সাগরের হাতছানি
মিঠুন মুখার্জী
ছোট্ট আরাধ্যা সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখে ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি খুবই পছন্দের তার। মাত্র দশ বছর বয়সে অনেক জায়গায় ঘুরেছে আরাধ্যা। বৃষ্টির দিনে সমুদ্রে যেতে আরাধ্যার খুব ভালো লাগে। শুধু আরাধ্যা নয়, সকলেরই খুবই ভালো লাগে। এ পর্যন্ত দীঘা ও পুরীতে চারবার গেছে। বাবার অফিসের ছুটি পেলেই দুই-তিন দিনের জন্য তারা ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে। অনেক দিন ধরে বিশাখাপত্তনমে যাওয়ার ইচ্ছা তার মনে বারবার জেগে উঠছিল। পাহাড় আর সমুদ্রের মেলবন্ধন একবারে দেখতে চায় সে। আর প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য মনোমুগ্ধকর। এরই মধ্যে দুই-তিন দিন স্বপ্নে বিশাখাপত্তনমে পৌঁছে গিয়েছে সে। সমুদ্রের নীল জলে স্নান থেকে শুরু করে পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য, মন্দির, জাহাজ বন্দর, আরাকু ভ্যালি সবই দর্শন করেছে সে। তবে বাস্তবে একবারও সেখানে যাওয়া হয়নি।
হাওড়া থেকে ট্রেনে মাত্র চোদ্দ ঘন্টা যাত্রা। হাতের নাগালে এত সুন্দর জায়গা দর্শন--- না গেলে ঠিক রসাস্বাদন সম্ভব নয়। বৃষ্টির জন্য বাবা কৌশিক সেন সেদিন অফিস যাননি। টাটা কোম্পানিতে চাকরি করেন তিনি। ঘুমের থেকে উঠে আরাধ্যা সোজা বাবার ঘরে এসে কান্না জুড়ে দেয়। কান্নার কারণ বাবা জানতে চাইলে সে ভাইজ্যাক যাওয়ার কথা জানিয়ে বলে---"আজ আর আমি তোমার কোনো কথাই শুনছি না। আমাকে আজ ভাইজ্যাক নিয়ে যেতেই হবে। তুমি আমাকে প্রত্যেকবার কথা দাও , কিন্তু কথা রাখো না।" বাবা বুঝতে পারেন, এতদিন নানান কথা বলে মেয়েকে থামানো গেলেও আজ বুঝি তা আর সম্ভব হবে না। তাই আর প্রতিশ্রুতি না দিয়ে বললেন--- " ঠিক আছে, আগামী পরশুর তিনটি তৎকাল টিকিট আমি আজই কেটে নিচ্ছি। এবার আর তোকে আশাহত করব না।" বাবার এই কথা শুনে আরাধ্যা আনন্দে লাফিয়ে ওঠে। দৌড়ে গিয়ে বাবাকে একটা হামি দিয়ে বলে---" আমি খুব খুশি বাবা। তুমি আমার পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো বাবা।"
কৌশিক সেন তার কথা মতো তিনটি তৎকাল টিকিট কেটে নিয়ে অফিস থেকে তিন দিনের ছুটি মঞ্জুর করিয়ে বিশাখাপত্তনমের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। আরাধ্যার মা বিদিশা সেন গৃহবধূ হওয়ায় আর কোনো সমস্যায় তাদের পড়তে হয়নি। টিকিট কাটার পর দিন লাগেজে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দেখে শুনে গুছিয়ে নেন তিনি। যেদিন তাদের যাত্রা সেই দিনও সকাল থেকে মুষলধারায় বারিবর্ষণ হচ্ছিল। বিকেলবেলা হাওড়া স্টেশন থেকে তাদের ট্রেন। হাতে কিছুটা সময় নিয়ে কিছু শুকনো খাবারসহ নিজেদের গাড়ি করে হাওড়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে তারা। ড্রাইভার অনেক আগেই এসেছিল। সারা রাস্তা আরাধ্যা গাড়ির কাঁচ দিয়ে বাইরের বৃষ্টি দেখছিল। মুষলধারায় বৃষ্টি পড়তে দেখে তার ভিজতে ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু ঘুরতে যাওয়ার কারণে তা সম্ভব হয়ে ওঠে নি। রাস্তার উপর কয়েকটি পাখিকে ভিজতে দেখে খুব আনন্দ পায় সে। মনে মনে ভাবে আমিও যদি ওদের মতো বৃষ্টিতে ভিজতে পারতাম। দুপুর দুটোর মধ্যে তারা হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে যায়। তখনও ট্রেনের ঘন্টা দুয়েক দেরি। দুপুরের খাবার তারা হাওড়া স্টেশনের 'জনআহার' থেকে সেরে নেয়।
বিকেল পাঁচটা নাগাদ ট্রেন ছাড়ে। আধা ঘন্টা আগে প্লাটফর্মে ট্রেন এলে লাগেজগুলো ট্রেনে তুলে তারা সকলে যে যার সিটে গিয়ে বসে। এসি টু টিয়ারে তারা যাত্রা করেছিল। ঠান্ডাটা বেশি লাগায় আরাধ্যা তার মার কাছে চেয়ে একটা চাদর গায়ে দিয়ে বসে। করমন্ডল এক্সপ্রেসে আরাধ্যারা বিশাখাপত্তনমে যাত্রা করেছিল। উড়িষ্যার কটক থেকে একটা পরিবার ট্রেনে ওঠে। তারাও বিশাখাপত্তনমে ঘুরতে যাচ্ছে। একটি দশ-এগারো বছরের ছেলে ও তার বাবা-মা এই পরিবারের সদস্য ছিল। ট্রেন ভুবনেশ্বরে এলে আরাধ্যারা রাতের খাবার খেয়ে নেয়। ট্রেনের ক্যান্টিন থেকে রুটি, চানা মশলা ও ডিমের কারি নিয়েছিল তারা। আরাধ্যাদের সঙ্গে কটক থেকে ওঠা পরিবারের আলাপ হয়। কথা প্রসঙ্গে আরাধ্যার বাবা ছেলেটির বাবাকে তার নাম ও পেশা জিজ্ঞাসা করেন। আগন্তুক লোকটি আরাধ্যাদের সঙ্গে তার পত্নী ও ছেলের পরিচয় করিয়ে বলেন--- 'তিনি সুরেশ সাহু, পত্নী অঞ্জনা সাহু ও ছেলে বিদেশ সাহু। তিনি ন্যাবাডে চাকরি করেন। তিন দিন অফিসে ছুটি পাওয়ায় ছেলে বউকে নিয়ে ভাইজ্যাক ঘুরতে যাচ্ছেন।' কৌশিক সেনও তাদের সম্বন্ধে সবকিছু তাকে জানান। রাত এগারোটার সময় লাইট বন্ধ করে তারা সকলে শুয়ে পড়েন।
ভোর পাঁচটার সময় আরাধ্যার ঘুম ভেঙে যায়। এসির কাঁচের মধ্য দিয়ে বাইরের দৃশ্য একদৃষ্টিতে দেখতে থাকে। বিদেশও একটু পরেই ঘুম থেকে উঠে যায়। তাদের দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। বিদেশ উড়িয়া হলেও বাংলা বুঝতে ও বলতে পারত। সেই কারণেই দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব হতে বেশি সময় লাগেনি। সাতটার মধ্যে বাকিরা সবাই উঠে পড়েন। ক্যান্টিনে কফি অর্ডার দেন। কফি পান করেন সকলে। আবার আড্ডা জমে যায়।
ট্রেন একটু লেট থাকায় সকাল আটটার বদলে নটার সময় বিশাখাপত্তনম স্টেশনে পৌঁছায়।দুই পরিবার ইতিমধ্যে মনস্থির করে নেন, তারা একই হোটেলে উঠবেন এবং একই সঙ্গে ঘুরবেন। আরাধ্যাও গল্প করার সঙ্গী পাবে, বড়রাও তাই। সমুদ্র তটের কাছেই ছয় তলা একটা ঝা চকচকে হোটেলে সমস্ত লাগেজপত্র নিয়ে ওঠেন তারা। সকাল এগারোটা নাগাদ সমুদ্র স্নানে যান দুই পরিবারের সদস্যরা। আরাধ্যা ও বিদেশ সমুদ্র স্নানের লোভটা সামলাতে পারেনি। অসাধারণ ঢেউ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। আরাধ্যার শরীরে সমুদ্রের জল লাগায় রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছিল। আকাশে ঘন মেঘ দেখা গিয়েছিল। দেখতে দেখতে বৃষ্টি নেমে এলো। বৃষ্টিতে সমুদ্রের চেহারা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল। বাবার হাত ধরে বিদেশ ও আরাধ্যা স্নান করে ও প্রচন্ড আনন্দ অনুভব করে। ছোটবেলা থেকেই জল দেখলে আরাধ্যা ঠিক থাকতে পারে না। জলের প্রতি একটা গভীর টান অনুভব করে সে। তাই বাবা-মা তাকে খুব সাবধানে ও চোখে চোখে রাখার চেষ্টা করে সবসময়।
প্রায় দু'ঘণ্টা সমুদ্র স্নান সেরে হোটেলে ফিরেছিল সকলে। এই আনন্দ ভোলার নয়। বিকেলবেলা জাহাজ বন্দরে ঘুরতে যায় তারা। বিশাল বড় বড় জাহাজ দেখে আরাধ্যা ও বিদেশ অবাক হয়ে যায়। শিশু মনের কৌতূহল নিয়ে বাবা ও মাকে তারা বিভিন্ন প্রশ্ন করে। তারাও তাদের প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দান করেন। সমুদ্র সৈকতের পাশে একটা সাবমেরিন ছিল। টিকিট কেটে সকলে সাবমেরিনের ভেতর ঢুকেছিল। সন্ধ্যের টিফিন হিসাবে বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ ভাজা খেয়েছিল সকলে। রাত দশটা পর্যন্ত সমুদ্র সৈকতের মনোমুগ্ধকর পরিবেশে কাটিয়ে হোটেলের ফিরে যায় তারা।
পরদিন সকাল সকাল স্নান সেরে একটা বুলেরো গাড়ি ভাড়া করে বিশাখাপত্তনমের সাইড সিন দেখতে যায় সকলে। পাহাড়ের উপর শিব-পার্বতীর মন্দির, দক্ষিণী ফিল্ম স্টুডিও, সামরিক মিউজিয়াম, আরো অনেকগুলি অসাধারণ জায়গায় গিয়েছিল সবাই। বেশিরভাগটাই ছিল সমুদ্র ও পাহাড়ের মিলনের স্থল। একসাথে পাহাড় ও সমুদ্র দেখার আনন্দ আরাধ্যা এই প্রথম অনুভব করে। তাদের সঙ্গে ক্যামেরাও ছিল। প্রায় পাঁচশোর মতো ছবি তুলেছিল তারা। শিব-পার্বতীর মন্দিরে গিয়ে আরাধ্যা ও বিদেশ টয়ট্রেনে চড়েছিল। মেয়ের আনন্দ দেখে কৌশিক সেন ও বিদিশা সেন খুবই খুশি হয়েছিলেন। সারাদিন ঘুরে হোটেলে ফিরে আসতে সন্ধ্যা সাতটা বেজে যায়। আরাধ্যার বাবা বলেছিলেন--- "তোমাদের যা যা কেনার আছে আজই সেরে নাও। কাল আরাকু থেকে ফিরতে দেরি হয়ে গেলে কেনাকাটা আর হবে না। পরশু সকাল আটটার সময় আমাদের ফেরার ট্রেন।" বাবার কথা মতো আরাধ্যা ও তার মা সমুদ্র সৈকতের পাশের একটা মার্কেটে যায়। সুরেশ সাহুরাও তাদের সঙ্গে কেনাকাটা করেন ।
রাত্রি নটা নাগাদ কেনাকাটা শেষ করে সকলে সমুদ্র সৈকতে বসেছিল। সমুদ্রের হাওয়া লাগছিল গায়ে। সমুদ্রের গর্জন কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছিল। সমুদ্র সৈকতের পাশেই কলকাতার দক্ষিণেশ্বরের আদলে একটা কালী মায়ের ছোট মন্দির ছিল। আরাধ্যা ও বিদেশ সেখানে যাওয়ার জন্য বায়না জুড়ে দেয়। অধৈর্য হয়ে তারা সকলে সেই কালী মায়ের মন্দিরে যায়। সেখানে কয়েকজন বাঙালির সঙ্গে পরিচয় হয় তাদের। কৌশিক সেনের সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরের মন্দির নিয়ে বিভিন্ন কথাবার্তা হয়। গত দিনের মতো এদিনও রাত দশটার সময় হোটেলে ফেরে তারা। ঘুমোতে ঘুমোতে রাত বারোটা বেজে যায়।
পরদিন সকাল সাতটার মধ্যে তৈরি হয়ে রেলস্টেশনে পৌঁছে যায় তারা। ট্রেন ধরে আরাকুর উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। আরাকু পৌঁছতে প্রায় দশটা বেজে যায়। ছোট ছোট অনেকগুলি গুহা, জলপ্রপাত, আরো অনেক কিছু দেখার আছে সেখানে। চোখ যেন জুড়িয়ে যায়। অসাধারণ সুন্দর দৃশ্য সব। বিশাখাপত্তনমে ঘুরতে এসে আরাকু ভ্যালি না গেলে ঘোরা অপূর্ণ থেকে যাবে। সারাদিন ঘুরে বিকেল পাঁচটা নাগাদ আরাধ্যারা ভাইজ্যাকে ফিরে আসে। সারাদিনের যাত্রা মূলত বন্ধুর এলাকায় হওয়ায় শরীর তাদের ঠিকমতো চলছিল না। সমুদ্র সৈকতে এসে ঘন্টাখানেক সময় এক জায়গায় বসে সকলে বিশ্রাম নেয়। সমুদ্রের বাতাস সমস্ত ক্লান্তি দূর করে দেয়। আরাধ্যার মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। বাবা বলেন--- "তোর কি হয়েছে মা? এত চুপচাপ রয়েছিস কেন? তুই তো এরকম থাকিস না!" বাবার প্রশ্নের উত্তরে আরাধ্যা জানায়--- "বাবা আর কয়েকদিন এখানে থেকে যেতে ইচ্ছে করছে। যেতে একেবারেই ইচ্ছে করছে না। কিন্তু আমি জানি আমাদের ফেরার ট্রেনের টিকিট কাটা। তোমার অফিস রয়েছে।" মেয়ের কথা শুনে কৌশিক সেন বলেন ---"আমি তোর মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। মন খারাপ করিস না। আমরা সামনের বছর আবার আসবো।" বাবার কথা শুনে আরাধ্যা খুব খুশি হয়। রাতের খাবার হোটেল থেকে খেয়ে 'সাগরিকা লজে' তারা ফিরে যায়।
রাতেই আরাধ্যারা তাদের লাগেজপত্র গুছিয়ে নেয়।বিদেশদের বিকেল বেলায় ট্রেন হওয়ায় তারা সকালে গোছানোর পরিকল্পনা করে। রাত বারোটায় শুতে যায় আরাধ্যারা। সকলের ঘুম এলেও আরাধ্যার কিছুতেই ঘুম আসেনা। বাড়ি ফেরার চিন্তায় বারবার মনটা বিষাদগ্রস্ত হয়ে ওঠে। পরদিন সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে স্টেশনে যাওয়ার জন্য গাড়ি এসে যায়। লাগেজ তুলে গাড়িতে ওঠার সময় আরাধ্যা সমুদ্রের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। ছেড়ে যেতে মন চায় না তার। বিদেশকে টাটা দেয় সে। তাদের ফোন নাম্বারও নিয়ে নেয়। আরাধ্যা যখন গাড়িতে উঠে স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়, তখন মন থেকে সমুদ্রের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে--- "আবার আসবো বন্ধু। আবার আসবো।" প্রিয় বিচ্ছেদের জন্য মানুষের যেমন অবস্থা হয়, তেমনি অবস্থা হয়েছিল আরাধ্যার। বাড়ি ফিরলেও আরাধ্যার বারবার মনে হতো সমুদ্র তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। বিশাখাপত্তনমের স্মৃতি তার মনে দীর্ঘদিন ধরে উজ্জ্বল হয়ে ছিল।
__________________________________________________________________________________
মিঠুন মুখার্জী
C/o -- গোবিন্দ মুখার্জী
গ্ৰাম -- নবজীবন পল্লী
পোস্ট + থানা -- গোবরডাঙা
জেলা -- উত্তর ২৪ পরগনা
পিন -- ৭৪৩২৫২
[ছবি: ইন্টারনেট মাধ্যম থেকে সংগৃহীত]
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন