Featured Post

লেখা-আহ্বান : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫ সংখ্যার জন্য

ছবি
     মুদ্রিত  নবপ্রভাত  বইমেলা ২০২৫ সংখ্যার জন্য  লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি মুদ্রিত  নবপ্রভাত  বইমেলা ২০২৫ সংখ্যার জন্য  প্রবন্ধ-নিবন্ধ, মুক্তগদ্য, রম্যরচনা, ছোটগল্প, অণুগল্প, কবিতা ও ছড়া পাঠান।  যে-কোন বিষয়েই লেখা যাবে।  শব্দ বা লাইন সংখ্যার কোন বাঁধন  নেই। তবে ছোট লেখা পাঠানো ভালো (যেমন, কবিতা ১২-১৪ লাইনের মধ্যে, অণুগল্প কমবেশি ৩০০/৩৫০শব্দে)। তাতে অনেককেই সুযোগ দেওয়া যায়। সম্পূর্ণ অপ্রকাশিত লেখা পাঠাতে হবে। মনোনয়নের সুবিধার্থে একাধিক লেখা পাঠানো ভালো। তবে একই মেলেই দেবেন। একজন ব্যক্তি একান্ত প্রয়োজন ছাড়া একাধিক মেল করবেন না।  লেখা  মেলবডিতে টাইপ বা পেস্ট করে পাঠাবেন। word ফাইলে পাঠানো যেতে পারে। লেখার সঙ্গে দেবেন  নিজের নাম, ঠিকানা এবং ফোন ও whatsapp নম্বর। (ছবি দেওয়ার দরকার নেই।) ১) মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখবেন 'মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা সংখ্যা ২০২৫-এর জন্য'।  ২) বানানের দিকে বিশেষ নজর দেবেন। ৩) যতিচিহ্নের আগে স্পেস না দিয়ে পরে দেবেন। ৪) বিশেষ কোন চিহ্ন (যেমন @ # *) ব্যবহার করবেন না। ৫) লেখার নীচে একটি ঘোষণা দিন:  'লেখাটি স্বরচিত ও অপ্রকাশিত'। মেল আইডি :  printednabapravat@

ছোটগল্প ।। শিশির পড়ার শব্দ ।। সোমা চক্রবর্তী


শিশির পড়ার শব্দ

 

  সোমা চক্রবর্তী


মিতুল বারান্দায় মাদুরে শুয়ে শুয়ে চাঁদটা দেখছিলো। আজ পূর্ণিমা নয়। অর্ধেকটা চাঁদ সেই আকাশের কোণায় দেখা দিয়েছে মাত্র কিছুক্ষণ আগেই। ভাঙা চাঁদের ঘোলাটে আলোয় আকাশটা এখন অল্প উজ্জ্বল।‌ বাবা এখনো ফেরেনি। ঠাকুমা চোখে চশমা লাগিয়ে হ্যারিকেনের আলোয় সুর করে রামায়ণ পড়ছে আর মাঝে মাঝে উসকে দিচ্ছে হ্যারিকেনের পলতেটা। মিতুলের দাদা মহুল কাছেই পারাবত মাস্টারের বাড়িতে পড়তে গেছে। মা এখন রান্নাঘরে। মিতুল জানে, চাঁদটা এখন মাঝ আকাশের দিকে গুটি গুটি পায়ে, নিঃশব্দে এগিয়ে যাবে। তার সাথে একটু একটু করে শেষ হয়ে যাবে রাতটা। দূরে ফসলের ক্ষেত। তার ওপরে ছড়িয়ে রয়েছে তরল অন্ধকার। তার ঠিক পাশেই বাঁশ বাগান। মিতুল হঠাৎ মাথাটা তুলে ঠাকুমাকে জিজ্ঞেস করলো,
- আমাদের সেই শহরের বাড়িতে এখন কারা থাকে গো, ঠাকুমা?
- জানি না তো, দিদি।
ঠাকুমা তোবড়ানো গালে হেসে বলেন। মিতুল বলে,
- ওই জায়গাটা এরকম চুপচাপ না, তাই না ঠাকুমা?
- হ্যাঁ। ওখানে বড়ো শোরগোল।
- এখানে কেমন গাছের পাতার ওপর শিশির পড়ার শব্দ শোনা যায়, না গো? তুমি শুনেছো ঠাকুমা?
মিতুলের কথায় ঠাকুমা হাসেন। ওদের কথা শুনে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে মা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মিতুলের দিকে। তারপর জিজ্ঞেস করলো,
- পাতার ওপর শিশির পড়ার শব্দ?
মিতুল অদ্ভুত চোখে তাকালো মায়ের দিকে। তারপর বললো,
- ওমা, তুমি শোনো নি কখনো?
- কই না তো?
আঁচলে হাত মুছতে মুছতে মা বললো। মিতুল বললো,
- যখন রাত আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যায়, চারদিকটা কেমন ঠান্ডা হয়ে যায়, তখন ভেজা ভেজা হাওয়ায় ভেজা ভেজা গন্ধ। তখনই পাতার ওপর শিশির পড়ে খুব আস্তে আস্তে, টুপ টুপ করে। সেই শব্দ শোনা যায় তো!
মা হেসে বললো,
- তুই কেমন করে জানলি? দেখেছিস কখনো?
- ঘুম না এলে, জানলা দিয়ে দেখি তো!
বলতে বলতে মিতুল অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো। এখানে আসার পর প্রথম প্রথম ওর ঘুম আসতো না রাতে, কিম্বা অনেক রাতে কেমন করে যেন ভেঙে যেতো ঘুমটা। রাত তখন ক'টা, ও আন্দাজও করতে পারতো না। সারাদিনের পরিশ্রমের পর গভীর রাতে অকাতরে ঘুমোয় মা। মহুলও মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে অঘোরে ঘুমিয়ে থাকে। বাবার নাক ডাকে মৃদু মৃদু। বাইরে তখন অদ্ভুত সব শব্দ শোনা যায়। ঠাকুমা বলে, ওগুলো নাকি রাত্রির শব্দ। তার কতগুলো মিতুল বুঝতে পারে, কতগুলো পারে না। ও আস্তে আস্তে ঠাকুমার বিছানায় গিয়ে ঠাকুমার গা ঘেঁষে শুয়ে পড়ে। টের পেয়ে ওকে কাছে টেনে নিতে নিতে ঠাকুমা বলেন,
- ঘুমোসনি দিদি?
মিতুল তখন ঠাকুমার গলাটা জড়িয়ে ধরে ঠাকুমার গায়ের গন্ধ পেতে চায়। ঠাকুমার গায়ে কেমন যেন ধূপধুনো আর ফুলের মিশেল গন্ধ একটা। পূজো পূজো ভাব। তখন ওর মনে হয়, বাবা, মা আর দাদাকে নিয়ে যদি ও এক্ষুনি ঠাকুমার সাদা কাপড়টার মধ্যে লুকিয়ে পড়তে পারতো, তবে বেশ হতো! ওখানে কোনো ভয় নেই। বিশ্ব সংসারে ঠাকুমার কোলটাই ওর কাছে একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়। ওর মনের ভাব বুঝতে পেরে, ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ঠাকুমা জিজ্ঞেস করেন,
- কি হয়েছে দিদি?
- ঘুম ভেঙে গেলো, ঠাকুমা। বাইরে ওগুলো কিসের শব্দ?
- বাইরে এখন রাত্রির রাজ্য চলছে তো? এসব তারই শব্দ। যারা ঘুমিয়ে থাকে, এই সময়তেই স্বপ্নপরীরা এসে তাদের ঘুম চোখে স্বপ্ন দিয়ে যায়। তারা চাঁদের থেকে নেমে আসে।

তারপর ঠাকুমা ওকে কতো রাজ্যের কতো গল্প বলেন মৃদু স্বরে। তার কিছু কিছু মিতুল শোনে, আর কিছু গল্প শেষ হবার আগেই ও ঘুমিয়ে পড়ে। এই সময় ঠাকুমার গলার স্বর অদ্ভুত মিষ্টি লাগে মিতুলের। এই গল্পের স্বাদ একা মিতুল ছাড়া আর কেউ পায় না। বাবা না, মা না, এমনকি দুষ্টু দাদাটাও না। মিতুল তাই ঠাকুমার দিকে তাকিয়ে এবার হাসলো। রহস্যজনক ভাবে বললো,
- মা জানে না, তাই না ঠাকুমা? শুধু তুমি আর আমি জানি, কখন পড়ে শিশির!
বাইরে থেকে বাবার গলা শোনা গেলো,
- মিতু মা...
মিতুল এক লাফে উঠোনে এসে দাঁড়ালো। বাবা মহুলকে নিয়ে ফিরেছে। মহুল ব্যস্ত হয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা মায়ের কাছে এসে বললো,
- মা, ভীষণ খিদে পেয়েছে। শিগগিরই খেতে দাও।
তারপরই ঠাকুমার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
- তুমি একা একা ওকে সব গল্প বলে দাওনি তো?
- না রে দাদুভাই।
ঠাকুমা মহুলকে নিবিড় করে জড়িয়ে ধরেন।
- তাহলে বলো, সেই শাওনপুরের রাজপুত্র আর ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমীর গল্পটা!

অমনি ঠাকুমার ঝুলি থেকে বেরিয়ে আসে অপরূপ এক রূপকথার রাজ্য। এ রাজ্যের কারিগর তিনি নিজে। তিনিই পোটো, আবার তিনিই  এর সমঝদার। দুই ভাইবোন গল্পে একেবারে মশগুল হয়ে পড়ে।

**

অসিতাভ হাতের ব্যাগটা নিয়ে রান্নাঘরের দাওয়ায় গিয়ে বসলো। সারাদিনের মধ্যে এই সময়টাতেই সাংসারিক বিষয় নিয়ে আলোচনা চলে সুপর্ণার সঙ্গে। বেশ কিছুদিন হয়ে গেলো, সময়টা ওদের ভালো যাচ্ছে না। বাবা মারা যাওয়ার পর, দেশের বাড়ি ছেড়ে সপরিবারে কলকাতায় চলে গিয়েছিলো অসিতাভ। সম্বল বলতে ছিল কারখানার চাকরিটা। সুপর্ণা তখন সবে নতুন এসেছে এই সংসারে। মস্ত বড়ো মোটর পার্টসের কম্পানি, রমরমিয়ে চলছিলো সবকিছু। কিন্তু হঠাৎ একদিন দুম করে বন্ধ হয়ে গেলো অতো বড়ো কম্পানিটা। হরতাল, মিটিং, মিছিল, জমায়েত, ইউনিয়ন সবকিছুই চলতে লাগলো দিনের পর দিন। টেনেটুনে দুটো বছর অপেক্ষা করতে পেরেছিলো অসিতাভ। না খুললো অতো বড়ো কম্পানি, না জুটলো অন্য কোথাও অন্য কোনো কাজ। তাই শেষ পর্যন্ত, একরকম বাধ্য হয়েই, ফেলে যাওয়া পৈতৃক ভিটেতেই আবার ফিরে এসেছে সকলে মিলে। ভাঙাচোরা বাড়িটাকে টুকটাক মেরামত করে সেখানে সংসার পেতেছে নতুন করে। অসিতাভর মা অবশ্য এতে খুশীই হয়েছেন। চারদিকে সব চেনাজানা লোকজন। এই সবুজডাঙাতেই ওঁর প্রায় সারাটা জীবন কেটেছে। এখানকার সবকিছু ওঁর চেনা, জানা, আপনার। শুধু সুপর্ণার মনের কথা বুঝতে পারে না অসিতাভ। কখনো কোনো অভিযোগ করে না সুপর্ণা। সবসময় মুখে হাসি লেগেই থাকে। খুশী হয়েছে ছেলেমেয়েরাও। মহুলকে স্কুলে ভর্তিও করে দেওয়া হয়েছে। মিতুল পরের বছর ভর্তি হবে। সেই স্কুল, যেখানে অসিতাভর ছোটবেলা কেটেছে। 

সামান্য কিছু জমিজমা ছিল। এতোদিন ভাগ চাষীদের দিয়ে চাষ করাতো অসিতাভ। ফিরে এসে এখন নিজেই দেখাশোনা করছে। বেশ উৎসাহ পেয়ে গেছে। নিজে হাতে চাষ আবাদ শিখতে চেষ্টা করছে। অনভ্যস্ত শরীরে ক্লান্তির ছাপ। তার মধ্যেই চলে নিত্যনতুন পরিকল্পনা এই সবুজডাঙাকে ঘিরে। অসিতাভ ঠিক করেছে, মহুলকে এগ্রিকালচার নিয়ে পড়াশোনা করতে বিদেশে পাঠাবে। এর মধ্যে অনেক বার কথাটা বলেই ফেলেছে সুপর্ণাকে। "জানো তো, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নিজের ছেলেকে এগ্রিকালচার পড়ানোর জন্য বিদেশে পাঠিয়েছিলেন। রথী ফিরে এসে দেশের চাষীদের নতুন ভাবে চাষের পদ্ধতি ব্যবহার করতে শেখাবে, তাতে চাষীদের উপকার হবে, ফলন বেশী হবে- এই ছিল ওঁর ভাবনা। আমাদের মহুলও ঠিক তাই করবে।" সুপর্ণা হাসে। মুখে বলে,
- বেশ হবে।
আজ অসিতাভ বললো,
- মিতুলকে ডাক্তার বানাবো, দেখো। ও হবে এই সবুজডাঙার প্রথম মেয়ে ডাক্তার। এখানে ভালো চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। মিতুল অনেক বড়ো ডাক্তার হয়ে এখানকার মানুষের জন্য কাজ করবে।
সুপর্ণা মৃদু হেসে বললো,
- সে ঠিক আছে। কিন্তু তার কি ডাক্তারীর পড়া পড়তে ভালো লাগবে?
- কেন?
অসিতাভ ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো। সুপর্ণা বললো,
- আমার তো মনে হয়, তোমার মেয়ে কবি হবে। তরু দত্তর মতো ইংরেজিতে কবিতা লিখবে।
সুপর্ণার বলার ভঙ্গীতে অসিতাভ হেসে ফেললো। বললো,
- আজ আবার কি বলেছে?
- বলেছে, শিশির পড়ার শব্দ শুনতে পায় ও। সবাই যখন ঘুমিয়ে থাকে, তখন টুপটাপ করে গাছের পাতায় ঝরে পড়ে শিশির।

**
মিতুল এখনো স্কুলে ভর্তি হয়নি। তাই সন্ধ্যা থেকেই ঠাকুমার কাছে গল্প শোনার আসর বসায় রোজ। মাদুরে শুয়ে শুয়ে গল্প শুনতে শুনতে হঠাৎ মিতুল খেয়াল করে, রান্নাঘর থেকে চাল সেদ্ধ হবার গন্ধ ভেসে আসছে। ভাত রান্নার সময় এতো সুগন্ধ পাওয়া যায়, এখানে আসার আগে কখনো জানতোই না মিতুল। ও ঠাকুমাকে জিজ্ঞেস করলো,
- কলকাতায় ভাত রান্না করার সময় এরকম গন্ধ পাওয়া যেতো না কেন, ঠাকুমা?
অসিতাভ উঠোনে ঢুকতে ঢুকতে কথাটা শুনতে পেয়ে উত্তর দিলো,
- এ হলো পাড়া গাঁয়ের জাদু বুঝলি? এইরকম চাল কি আর কলকাতায় পাওয়া যায় রে?
সেই অদ্ভুত গন্ধওয়ালা চালের ভাত খেতে খেতেই ঘুম জড়িয়ে আসে মিতুলের দু'চোখে। তারই মধ্যে ঠাকুমা ওর গায়ের সারাদিন পরে থাকা, ঘামে ভ্যাপসানো জামাটা বদলে দিয়ে, চুলটা আঁচড়ে দেন। মিতুল প্রায় ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই জিজ্ঞেস করে,
- আমি তো এখন ঘুমিয়ে পড়বো। তাহলে এতো কিছু করছো কেন, ঠাকুমা? বেড়াতে না গেলে কি কেউ সাজে?
মিতুলকে কাছে টেনে নিয়ে ঠাকুমা বলেন,
- বেড়াতেই তো যাবি?
- কোথায়?
অবাক হয়ে মিতুল জিজ্ঞেস করে। ঠাকুমা বলেন,
- বাঃ! মনে নেই? ঘুমের দেশে, স্বপ্নের রাজ্যে!
- সত্যি?
- হ্যাঁ, দিদি।
ঠাকুমার চুল আঁচড়ানো শেষ হবার আগেই মিতুল তলিয়ে যায় ঘুমের অতলে।

**
- মিতুল... মহুল... শিগগিরই বাইরে আয়।
বাবার গলা শুনে বিছানায় লাফিয়ে উঠে বসলো মিতুল। উঠোন থেকে ডাকছে বাবা। মহুল আগেই চলে গেছে বাইরে। মিতুল উঠোনে এসে দেখলো, গগন খুড়ো এক হাঁড়ি খেজুরের রস নিয়ে এসেছে সদ্য গাছ থেকে পেড়ে। একদম টাটকা। হিমের মতো ঠান্ডার মধ্যে উঠোনে দাঁড়িয়ে, হিমের মতো ঠান্ডা রস খেতে খেতে দুই পাটি দাঁতে খটাখট আওয়াজ ওঠে মিতুলের। জলের মতো স্বচ্ছ খেজুরের রস। স্টীলের গ্লাস ভর্তি সেই রসের ওপর হালকা হালকা ফেনা ভাসছে। কি তার স্বাদ! কি গন্ধ! মিতুল আর মহুলের কাছে এর স্বাদ সম্পূর্ণ নতুন। ওদের স্বল্প শহুরে জীবন পরিধিতে প্রকৃতির এমন সুরসিক রূপ আগে কখনো ধরা পড়েনি। গ্রামের পথ ধরে মহুল যখন রাঙা ধূলো উড়িয়ে স্কুলে যায়, যখন ও স্কুল ঘর থেকে শুনতে পায় নিস্তব্ধ দুপুরে দূরের মাঠে বিষণ্ণ সুরে ঘুঘু ডাকছে, যখন স্কুলে ছুটির ঘন্টা বাজলেই এক ছুটে ও এসে পথে নামে, আঁকাবাঁকা পথের বাঁকে হঠাৎ যখন দূর থেকে ওদের বাড়িটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে, আবার যখন মিতুল সন্ধ্যা বেলায় একটা একটা করে তারা ফুটতে দেখে আকাশে, যখন আল পেরিয়ে বাবার ক্ষেতের পাশে গিয়ে একা একা দাঁড়িয়ে থাকে, যখন দেখে, ফাঁকা আকাশের মাঝখানে একফোঁটা এক চিল আপন মনে উড়ে বেড়াচ্ছে, আবার যখন বাবা এসে ডাক দেয়, "মিতু মা" বলে, তখন যেমন আনন্দে প্রাণটা ভরে ওঠে, ঠিক সেইরকম, এই হিম ঠান্ডায় বাবা, মা আর ঠাকুমার সঙ্গে কাঁচা মাটির উঠোনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গগন খুড়োর পেড়ে আনা বরফের মতো ঠান্ডা এই অদ্ভুত খেজুরের রস খায়, তখনও ঠিক একই রকম খুশী ওদের পাগল করে দেয়। মহুল মিতুলের কানে কানে ফিসফিস করে বললো,
- এই, আর একটু খাবি?
- তুই খাবি দাদা?
- খুব ভালো খেতে, তাই না রে?
বাবা শুনতে পেয়ে ওদের দুজনের গ্লাসে আর একটু করে রস ঢেলে দিলো। মজা করে খেয়ে নিলো ওরা। 

আস্তে আস্তে শীতের নরম রোদ ওঠে। সকাল গড়ায় দুপুরের দিকে। সূর্যটা একসময় বাঁশ বাগানের মাথার ওপর উঠে যায়। মহুল স্কুলে চলে যায়। বাবা বেরিয়ে যায় ক্ষেতের কাজে। এখানে ওখানে ছুটোছুটি করে, মা আর ঠাকুমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়ে দিনগুলো কেটে যায় মিতুলের। তারপর আবার একসময় সন্ধ্যার অন্ধকার নামে। তখন মা গলায় আঁচল জড়িয়ে, তুলসী তলায় প্রদীপ দেখিয়ে প্রণাম করে, শঙ্খ বাজায়। ঠাকুমা কপালে হাত ঠেকিয়ে কিসের উদ্দেশ্যে যেন প্রণাম করে। ধীরে ধীরে তখন  বাঁশ বাগানের ওপাশে দাঁতনের ঝোপটায়, রাঙামাটির পথে পথে ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে আসে। বিশুদের ঝিলটার জল কুচকুচে কালো হয়ে যায়। একেবারে মিশকালো। যেন আলকাতরার পুকুর একখানা। আগের দিনের কথার খেই ধরে মিতুল তখন ঠাকুমাকে জিজ্ঞেস করে,
- কই, কাল তো তুমি আমাকে স্বপ্নের দেশে নিয়ে গেলে না, ঠাকুমা?
ঠাকুমা হেসে বলেন,
- সে দেশে সবাইকে নিজে নিজে পথ চিনে যেতে হবে যে! আমি তোমাকে কেমন করে নিয়ে যাবো?
মিতুল হতাশ হয়ে পড়ে। বলে,
- যাঃ। আমি যে ভেবেছিলাম, স্বপ্নের দেশে গিয়ে আমি তোমার সঙ্গে ঘুরে বেড়াবো। সেটা কি তাহলে হবে না?
- হতেই পারে। যদি সেই দেশে গিয়ে আমাদের দুজনের দেখা হয়ে যায়।
- স্বপ্নের মধ্যে কি দেখা হতে পারবে না, ঠাকুমা?
মিতুল অত্যধিক আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করে। ঠাকুমা হেসে বলেন,
- কেন পারবে না? ঠিক মতো খুঁজে বের করতে পারলেই হলো।
- আজ তাহলে আমি তোমাকে ঠিক খুঁজে বের করবো। তুমি আমাকে সাজিয়ে দাও তো খুব সুন্দর করে। পরীরা যেন আমাকে নিয়ে যায় ওদের দেশে!
ঠাকুমা হাসেন। মিতুলের কথার উত্তর দেন না।

**
চাঁদের আলোয় ভেজা একটা প্রান্তরের ভেতর দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে মিতুল। ওর গায়ে এখন নীল মেঘের পোশাক। ওমা! এ কি কান্ড! মিতুলের পিঠে কে যেন দুটো ডানাও বেঁধে দিয়েছে। ছোট্ট ছোট্ট, হালকা দুটো ডানা। কিন্তু তবুও মিতুল পায়ে হেঁটে চলছে কেন? ডানা দিয়েও কি উড়তে পারবে না মিতুল? এইসব ভাবনার মধ্যেই কে যেন কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
- ডানা দুটো আস্তে আস্তে নাড়াও। দেখবে, কেমন সুন্দর উড়তে পারবে তুমি।
মিতুল তাকিয়ে দেখলো ওকে ঘিরে রয়েছে এক দল পরী। তারাদের মতো উজ্জ্বল তাদের রূপ, ঝরণার মতোই চঞ্চল তারা, নদীর মতো কুলকুল করে তারা কথা বলছে। পরীরাও সবাই মেঘের পোশাক পরে রয়েছে। মিতুল ওর ডানা দুটো নাড়ানোর চেষ্টা করলো। এই তো! এই তো সে উড়তে পারছে। খুশীতে দুলে উঠলো মিতুল। পরীরা নদীর ঢেউয়ের মতো করে হাসলো। ওরা সবাই মিলে বাতাসে ভেসে ভেসে এগিয়ে চললো। হঠাৎ নীচে একটা সুন্দর বাগান দেখতে পেয়ে কেমন চেনা চেনা লাগলো মিতুলের। তাড়াতাড়ি করে সেখানে নেমে এলো ও। এই তো সেই পারিজাত ফুলের বন, ঠাকুমা যার গল্প বলেছে এতোদিন। পারিজাতের বনে লাল, নীল, আরো সাতরঙা ফুলের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মিতুল এগিয়ে চললো। হঠাৎ মিতুল দেখতে পেলো ছোট্ট একটা মেয়ে একটা দোলনায় বসে দোল খাচ্ছে। একটু একটু করে মিতুল এগিয়ে গেলো মেয়েটার কাছে। মেয়েটা প্রায় ওরই বয়সী হবে। মিতুল কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই মুখ ফিরিয়ে তাকালো মেয়েটা। ওকে দেখে মিতুল তো অবাক হয়ে গেছে!
- এ কী! ঠাকুমা তুমি?
মিতুল চিৎকার করে উঠলো। জিজ্ঞেস করলো,
- তুমি এখানে কেমন করে এলে? 
- যেমন করে তুমি এলে!
দুষ্টুমি মাখানো হাসি হেসে বললো সেই ছোট্ট মেয়েটা।
- আর... আর... তুমি এইরকম ছোট্ট হয়ে গেলে কি করে? ও ঠাকুমা, বলো না...
ঠাকুমা মিতুলের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। বললেন,
- এতে অবাক হবার কিচ্ছু তো নেই। তোমার মতো আমিও যখন ছোট ছিলাম, তখনই এই স্বপ্নের দেশে এসেছিলাম যে! তাই এখানে আমার বয়েস ঠিক সেইরকমই আছে। এটাই তো মজা!
- তুমিও ছোট্ট ছিলে? সত্যি?
- হ্যাঁ গো, ঠিক তোমারই মতো।
- তখন কি করতে তুমি?
- খুব দুষ্টুমি করতাম। সারাদিন ধরে খেলা করে বেড়াতাম। ঠিক তুমি যেমন করো। একদম কোনো কাজ করতে চাইতাম না।
ঠাকুমা মিটিমিটি হাসছেন। 
- আর কি করতে?
বাঁধন ছাড়া বিস্ময়ে মিতুল জিজ্ঞেস করলো। ঠাকুমা বললেন,
- স্বপ্নের দেশে ঘুরতাম, এইখানেই।
ঠাকুমার সঙ্গে খুব ঘুরে বেড়ালো মিতুল। খুশীর গলায় বললো,
- বলেছিলাম না, তোমাকে ঠিক খুঁজে পাবই আমি। পেলাম কিনা বলো?
- ঠিকই। তুমি তো খুঁজে পেয়েই গেছো আমাকে।
মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন ঠাকুমা। হঠাৎ কি মনে পড়ায় মিতুল জিজ্ঞেস করলো,
- কিন্তু ঠাকুমা, এটা তো স্বপ্ন! ঘুম ভাঙলেই তো শেষ হয়ে যাবে। তখন কি হবে?
মিতুলের গলায় ব্যথা আর হতাশার ছোঁয়া। ওর কথা শুনে হাসলেন ঠাকুমা। বললেন,
- ধরে রাখতে চেষ্টা করতে হবে!
কিছুক্ষণ পর মিতুল দেখতে পেলো, ডানায় ভর দিয়ে আকাশ পথে মহুলও উড়ে আসছে ওদের দিকে।
- অ্যাই দাদা!
মহুলকে চেঁচিয়ে ডাকলো মিতুল। ডাক শুনে বাগানে নেমে এলো মহুল। আর এসেই, মাথায় রিবন বাঁধা, সাদা মেঘের পোশাক পরা, ছোট্ট মেয়ে ঠাকুমাকে দেখে মহুলও একেবারে অবাক।
- তুমি? ঠাকুমা? এইটুকু মেয়ে?
- হ্যাঁ গো দাদুভাই।
- কেমন করে এলে?
- যেমন করে তুমি এলে!
ঠাকুমাকে খুঁজে পেয়ে দারুন খুশী দুই ভাইবোন। সারাটা পরীদের দেশ একসঙ্গে ঘুরে বেড়ালো ওরা। কতো যে খেলা, কতো যে গল্প, আর কতো যে গান চললো সারাক্ষণ, তার আর হিসেব কে রাখে! সঙ্গে আবার যোগ দিলো সেই রাজ্যের যতো পরী আছে, সব্বাই। শেষ পর্যন্ত একসময় এসেই গেলো বাড়ি ফেরার পালা!

**
পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো মিতুলের। "ঠাকুমা", বলে চিৎকার করে, ছুটে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলো মিতুল। ঠাকুমার কাছে গিয়ে বললো,
- ঠাকুমা, আমি সেই স্বপ্নের দেশের খোঁজ পেয়ে গেছি।
- সত্যি?
ঠাকুমার গলায় কৌতুক মেশানো হাসি। মিতুল বলে চললো,
- হ্যাঁ গো! সেখানে আকাশের তারাগুলোই তো পরীদের দল। নদীর কলকল হলো ওদের কথা, আর হাওয়াটাই ওদের ডানা। তাই না?
- ঠিক বলেছো দিদি। আমাদের মধ্যে, রাতের আকাশের সব তারাদের মধ্যে, এই নদী আর হাওয়ার মধ্যেই তো লুকিয়ে আছে আমাদের স্বপ্নের দেশ। মনটাকে যদি খুশীতে ভরে রাখো, দেখবে তোমার ঘরের সামনের ফুল বাগানটাই স্বর্গের পারিজাত ফুলের বাগান হয়ে গেছে। আসলে, সত্যিকারের সবকিছুর মধ্যে, আমাদের নিজেদের জগতের মধ্যেই তো আমাদের মনের কল্পনাটা বাস করে। কবি মনের ছোঁয়া পেলেই সে তার কল্পনার পাখা মেলে উড়ে চলে যায়- স্বপ্নের দেশে!
অবাক হয়ে মিতুল শুনছিলো ঠাকুমার কথা। ঠাকুমা থামতেই ও হঠাৎ ঠাকুমার কোলের কাছে সরে এসে, ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো,
- আর সেই 'ছোট্ট তুমি'টা কোথায় লুকিয়ে আছো? ঠাকুমা?
ঠাকুমা হাসেন। বৃদ্ধার লোলচর্মাবৃত মুখের সঙ্গে ছোট্ট মিতুলের মুখখানি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। নিজের বুকের মধ্যে মিতুল শুনতে পায় ঠাকুমার ফিসফিস গলা,
- দিদিভাই, তুমিই তো আমি!
_____________________________________________________


 
সোমা চক্রবর্তী

Kalikapur, Taki Road,
Barasat, North 24 Pgs,
Pin- 700124.

মন্তব্যসমূহ

সপ্তাহের পছন্দ

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 32nd issue: May 2024

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচীপত্র ।। 28th issue: January 2024

ছড়া ।। তোর ।। বিবেকানন্দ নস্কর

লেখা-আহ্বান : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫ সংখ্যার জন্য

প্রচ্ছদ ও সূচীপত্র ।। 25th issue: October 2023

ছড়া ।। সবুজ ঘাসেতে প্রাণ খুঁজে পাই ।। জয়শ্রী সরকার

অনুবাদ ।। কথা না-বলা টিয়া ।। সুস্মিতা পাল

প্রচ্ছদ ও সূচীপত্র ।। 23rd issue: August 2023

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। ষড়ত্রিংশ সংখ্যা ।। সেপ্টেম্বর ২০২৪

মাসের পছন্দ

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। ষড়ত্রিংশ সংখ্যা ।। সেপ্টেম্বর ২০২৪

ছড়া ।। খোকাবাবু ।। মেশকাতুন নাহার

কবিতা ।। মাটির কাছে যায় ।। অবশেষ দাস

ছড়া ।। তোর ।। বিবেকানন্দ নস্কর

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 32nd issue: May 2024

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচীপত্র ।। 28th issue: January 2024

ছড়া ।। বর্ষার উৎসবে ।। আরতি মিত্র

ছড়া ।। পুজোর খুশী ।। আরতি মিত্র

কবিতা ।। ব্যাঘ্রমশাই ।। দীনেশ সরকার

বছরের পছন্দ

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। ত্রয়োত্রিংশ সংখ্যা ।। জুন ২০২৪

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচীপত্র ।। 29th Issue: February

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। চতুর্ত্রিংশ সংখ্যা ।। জুলাই ২০২৪

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 31st issue: April 2024

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 32nd issue: May 2024

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 30th issue : March 2024

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। পঞ্চত্রিংশ সংখ্যা ।। আগষ্ট ২০২৪

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। ষড়ত্রিংশ সংখ্যা ।। সেপ্টেম্বর ২০২৪

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচীপত্র ।। 26th issue: November 2023

অতি প্রিয়

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। আত্মপ্রকাশ সংখ্যা ।। অক্টোবর ২০২১

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। দ্বিতীয় সংখ্যা ।। নভেম্বর ২০২১

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 4th issue: January 2022,

নিবন্ধ ।। শিশু-কিশোর সাহিত্যবলয়ে শিশুরাই যেন ব্রাত‍্য না থাকে ।। অরবিন্দ পুরকাইত

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 7th issue: April 2022

নিবন্ধ ।। দেশীয় উদ্ভিদ কেন গুরুত্বপূর্ণ ? ।। ডঃ চিত্তরঞ্জন দাস

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় - ১০ ।। জুলাই ২০২২

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় - ১১ ।। আগস্ট ২০২২

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র : 8th issue: May 2022

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 5th issue: February 2022