর লোকের ফায় ফরমায়েশি খেটে মাঝেমধ্যে পান্তা- রুটি -পেয়ারা- পয়সা পেয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি করে।
সে যখন তৃতীয় শ্রেণি - মনের মধ্যে হতাশা- অভিমান -নিঃস্বতার ভাবনা ভীড় করে । হয়তো তার পড়াশোনা হবে না । যার ঘরে সন্তান দু'বেলা পেটপুরে খেতে পায় না সে কি করে পড়াশোনা করবে? পড়ালেখা করাটা যেন বিলাসিতা এবং ধনীরা একমাত্র পারবে সন্তানের লেখাপড়া শেখাতে। সত্যি তাই বাস্তবটা দেখে তাই তার মনে হয় । অভাব যেন রোগ ; সারতে চায়না । অর্থই অনর্থের মূল কারণ ।
সামান্য ক' ক্লাস পড়া বাবাও যেন অভাবের তাড়নায় খিটখিটে মেজাজের , সকলের ভরণপোষণের দায় ঝুঁকি নিতে নাস্তানাবুদ । অধিক সন্তানের পিতা হয়ে নিজেকে বুঝতে শিখেছে শুধুমাত্র বাঁচার জন্য বাঁচা নয় বাঁচতে গেলে খাদ্য তো জরুরী সঙ্গে শিক্ষা । অসহায়তার কথা জয়দেব যেন বাবার আচরণ কথাবার্তা অনুধাবনে বুঝতে পারে। মায়ের করুণ অবস্থা অনাহারক্লিষ্ট শরীর দেখে বিবেকে দংশন করে । যেখানে যায় মায়ের কথা ভেবে সামান্য অংশ এনে মায়ের ক্ষুধার্ত মনকে ক্ষণিক আনন্দে ভরিয়ে দেয় । সে কি করবে ভেবে পায় না ।
খিদের তাড়নায় সে যখন যত্র তত্র ঘুরে বেড়ায় কিঞ্চিত খাদ্য আহরণের সাথে চোখ চলে যায় দুর্বার লক্ষ্যে । হঠাৎ সে দেখতে পেল একটা এক টাকার নোট ঝুপড়ি গাছে আটকে রয়েছে । হাতে তুলে নিয়ে তার কি যে আনন্দ হলো তা বোঝানো যাবে না । সে মতলব খাটিয়ে মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করল । বাবার সাথেও। সংসারে অভাব মেটানোর জন্য সামান্য চালও কিনতে বলল। সে স্বার্থপরের মতো সেটি নিয়ে চকলেটের প্যাকেট কিনে স্কুলে আসল বিক্রি করতে। এক-দু'দিনে প্যাকেট শেষ হলে আবার এনে বিক্রি করে লভ্যাংশ খুঁজে পায়। এভাবে নিজের লেখাপড়ার খরচ সামলেছে। সে আজ বড় মাপের মানুষ । ডক্টর জয়দেব মন্ডল। প্রতিটি ক্লাসে সে কিশোর বয়স অবধি চকলেট বিক্রি করেছে । তারপর হকারি, চা বিক্রি ইত্যাদি । জীবনে মেধা -ইচ্ছা- লক্ষ্য থাকলে কোনও কিছু অধরা থাকে না।
কিন্তু জয়দেব মা-বাবাকে কোনওদিন দোষী সাব্যস্ত করে না । বরঞ্চ এখন মা -বাবার সেবা যত্ন নিজেই করে । আজও কাউকে দোষ দেয় না । দোষ দেয় কেবল সমাজ ব্যবস্থাকে।
______________________________________________________________________________________
সুদামকৃষ্ণ মন্ডল
গ্রাম: পুরন্দর পুর (অক্ষয় নগর)
পোস্ট : অক্ষয় নগর
থানা : কাকদ্বীপ
জেলা : দঃ চব্বিশ পরগণা
[ছবি: ইন্টারনেট মাধ্যম থেকে সংগৃহীত]
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন