
এসো হে বৈশাখ
তপন তরফদার
পৃথিবীর আর্বতন গতির সঙ্গে তাল রেখে মানুষের মন মেজাজ এগিয়ে যায়। সামাজিক পরিবর্তন হয়। সভ্যতা সংস্কৃতি ও পাল্টে যায়। গোলক ঘোরাঘুরি করে গোলকধাঁধার সঙ্গী হয়ে সময় এগিয়ে যায়। সময়কে কেউ ধরে রাখতে পারে না। সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয় প্রাণীকুল। আপাত দৃষ্টিতে জড় বস্তুর পরিবর্তন হয়না। চমকিত ঘটনা আমাদের চোখে ধরা পরে। কোভিড১৯ ভাইরাস কত রুপে পরিবর্তিত হয়ে পৃথিবীকে ঘোল খাওয়াচ্ছে। জড় বস্তুরা কিন্তু ঘটনার সাক্ষী থেকে যায়।
অনেক বাড়ি আছে যার অন্দরে পুরানো বাতাস ঘুরপাক খায়। মনে করিয়ে দেয় আদিকালের ইতিহাস।যে মনে করিয়ে দিতে পারে একশো বছর আগের স্প্যানিশ ফ্লু। এই ধরনের এক বাড়ি দেখতে পাওয়া যাবে কাশি মিত্তির ঘাট থেকে নরেন দাস রোড দিয়ে কয়েক পা হাঁটলেই গঙ্গার কান ঘেঁষে। ওটা মিন্টুদের বাড়ি। মিন্টুর ভালো নাম মুকুল রায়। মুকুল ক্লাস সেভেনে পড়ে। গড়পরতা বাড়ি থেকে ওদের বাড়িটা আলাদা। অনেক সেকেলে, বাড়ির ঢোকার মুখেই দেউড়ি। দেউড়ির মাথায় দুদিকে চুন-সুরকির মন্ড দিয়ে তৈরি করা সিংহ লেজ উচিঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জরাজীর্ণ সিংহের কেশর খষে গিয়ে সুরকির লাল আভা দেখা যাচ্ছে। মুকুলের দাদু সুধাংশবাবু বলে থাকেন ওদের পূর্বপুরুষ ইংরেজদের কাছ থেকে রায় বাহাদুর উপাধি পেয়েছিল।তখন ওরা নুনের ব্যবসা করত। নুনের আড়ত ছিল গঙ্গার ঘাটে।
মুর্শিদাবাদের কর্ণসুবর্ণ গ্রামে ওদের বাগানবাড়ি, চাষের জমি আছে। কলকাতার বাড়িতে অনেক পুরনো ঐতিহাসিক জিনিস ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। দেউড়িতে ঢুকতেই দেখা যায় দেওয়ালে একটা গোল চাকা আটকানো আছে। ওটা ঘোড়ার গাড়ির চাকা। মুকুলদের বাড়িতে এককালে ফিটন গাড়ি ছিল। ওই গাড়ি চালাতে কর্ণসুবর্ণ থেকে কোচোয়ান আসতো। দাদু শুভ্রাংশুর সাথে মুকলের পুরানো দিনের গল্প হয়। মুকুল ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। আমব্দেকার এর জন্মদিনে ওদের স্কুল ছুটি থাকে। ওর এক বন্ধু বলেছে এবার নববর্ষের দিন আমব্দেকারের জন্ম দিন। নববর্ষের দিনই আমব্দেকারের জন্ম তিথি পড়েছে। মুকুল দাদুকে প্রশ্ন করে, নববর্ষ মানে নিউ ইয়ার, নতুন বছর। নতুন বছরতো র্ফাস্ট জানুয়ারি। এপ্রিল মাসে কেন। দাদু বলে বাংলা নববর্ষের বাংলা সনের প্রথম মাস বৈশাখ মাস। পয়লা বৈশাখ। বৈশাখ মাসের প্রথম দিনকে বলা হয় নববর্ষ। সেদিন থেকে নতুন বাংলা সন শুরু হয়। মুকুল বলে "এসো হে বৈশাখ এসো এসো" গান শুনেছি। মুকুল দাদুকে প্রশ্ন করে, সন কি। দাদু বলে সন মানেই বৎসর। বাংলা সন কিভাবে শুরু হয় তা নিয়ে অনেক কাহিনী আছে। তবে বিশ্বাসযোগ্য কাহিনী হচ্ছে, সম্রাট আকবর যার সূচনা করেন। পনেরশ ছিয়াত্তর খ্রিস্টাব্দে বাংলায় মুঘল সাম্রাজ্যের অঙ্গীভূত করে নাম দেয়া হয় "সূবা বাংলা"। ফসল কাটার মরশুমে খাজনা আদায়ের জন্য বঙ্গাব্দের সূচনা, যার নাম 'ফসলি সন'। ফসলি মানে ফসল বা শস্য। ফসলি আরবি শব্দ। আকবরের দরবারে বিশিষ্ট জ্যোতিষশাস্ত্রবিদ পণ্ডিত আমির ফতেহউল্লাহ সিরজি বাংলা নববর্ষের বা নতুন সন গণনার রীতি উদভাবন করেছিলেন। সরকারি নির্দেশনামা জারি হয় ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে আকবরের সিংহাসনে আরোহণের বছরে। মুল হিসাব দাঁড়ায় খ্রিস্টাব্দের সঙ্গে বঙ্গাব্দের বয়স ৫৯৩ বছর কম। আমাদের বাড়িতেও নববর্ষ পালন করা হতো। হালখাতা হতো। মুকুলের কানে হালখাতা শব্দটা খটমট লাগে। প্রশ্ন করে, হালখাতা কি? নৌকায় হাল থাকে জানি। ওর সঙ্গে কি কোনো সম্পর্ক আছে। ওটা কি খুব বড় খাতা। দাদু হো হো করে হেসে উঠে। মুকুলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ওইসব ইংরেজি স্কুলে পড়াশোনার ফলে নিজেদের কৃষ্টি ভুলে যাচ্ছে এই প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা। জেনে রাখ হালখাতর চলন হয় ব্যবসার স্বার্থে। আকবর যেমন খাজনা আদায় করার জন্য ফসলের অপেক্ষা করতো আমরাও বছরের প্রথম দিনে যারা ধারে গস্ত করতো তাদের থেকে ধার বাকির টাকা আদায় করার জন্য এই হালখাতার প্রচলন। মুকুল বলে এখনো হালখাতা হয়। দাদু বলে, হালখাতা হয়। শহরের কিছু কিছু দোকানে এখনও পয়লা বৈশাখে হালখাতা হয়। আর জেনে রাখ, আকবরের নাতি শাজাহান প্রথম সাত দিনের এক সপ্তাহ শুরু করেন এবং শুরু হয় রবিবার সোমবার মঙ্গলবার এইরকম ক্রম অনুযায়ী।
( ২)
দাদু মুকুলকে দেশের বাড়ি কর্ণসুবর্ণতে নিয়ে আসে ওকে আমাদের বর্ষ বিদায় ও নববর্ষের উৎসব দেখাতে, পরিচিত হতে। মুকুল শহরের মেলা দেখেছে, এ এক অন্য ধরনের মেলা। চৈত্র সংক্রান্তির মেলা। মানুষ সন্ন্যাসী হয়ে চড়ক দন্ডে ঘুরপাক খাচ্ছে। শহরের মিলনমেলায় কয়েকটা মেলা মুকুল দেখেছে কিন্তু আদিগন্ত এমন খোলামেলা মেলা দেখেনি।
পয়লা বৈশাখের দিন দাদু ওকে নিয়ে যায় রসূল মিঁয়ার কাপড়ের দোকানে। দোকানের মাথায় টিনের সাইনবোর্ড। যেখানে হলদে রঙের লেখা "আধুনিক বস্ত্র বিপনী।" মুকুল মনে মনে হেসে ওঠে আধুনিক কথাটা দেখে। ।দোকানটায় দরমার বেড়া, টালির ছাদ। শিরীষ কাঠের দেওয়ালে পেরেকে হ্যঙ্গার দিয়ে টাঙানো কিছু ফ্রক,ছোটোদের জামা। একটা আলমারিতে হরেক রকমের শাড়ি সাজানো আছে। কাঁচের পাল্লা দিয়ে শাড়ি দেখা যাচ্ছে। রসূল মিঞার মুখে লম্বা দাড়ি, বক পাখির মতো লম্বাটে নাক, চোখে গোল রিমের চশমা, মাথায় ফেজের টুপি। দেখলেই বোঝা যায় ধর্মপ্রাণ মুসলিম মানুষ। মুকুলের মনে খটকা লাগে ও জানে নববর্ষ হিন্দুদের উৎসব। ফিসফিস করে কানে কানে মুকুল দাদুকে কথাটা বলে। দাদু নিচু স্বরে বলে নববর্ষ সবার উৎসব। সব জাতি ভেদ দূর করার উৎসব এই নববর্ষের উৎসব। রসুল মিঞা দাদুকে দেখেই এক মুখ হাসি দিয়ে বলে আসেন কর্তা আসেন আমার কি সৌভাগ্য আপনার পায়ের ধুলো পড়েছে আমার দোকানে। বসেন কর্তা বসেন। রাস্তায় কোন অসুবিধা হয়নি তো। এ নিশ্চয়ই আপনার নাতি। খুবই ভালো হলো। ভবিষ্যতের খরিদ্দার। রশুল মিয়া গলাছেড়ে হাঁক পাড়ে, এই হিরূ কর্তাকে আমাদের নাতি মেহেমান কে শরবত দে। চৌকির উপরে একটা ছোট্ট জল চৌকি যা সাদা মোটা সুতোর ক্রুশের কাজ করা কাপড় দিয়ে ঢাকা। চৌকির ওপরে কাঠের হাত বাস্ক। দুটো কাচের গ্লাসে সবুজ শরবত আসলো। মুকুল একটা চুমুক দিয়ে আনারস আনারস গন্ধ পেল। সুস্বাদু শরবত।
মুকুল দেখছে একটা অ্যালমনিয়ামের ড্রামে কি সব গুলে শরবত তৈরি হচ্ছে। লালসালুতে মোড়ানো বরফের খন্ড দেখা যাচ্ছে। দোকনের সামনে লাল-হলুদ গাঁদাফুলের মালা টাঙানো। লোকজনেরা রশুল মিঞাকে টাকা দিচ্ছে। উনি সবার হাতে হাসিমুখে এক বাস্কো মিষ্টি আর নতুন সনের বাংলা ক্যালেন্ডার তুলে দিচ্ছে। লম্বাটে একটা লাল খাতার পাতায় কে কত টাকা দিচ্ছে লিখে রাখছে। দাদু বললো ওই খাতাটিকে বলে হালখাতা। হাল মানে এখন।। এই সময়ের। নতুন খাতা দিয়ে শুরু হয় হালখাতা। মুকুলের এক অন্যধরনের অনুভূতি হয়। একজন আতরদানি দিয়ে মুকুলের জামায় ছিটিয়ে দেয়। রজনীগন্ধার গন্ধে ম ম করতে থাকে মুকুলের সারা দেহ। দাদু বলে এই রীতি অনেক পুরনো, অতিথিদের গায়ে আতর, সুগন্ধি ছিটয়ে দেওয়া।
দাদুর সব ভালো, কিন্তু দাদুর একটা বদ অভ্যাস আছে অন্যের বাড়িতে গেলে অসতর্ক মুহূর্তে ওই বাড়ির 'পেন' পকেটে পুরে নেয়। মুকুল জানে স্কুলের স্যার বলেছে এটা একটা রোগ নাম মনে হয় বলেছিলেন ক্রিপ্টোম্যানিয়া। রসূল মিঞা লালচে হলুদ রঙের কলমে সবুজ কালি দিয়ে লিখে রাখছিল। কলমটা রেখে তদারকি করতে অন্যদিকে উঠে গেছে। মুকুল দেখে দাদু পেনটা খপ্ করে পাঞ্জাবির পাশ পকেটে ঢুকিয়ে নেয়। রসূল মিঞা তার আসনে এসে আবার বসল। খদ্দের যেই টাকা দিল তখনই পেন খুঁজতে শুরু করে দিলো লেখার জন্য। কর্মচারী হিরুকে বকাবকি করতে থাকে। হিরু অন্য একটা কলম এগিয়ে দেয়। রসূল মিঞা বলে, জানিস না আমি পয়লা বৈশাখে ওই সবুজ কালি দিয়ে লিখি।এই গরমে র সময়ে সবুজের ছোঁয়া চোখে আরাম আনে। আজকের দিনে শুভ কালি সবুজ কালি। মুকুল কি করবে ভাবতে শুরু করে। রসূল মিঞা ভালো লোক, দাদু আরো ভালো, এই একটা সুযোগ, হয়তো দাদুর রোগ ভালো হয়ে যাবে। মুকুল বলে রসূল জেঠু আমি ম্যাজিক করে আপনার কলম এনে দেবো। মন্ত্র পড়তে শুরু করে মুকুল, গিলি গিলি গিলি ফোকাস। গিলি গিলি গিলি আয় লালচে-হলুদ কলম আয়, বলতে বলতে দাদুর পকেটে হাত ঢুকিয়ে কলমটা বার করে রসুলের হাতে তুলে দেয়। রসূল মিঞা আনন্দে মুকুলের হাত জড়িয়ে ধরে বলে ধন্যি -ধন্যি আমাদের ছোট বাবু। বাবু ছোট হলেও মস্ত বড় জাদুগর।
দাদু সব বুঝতে পারে মুকুলকে ফিসফিসিয়ে বলে দাদুভাই নতুন সনে আমি নতুন করে নিজেকে খুঁজে পেলাম । আর কখনো ওই কাজ করবোনা। নববর্ষের মনের হালখাতায় বড়ো বড়ো অক্ষরে খোদাই করে রাখলাম।সারা জীবন মনে থাকবে এই নববর্ষের যাদু। রসুল মিঞার দোকানের রেডিওতে বেজে উঠেছে, এসো হে বৈশাখ... ...এসো এসো, বৎসরের আর্বজনা দুর হয়ে যাক, যাক, মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জ্বরা।
==============
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন