Featured Post
ধারাবাহিক গল্প-সিরিজ ।। ঢোলগোবিন্দের কড়চা ।। পর্ব ১ ।। অরুণ চট্টোপাধ্যায়
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
[ছবি: ইন্টারনেট মাধ্যম থেকে সংগৃহীত]
ঢোলগোবিন্দের মহাকাশ পরিক্রমা
অরুণ চট্টোপাধ্যায়
দুই বন্ধুর মধ্যে প্রচন্ড ভাব। একেবারে হলায় গলায় যাকে বলে। এমনই হলায় গলায় যে দুটো নাম মিলিয়ে মিশিয়ে একটা নাম হয়ে গেছে। দীপক ঢোল আর গোবিন্দ পরমানিককে সর্বদাই একসঙ্গে দেখে লোকে একজনের পদবি আর একজনের নামের সন্ধি করে এমন সুন্দর নতুন নাম বানিয়েছে।
এই ঢোলগোবিন্দের একবার ইচ্ছে হল আকাশে ওড়ার। পাখিরা কেমন ওড়ে দিব্বি। যেখানে খুশি উড়ে উড়ে যেতে পারে। মাটিতে কত বাধা। রাস্তায় কত বিপত্তি। কিন্তু আকাশ তো ফাঁকা।
ঢোল বলল, চল গোবিন্দ আমরা পাখি হয়ে যাই।
গোবিন্দ বলল, বা রে, ডানা কোথায় পাব?
তা ঠিক। পাখির তো ওড়ার জন্যে ডানা আছে কিন্তু মানুষের তো নেই।
ঢোল আক্ষেপ করে বলল, ইস যদি দুটো ডানা পেতাম।
--পাবি কী করে? এযুগে কি আর কল্পতরু বৃক্ষ আছে যে সেই গাছের তলায় দাঁড়িয়ে যা চাইব তাই পাব?
এখন হয়েছে কী এরা এই কথাগুলো সব বলছিল প্রফেসর ক্ষেপচুরিয়াসের বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে যেতে। প্রফেসর ক্ষেপচুরিয়াস হলেন একজন বিখ্যাত মহাকাশবিজ্ঞানী। ইংরেজিতে যাকে বলে অ্যাস্ট্রো-ফিজিসিস্ট। তবে এটা তিনি নিজের বাড়ির দরজার সামনে মার্বেল পাথরে খোদাই করে রেখেছেন। তাই সবাই বলাবলি করে। সেই থেকে চালু হয়ে গেছে মহল্লায়। মহাকাশ গবেষণা নিয়ে ভেবেছেন দীর্ঘকাল। সবাই তো রকেটে করে মহাকাশে যায়। পায়ে হেঁটে তো কেউ যায় না।
প্রফেসর ক্ষেপচুরিয়াসের আসল নাম ক্ষেত্রবিনোদ আচার্য। কিন্তু একটুতেই ক্ষেপে যান বলে সবাই নাম আর পদবী সন্ধি করে ক্ষেপচুরিয়াস করে দিয়েছে। তাঁর গবেষণা মহাকাশ নিয়ে। তিনি পায়ে হাঁটিয়ে মানুষ পাঠাতে চান মহাকাশে। কিন্তু কাকে পাঠাবেন? নিজে তো যেতে পারছেন না। কারণ তিনি গেলে মাটির গ্রাউন্ড স্টেশন কন্ট্রোল করবে কে? এটাই তো আসল কনট্রোল।
ঢোলগোবিন্দের কথাবার্তা শুনে তাঁর মনে আশা জাগল। তিনি দরজা খুলে তাদের ডাকলেন। জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা সত্যি আকাশে উড়তে চাও?
দুজনেই তো একেবারে একপায়ে খাড়া। আর স্বয়ং বিজ্ঞানী যদি সাহায্য করেন তো আর বেশি কি? একসঙ্গে বলে উঠল, হ্যাঁ হ্যাঁ চাই।
--কেন? প্রফেসর গম্ভীর জিজ্ঞেস করলেন।
--আমরা একটা রাজ্য থেকে আর একটা রাজ্যে, একটা দেশ থেকে আর একটা দেশে উড়ে বেড়াব। দিব্বি মজা হবে স্যার।
বিজ্ঞানী খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, বেশ বেশ। তা শুধুই এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে বা এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে চাও? আমাদের পৃথিবীর এই ছোট্ট আকাশ ছাড়িয়ে মহাকাশে যেতে চাও না?
ঢোল বলল, মহাকাশ কী স্যার?
--মহাকাশ আরও বড়। অনেক অনেক বড়। এত বড় যে তোমরা ভাবতেই পারবে না।
গোবিন্দ বলল, সেখানে কি আরও বেশী দেশ দেখা যাবে?
বিজ্ঞানী মানুষ তাই ভুলেও হাসেন না। তবু দুটো বাচ্চা ছেলের সামনে গম্ভীর হয়ে তাদের মহাকাশ যাত্রার উৎসাহ নষ্ট করতে চাইলেন না। সামান্য হেসে বললেন, হা হা হা। দেশ বলছ কি? বলছি না অনেক অনেক বড়। ওখানে দেশ দেখা যায় না। সব দেশ মিলে যেমন একটা পৃথিবী হয় তেমনি পৃথিবীর মত অনেক গ্রহ দেখতে পাবে। কত রকমের গ্রহ। কত নানান আকার, নানা রঙ নানা ঢং এইসব।
--কিন্তু কিসে করে যাব? মানে কিসে চেপে যাব? ঢোল জিজ্ঞেস করে।
বেশিক্ষণ ধৈর্য রাখতে পারেন না প্রফেসর ক্ষেপচুরিয়াস। ক্ষেপে গিয়ে দিলেন ধমক, রকেটে আবার কিসে? রকেটে চড়ে মহাকাশে যায় তা জান না?
রকেট সম্পর্কে এদের দুজনের কারোর কিন্তু স্পষ্ট ধারণা তেমন ছিল না। গোবিন্দ মিনমিন করে বলল, রকেটে যদি হয় তো তার বড় বড় জানলা থাকবে তো?
--জানলা? তার কি দরকার? ঢোলের কথায় বিজ্ঞানী নাক কোঁচকালেন, পুরোটাই তো খোলা?
গোবিন্দ রীতিমত ঘাবড়ে গিয়ে বলল, সে আবার কী? তাহলে তো পড়ে যাব স্যার।
-কিচ্ছু পড়বে না। বলে বিজ্ঞানী দুজনের পায়ের মাপ নিয়ে গম্ভীর ভাবে বললেন, দশদিন পরে এস।
দশ দশটা দিন খুব উত্তেজনার সঙ্গে কাটল দুজনের। পেট ফুলছে অথচ কাউকে কিছু বলতে পারছে না। পাছে বিজ্ঞানী ক্ষেপচুরিয়াস ক্ষেপে যান। দশদিন পরে দুজনের পায়ে দুটো অদ্ভুত জুতো পরিয়ে দিয়ে বিজ্ঞানী বললেন, দারুন ফিট করেছে। শোন, মহাকাশে যাবে পায়ে হেঁটে। এই জুতোসমেত পা বাতাসে রেখে।
ঢোল খুব খুশি, উড়ব নাকি স্যার? একদম পাখির মত?
গোবিন্দের মনে রীতিমত সন্দেহ। বলল, পাখির তো ডানা থাকে স্যার এর তো নেই?
--দরকার নেই। বিজ্ঞানী বললেন, তোমরা দুজনে কত ক্লাস পর্যন্ত পড়েছ? অন্তত এইট পর্যন্ত নিশ্চয়?
দুজনেই ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ স্যার।
--ওতেই হবে ওতেই হবে। জোরে জোরে ঘাড় দুলিয়ে বিজ্ঞানী বললেন, বেশ এবার শোন। এই যন্ত্র চলবে কিছুটা জলে যেমন করে বোট বা স্টিমার এই সব চলে আর কী। সেখানে কি করে চলে ঢোল?
ঢোল মাথা চুলকে বলল, ইয়ে মানে—স্যার। হ্যাঁ তবে দেখেছি। সেবারে গঙ্গায় একটা লঞ্চে উঠেছিলুম স্যার। সেখানেই দেখেছি।
--কী দেখেছ?
--পেছনে একটা চাকা ঘুরতে দেখেছি স্যার। আর হুড় হুড় করে জল বেরিয়ে আসছে।
বিজ্ঞানী খুশি হয়ে বললেন, ঠিক ঠিক।
গোবিন্দ মাথা চুলকে বলল, জল বেরোয় কেন স্যার? জল বেরোলে কী হয়?
--আসলে জল বেরোয় না। চাকাটা ঘুরে গিয়ে সামনের জলকে জোরে ঠেলে দেয় দূরে। তারপর পেছনের জল ছুটে এসে বোট বা স্টিমারকে ঠেলে দেয় সামনে।
দুজনেই ঘাড় নাড়ে আস্তে আস্তে। প্রফেসর ক্ষেপচুরিয়াস বললেন, আর একই কাজ জলের বদলে বাতাস করে পাখি আর উড়োজাহাজের বেলায়।
ঢোল চোখ বড় বড় করে বলল, স্যার আমরা পাখি নই—
--আমরা উড়োজাহাজও নই। গোবিন্দ বিরস মুখে বলল।
--তোমরা সব কিছু। প্রফেসর ক্ষেপচুরিয়াসক্ষেপে গেলেন আবার। কথার পিঠে কথা বলা একদম সহ্য করতে পারেন না মানুষটা।
--মানে স্যার? ঢোল তো অবাক।
--মানে হল--, প্রফেসর বুঝিয়ে বলতে লাগলেন, তোমরা মানে তোমাদের পায়ের এই জুতোজোড়াই সে সব কাজ করবে। হাতের রিমোট টিপলেই একপাশ থেকে হাওয়া বের করে অন্যপাশে সরিয়ে দেবে। আর সঙ্গে সঙ্গে সেই হাওয়া জুতো সমেত তোমাদের চলতে সাহায্য করবে। তবে একটা কথা মনে রেখ এর জন্যে তোমাদের নিজেদের পা ফেলার কোনও দরকার নেই।
--তবে?
--এসক্যালেটর দেখেছ? চলন্ত সিঁড়ি? তোমাকে উঠতে হয় না। সিঁড়ির ধাপ নিজেই উঠে যায়। তেমনি আর কী। আবার নামার সময়ও একই।
ঢোলের মাথায় একটা জিনিস ঝট করে চলে এল। জিজ্ঞেস করল, কিন্তু হুড়হুড় করে চললে তো মুশকিল। থামাব কি করে? বাড়াব কমাবই বা কী করে স্যার?
--খুব সোজা। রিমোটের একটা বোতাম টিপলেই হাওয়া টানা আর বার করা শুরু হবে। এটার ভেতরে একটা নোজল মানে ছিদ্রপথ আছে। সেটা ঘুরে ঘুরে ক্রমশ ছিদ্রপথ সরু থেকে মোটা করে দিলে বেশী করে হাওয়া ঢুকবে আর বেরোবে। তাহলে এইভাবে জুতোর মানে তোমার গতি বেড়ে যাবে। আবার কমাবার সময় ঠিক এর উলটো।
গোবিন্দ বলল, কিন্তু এপাশ ওপাশ ঘুরবে কী করে? স্টিয়ারিং আছে?
--হ্যাঁ তাও আছে। বিজ্ঞানী বললেন, এই নোজলটা তিনশত ষাট ডিগ্রী ঘুরতে পারে। মানে একটা বিন্দুর চারপাশে। আবার ওপর থেকে নিচে।রিমোটের সুইচ টিপলেসেটা ঘুরবে। ঘুরলেই গাড়ির গতির অভিমুখ পাল্টে যাবে। এমন কি চাইলে তুমি চর্কির পাক খেতে পার এর সাহায্যে।
ঢোলগোবিন্দরা ঘাড় নেড়ে জানাল তারা সব বুঝে গেছে।
নির্দিষ্ট দিনে দুই বন্ধুর পায়ে জুতো জোড়া পরিয়ে সবুজ পতাকা উড়িয়ে দিলেন বিজ্ঞানী। তবে মুখ কাঁচুমাচু করে জানালেন তাড়াতাড়িতে ফ্লাইং শু মানে উড়ন্ত জুতোর মধ্যে এখনও ইঞ্জিন ভরা হয় নি। তার বদলে ঠেসে দিয়েছেন দু’ দুটো ইয়া বড় হাউই। দাড়ি নেড়ে নেড়ে বললেন, চিন্তার কিছু নেই হাউইয়ে বেশ বেশি করে বারুদ ঠাসা আছে। যা আছে কয়েক ঘন্টা পাক দিয়ে আসা যাবে বুঝলে?
ঢোক মুখটা ঢোলের মত ফুলিয়ে বলল, এ ম্যা মাত্র কয়েক ঘন্টা?
গোবিন্দ উৎসাহের সঙ্গে বলল, আসলে সফটওয়ারের যেমন ফুল ভার্সানের আগে ট্রায়াল ভার্সান হয় আর কি। চল ঢোল কয়েক ঘন্টাই বা মন্দ কি? পাখিরা কত সুখে আকাশে উড়ে বেড়ায় সেটা তো জানা হবে?
বিজ্ঞানী ক্ষেপচুরিয়াস এবার না খেপে সামান্য হেসে বললেন, ঠিক বুঝেছ। এটায় সফল হলে তবে ফুল ভার্সান। মানে চাঁদে মঙ্গলে যেতে পারবে হেঁটে হেঁটে। ততদিনে জেট ইঞ্জিন তৈরি হয়ে যাবে মনে হয়।
বিজ্ঞানীর বাড়ি বড্ড নির্জন জায়গায়। তাই রাস্তায় লোক বলতে শুধু ডাস্টবিনের সামনে জড় হওয়া কতগুলো কুকুর, মিনিমাসির রান্নাঘরের জানলার পাশে মাছের আশায় ওত পেতে বসে থাকা মিনি, রাস্তার ইলেক্ট্রিকের তারে বসে থাকা একসার কালো কাক। একটা ইঁদুর মরে পড়ে ছিল রাস্তায়। সেটা কে নিয়ে যাবে আর তার কত ভাগ কে কে নেবে এই নিয়ে ছিল কাকেদের জরুরী মিটিং। আপাতত বিজ্ঞানী ক্ষেপচুরিয়াস আর ঢোলগোবিন্দের এই ঐতিহাসিক দৃশ্য দেখার জন্যে সাক্ষী কেবল তারাই।
হাউইয়ের সলতেয় আগুন দেওয়া হল। আগুনের ফুলকি ধোঁয়া আর সামান্য শব্দ। তারপরই মাটি থেকে একেবারে আকাশে দুজন। ভয় পেয়ে কাকগুলো ভয়ানক স্বরে কা কা করে ডাকতে লাগল। কুকুরগুলো ডাস্টবিন ছেড়ে আকাশের দিকে মুখ করে ঘেউ ঘেউ করতে লাগল। আর ব্যাপারটা কি হয়েছে সেটা দেখতে মিনিমাসি যেই বাইরে বেরিয়েছে অমনি মিনি ভেতরে ঢুকে মাছের লেজায় কামড় দিয়েই হাওয়া।
পত পত করে বিজ্ঞানীর হাতের পতাকা উড়ছে আর আকাশে উড়ছে ঢোলগোবিন্দর ফ্লাইং শু মানে উড়ন্ত পাদুকা। তার নিচে বেরোচ্ছে হাউইয়ের আগুন। সেদিকে তাকিয়ে ঢোল খুশিতে ডগমগ হয়ে বলে উঠল, দেখলি কেমন রকেট রকেট মনে হচ্ছে না?
গোবিন্দ বলল, সত্যিই তো। কাল কাগজে নির্ঘাত আমাদের ছবি বেরোবে।
পতাকা উড়িয়েই বিজ্ঞানী নিজে বসে গেলেন গ্রাউন্ড স্টেশনের বিরাট দেওয়াল জোড়া মনিটরে। যেখানে সাঁই সাঁই করে উড়ছে দুই বন্ধু। দীপক ঢোল আর গোবিন্দ পরমানিক। কি-বোর্ডের বাটন টিপে টিপে সেই ছবি কখনও বড় করছেন তো কখনও ছোট।
[ছবি: ইন্টারনেট মাধ্যম থেকে সংগৃহীত]
প্রফেসর ক্ষেপচুরিয়াসের মুখে প্রশান্তির হাসি। এই হাসি সফলতার। ভাবছেন এই প্রক্ষেপন যদি ইসরোর প্রকল্প হিসেবে চাঁদিপুরের সাগরের তীরে হত তো এতক্ষণে এটা সারা পৃথিবী দেখত। যাই হোক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবছেন এরপরে নিজেই ইসরোর মত কিছু একটা খুলতে পারেন কিনা। চাঁদিপুর না হলেও দীঘা কি শংকরপুর তো আছে নাকি? সাগরের তীর হিসেবে সেটা মন্দ কী?
কিন্তু একি। ওরা দুজন তো উড়ছে না। এতক্ষণ তো দিব্বি উড়ছিল এখন কি হল? সারা পর্দা জুড়ে নীল আকাশে সাদা মেঘগুলোই শুধু উড়ছে। ঢোলগোবিন্দেরহদিশ নেই। কি হচ্ছে সেই নিয়ে মহা চিন্তা। আর সেই চিন্তায় পেয়ে গেল ঘুম।
এদিকে উড়তে উড়তে ঢোলগোবিন্দেররা দেখল অনেক দূর চলে এসেছে। নীচে দেখা যাচ্ছে না কিছুতেই। খুব ভয় করতে লাগল। ঢোল জিজ্ঞেস করল, একি গোবিন্দ আমরা কি মহাকাশে চলে এসেছি নাকি রে?
আশপাশ দেখে গোবিন্দ বলল, তাই তো মনে হচ্ছে জানিস?
ঢোল বলল, আর একটা জিনিস দেখেছিস গোবিন্দ? আমাদের রকেট শু থেকে আর কোনও আগুন বা ধোঁয়া বেরোচ্ছে না।
গোবিন্দ দেখল তাদের জুতোজোড়া আগের মত আর হুস হুস করে চলছে না। বদলে যেমন করে আকাশ থেকে ঢিল মাটিতে পড়তে থাকে তেমনি করে পড়ছে। সে তো খুব ভয় পেল। বলল, এইরে তবে ফিরব কি করে?
-আরে আরে এই দেখ হিমালয়। সাদা একেবারে ধপ ধপ করেছে। খুব বরফ জমেছে রে।
ঢোল চেঁচিয়ে উঠতেই গোব্বিন্দ দেখল তারা দুজনে একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়ল পাহাড়ের গায়ে। আর তারপরেই গড়াতে লাগল। গড়াতে গড়াতে ঢোল বলল, আমাদের আর মহাকাশ যাওয়া হল না রে। আমরা বোধহয় আবার পৃথিবীতেই ফিরে যাচ্ছি।
গোবিন্দ বলল, ধুস তাই আবার হয় নাকি? আমার মনে হয় কি জানিস ঢোল?
-কি?
-মনে হয় এটা মহাকাশের হিমালয়।
ঢোল তো অবাক, মহাকাশে আবার একটা হিমালয়?
-কেন থাকবে না বল? কালীমন্দির কি শুধু আমাদের পাড়াতেই আছে বল?
ঢোল ভেবে দেখল তা ঠিক। কিন্তু বেশি ভাবার সুযোগ পেল না। হিমালয় দিয়ে গড়াতে গড়াতে খপ করে একটা ঝুড়ির মত হেলিকপ্টারে পড়ে গেল। সে বলল, এই দেখ গোবিন্দ মহাকাশে হেলিকপ্টারও থাকে।
গোবিন্দ বলল, আমার মনে হয় কি জানিস এটা হল রকেট। বিজ্ঞানী ক্ষেপচুরিয়াস স্যার আমাদের মহাকাশে যাবার জন্যে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে।
--তুই ঠিক বলেছিস গোবিন্দ। নে এখন ঠিক হয়ে সিটে বসে পড়। এখুনি স্টার্ট দিতে হবে নাহলে দেরি হয়ে যাবে। দেরি হলে কিন্তু ক্ষেপচুরিয়াস স্যার ক্ষেপে গেলে শেষে আকাশেই থাকতে হবে ভাই?
ঢোল বলল, ধুস কি যে বলিস। স্টিয়ারিং তো আমাদের হাতে। আমরা এখন গুপী গাইন বাঘা বাইন। যেথায় খুশি যাইতে পারি। নে গান ধর।
কিন্তু গান ধরার আগেই থামিয়ে দিতে হল। কেননা রকেট ততক্ষণে নিজে থেকেই চলতে শুরু করেছে। ঢোল বলল, আমরা চালাবার আগেই চলতে লাগল?
-আরে বুঝলি না এটা অটোমেটিক। মনে হয় গ্রাউন্ড স্টেশনে বসে স্যার ক্ষেপচুরিয়াস এটা কনট্রোল করছেন।
রকেট যে একটুপরেইতাবেশটেরপাওয়াগেল।সেইঝুড়ির মত হেলিকপটারের নিচে একটা পাইপ দিয়ে সাদা ধোঁয়া উড়তে লাগল গলগল করে আর সেটা ওপরে উঠতে লাগল।পড়লটানআরসেটা উঠতে লাগল ওপরে। কেউ যেন দড়ি দিয়ে টেনে তুলছে। শোঁ শোঁ করে উঠছে আর দৃশ্যের পরে দৃশ্য পাল্টে যাচ্ছে। ঢোল বলল, একি রে আমরা যে আবার আকাশে উঠে যাচ্ছি। চারপাশ দেখ কেমন ফাঁকা ফাঁকা। আরে দেখ দেখ আমাদের সঙ্গে সঙ্গে একটা করে ক্যামেরাও উঠে যাচ্ছে।
ঢোল বলল, বিজ্ঞানী স্যারের ব্যবস্থা। একেবারে সারা পৃথিবীকে আমাদের মহাকাশে হাঁটার লাইভ দেখাবে।
গোবিন্দ মুখ বেজার করে বলল, মহাকাশে হাঁটার বোধহয় সুযোগ পাব না রে ঢোল। বিজ্ঞানী স্যার শেষ মুহূর্তে বোধহয় সিদ্ধান্ত বদলে এই রকেট পাঠিয়ে দিয়েছে।
ঢোল বলল, এই ভাল রে গোবিন্দ। বেশ বসে বসে যাওয়া যাবে। নাহলে হাঁটতে গিয়ে পায়ে ব্যাথা হয়ে যেত কি বল?
গোবিন্দ এবার বাইরে তাকিয়ে দেখল। মহানন্দে হাততালি দিয়ে বলল, এই দেখ আমাদের পাশ দিয়ে মেঘ ভাসছে।
--আমরা তবে মেঘের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি? ঠিক এরোপ্লেনের মত?
এরপর আশপাশ থেকে সব মেঘ উধাও হতে লাগল। আর সব ছোট ছোট কিছু ঝিকমিক করতে থাকে। ঠিক তারার মত। বিরাট লাল বলের মত একটা কি ছুটে আসতে লাগল। ঢোল ভয়ে শিউরে উঠে বলল, গোবিন্দ রে ধাক্কা মারলে গুঁড়িয়ে যাব রে।
কিন্তু ধাক্কা মারল না। সেটা পাশ দিয়ে চলে গেল সাঁই করে। গোবিন্দ বলল, আমরা মহাকাশে পৌঁছে গেছি রে ঢোল।
--তাই নাকি? কী করে বুঝলি?
--এই যে পাশ দিয়ে মার্স মানে মঙ্গল গ্রহ চলে গেল। কেমন টকটকে লাল দেখলি? ওই দেখ ওই দেখ জুপিটার মানে বেস্পতি। আর এই যে সব জ্বলছে মনে হয় সব তারা মানে স্টার।
এরপর আস্তে আস্তে শনি, ইউরেনাস, প্লুটো সব আসতে লাগল। মহা আনন্দে উপভোগ করতে লাগল তারা দুজন। ঠিক যেন বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামের সীটে বসে মহাকাশ দেখছে। ঢোল বলল, আরে এটা কি প্ল্যানেটোরিয়াম নাকি?
--দূর বোকা। গোবিন্দ বলল, প্ল্যানেটোরিয়ামে কি আমাদের মত ঘুরে ঘুরে মহাকাশ দেখা যায় নাকি?
দেখতে দেখতে কিন্তু রকেট হঠাৎ থেমে গেল। দেখা গেল সেখানে বিরাট একটা প্ল্যাটফর্ম।
-ওই দেখ মহাকাশ এসে গেছে। ঢোল বলল।
দুজনে নেমে দেখল যেন কাঠের পাটাতন। কিন্তু মহাকাশে কাঠের পাটাতন কি করে আসবে তারা ভেবে পেল না। মহা আনন্দে ঢোল বলল, আয় আয় মহাকাশে হাঁটবি না? সত্যি স্যারক্ষেপচুরিয়াসের সব ব্যবস্থা একেবারে পাকা। মহাকাশে কিছুক্ষণ পায়চারি করার পর আবার রকেটে করে পৃথিবীতে ফিরতে হবে।
দুজনে নেমে অবাক। মহাকাশটা গোল গম্বুজের মত। আর তাতে ঝলমল করছে কত তারা। কেউ ঘুরছে আবার কেউ স্থির। সবাই বেশ ঝকমক করছে। আজকাল মাথার ওপর মিনিইয়েচার যেমন বিছোন থাকে তেমন।
হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর চলে এসেছিল। হঠাৎ দূর থেকে দেখল তাদের রকেট হেলিকপ্টার নড়ে উঠেছে। তারা পড়ি কি মরি করে দৌড়ে দৌড়ে আবার এসে বসল সেই রকেটে।
ঢোল আনন্দে বলছে, কি দারুণ অভিজ্ঞতা। আমরা মহাকাশে সত্যি পদচারণা করেছি।বিজ্ঞানী স্যার বলেছিলেন মনে নেই? পায়ে হাঁটিয়ে মহাকাশ পরিভ্রমণ করাবেন আমাদের?
গোবিন্দ বলল, হ্যাঁ বিজ্ঞানী হো তো এইসা। স্যার ক্ষেপচুরিয়াস যুগ যুগ জিয়ো।
এমন সময় অনেক নীচে থেকে কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, কাট কাট। মনে হচ্ছে রকেটে ভুল লোক উঠে পড়েছে।
আর একজন বলল, তাই তো মনে হচ্ছে স্যার। ওরা আসল স্টান্ট ম্যান নয়। আসল স্টান্ট ম্যানেরা মিনিট পাঁচেক পরে এসেছে। ওরা এসে দেখেছে তাদের রকেট হাওয়া।
মুহূর্তে যে রকেটে ঢোলগোবিন্দরা বসে ছিল সেটা হু হু করে নীচে নামতে শুরু করেছে। ঠিক যেন কোনও কপিকলে বাঁধা হয়ে নামছে।
হেলিকপ্টার মাটিতে পৌঁছতেই অনেকে চারপাশে ভিড় করে এল। একজন কড়া চোখে প্রশ্ন করল, এই তোমরা কারা?
ঢোল অবাক হয়ে বলল, আমরা মহাকাশচারী।
--হ্যাঁ অ্যাস্ট্রোনট। গোবিন্দ খুব উৎসাহের সঙ্গে বলল।
তারপর সে এক যাচ্ছেতাই কান্ড। আসল কান্ডটা হল এটা একটা সিনেমার সেট। বিরাট এক সার্কাসের তাঁবু ভাড়া করে সাজানো হয়েছে। মহাকাশের গ্রহতারা নিয়ে একটা সিনেমা হবে। একটা মাচা করে সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে হিমালয় পাহাড় বানানো হয়েছে। কিন্তু গোলমালটা হয়েছে সেইখানে, যে হেলিকপটারের মত সাজিয়ে রকেট করা হয়েছে সেটার ওপরেই গড়িয়ে পড়েছে ঢোলগোবিন্দ পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়তে পড়তে।কিন্তু সিনেমার কিছু কাজ অটোমেটিক ছিল। রকেটে ওরা পড়তেই সব অটোমেটিক হতে থাকে। তাঁবুর মাথায় লাগান নানা কপিকলের সাহায্যে রকেট নিজেই চলতে আর ঘুরতে থাকে।
একটু পরেই ভুলটা ধরা পড়ে আসল স্টান্ট ম্যানেরা এলে। আসল অভিনেতারা তো এত উঁচুতে ওড়ার ঝুকি নেয় না। তাই স্টান্ট ম্যানেদের দরকার হয়। বাইরে থেকে তো বটেই এমন কি ভেতর থেকেও ছবি তোলা অটোমেটিক ছিল। অনেক ছবি উঠে গেছে এখন কি হবে?
পরিচালক মাথায় হাত দিয়ে কিছুক্ষণ ভাবছিলেন। তখন প্রোডিউসার বললেন, ছেলেগুলো তো কাজ খারাপ করে নি। বেশ সাহসী ডাকাবুকো ছেলে দেখছি। বাকিটা ওদের দিয়েই চালিয়ে নাও। পরিচালক রাজি। কিন্তু ক্যামেরাম্যান বলল, কিন্তু স্যার ওরা তো বাচ্চা। ওদের দিয়ে—
--বাচ্চা বলে কি মহাকাশে যেতে পারে না? কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা।
--কি কথা? সহকারী পরিচালক বললেন।
--ভাবছি স্ক্রিপটা একটু পাল্টাতে হবে। ছোটদের দিয়েই ছোটদের জন্যে বই করতে হবে। ছোটদের যে সাহস কম নয় আর তারাও যে বিজ্ঞানের বিষয়ে বেশ উৎসাহী তাই লোককে বোঝাতে হবে। কিন্তু সে স্ক্রিপট লিখবে কে? আসলে আমার মনে হয় আমাদের গল্পের সঙ্গে এই উড়ন্ত শু-এর গল্পটা জুড়ে দিলে মন্দ হবে না। কল্পবিজ্ঞান যে বিজ্ঞানের ভিত দৃঢ করে আর এটা যে গালগল্প নয় এটা তো লোককে বোঝাতে হবে।
ঢোলগোবিন্দ দুজনেই খুব উৎসাহিত হয়ে বলল, বিজ্ঞানী প্রফেসর ক্ষেপচুরিয়াস আমাদের এই শু বানিয়ে দিয়েছেন স্যার। এটা তাঁর আবিষ্কার। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা সফলতা দেখাতে পারলাম না আমাদের দোষে।
--কিচ্ছু দোষ নেই তোমাদের। পরিচালক পিঠ চাপড়ে বললেন, চল বরং প্রফেসর বিজ্ঞানীর কাছেই যাওয়া যাক। স্ক্রিপ্ট যদি উনিই লিখে দেন আমাদের জন্যে।
প্রফেসর ক্ষেপচুরিয়াস এবার আর ক্ষেপে গেলেন না। বরং সানন্দে রাজি। তাঁর আবিষ্কৃত মহাকাশ জুতো দিয়ে ছেলেগুলোকে মহাকাশে হাঁটান গেল না বটে তবে তাঁর লেখা স্ক্রিপট সিনেমার পর্দায় দিব্বি হাঁটবে এই বা কম কি?
_____________________________________________________________________________________
Dr. ARUN CHATTOPADHYAY
181/44 G.T.ROAD (GANTIR BAGAN)
P.O. BAIDYABATI
DIST. HOOGHLY (PIN 712222)
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন