রহস্যময় পুঁথি
সুলগ্না ব্যানার্জ্জী
মানুষ সব সময় অতিপ্রাকৃত-অভিশপ্ত ও অতিলৌকিকতার পেছনে ছুটেছে এক অমোঘ আকর্ষণে। চিরকালই যা রহস্যময় তার প্রতি আমাদের আগ্রহ অপরিসীম। তা হোক না কোনো বিশেষ স্থান বা বস্তু বা অন্যকিছু। গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে এমন রহস্যের শেষ নেই যার কিছু টা হয় তো আমরা জানি বাকিটা জানি না। কেবলমাত্র স্থান - কাল - দ্রব্য - পাত্রই নয় ; পৃথিবীর ইতিহাসে বর্ণিত এমন কিছু বইয়ের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে যা আজও রহস্যময়। জানতে ইচ্ছে করছে তো এমন বই সত্যিই আছে কিনা ?? আসুন জেনে নেওয়া যাক।
ভয়নিখ :
বিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় বই হিসেবে গোটা বিশ্বে সর্বপ্রথম যে বইটি স্বীকৃতি পেয়েছে তা 'ভয়নিখ' এর পান্ডুলিপি।
কেউ বলেন এতে আলকেমির গোপন ফর্মুলা লেখা হয়েছে ; কেউ বা বলেন এতে লেখা আছে মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্য। আবার কেউ বলেন ভেষজ চিকিৎসা অথবা জাদুটোনার কথা। কিন্তু কেউ এখনও নিশ্চিত না এতে আসলে কী আছে।
কারণ কেউই জানতে পারেননি এর আসল রহস্য। তাই আজও পোলিশ বই ব্যবসায়ী উইলফ্রিড ভয়নিখের নামেই এই পাণ্ডুলিপিটি পরিচিতি পায়।
এই পান্ডুলিপির সম্পূর্ণটাই হাতে লেখা। এতে আঁকা রয়েছে হাজারো ছবি - নকশা - ডায়াগ্রাম ও প্যাটার্ন।
পাণ্ডুলিপির ভাষা কারো বোধগম্য না হলেও ছবি ও নকশাগুলো থেকে বিভিন্ন বিষয় আন্দাজ করেন গবেষকরা। এতেই যেন রহস্যের জাল আরও ঘনীভূত হয়েছে।
শোনা যায় হিটলার বাহিনীর গোপন সাংকেতিক ভাষার রহস্য ভেদ করা বিখ্যাত ক্রিপ্টোগ্রাফার ব্লেচলি পার্ক অনেক সময় ব্যয় করেন ভয়নিখের পাণ্ডুলিপির পিছনে। কিন্তু এর ভাষা তাঁর বোধগম্য হয় না। বেশিরভাগ গবেষকদের মত তাঁর চোখও আটকে থাকে অদ্ভুত ছবিগুলোর মধ্যে।
অন্যান্য গবেষকরা এতে ব্যবহৃত কালির রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য পরীক্ষা করে বলেন আনুমানিক ১৪০৪ থেকে ১৪৩৮ সালের দিকে বইটি লেখা হয়েছিল।
সম্প্রতি এ রহস্যের কূল-কিনারা করতে নামেন বিশ্বের প্রথম সারির কয়েকজন কম্পিউটার বিজ্ঞানী। এ ভাষা পাঠোদ্ধারের জন্য তারা ব্যবহার করেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই। এটি একটি পরিসংখ্যান ভিত্তিক অ্যালগরিদম যা বিশ্বের ৩৮০টি ভাষার ৯৭ শতাংশ সফলতার সঙ্গে ভাষান্তর করতে পারে। গবেষকরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করেছিলেন পাণ্ডুলিপিটি হয়তো প্রাচীন আরবিতে লেখা হতে পারে। কানাডার আলবার্টা ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার বিজ্ঞানী গ্রেগ কনডার্ক ও তার দল বলছে এ পাণ্ডুলিপি প্রাচীন হিব্রু ভাষায় লেখা। তাছাড়া এর শব্দগুলো এলোমেলোভাবে সাজানো এবং এতে কোনো স্বরবর্ণের ব্যবহার নেই।
তবে পরবর্তীকালে গ্রেগ জানান কম্পিউটারের সাহায্যেও পাণ্ডুলিপিটির মূল রহস্য উদ্ধার সম্ভব না। কারণ মানুষের শেখানো ভাষা নিয়েই কাজ করে কম্পিউটার। পাণ্ডুলিপিটি প্রাচীন হিব্রু ভাষায় লেখা হলেও তা এতটাই প্রাচীন যে এ বিষয়ক কোনো পণ্ডিত বর্তমানে নেই। সুতরাং ভয়নিখের পাণ্ডুলিপির মূল অর্থ হয়তো রহস্যের আড়ালেই থেকে যাবে চিরকাল।
কোডেক্স গিগাস :
এবার বলবো এমন একটি বিশেষ বইয়ের কথা যার অপর নাম 'শয়তানের বাইবেল'। বিশ্বের রহস্যময় বইগুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে বেশি আলোচিত।
ধারনা করা হয় ১২০০ শতকে চামরা দিয়ে পৃষ্ঠা আর কাঠের উপর বিভিন্ন ধাতুর দ্বারা এই বইটির মলাট প্রস্তুত করা হয়েছিলো। কথিত আছে ৩১০ পৃষ্ঠার পার্চমেন্ট কাগজের ৭৪ কেজি ওজনের বইটি তৈরীতে ১৬০ টি গাধার চামরার প্রয়োজন হয়েছিলো যদিও বর্তমানে বইটির অনেক পৃষ্ঠা গায়েব।
গবেষকদের মতে শয়তানের সাথে যোগাযোগের বিস্তারিত আলোচনাই ছিলো বইটির হারানো পৃষ্ঠাগুলোতে ।
বইটির উদ্ধারকৃত বিষয়বস্তু সম্পর্কে যতোটুকু জানা গেছে বিভিন্ন ধরনের অদ্ভুত বস্তু দিয়ে ওষুধ প্রস্তুত - অশুভ শক্তির আছর ছাড়ানো - মেডিকেল সাইন্সের সাথে মিল রয়েছে এমন কিছু টপিক - অশুভ লুসিফার বিষয়ক অনেক তথ্য বইটিতে রয়েছে।
এই বইটির লেখক সম্পর্কে বিভিন্ন ধারনার মধ্যে যেটি গ্রহনযোগ্য ধরে নেয়া হয় তা হলো বর্তমানের চেক রিপাবলিকের একটি গ্রামের চার্চে ছিলেন এক সাধু চার্চের কিছু গুরুত্বপুর্ণ নিয়ম ভঙ্গ করার জন্য তাকে একটি ঘরের মধ্যে স্বেচ্ছায় বন্দীত্বের শাস্তি দেয়া হয়।
বন্দি থাকা অবস্থায় সাধুর সাথে শয়তান লুসিফার যোগাযোগ করে এবং বইটি লেখার জন্য অনুরোধ জানালে সাধু বইটি লেখার কাজ শুরু করেন। অনেকে বলে এক রাতের মধ্যে বইটি লেখার কাজ শেষ হয় আবার অনেকে বলে ৩০ বছরের কাছাকাছি সময় লেগেছিলো।
বইটির পরীক্ষা করে দেখা যায় এটির লেখক একজনই তবে বইতে লেখার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের চিত্রও আঁকা হয়েছে। বইয়ের প্রথম পরিচ্ছদে শয়তান লুসিফারের একটি পোর্ট্রেট রয়েছে। এছাড়াও যাদু বিদ্যা সম্পর্কিত অনেক অদ্ভুত ছবিও আছে । বইতে জেরুজালেম নগরের ছবিও রয়েছে বলে জানা যায় ।
বইটি বর্তমানে সুইডেনের স্টকহোমের জাতীয় গ্রন্থাগারে রাখা হয়েছে।
নেক্রোনোমিকেন :
রহস্যময় বইয়ের দুনিয়ায় আরেকটি বিখ্যাত নাম হলো ' নেক্রোনোমিকেন' যা ঠিক কোথায় রয়েছে বলতে পারেন না কেউই। কিন্তু গবেষকদের ধারণা এই বইটির অস্তিত্ব আছেই। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে খ্যাতনামা মার্কিন লেখক এইচ পি লাভক্র্যাফ্ট এই বইটিকে নিয়ে সরব হন। তাঁর অসংখ্য গল্পে তিনি লিখতে শুরু করেন 'নেক্রোনোমিকেন'- এর কথা।
যতোদূর জানা যায় এই গ্রন্থটি আসলে আরবি ভাষায় লিখিত। পরে এর গ্রিক অনুবাদ ইউরোপের রহস্যবাদী কাল্টগুলোর হাতে পৌঁছায়।
মনে করা হয় 'নেক্রোনোমিকেন'-এর লেখক আবু আলি আল-হাসান নামে জনৈক আরবি ব্যক্তি । তাঁকে দামাস্কাসে 'আরব আবদুল' বলে ডাকা হতো। ইউরোপে তিনি 'দ্য ম্যাড অ্যারাব' নামেই পরিচিত ছিলেন। তাঁর আসল পরিচয় আজও জানা না গেলেও এটুকু অনুমান করা যায় ৮২৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ আরব আবদুল জীবিত ছিলেন এবং 'ইরাম' নামে কোনও এক গুপ্ত শহরে ১০ বছর থেকে তিনি বিস্তর গুপ্তবিদ্যা শিক্ষা করেন। তার পরে 'আজিফ' ছদ্মনামে এই বইটি লেখেন।
কী রয়েছে এই বইতে তা কারোর কাছেই স্পষ্ট নয়। তবে লাভক্র্যাফ্ট- এর মতোই অসংখ্য সাহিত্যিক মনে করেন এই বই কালোজাদুর এক খনি। এতে পিশাচ-জাগরণের পদ্ধতি থেকে শুরু করে মৃতকে জীবিত করার উপায় পর্যন্ত বর্ণিত রয়েছে। যে ব্যক্তি এই বইটি পড়ে ফেলতে পারবেন মহাজগতের সব রহস্য তাঁর হাতের মুঠোয় চলে আসবে।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য মধ্যযুগে ইউরোপে যখন ডাকিনীবিদ্যার চর্চা তুঙ্গে তখন 'নেক্রোনোমিকেন' নিয়েও পাগলামি বিপুল ভাবে দেখা দেয়। অসংখ্য মানুষ সন্ধান করতে থাকেন বইটির। তাল বুঝে বেশ কিছু নকলনবিশ 'নেক্রোনোমিকেন' নাম দিয়ে কল্পিত কিছু বই বাজারে ছাড়তে শুরু করে। অসংখ্য নকল 'নেক্রোনোমিকেন'-এ ভরে যায় ইউরোপের গুপ্ত বইয়ের বাজার।
১৯২৭ সালে লাভক্র্যাফ্ট 'নেক্রোনোমিকেন'-কে নিয়ে একটি কল্প-ইতিহাস লেখেন। ১৯৩৮-এ তা প্রকাশিত হলে তুমল হইচই পড়ে যায় পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে । এরপর থেকে মাঝে মাঝেই এই বইয়ের তথাকথিত খণ্ডাংশ - কল্পিত টীকাভাষ্য ইত্যাদি প্রকাশিত হতে শুরু করে। গুজব ছড়ায় জারতন্ত্রী রাশিয়ার কুখ্যাত জাদুকর রাসপুটিন ; নাৎসি নেতা হিমলার এমনকী স্বয়ং হিটলারও একটি করে কপি হস্তগত করেছিলেন। তবে লাভক্র্যাফ্টের মতে কোনও দিনই আসল বইটাকে কেউ চাক্ষুষ দেখে উঠতে পারেন নি।
তাই আজও অসংখ্য মানুষ বিশ্বাস করেন বিশ্বের কোথাও না কোথাও 'নেক্রোনোমিকেন' ঠিকই রয়েছে। হয় কোনও পুরোনো গ্রন্থাগারের ধুলোভরা তাকে বা কোনও গির্জার ভূগর্ভস্থ ক্রিপ্ট-এ কোনও ব্যক্তিগত সংগ্রাহকের গোপন ভল্টে নিঃশ্বাস নিচ্ছে এই মহাগ্রন্থ। যিনি একে পড়ে ফেলতে পারবেন তাঁর হাতে আসবে অগাধ ক্ষমতা। চন্দ্র - সূর্য ছাড়া কেবলমাত্র তিনিই পৃথিবী শাসনের স্পর্ধা দেখাতে পারবেন।
____________________________________________________________________________________
সুলগ্না ব্যানার্জ্জী
ঠিকানা - ৮বি , যাদব লেন , ভবানীপুর
কলকাতা - ৭০০০২৫.
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন