প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় ৪১ ।। এপ্রিল ২০২৫

শহরের এক কোণে পুরনো একটি দোতলা বাড়ি। চারদিকে গাছপালায় ঘেরা, রাত হলে জায়গাটা আরও বেশি ভয়ানক মনে হয়। এখানে থাকে কিশোর রহিত আর তার পোষা বিড়াল 'স্নো'। রহিতের বাবা-মা দুজনই গবেষক, তাই বাড়ির নিচতলায় তাদের বিশাল লাইব্রেরি আর ল্যাবরেটরি। স্নো শুধু সাধারণ বিড়াল নয়, তার কিছু অদ্ভুত বুদ্ধিমত্তা আছে। রহিত মাঝেমধ্যে মনে করে, স্নো যেন সবকিছু বোঝে! একদিন শহরে একের পর এক চুরির ঘটনা ঘটতে শুরু করল। সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো, চোরেরা কোনো দরজা বা জানালা ভাঙে না, কিন্তু মূল্যবান জিনিস উধাও হয়ে যায়। পুলিশ হিমশিম খাচ্ছে, কিন্তু কোনো সূত্র খোঁজে পাচ্ছে না। রহিত এই সমস্যাটা নিয়ে ভাবতে শুরু করল। রাতে যখন সে পড়ার টেবিলে বসে, স্নো এসে টেবিলের ওপর লাফিয়ে উঠল। হঠাৎ করেই সে জানালার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। রহিত জানালা দিয়ে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেল না, কিন্তু বিড়ালটা যেন কিছু একটা টের পেয়েছে।
পরদিন সকালে রহিত এক চাঞ্চল্যকর খবর পেল—তার পাশের বাড়ির বিজ্ঞানী রফিকের গবেষণাগার থেকেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি চুরি হয়েছে! রহিত আর স্নো তখনই সেখানে ছুটল। রফিকের বাড়িতে ঢুকেই রহিত চারপাশ খেয়াল করতে লাগল। কিন্তু কিছুই সন্দেহজনক মনে হলো না। হঠাৎ স্নো মিউ মিউ করে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করল। সে সোজা জানালার পাশে গিয়ে থামল, তারপর মেঝের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় থাবা দিয়ে ঘষতে লাগল। রহিত সেখানে হাত দিয়ে দেখতেই বুঝল—মেঝেতে ক্ষীণ একটা দাগ! সে রফিককে জানাল, "স্যার, এখানে একটা গোপন দরজা থাকতে পারে!" রফিক অবাক হয়ে বললেন, "আমার তো জানা নেই এখানে কিছু আছে!"
সবাই মেঝেতে ঠোকাঠুকি করতেই খচ করে একটা শব্দ হলো। সত্যিই একটা গুপ্ত দরজা! দরজাটা খুলতেই নিচে একটা সিঁড়ি দেখা গেল। রহিত, রফিক আর স্নো ধীরে ধীরে নেমে গেল। সিঁড়ি নেমে রহিতরা একটা ছোট্ট ঘরে পৌঁছাল। ঘরটা অন্ধকারাচ্ছন্ন, কিন্তু স্নো তার চোখ বড় বড় করে সতর্ক দৃষ্টি রাখছিল। হঠাৎই কোণার দিকে থাকা একটা ছায়া নড়ল! রহিত দ্রুত টর্চ জ্বালাতেই দেখা গেল—একজন মুখোশধারী লোক সেখানে দাঁড়িয়ে! লোকটা পালানোর চেষ্টা করতেই স্নো এক লাফে তার হাত আঁচড়ে দিল। ব্যথায় লোকটা চিৎকার করল, আর ঠিক তখনই রহিত তার মোবাইল বের করে পুলিশকে ফোন দিল। পুলিশ এসে ধরা পড়া চোরের মুখোশ খুলে দিল। এটা ছিল রফিকেরই এক সহকারী, যে গোপনে তার গবেষণার মূল্যবান যন্ত্রপাতি চুরি করছিল!
স্নো'র তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আর বিচক্ষণতার জন্য রহিত এই অদ্ভুত সমস্যার সমাধান করতে পেরেছে। পুলিশের অফিসার বিস্ময়ভরে বিড়ালের দিকে তাকিয়ে বললেন, "এমন চতুর বিড়াল আমি আগে দেখিনি!" রফিক স্নো'র মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, "এটা শুধু একটা বিড়াল নয়, এটা একজন প্রকৃত গোয়েন্দা!"রহিত হাসল। তার ছোট্ট সঙ্গী স্নো যে সত্যিকারের বুদ্ধিমান, সেটা আজ সবাই বুঝেছে।
স্নো'র বুদ্ধিমত্তায় রহস্যের সমাধান হয়ে গেলেও রহিতের মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল—চোর কেবলমাত্র গবেষণাগারের জিনিসপত্রই চুরি করছিল কেন? সাধারণ টাকা-পয়সা বা অন্যান্য মূল্যবান জিনিসে তার কোনো আগ্রহ ছিল না! পরদিন সকালে রহিত যখন তার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল, তখন সে খেয়াল করল—স্নো ছাদে বসে নিচের গলির দিকে তাকিয়ে আছে, ঠিক আগের রাতের মতো। রহিত কৌতূহলী হয়ে নিচে নেমে গেল। গলিতে গিয়ে দেখে, একটা কালো গাড়ি ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে। রহিত সন্দেহ করল, কিন্তু গাড়ির নম্বর ভালো করে দেখতে পেল না। ঠিক তখনই স্নো গলির এক কোণে দৌড়ে গেল এবং থামল একটা কাগজের টুকরোর সামনে।
রহিত কাগজটা হাতে নিতেই চমকে উঠল। সেখানে একটা ম্যাপ আঁকা, আর কিছু গাণিতিক সংকেত লেখা!রহিত ম্যাপটা নিয়ে রফিকের কাছে গেল। "রহিত তখনই বুঝতে পারল, চোর কেবল একজন সাধারণ সহকারী ছিল না। তার পেছনে আরও বড় কেউ আছে, যে গবেষণার গোপন তথ্য হাতিয়ে নিতে চাচ্ছে! স্নো তখন রহিতের পাশে এসে তার লেজ দোলাতে লাগল, যেন ইঙ্গিত দিচ্ছে—"এই রহস্য এখনও শেষ হয়নি!"
রহিত আর রফিক তখনই পুলিশের কাছে গেল। তারা ম্যাপটা পরীক্ষা করল, কিন্তু বুঝতে পারল না এটি কোথাকার। পুলিশের এক অফিসার বললেন, "এটা কোনো গোপন গবেষণাগারের মানচিত্র হতে পারে। তবে কোথায়, সেটা বের করতে হবে!"রহিত বাড়ি ফিরে স্নো'র দিকে তাকিয়ে বলল, "তুই না থাকলে তো আমরা কিছুই বুঝতে পারতাম না, বন্ধু!" স্নো মিউ মিউ করে সাড়া দিল, তারপর জানালার পাশে গিয়ে বসে বাইরে তাকাতে লাগল।
রাত বাড়তেই রহিত লক্ষ্য করল, স্নো আবার জানালার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রহিতও এক ঝলক বাইরে তাকিয়ে দেখল—একজন কালো পোশাকধারী লোক তার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে! সে দ্রুত মোবাইল বের করে ছবি তুলতে গেল, কিন্তু তখনই লোকটি গলির অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
"ব্যাপারটা ধীরে ধীরে বিপদ জনক হয়ে উঠেছে ," রহিত নিজেকে বলল। পরদিন সকালে সে রফিকের সাথে ম্যাপের গাণিতিক সংকেত বিশ্লেষণ করতে বসল। হঠাৎই রহিত চমকে উঠল! "স্যার, এই সংকেত তো জিপিএস কোঅর্ডিনেটের মতো দেখাচ্ছে!"
সংকেত বিশ্লেষণ করে রহিত বুঝতে পারল, এটি শহরের অদূরে একটি পরিত্যক্ত কারখানার অবস্থান দেখাচ্ছে। "আমাদের সেখানে যাওয়া দরকার!" রহিত বলল। রফিক কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, কিন্তু রহিতের আত্মবিশ্বাস দেখে রাজি হলেন। পুলিশের সাহায্য নিতে তারা দেরি করল না। রাতের বেলা রহিত, রফিক, চারজন পুলিশ অফিসার, আর অবশ্যই স্নো, সেই পরিত্যক্ত কারখানার দিকে রওনা দিল। গাড়ি থেকে নেমেই স্নো দ্রুত ছুটে গিয়ে মিউ মিউ করতে লাগল। সে কারখানার এক গোপন দরজার সামনে গিয়ে থামল।
"এই দরজার পেছনেই কিছু একটা আছে!" রহিত ফিসফিস করে বলল। পুলিশ দরজাটি খুলতে গেল, ঠিক তখনই ভেতর থেকে আওয়াজ এল—
"তোমরা ভুল জায়গায় চলে এসেছো!"
অন্ধকার কারখানার ভেতর থেকে ভেসে আসা গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনে সবাই থমকে গেল। পুলিশের অফিসাররা অস্ত্র হাতে প্রস্তুত হলো, আর রহিত স্নোকে বুকে জড়িয়ে ধরল। "তোমরা চলে যাও, নাহলে পরিণতি ভালো হবে না!"—ভেতর থেকে আবার শোনা গেল।
পুলিশ কোনো কথা না বলে দরজা ঠেলে খুলে ফেলল। বিশাল ঘরটার মধ্যে কয়েকজন মুখোশধারী লোক দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সামনে বড় একটা টেবিল, যেখানে কিছু যন্ত্রপাতি ছড়িয়ে আছে। রহিত এক ঝলকে বুঝতে পারল—এগুলো চুরি হওয়া গবেষণার যন্ত্রপাতি!
হঠাৎ স্নো মিউ মিউ করতে করতে রহিতের কোল থেকে লাফিয়ে পড়ল। সে সোজা ছুটে গিয়ে টেবিলের ওপর থাকা একটা কন্ট্রোল প্যানেলে থাবা দিয়ে আঘাত করল! এক মুহূর্তের মধ্যেই প্যানেল থেকে আগুনের ফুলকি ছিটকে বের হলো, আর কারখানার বিদ্যুৎ চলে গেল!
ঘোর অন্ধকারে মুখোশধারীরা হতবিহ্বল হয়ে পড়ল।
"এটাই সুযোগ!"—পুলিশের অফিসার ফিসফিস করে বললেন। পুলিশ দ্রুত টর্চ জ্বালিয়ে অপরাধীদের ঘিরে ফেলল। মুখোশধারীরা পালানোর চেষ্টা করল, কিন্তু স্নো এবার আরেকটা চাল দিল—সে একজনের পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আঁচড়ে দিল। ব্যথায় লোকটা চিৎকার করে পড়ে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ তাকে ধরে ফেলল। বাকি সবাইকেও দ্রুত পাকড়াও করা হলো। পুলিশ তাদের হাতকড়া পরিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল।
একজন মুখোশধারী স্বীকার করল, "আমরা এই প্রযুক্তি বিক্রি করার জন্য চুরি করেছিলাম। কিন্তু তোমাদের বুদ্ধিমান বিড়াল আমাদের সব প্ল্যান নষ্ট করে দিল! "পুলিশের অফিসার আফজাল বিস্মিত হয়ে স্নো'র দিকে তাকিয়ে বললেন, "এমন চতুর বিড়াল আগে দেখিনি!"
সকালবেলা পুলিশের গাড়িতে অপরাধীরা ধরা পড়ে চলে গেল। রফিক যন্ত্রপাতি ফিরে পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।
রহিত স্নোকে কোলে নিয়ে বলল, "তুই না থাকলে আমরা কিছুই পারতাম না, বন্ধু!"
স্নো মিউ মিউ করে রহিতের গালে মুখ ঘষে দিল, যেন বলছে—"তোমার ওপর আমার ভরসা আছে!"
=================
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন