মামারবাড়িতে দুপুরবেলা
অনমিতা মুখার্জি
(নবম শ্রেণি, ত্রিবেণী টিস্যুস বিদ্যাপীঠ)
'তাই তাই তাই মামার বাড়ি যাই
মামার বাড়ি ভারী মজা
কিল চড় নাই '
ছোট থেকে সবার মুখে মুখে এই ছড়াটা শিখেই একটু একটু করে বড় হয়েছি ।ছড়াটা থেকে মামার বাড়ির বেশ একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা পাওয়া যায় বটে। আমার মামার বাড়ি বেশ দূরে ,তাই সেটার সাথে সামনাসামনি পরিচয়ও হয় বেশ ধেড়ে বয়সে। প্রথম পরিচয় কিন্ত এই ছড়া থেকেই। নিজের জ্ঞানত অবস্থায় মামার বাড়িতে আমার এই মার্চ মাসের অনেকটা সময়ই কেটেছে। মায়ের স্কুলে এই সময়েই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ডিউটি থাকত। স্কুলটা মামারবাড়ি অর্থাৎ হাওড়া থেকে বেশ কাছে ছিল ।যাতায়াতে তাই সুবিধা হত মায়ের। আর আমারও ফাইনাল পরীক্ষা এই সময়ে শেষ হয়ে যেত ,বেশ বেরিয়ে আসাও হতো।
মামারবাড়িতে পা রাখার পর থেকে যে ঘরটার সাথে আমার বেশ বন্ধুত্ব হয়ে যায় তা হচ্ছে পরোটা ঘর। একপ্রকার 'love at first sight' বলা যেতে পারে। ঘরটার নাম 'পরোটা 'কেন হল তা নিয়ে আজও আমি গবেষণা করছি, আগেও করেছি, হয়তো এরপরেও করব কিন্তু কোন ফল হবে কিনা তা ঠিক জানা নেই। ত্রিকোন মার্কা ঘর , চ্যাপটানো দেওয়ালে জানলা দরজা সাঁটা । মেঝের দিকে তাকালে শুধু নানা রকমের পায়া -যেমন খাটের পায়া ,চেয়ারের পায়া, জলচৌকির পায়া ইত্যাদি একমাত্র দেখা যাবে। এতদিন থেকেও মেঝের ঠিক আসল রং আমি বুঝতে পারলাম না। ঘরটা আমাকে প্রথম দেখাতেই আপন করে নিয়েছে। কত দুপুর ভয়ে ভয়ে কাটিয়েছি ওর সাথে কিন্তু কখনো মনে হতে দেয়নি আমি একা আছি। আর কিছু না হোক নানান সাইজের আলমারি আছে, জিনিস ঠাসা মিটকেস আছে, দেওয়ালে মই হেলানো আছে, একটা কোণে ছোট ছোট দুটো তাকে রাধা কৃষ্ণ ,জগন্নাথ ,গোপাল ঠাকুর সাজানো আছে , আবার একটা কোণে ঝুলঝারার ডান্ডা রাখা আছে, ঝাঁটা , বালতি সর্বোপরি ঘরের তুলনায় একটু বেশি বড় চৌকি আছে। ওইটুকু ঘরে গুষ্টির জিনিস রাখলে ভয় ও একাকীত্ব ব্যাগ গুছিয়ে রওনা হবে। স্বাভাবিক!
দুপুরটা কেন জানি মামার বাড়িতে বিভীষিকা লাগত ।আমার দিদিমা উপরের রান্নাঘরে রাতের রান্না সেরে রাখতেন দুপুর বেলাতেই ।দাদু পাশের ঘরে টিভিতে সি-আইডি চালিয়ে খুন খারাপির রহস্য সমাধানে নেমে পড়তেন ,মা তো স্কুল যেত, এছাড়া বাড়ির আর সকলে ঘুমতো। আমি মাঝে মাঝে পরোটা ঘরের সিঁড়িটার ওপর বাঁ গোড়ালি টা ঠেকিয়ে পুরো শরীরের ভার হাতের উপর রেখে বিছানা থেকে উঁকি মেরে দাদুর হাতি- ঢোকানো হাঁ করে ঘুমোনো দেখতাম। টিভি কিন্তু যেমন চলছিল সেরকমই চলত। মাঝে মাঝে দাদুর ঘাড় টা ঝুঁকে পড়তো নিচের দিকে, ফুড়ুত-ফুড়ুত শব্দে নাক থেকে বিশেষ শঙ্খধ্বনি শোনা যেত। কিন্তু কি অদ্ভুত সে ঘুম !আমি ঘর থেকে একটু বেরোলেই সে ঘুম চুরচুর করে ভেঙে যেত এবং দাদুর বাজখাঁই কন্ঠে সুমধুর বকুনি শুনতে হতো। অগত্যা ঘরে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। যেদিন গুলো ঘুম পেতো অথচ ভয়কে উপেক্ষা করে সে আমার চোখে আসন পেতে বসত না সেদিন গুলো এক অদ্ভুত উপায়ে ঘুমোনোর চেষ্টা করতাম। এই ভয়ের কারণ ছিল মূলত একা থাকা ,এবং সিআইডির 'ঢিচকেঁও' বন্দুকের শব্দ আর ওই ক্রাইম সিন এর মিউজিক গুলো। একদিন দিদিমার সাথে রান্নাঘরে বিভিন্ন জিনিস ঘাঁটাঘাঁটি করার সময় একটা চৌকো সেপের নীল রঙের লাইটার খুঁজে পাই। তাতে আগুন জ্বলে না বরং একটা গুনগুন করে আওয়াজ হয় ওর মাথার কাছে একটা রিং ঘোরালেই। সেই লাইটারটাকে এই দুপুরগুলোতে কানের কাছে রেখে এক অদ্ভুত মায়াময় সুরের স্নেহের স্পর্শে আমার ঘুম ঠিক চলে আসত। শুনেছিলাম দাদু ওটা দার্জিলিং থেকে এনেছিলেন। মাকে যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম ওটায় অমন আওয়াজ কি করে হয় মা বলেছিল ছোটবেলায় মা একবার লাইটার টার নাড়ি ভুঁড়ি টেনে বার করে দেখেছিল ওইটার ভেতরে একটা চাকা ঘুরতো আর একটা ছোট্ট তামার কাঠি ওটার গায়ে আঁচড়ে দিত। অমনি ওই সুন্দর আওয়াজটা হতে থাকতো। ব্যাস !আমিও এক তুমুল উত্তেজনা ও বিস্ময় নিয়ে লাইটারটার বাইপাস সার্জারি শুরু করলাম। প্রশ্ন ছিল একটাই— আমার মত এত গুণী চিকিৎসকের হাতে কাটা ছেঁড়া হওয়ার পর ওটা বেঁচে থাকবে কিনা । অমনি এক দুপুরে আবার ওটার নাড়ি ভুঁড়ি টেনে বার করা শুরু করেছি ,হঠাৎ কোত্থেকে দাদু হাজির। "ভালো জিনিসটার সর্বনাশ না ঘটালে শান্তি হচ্ছে না । জেনারেশন প্রবলেম "এই বলে এক হুংকার ছাড়লেন। অগত্যা ঢোঁক গিলতে গিলতে ওটাকে পাশে রেখে দেয়া ছাড়া আর উপায় ছিল না। আমার লাইটারের গান শুনে ঘুমোনোটাও ঘুচে গেল সেদিন থেকে। আজও কেন জানিনা খালি মনে হয় ওটার মধ্যে নিশ্চয়ই একটা কোন মানুষ ঢুকে বাজনা বাজিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে বেরিয়ে আসে। তাই বোধহয় দেখতে পাই না। খানিকটা এই ভাবেই মামারবাড়ির দুপুরগুলো কাটতো আমার।
আর যেমনি আমার বহু অপেক্ষিত বিকেল পাঁচটা বাজতো ,হাজী মালাং রেস্তোরাঁ থেকে বিরিয়ানির গন্ধ হামাগুড়ি দিয়ে পরোটা ঘরে পা রাখত, দিদিমা উপর থেকে রান্না করে নামতেন ,সিআইডি শেষ হতো, রিকশায় পঁ পঁ হর্নে মা বাড়ি পৌঁছতো আর আমার বোনপো খেলবে বলে ডাকতে আসতো, ওমনি আমি তিড়িং করে ফড়িং এর মত লাফিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তাম, এবার আর কারোর শাসন খাটবে না। পাঁচটা বেজে গেছে মানে আমি স্বাধীন হয়ে গেছি। রোজ খাওয়ার পরে বড়দিদু আমার হাতে যে আমসত্ত্ব টা গুঁজে দিত সেটাকে আধখানা করে অর্ধেকটা নিজের মুখে পুরে আর বাকি অংশটা বোনপোর মুখে গুঁজে দিয়ে ছাতে খেলতে চলে যেতাম।
===============
অনমিতা মুখার্জি
কালিয়াগড়, বলাগড়, হুগলি
বয়স:14
নবম শ্রেণি
ত্রিবেণী টিস্যুস বিদ্যাপীঠ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন