চির মঙ্গল
সৃজনী ঘোষ
নতুন ছেলেটা মাঝে মাঝেই ক্লাসটাকে নিজের রাজত্ব মনে করে নেয় ৷ নিজে ক্লাসের মনিটারও নয় , অথচ শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে কেউ টুঁ শব্দটি করলেই নাম সোজা প্রিন্সিপল এর কাছে ৷
ছেলেটার নাম চিরন্তন দে ৷ আমার চেয়ে বোধহয় দু-তিন বছরের বড় ৷ ফর্সা , ছিপছিপে গড়ন, এলোমেলো চুল ; পড়াশোনায় মোটামুটি ভালোই , - অন্ততঃ মন্দ বলা যায় না । তবে এমনিতে তার মনে সবসময় একটা উদাস উদাস ভাব ৷ তার বিষয়ে কেউই ভালো রকম জানেনা I জানতে চাইলে , সে কেমন যেন একটু অপ্রতিভ হয়ে ওঠে ৷ তাই আমি সেই সম্বন্ধে বিশেষ আগ্রহ দেখাই না ৷ তার ব্যবহারও মন্দ নয় ৷ কিন্তু তার জন্য আসলে ক্লাসের অধিকাংশ দুষ্টু ছেলেমেয়েদের খুব ভুগতে হয় ৷
তবে আমার কিন্তু চিরন্তনকে রাগাতে বেশ মজা লাগে ৷ যেমন একদিন ফুটবল মাঠে আমি বললাম – " আমার দল জিতলে তুমি আমায় মিষ্টি খাওয়াবে ৷ আর তোমার দল জিতলে আমি তোমায় খাওয়াব ; কী রাজী তো ? '' আমি অত্যন্ত ভালো করে জানতাম যে আমার দল জিতবে I আর সেও বোধহয় তাই জানতো , কিন্তু তবুও সে চ্যালেঞ্জ নেবেই I বলল , - " আ-আ-আচ্ছা ঠিক আছে । তাই কথা রইল । " কিন্তু দুর্ভাগ্যবসতঃ সেদিন তার পেটে আর মিষ্টি জোটেনি I কারণ তার দলকে খুবই লজ্জাজনক ভাবে হারিয়েছিলাম সেদিন ৷
আর একদিন ঘটেছে কী –সে দাবি করে বসল তাকে নাকি 'দাদা' বলে ডাকতে হবে ৷ আসলে আমি মনে মনে দাদা বলেই ভাবতাম ৷ কারণ দাদা বলে ডাকলে মানুষকে বেশি কাছের মনে হয় ৷ কিন্তু কোনদিন তা প্রকাশ করিনি , পাছে বন্ধুরা জিগ্যেস করে বসে কেনো এরকম বলছি ? তাই সেদিন মিছে রাগ দেখিয়ে বললাম- "বেশতো ¸বয়সে বড় হলে এইটে পড়বে যাও ,সেভেনে পড়তে গেলে কেন ? আমি তোমায় দাদা বলে ডাকছি না , যাও ৷" আমার এই কথা বোধহয় সেদিন তার মনে আঘাত করেছিল একটু ৷ দেখেছিলাম কিছু উত্তর না দিয়েই হনহন করে চলে গেল ৷আমিও সেদিন অপরাধ বোধে ভুগেছিলাম ৷ মনে মনে বলেছিলাম-" তুমি হয়ত খানিকটা ভুল বুঝলে চিরন্তন ৷ আমি তোমায় একটুও কষ্ট দিতে চাইনি ৷"
আর কারোর সাথে ও সেরকম কথা বলে না ৷ শুধু বলে দেয় – " ক্লাসটা তো পড়ার জায়গা , গল্প করতে যাবো কেন ? " কিন্ত না জানি কেন , আমার সঙ্গে সে রোজ টিফিন ব্রেকে খুব গল্প করে , মাঝে মাঝে তো হাসিঠাট্টাও বাকি রাখেনা।
তবে হঠাৎ একদিন দেখলাম চিরন্তন এসে লাস্ট বেঞ্চে বসে গেল ৷ আজ তার উজ্জ্বল মুখে কে যেন কালি মাখিয়ে দিয়েছে । সারাক্ষণ মাথা হেঁট করে রইল , ম্যামের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আর , " আমি বলি , আমি বলি " করল না I টিফিনের বেল বাজতেই , তার কাছে গিয়ে বসলাম , বললাম – " কী হয়েছে গো চির দা ? " কিছুক্ষণ মৌন থেকে সে মুখ তুলল l দেখলাম তার পদ্মের মতো চোখ দুটো জবাফুলের মতো লাল হয়ে উঠেছে ।
আমি আবার বললাম , " অমন ঝিমিয়ে গেছো কেন গো ? আমার কিন্তু একটুও ভাল লাগছেনা বলেদিলাম ৷" সে হয়তো একটু হাসার চেষ্টা করেছিল , কিন্তু পারল না ৷ গম্ভীর হয়ে বলল –
" আজ বোধহয় আমায় চলে যেতে হবে …"
বাধা দিয়ে জিগ্যাসা করলাম-
" কোথায় ? "
" অনেক অনেক দূরে…"
" মানে ? "
" মঙ্গলে ৷ "
" মঙ্গল গ্রহে ? " হতবাক হয়ে ভয়ার্ত কন্ঠে প্রশ্ন করি আমি ৷
" হ্যাঁ , আমার মাতৃভূমিতে ৷" সে বললো ৷
আমি ভাবলাম হয়ত আমার সঙ্গে রসিকতা করছে সে ৷ তাই হেসে বললাম , " এইরকম আজগুবি হাসিঠাট্টা কিন্তু আমার এক্কেবারে ভালো লাগে না বলছি ৷" সে বলল , " হাসিঠাট্টা নয় গো ৷ আমার জন্মভূমি মঙ্গল গ্রহে ৷ আমি ছিলাম স্কুল টপার আর প্রচন্ড সাহসী ৷ তাই সেখানকার বিজ্ঞানীরা ,যারা একটা মহাকাশযান পাঠাবে ভাবছিল পৃথিবীতে , আমাকে তাদের স্পেসক্রাফ্টে চাপিয়ে দিল ৷ জানো তো , সেখানকার মানুষজন বড় নির্দয় ৷ মা বাবা কত কাকুতি মিনতি করেছিল , বলেছিল , " একটা অত কম বয়সি ছেলে কীভাবে স্পেসশিপ চালাবে ! আর বিপদ তো ঘটতেই পারে ৷ " কিন্তু আমাকেই নিয়ে এল ওরা জোর করে ৷ আমি কী ভাগ্যিস বড়ো বড়ো দাদা-দিদিদের মহাকাশ বিজ্ঞানের বইগুলো একটু পড়ে নিয়েছিলাম ! নয়তো কী যে হতো কে জানে ! ওরা আমায় কেবল পাঁচ মাসের জন্য পৃথিবীতে পাঠাল ৷ বলল , পাঁচ মাস শেষ হলে ওরা আমায় আবার নিয়ে যাবে ৷"
আমাকে সাধারণতঃ কাঁদানো খুব কঠিন ৷ কিন্তু চিরদার কথাগুলো শুনে কেন জানি না , আমার চোখের জলের বাঁধ ভাঙল ৷ আমি জানতাম সে খুব সুন্দর বাঁশি বাজায় ৷ আমায় শুনিয়েও ছিল কয়েকবার ৷ বললাম , " একবার তোমার সেই বাঁশি… শেষ বারের জন্য বাজাও নাগো চির দা ! সে কিছু বলতে পারলো না ৷ পকেট থেকে বাঁশিটা বার করে , দৌড়ে দৌড়ে মাঠে গেল ৷ আমিও ছুটলাম পিছু পিছু ৷ তারপরে ও বাঁশি বাজাতে লাগলো ৷ আঃ…সে এক মনমুগ্ধকর , করুন সুর ! শুনলেই গায়ে কাঁটা দেয় ৷ বাঁশির সুর শুনতে শুনতে কিছুটা অচেতন হয়ে গিয়েছিলাম হয়তো ৷ চেতনা ফিরতে দেখলাম , সামনে একটা বড় , গোলাকার মহাকাশযান দাঁড়িয়ে ৷ সেখান থেকে একটা লম্বা মই বেরিয়ে এলো ৷ মই এর শেষ ধাপে উঠে বিষন্ন মুখে সে আমার দিকে তাকাল , দেখলাম তার চোখেও জল । আমি কাতর স্বরে জিগ্যাসা করলাম , " আবার কবে আসবে গো চির দা ? "
" তাতো জানিনা ! তবে বড় হয়ে ভাবছি একবার তোমাকে আর এই সুন্দর পৃথিবীটাকে দেখতে আসব ৷"
সে তার ব্যাগের থেকে একটা ছোটো , শক্তিশালী এবং উন্নতমানের যন্ত্র আমাকে উপহার দিয়ে বলল – " চাইলে এর সাহায্যে তোমরাও আমাদের দেশে আসতে পার ৷ " সে মহাকাশযানের মধ্যে প্রবেশ করল এবং মহাকাশযানের দরজা বন্ধ হয়ে গেল ৷
ধীরে ধীরে মহাকাশযান আকাশে মিলিয়ে গেল । আমি স্তব্ধ হয়ে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে মঙ্গলের দিকেই চেয়ে রইলাম ৷
______________________________________________________________________________________________
বয়স - ১২+ , সপ্তম শ্রেণী , আরামবাগ বিবেকানন্দ একাডেমি ,
আরামবাগ , হুগলি ।
ঠিকানা - বাসুদেবপুর মোড় , আরামবাগ , হুগলী , 712601
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন