
কঙ্কাল হাত
শ্যামল হুদাতী
--------------------------------
রীতিমতো চাঞ্চল্য। জীবনের প্রথম শর্ট হ্যান্ড পরীক্ষা দিতে বসছি। কম্পিটিশন সেন্টারে গিয়ে খবর পেলাম 'জুনিয়ার স্টেনোগ্রাফার' দুটো পোষ্ট খালি আছে। আমি সম্ভবত সবচেয়ে কম বয়সী পরীক্ষার্থী ,মোট ৪০ জন পরীক্ষার্থী ছিল। সকালে অফিসে এক কনফারেন্সের রুমে পরীক্ষা হল। দু'ঘণ্টার মধ্যে ফলাফল জানিয়ে দিল।সে এক রীতিমতো অবাক করার মতো ফল। আমি প্রথম স্থান অধিকার করলাম। বিকেলে ইন্টারভিউ হল। হাতে হাতে অফার লেটার। দশ দিনের মধ্যে চাকরিতে জয়েন করতে হবে, পোস্টিং দুর্গাপুর।
দশ দিনের আগেই এক ভালো দিন দেখে চাকরিতে জয়েন করলাম। অফিস থেকে ব্যাচেলার হোস্টেল অ্যালট করল। সব সিনিয়র দাদা। বাড়ি ছেড়ে কোনদিন থাকি নি। তাই একটু অসুবিধা প্রথম প্রথম বেশ হচ্ছিল। আমার রুমমেট ছিল দেবু পুরো নাম দেবপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। খুব মজাদার ছেলে - সে দু'বছর আগে জয়েন করেছে। দেবুর একটা সুন্দর Yezdi বাইক ছিল। আমার অফিসে যাওয়া আসার কোন অসুবিধা হচ্ছিল না। অফিসের পর আমরা হোস্টেলে ক্যারাম, টেবিল টেনিস খেলতাম মজা করে। দেবু রাজবাঁধ গ্রামে তার মামার বাড়ি কথা প্রায়ই বলতো। আমাদের অফিস থেকে খুব জোর কুড়ি কিলোমিটারের মধ্যেই হবে, সে প্রায়ই মামার বাড়ির গল্প বলতো। কিন্তু আমাদের সময় কোথায়? সোমবার থেকে শুক্রবার অফিস, শনিবার বাড়ি ফেরা। আবার সোমবার ভোর বেলায় ব্ল্যাক ডায়মন্ডে ফিরতাম।
- "মা একটা প্যাকেট পাঠিয়ে দিয়েছে মামার বাড়িতে পৌঁছাতে হবে, যাবি তো ?" দেবু বলল
- "কখন যাবো বল তো?" আমি উত্তর দিলাম
-"একদিন ম্যানেজ করে টিফিনের পর বেরিয়ে যাব।"
- "ঠিক আছে অনুমতি নিতে হবে।"
একদিন অনুমতি নিয়ে ওর বাইকে করে মামার বাড়ি পৌঁছালাম। ওই গ্রামের মধ্যে এত সুন্দর বাড়ি যে থাকতে পারে আমার ধারণা ছিল না। বিরাট দু মহলা বাড়ি, চারিদিকে ইটের পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। পূর্ব দুয়ারী দালানটার সামনে ছিল মস্ত বড় উঠোন। উঠোনটা দুপাশে ছিল লম্বা টানা দুটো দোতলা ঘর বাঁদিকের ঘরে রান্না বান্না হত আর ভাঁড়ার থাকতো। ডান দিকের ঘরে রাত্রিবেলায় শোয়া হতো। ডানদিকে লম্বা ঘরখানার সঙ্গে লাগোয়া, দুদিক দরজাওয়ালা একখানা ঘর ছিল। সেই ঘর দিয়ে বার মহলে যাওয়া হত বলে বলা হতো চলন ঘর। ঘরখানা পড়েই থাকতো।
আলাপ পরিচয়ে মামাবাবু জানালো, তার পাঁচ ছেলের মধ্যে এখন মাত্র দুই ছেলে আর পাঁচ বৌমার মধ্যে মাত্র এক বউ মা বেঁচে আছে। বাড়ির গিন্নি তো অনেক আগেই মারা গেছে। আমার প্রচুর জমি সম্পত্তি কিন্তু ভোগ করার লোক কই? এইতো গত বছরে এক সামান্য জ্বরে ছোট নাতি মারা গেল। কি হচ্ছে কে জানে, হতাশার সুরে বলল।
রাত আটটার মধ্যে আমাদের ডিনার হয়ে গেল। আমরা ফিরতে চাইলাম। রাত্রিবেলা ফেরা ঠিক হবে না, জানালো। অগত্যা রাতে থাকতে হল। আমাদের দোতালায় একটা ঘরে থাকতে দিল। মামাবাবু আমাদের বারবার বলে দিলেন,
-" ঘরের লাইট বন্ধ করবে না। কেউ দরজায় ধাক্কা দিলে খুলবে না। সব জানালা বন্ধ রাখবে।"
- "চারিদিকে বন্ধ। কেউ যদি ডাকে, বাড়ির লোক ছাড়া কেই বা ডাকবে?" প্রশ্ন করলাম।
- "আমাদের বাড়িটা তো ফাঁকা জায়গায়। হাওয়া বইলে মনে হয় কেউ যেন দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। সুতরাং দরজা না খোলাই ভালো। আর জানালা দিয়ে মাঝে মাঝে সাপ ঢুকে পড়ে। একটু সাবধানে থাকাই ভালো।"
যুক্তিটা মানতে পারছিলাম না তবুও আমরা ঠিক আছে, ঠিক আছে বলে সম্মতি দিলাম।
আমরা রাত নটার মধ্যে শুয়ে পড়লাম। এত তাড়াতাড়ি শোয়ার অভ্যাস আমাদের ছিল না। লাইট জ্বালিয়ে শুয়ে ছিলাম। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। কে যেন দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। প্রথমে আস্তে আস্তে দিচ্ছিল - পরে একটু জোরে জোরে আওয়াজ করে ধাক্কা মারছিল। মনে হচ্ছে যেন দরজাটা না ভেঙে পড়ে। আমরা দুজনেই বিছনার ওপর বসে বসে চিন্তা করছি কি হতে পারে? আমরা জোরে জোরে জিজ্ঞাসা করছি, কে আপনি কে ? কোন উত্তর নেই।
ঘড়ি দেখলাম - রাত দুটো। এ যদি এখনকার সময় হতো, আমরা মোবাইল ফোনে মামা বাবু বা অন্যান্য আত্মীয়দের সাথে কথা বলে নিতে পারতাম। সেই সুযোগ তখন ছিল না।
দরজা ছেড়ে এখন জানালায় ধাক্কা মারছে। জানলাটা ছিল নিচের দিকে কাঠ , আর ওপরের দিকে কাঁচ। আমাদের ঘর থেকে কাঁচে হাতের ছাপ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে এক মেয়ের কান্নার গোঙানি শব্দ পাচ্ছিলাম অপরপ্রান্ত থেকে। আমরা কি করব ঠিক করতে পারছিলাম না। আমরা দুজন তো আছি চিন্তা কিসের, চল দরজা খুলে দেখি ,দেবু আমাকে বলল । হঠাৎ দেখি, জানলার কাঁচের ওপর এক কঙ্কাল হাত। দেখে আমরা চমকে উঠি! আমার একে অপরকে জড়িয়ে ধরে, রাম রাম করতে লাগলাম। প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেছিলাম। শীতের রাত আমরা প্রচন্ড ঘামছিলাম।
সকালে উঠে মামাবাবুকে আমাদের রাতের অভিজ্ঞতার কথা শোনালাম। বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয় শুধু বলল, " ও তাই।" আমাদের বাড়িতে এসব মাঝে মাঝেই ঘটে। ভয়ের কিছু নেই। খুব সম্ভবত ওটা ছিল আমার মেজ বৌমার আত্মা। কাউকে কিছু ক্ষতি করে না, ও শুধু ভয় দেখায়। আমার মেজ বৌমার মৃত্যুটা অনেকটা নাকি ভৌতিক। আর মৃত্যুর তিন মাস আগে এই বাড়িতেই একদিন দুপুর বেলায় যখন কেউ ছিল না হঠাৎ কিছু দেখে মূর্ছিত হয় পরে। তখন সব জানালা বন্ধ থাকলেও সামনের দিকে হল ঘরের একটা জানলা হঠাৎ খুলে যায় আর সেই খোলা জানালা দিয়ে বরফের মত সাদা লম্বা একটা হাত বেরিয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে তাকে। তা দেখে ভয়ে খুব জোর একটা চিৎকার করে মাটিতে অচৈতন্য হয়ে লুটিয়ে পড়ে। চিৎকার শুনে বাইরে থেকে লোকজন ছুটে এসে চোখে মুখে জল দিয়ে জ্ঞান ফেরায়। এই ঘটনার তিন মাসের মধ্যেই মৃত্যু হয় বৌমার।
- "আপনাদের ভয় করে না?" প্রশ্ন করলাম
- "কিসের ভয়, কেন ভয় ? যত ভয় পাবে, ভয় তত চেপে বসবে," মামা বাবু দৃঢ় কন্ঠে বললেন। অনেকদিন ঠাকুর নারায়ণের পুজো দেওয়া হয়নি। তার ব্যবস্থা করতে হবে।
আমরা আর কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম অফিসের দিকে। এক নতুন অভিজ্ঞতা।
গতরাতের ঘটনা কোন বুদ্ধি দিয়ে বিশ্বাস করতে পারি না, যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারি না। এক জীবনগত অভিজ্ঞতায় যে পরম বিশ্বাস আমি সেদিন অনুভব করেছিলাম, সেই বিস্ময়ের অনুভূতি আমার মনের মণিকোঠায় এক অক্ষয় রত্ন রূপে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে আজও। আর থাকবেও চিরদিন।
--------------------------------------
শ্যামল হুদাতী
357/1/13/1, Prince Anwar Shah Road
Kolkata - 700068
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন