মুন্নি আজ সবার আগেই টিয়াদের বাগানে এসে অন্যদের আসার অপেক্ষায় একটা জায়গায় বসে আপন মনে খেলা করছিলো। পাপা, ঝুনু আর জুন এখনো এসে হাজির হয় নি। টিয়া এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। এরা সবাই এসে জোটে টিয়াদের বাগানে লুকোচুরি খেলতে। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসার পূর্বেই যে যার বাড়ি ফিরে যায়। টিয়াও তার ঘরে ঢুকে পড়ে।
আজ মুন্নি একটু আগেই চলে এসেছে। টিয়ার মা, জেঠীমা মুন্নিকে একটা গাছের তলায় একা একা খেলতে দেখেছে। জেঠীমা টিয়ার মাকে বললো,
"টিয়াকে ডেকে দাও না। একজন জুটি তো আগেই এসে আপন মনে খেলে যাচ্ছে।" টিয়ার মা টিয়াকে ডেকে দিলো। টিয়া উঠে চোখেমুখে জল দিতে গেলো। মা বললো, " দুধটা খেয়ে যাস।"
— না, এখন দুধ খাবো না। দুধ খেয়ে খেলতে গেলে গা গুলোয়। বমি আসে। আমি খেলে এসে খাবো।
এদিকে মুন্নি হঠাৎ যেন দূরে গাছ -গাছালির মধ্যে একটা ময়ূরকে নাচতে দেখলো। এতো দিন ও এই বাগানে আসছে ময়ূর তো দূরের কথা,কোন জন্তু জানোয়ারকে ও দেখে নি, এক ছাগল ছাড়া। এই অপূর্ব দৃশ্য দেখার জন্য সে দৌড়ালো। যতো সে এগিয়ে যায়, ময়ূটাও ততো পেছিয়ে যায়। এগোতে এগোতে ওই বিস্তীর্ণ বাগানের একদম কোণের দিকে গিয়ে অবশেষে মিলিয়ে যায়। আর ফিরে আসে না।
টিয়া বাগানে এসে দেখে মুন্নি নেই। জেঠীমাকে বলে," তুমি যে বললে, মুন্নি এসে বসে আছে। একা একা খেলছে।" জেঠীমা বাইরের রোয়াকে বেরিয়ে এসে বললো, " ঐ তো ওখানে বসে খেলছিলো। কোথায় গেলো? হয়তো চলে গেছে হবে।" এমনসময় পাপা, ঝুনু আর জুন এসে হাজির হলো।
টিয়া এদের জিজ্ঞেস করলো,
" এই তোরা মুন্নিকে দেখেছিস?"
ওরা সমস্বরে বললো," কই না তো।"
— তা হলে বাড়ি চলে গেছে হবে। যা না ডেকে আন না।
একজন দৌড়ালো মুন্নির বাড়িতে। জিজ্ঞাসা করাতে মুন্নির মা বললো, " কই,
মুন্নি তো আসে নি। ওদের বাগানে নেই?"
—না, নেই বলেই তো খুঁজতে এলুম।
—তোরা কোথায় ছিলি?
— আমরা তো পরে গেছি। গিয়ে ওকে দেখতে পাইনি। তাই তো দেখতে এলাম।
—দেখো দিকি মেয়েটা গেলো কোথায়?
মুন্নির মা দেখতে গেলো ওর পিছনে পিছনে। সবাই মিলে খোঁজাখুঁজি করেও মুন্নিকে পাওয়া গেলো না। মুন্নির মা কান্নাকাটি শুরু করে দিলো। প্রতিবেশীদের মধ্যে একটা হুলস্থুল পড়ে গেলো," মেয়েটা চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে গেলো! বয়স্ক কেউ একজন বলে উঠলো," আরে ওদের ছোট বউটার বড় মেয়েটা তো এইভাবেই কোথায় চলে গেলো। জায়গাটা তো ভালো নয়। জায়গাটার দোষ আছে। কেন যে তোমরা পাঠাও কে জানে।"
মুন্নির বাবা কাজ থেকে ফিরে যখন শুনলো যে মুন্নি জমিদারদের বাগান থেকে উধাও,মুন্নির মাকে খুব বকাবকি করলো, "তোমাকে কতোদিন বলেছি ওদের বাগানে খেলতে পাঠাবে না। জায়গাটা ভালো নয়। এবার হলো তো!"
টিয়া, মুন্নি, পাপা, ঝুনু আর জুন এরা সকলেই প্রায় সমবয়সী। সকলের বয়স এই আট থেকে দশ বছরের মধ্যে। টিয়ারা জমিদার। বিশাল বাগান আর পুরানো আমলের বিশাল বাড়ি। কিন্তু হলে কি হবে লোকজন কম। যেন ভুতূড়ে বাড়ি। বাড়িটার বাইরের দেওয়ালের অধিকাংশ জায়গার পলেস্তারা খসে খসে পড়ছে। মুন্নি, পাপা, ঝুনু ও জুনরা টিয়াদের ঠিকা প্রজা। টিয়ার ঠাকুরদা ছিলেন তখনকার দিনের একজন প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক স্বর্গীয় গঙ্গাধর মুখোপাধ্যায় যাঁর পিতা ছিলেন বেণীমাধব মুখোপাধ্যায়। ওনার নামেই রাস্তাটার নাম হয় বেণীমাধব মুখার্জ্জী লেন। বাড়ির গেটের পর থেকে বাগানের কিয়দংশ জুড়ে ছিলো গঙ্গাধর ডাক্তারের ডিসপেনসারি। দূরবর্তী জেলাগুলো থেকে রোগীরা আসতো। বাগানের সামনেটা ভীড় করতো। যদিও অনেকগুলো লম্বা লম্বা কাঠের ও লোহার চেয়ার ছিলো। চেয়ারগুলো ভর্তি হয়ে গিয়ে বাগানের গাছের তলায় সব লাইন দিয়ে বসতো। অনেক ভোরে বাড়ি থেকে বের হতো বলে কেউ রুটি কেউ মুড়ি বেঁধে আনতো। বসে খেতো। আর গেটের বাইরে মিউনিসিপ্যালিটির একটা টিউবওয়েল ছিলো, সেখান থেকে জল খেতো।
গঙ্গাধর ডাক্তারের দুই ছেলে। বড়ো ছেলের ডাক নাম ছিলো স্যান্ডো। ভীষণ খিটখিটে ধরনের লোক ছিলেন। পেশায় ছিলেন প্রফেসর। তাঁর এক ছেলে গোপাল ও এক মেয়ে বুলবুলি। গোপাল লন্ডনে পড়াশোনা করে ওখানেই থেকে গিয়ে মেম বিয়ে করে দুটি যমজ সন্তান সহ একবার এসেছিলো কিন্তু বেশিদিন টিকতে পারে নি। বালিগঞ্জে বাড়ি ভাড়া নিয়ে বসবাস করছিলো। তারপর থেকে তার আর কোন খোঁজ খবর পাওয়া যায় নি। স্যান্ডোবাবু কেন জানি না মেয়ে বুলবুলির বিয়ে দিলেন একজন বয়স্ক ও কিছুটা অসুস্থ পাত্রের সঙ্গে । অথচ এমন নয় তিনি খুব ধনী ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। এতো গেলো স্যান্ডোবাবুর পরিচয়। এবার আসি গঙ্গাধর ডাক্তারের ছোট ছেলে ছেলুবাবুর কথায়। ছেলুবাবু ছিলেন অ্যালুপ্যাথী ডাক্তার। তিনিও ছিলেন রোগাক্রান্ত, খিটখিটে স্বভাবের। ওনার প্রথম কন্যা ময়না ছয় বছর বয়সে ওই বাগান থেকেই নিখোঁজ হয়ে যায়। কোন কিনারা করা যায় নি। কোন তান্ত্রিক বলেছিলো ওকে কোন অশুভ আত্মা তুলে নিয়ে গেছে। যদিও স্যান্ডো বা ছেলুবাবু এসব বিশ্বাস করেন না। ওনারা ডাক্তারের ছেলে , তার ওপর নিজেরাও প্রফেসর, ডাক্তার। বিশ্বাস না করাটা স্বাভাবিক।
গঙ্গাধর ডাক্তারের স্ত্রী অর্থাৎ স্যান্ডবাবু ও ছেলুবাবুর মা অনেক বয়স পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। শোনা যায় বাগানে বাঁধা ছাগলের গলার দড়ি পায়ে জড়িয়ে পড়ে মারা যান। মরার মতো চোট বা আঘাত তিনি পেয়েছিলেন কিনা জানিনা না তবে মরার জন্যই যেন মরে ছিলেন। তাঁর স্বভাবও ছিলো লোক দেখলেই খ্যাঁক খ্যাঁক করা। সবচেয়ে ভাববার বিষয় হলো — ওনাদের বাড়ির পিছনে ওনাদের যে জ্ঞাতি বাস করতো, তাঁরাও ছিলেন দুই ভাই। তাঁরা অর্ধ-মস্তিষ্কবিকৃতসম্পন্ন বয়োবৃদ্ধ মানুষ। বড়ো ভাই বড়ো একটা বাইরে বের হতো না। এদের দুজনের বৈশিষ্ট্য ছিলো, কি শীত কি গ্রীষ্ম খালি গায়ে থাকা। ছোট ভাই বাইরে বের হলে পাড়ার বাচ্চা বাচ্চা ছেলেপুলেরা বলতো," ও হোল্লার দাদু, একটু বাতকর্ম করো না, করো না গো।" হোল্লার দাদু অমনি তার বগলটা বাজিয়ে দিতো। এদের বংশে বাতি দেবার কেউ ছিলো না।
ফিরে আসি মুন্নির কথায়। মুন্নি অন্তর্হিত হওয়ার পর সবার খেলা উঠলো মাথায়। অন্যান্য দের মায়েরাও গেটের কাছে এসে যে যার ছেলেমেয়েদের ডেকে নিলো আর বললো,
" এখানে আর খেলতে আসতে হবে না। এখানে ভূত আছে। মুন্নির মতো তোদেরও এক এক করে তুলে নিয়ে যাবে। তখন বুঝবি!"
আর একজনের মা বলে উঠলো, "জানেন তো দিদি, আমাদের মেয়েটাকে কতো বারণ করি, এখানে খেলতে না আসার জন্য। তবু কি শোনে কথা।" দ্বিতীয় একজন মা বললেন," ওরাই বা কি করবে বলুন। কাছে পিঠে তো একটা পার্কও নেই যে খেলবে। " তৃতীয় একজন বললেন, "পার্কে পাঠিয়েও কি নিস্তার আছে। কতো চিন্তা —এই কিছু একটা হলো বুঝি! এই তো দেখলেন, পাড়ার মধ্যে থেকেই গায়েব হয়ে গেলো। যার গেলো তার গেলো।"
সেদিন থেকে বাগানে আর কেউ আসে না। জমিদার বাড়ির গিন্নীদের মনে পড়ে গেলো টিয়ার দিদির উধাও হয়ে যাবার ঘটনা। কালের নিয়মে বিস্মৃতপ্রায় ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো। কালক্রমে স্যান্ডবাবূ, ছেলুবাবু মারা গেলেন। এমন কিছু মারা যাবার মতো বয়স ও কঠিন ব্যাধি তাঁদের হয়নি। বুলবুলি ফিরে এলো বিধবা হয়ে। টিয়ার এলো ধূম জ্বর। মাথায় রক্ত উঠে মারা গেলো। বাড়ি আর বাগান এখন মৃত্যুপুরী। তিনজন বিধবা সেই মৃত্যুপুরীতে যক্ষের ধন আগলে মৃতের তালিকায় নাম লিখিয়ে দিন গুনছে।
এলাকার বয়স্ক লোকেদের বলতে শোনা যায,"প্রবাদ আছে— ওই বাগানটি নাকি এক সময় শ্মশান ছিলো। তাই সে অনেক দিন আগে। শ্মশান বন্ধ হয়ে গিয়ে বাগানে পরিণত হয়েছে। সুতরাং মৃত আত্মারা ওখানে ঘোরাঘুরি করবে এটা তো স্বাভাবিক। এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ গঙ্গাধর ডাক্তারের পরিবারের সদস্যদের অস্বাভাবিক ও মর্মান্তিক জীবনযাত্রা ও তার ভয়ঙ্কর পরিণতি , বংশের বাতি দেবার কেউই থাকলো না। কেন গোপাল হারিয়ে গেলো? কেন স্যান্ডোবাবু, ছেলুবাবু ও তাঁদের মায়ের মেজাজটা খিটখিটে ছিলো? কেন তাঁদের মুখে কোন হাসি ছিলো না? কেন তাঁদের বিশেষ কোন রোগ না থাকা সত্বেও অসুস্থ মনে হতো? কেন একজন বয়স্ক ও অসুস্থ উর্দ্ধতন কর্মকর্তা কিংবা ধনী না হওয়া সত্বেও বুলবুলির সঙ্গে বিবাহ হলো এবং কোন সন্তানাদি হওয়ার আগেই তাকে বিধবা হয়ে ফিরে আসতে হলো? টিয়ার দিদি ময়না উধাও হলো কেন? কেন টিয়া একদিনের জ্বরে মারা গেলো? কেন বংশে বাতি দেবার কেউ রইলো না? সর্বোপরি মুন্নিকে হারিয়ে যেতে হলো কেন?— এই প্রশ্নগুলোই কি ভৌতিক প্রভাবের ফলশ্রুতির প্রমাণ দেয় না?
============================
Samir Kumar Dutta
23/1/A, Mohanlal Bahalwala Road
P.O. Bally, Dist. Howrah 711201
Mobile no. 9051095623 (WhatsApp)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন