Featured Post
ধারাবাহিক উপন্যাস ।। তিতলির বিশ্বভ্রমণ ।। (ডাঃ) অরুণ চট্টোপাধ্যায়
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
তিতলির বিশ্বভ্রমণ
-ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়
প্রথম পর্ব - বঙ্গভ্রমণ
চার
বনের মাঝে মনের সুখ
হাতিদাদার কলাগাছ খাওয়ার আশা পূরণ করেই আবার তিনজনকে পিঠে নিয়ে হাঁটা দিল সে। মাঝে একটা বড় মাঠ মত পড়তে হাতিদাদা বলল, তোমরা কি একটু বিশ্রাম নেবে নাকি গো দিদিরা?
তিতলিরা বোধহয় আপত্তি জানাতে যাচ্ছিল কিন্তু দাদু বুঝল বেচারি হাতিদাদার হেঁটে হেঁটে খুব পা ব্যথা হয়েছে। বলল, ভালই তো গো তিতলিদিদি আর পুচকি সোনা। চল আমরাও একটা পা ছাড়িয়ে নিই। অনেকক্ষণ বসে বসে পা ব্যথা করছে।
তিতলিদিদি খুব বুদ্ধিমতি। এক পলক দাদুর চোখের দিকে তাকিয়েই সব বুঝে গেছে। পুচকিকে বলল, ভালই হয়েছে। চলে নেমে একটি ঘুরেই নিই।
হাতিদাদা পা মুড়ে বসতেই সবাই নেমে গেল। তার মাথায় হাত রেখে তিতলিদিদি বলল, তুমি একটু বিশ্রাম নাও হাতিদাদা। আমি আর পুচকি ততক্ষণ এই মাঠে একটু ছোটাছুটি খেলে নিই।
দাদু হাতিদাদার মাথায় হাত দিয়ে একটু আদর করে বলল, হাতিদাদু তুমিও একটুঁ বিশ্রাম নিয়ে নাও ভাই। একটানা অনেকটা হেঁটেছ আজ।
তিতিলি পুচকির হাত ধরল। পুচকি তিতলির। দুজনে মিলে গোল হয়ে ঘুরতে ঘুরতে নাচতে লাগল। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কি সুন্দর বাতাস বইছে। মাঠের মধ্যে সবুজ ঘাসেরা যেন সতেজ আর চঞ্চল হয়ে উঠেছে দুই চঞ্চল মেয়ের আনন্দে। চারিপাশের গাছেরাও যেন হাসছে। হাসছে নীল আকাশের বুকে ভেসে বেড়ান সাদা মেঘেরাও। আর হাসছে মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি পাড়া সূর্যটা। আজ তার মেজাজ বেশ ভাল। মেঘের ফাঁক দিয়ে আসছে বলে গরম বেশ কম।
দাদু একপাশে নিজের মত করে একটা জায়গা করে নিল। ঝুলি থেকে বেরোল লেখার খাতা আর পেন। দাদু লিখবে তিতলি-পুচকির এই সোদরবনের ভ্রমণ কাহিনী। এই লেখাই তো বিখ্যাত করে দিয়েছে এই দুই বোনকে। তাদের নিয়ে এই কাহিনী কি পড়ে শুধু মানুষে? পড়ে বাঘ, সিংহ, হাতি, গন্ডার, হরিণ, ছাগল, গরু, কুকুর, বাঁদর, টিয়া সব পশুপাখীরা। তিতলিরাই তো বনের সব পশুপাখীদের মুখে মানুষের ভাষা এনে দিয়েছে। সত্যি তো ভালবাসায় কি না হয়? পশুপাখীদের, ভালবেসে মানুষের ভাষা শিখে নিয়েছে। আবার তিতলিরাও শিখে নিয়েছে পশুপাখীদের ভাষা।
খেলা একটু থামিয়ে তিতলিরা চলে এল হাতিদাদার কাছে। হাতিদাদা তখন একটু বিশ্রাম নিচ্ছে। তিতলি তার গায়ে হাত দিয়ে বলল, হাতিদাদা তুমি একটু বিশ্রাম কর তবে। আমি আর পুচকি একটু এধার ওধার ঘুরে এসে দেখি যদি কচি ঘাস পাই তো তোমার জন্যে নিয়ে আসব।
হাতিদাদা খুশি হয়ে মাথা এদিক ওদিক দোলাতে লাগল। কথাটা একটু দূরে বসে থাকা দাদুর কানেও পৌঁছে থাকবে। দাদু বলল, বেশী দূরে কিন্তু যেয়ো না দিদিরা কেমন?
--না গো দাদু। তোমার চিন্তার কিছু নেই। আমরা একটু পরেই ঠিক ফিরে আসব। ওরা লাফাতে লাফাতে চলে গেল।
কাজলনয়নার কান্না
মনের আনন্দে লাফাতে লাফাতে ওরা বেশ কিছুদূর চলে এসেছে। চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। সবুজের মেলা। চোখ যেন জুড়িয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে একটু ঝোপঝাড় পড়ছে। কোনও ঝোপ ছোট তো কোনও ঝোপ বড়।
একটা এমন ঝোপের কাছাকাছি এসে ফট করে দাঁড়িয়ে পড়ল পুচকি গালে হাত দিয়ে।
--কিরে দাঁড়ালি কেন চল? তিতলি তাগাদা দিল।
পুচকি কথা না বলে বড় ঝোপের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
--কি কি ওখানে?
পুচকি ততক্ষণে তিতলির খুব কাছে চলে এসেছে। তিতলিকে জড়িয়ে ধরে বলল, ভয় করছে দিদি।
--ওমা ভয় কিসের?
--ওখানে বাঘ টাঘ থাকবে না তো? এটা নাকি হেতালের জঙ্গল। আর হেতালের জঙ্গলেই বাঘ থাকে বইতে পড়েছি।
--দূর পাগল। মনে রাখিস আমরা এসেছি এই বনের রাজার আমন্ত্রণে। আমাদের বাঘুমামা হল এই সোদরবনের রাজা। সে জঙ্গলের সব পশুদের কড়া নির্দেশ দিয়ে রেখেছে কেউ যেন আমাদের একটুও ক্ষতি না করে। শুনলি না বানুদাদার কথা?
পুচকি এবার ঘাড় নাড়ল। সত্যি এটা তো মনে ছিল না। তারা যে এই জঙ্গলে রাজ-অতিথি। অতিথিদের এতটুকু অমর্যাদা হলে কি আর তাদের বাঘুমামা কাউকে আস্ত রাখবে? খুব গর্ব হল তার। আবার হাসিও পেল। তারা বাচ্চা বাচ্চা দুই বোন আবার নাকি রাজার অতিথি।
পুচকি তো চুপি চুপি একটু মুচকি হেসে নিল। তিতলি ভাবল যাক বোনের মন থেকে ভয়টা তবে দূর হয়েছে। সেও একটুঁ হাসল। হেসে বলল, চল তবে দেখি কোথায় বড় বড় নরম নরম ঘাস পাওয়া যায়।
একটু পরেই আবার পুচকি তার হাত ধরে টান দিল।
--কি হল রে আবার?
আবার একটা ঝোপ। আর সেই ঝোপের মধ্যে থেকে কি যেন জ্বলজ্বল করছে।
-ওটা কি দিদি? বড় ভয় করছে।
--আমাকে বাঁচাও। আমি আটকে পড়েছি। আমি তোমাদের কোনও ক্ষতি করব না। আমাকে বাঁচাও প্লিজ। লক্ষীটি দিদিরা আমাকে বাঁচাও।
খুব সরু গলায় এত কাতর আবেদন যে মন গলে গেল তিতলির। সে এগিয়ে গেল ঝোপের দিকে। পুচকি একবার সাবধান করার চেষ্টা করল, দিদি চল দাদুকে নাহয় ডেকে নিয়ে আসি।
--তুই একটা আস্ত ভীতুর ডিম। ধমকে উঠল তিতলি, দেখছিস না জন্তুটা বিপদে পড়েছে? আমরা এ সময় ওকে ফেলে চলে যেতে পারি?
ঢুকে গেল সে ঝোপের ভেতরে। একটা ছোট্ট গরুর বাছুরের মত প্রাণী। গায়ের রঙ ঝোপের অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না। তিতলি ভাল করে পরীক্ষা করে বলল, এটার একটা পা সরু সরু লতায় জড়িয়ে আটকে পড়েছে। আহা বেচারি কি কষ্ট পাচ্ছে।
সাহস পেয়ে পুচকিও তখন ঢুকেছে ঝোপের মধ্যে। দুজনে মিলে অনেক টানাটানি করেও পারল না পশুটাকে উদ্ধার। তিতলি আক্ষেপ করে বলল, ইস যদি একটা ছুরি টুরি থাকত। দাঁড়া দাঁড়া এই তো পেয়েছি। এটা দিয়েই হবে মনে হয়।
ঝোপের বাইরে মাটিতে পড়েছিল একটা ছোট এলুমিনিয়ামের ভাঙ্গা পাত্র। দাদু বলেছে এখানে জঙ্গল রক্ষীরা ছোট ছোট জন্তু জানোয়ারের দেখাশোনা করে। খেতে টেতেও দেয়। তাদেরই কোনও ফেলে দেওয়া পাত্র হয়ত।
সেই ভাঙ্গা পাত্রের ধারাল দিকটা দিয়ে ঘষে ঘষে লতা কেটে মুক্ত করে দিল জন্তুটাকে। সেটা অমনি তড়াক করে লাফিয়ে বেরিয়ে এল ঝোপ থেকে। ছোট্ট বাছুরের মত বটে তবে কি সুন্দর মিষ্টি সোনালী রঙ সারা গায়ে। আর সুন্দর ছোপ। মাথায় দুটো শিং বটে তবে তাদের আবার নানা শাখাপ্রশাখা বেরিয়েছে।
দুই বোন মুগ্ধ হয়ে দেখছে। এমন সময় তিতলি হাততালি দিয়ে বলল, ওমা এ যে আমাদের হরিণ সোনা গো।
--অনেক ধন্যবাদ। হ্যাঁ আমি তোমাদের হরিণ সোনা। তবে আমাকে এই জঙ্গলে সবাই কাজলনয়না বলে জানে।
--কাজলনয়না? তিতলি আর পুচকি তো অবাক।
--হ্যাঁ গো দিদিরা। আমার এই চোখদুটো দেখছ কত কালো?
--হ্যাঁ তাই তো কি সুন্দর! তিতলি বলল।
--যেন গভীর কালো জলের মত। পুচকি বলল।
কাজলনয়না হেসে বলল, আমার চোখদুটো বড় সুন্দর। কাজলের মত কালো সুন্দর। তাই তো লোকে আমাকে বলে কাজলনয়না।
পুচকি বলল, শুধু চোখদুটো কেন তোমার সব কিছু সুন্দর। গায়ের এই সোনালী রঙ। এই যে কাল কাল ছোপ।
তিতলি বলল, আর মাথার এই শিং দুটো। যেন একটা বাহারি গাছের ডাল। কি সুন্দর কি সুন্দর।
--ভাগ্যি তোমরা আমাকে উদ্ধার করলে। নাহলে যে কি হত।
তিতলি তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, থাক থাক কাজলনয়না দিদি। তোমার ওপর এত ধকল গেছে আর কথা কয়ও না।
খুব খুশি হয়ে কাজলনয়না বলল, কিন্তু তোমরা কেন এই ভয়ানক জঙ্গলে গো বোনেরা? জান না প্রতি পদে পদে বিপদ এখানে? বনের এত গভীরে মানুষেরা ঢোকে না।
পুচকি তড়বড় করে বলে উঠল, আমাদের আবার বিপদ কি? আমরা তো রাজার অতিথি।
কাজলনয়না তার কাল চোখদুটো বড় বড় করে বলল, মানে?
তিতলি তখন সব বুঝিয়ে বলল। তারা তাদের বাঘুমামার আমন্ত্রণে রাজ-অতিথি হয়ে এসেছে। সব শুনে হরিণ বলল, বাবা তোমরা সেই অত্ত দূর থেকে এসেছ?
--এই যা কথায় কথায় কত দেরি হয়ে গেল। হাতিদাদার ঘাস জোগাড় করা হল না তো?
--ঘাস? হাতিদাদার জন্যে? আরে আগে বলতে হয়। হাতিদাদা তো এই জঙ্গলে থাকে না। সে আমাদের অতিথি। চল আমার সঙ্গে আমি লম্বা লম্বা বড় বড় সবুজ টাটকা ঘাসের সন্ধান দিচ্ছি। আমি রোজ এখান থেকেই ঘাস খাই। হাতিদাদার খেতেও মজা হবে খুব।
ঘাস নিয়ে যেতে দেরি হয়ে গেল। এদিকে দাদু তাদের দেরি দেখে খুব চিন্তা করতে আরম্ভ করেছে। হাতিদাদাও মুখ চুন করে বলছে, দাদু একটা সত্যি কথা বলি। এ জঙ্গলটাও আমার চেনা নয়। তোমার কাছে তো মেশিন আছে। তুমি তো বাঘুমামার সঙ্গে একটা রেডিও যোগাযোগ করতে পার।
--আর কাউকে কিচ্ছু করতে হবে না দাদু। চিন্তা কর না। হাসতে হাসতে হাতের ঘাস দোলাতে দোলাতে দূর থেকে আসছে দুই বোন।
এসে হাতিদাদার মুখের সামনে ঘাস ধরে তারা গল্প বলে যেতে লাগল কাজলনয়নার। কানখাড়া করে সব শুনল দাদু। এগুলোই তো আবার একটু পরে লিখতে হবে তার খাতায় নাকি? তিতলির বিশ্বভ্রমণের কাজলনয়না পর্ব।
সুঁদরী মাসির সঙ্গে আলাপ
আজ দাদুর একটু শরীরটা ম্যাজ ম্যাজ করছে। হাতিদাদা বলল, তোমারা কি একা একা তবে যাবে দিদিরা? আমার ওপর কি ভরসা আছে?
তিতলি বলল, তুমি বলছ কি গো দাদা। তুমি আমাদের সেই কত দূর থেকে বয়ে এনেছ। ভরসা থাকলে আমরা আসতুম বুঝি?
কোথা থেকে লাফাতে লাফাতে বানুভাই এসে হাজির। কিচকিচ করে বলল, তা দিদিরা হাতিদাদার ওপর যেমন ভরসা কর তেমন ভরসা আমার ওপর আছে কি?
এরা দুই বোন তো অবাক। বানুভাইদের ওপর ভরসা থাকা না থাকায় কি যায় আসে?
-চল আজ আমরা তোমাদের দুই বোনকে বেড়িয়ে নিয়ে আসি।
অবাক দুই বোনের মুখ দিয়ে কথা ফোটে না। বানুভাই আবার বলল, ভয় কি যাবে আমাদের পিঠে পিঠে। আর চারপাশে থাকবে তোমাদের অসংখ্য ভক্তের দল আমার অনুগত বানর সেনারা।
পুচকি তো ভয়ে কাঠ। যদি পড়ে যায়। তিতলি হাততালি দিয়ে বলল, বেশ মজা হবে বানুদাদা। তুমি কি খুব জোরে লাফাবে?
-আরে না না। এমন জোরে লাফাব না যাতে তোমরা নিচে পড়ে যাও। আর তোমাদেরও শক্ত করে ধরে থাকতে হবে আমাদের গলা।
পুচকিকে অবশেষে রাজী করান গেল। তাছাড়া আজ দাদুর শরীর খারাপ। হাতিদাদারও মনে হচ্ছে একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। দাদুও অনুমতি দিল। বলল, তোমরা নির্ভয়ে যেতে পার। তাছাড়া ওরা তো দুএক জন নয় একসঙ্গে একদল।
শুরু হল পথচলা। দিব্বি বানুভায়ের পিঠে উঠে পড়ল তিতলি। দেখাদেখি উঠে পড়ল পুচকিও। বানরদের একটা মস্ত সুবিধে হচ্ছে ওরা লাফিয়ে লাফিয়ে যায়। এক লাফে অনেক দূর যায়। আবার যায় অনেক ওপর দিয়ে। চট করে মাটির কাছাকাছি জন্তু জানোয়াদের নাগালে আসতে পারে না।
একেবারে গোড়ায় খুব ভয় লাগলেও একটু পরে খুব ভাল লাগল তাদের। প্রথমে একটু নিচু দিয়ে গেলেও আস্তে আস্তে ওপর দিয়ে চলতে লাগল। আর চলতে চলতে মানে লাফাতে লাফাতে বানুভাই জঙ্গলের নানা বর্ণনা দিতে লাগল। নানা গাছপালা, ফলফুল আর নানা জন্তুতে ভরা এই সুন্দর বন। সবচেয়ে বেশি আছে সুন্দরী গাছ যার নাম থেকেই এই বনের নাম। একটা অদ্ভুত ঝোপ দেখে তিতলি অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, এই ঘাসের মত গাছগুলো কি গাছ গো বানুদাদা?
-এগুলো হল বেতগাছ। ঘাসের মত দেখতে হলেও এগুলো কিন্তু বড় বড় গাছের মত লম্বা হয়। এই গাছের কান্ড নলের মত। এগুলোকেই বেত বলে। তোমরা যে বেতের চেয়ার টেবিল ব্যবহার কর সেগুলো এই বেতগাছের নলের মত কান্ড শুকিয়ে হয়।
বেতগাছের একটু কাছে চলে এল বানুভাই আর তার সঙ্গী। পিঠে বসে দেখতে লাগল পুচকিও। কি সুন্দর গাছ। আর কেমন দানা দানা হলদে হলদে ফুল।
পুচকি বলল, কি সুন্দর গন্ধ!
বানুভাই বলল, এ ফুলে মালা গাঁথা যায় না গো দিদিরা। তবে এ ফুলের গন্ধ বড় মিষ্টি।
-হ্যাঁ তাই তো। কত মৌমাছি আর পিঁপড়ে কেমন ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখ দিদি।
-এই ফুল হবার আগে গাছ থেকে খুব মিষ্টি গন্ধের রস বেরোয়। সেই গন্ধের লোভেই তো আসে পিঁপড়ে মৌমাছির দল।
সত্যি তাই। দেখে তিতলির খুব ভাল লাগল। বেতের আসবাব পত্র আছে দেখেছে। কিন্তু সেই বেত যে গাছ থেকে হয় তা জানত না। আর জানত না সে গাছ এত বড় আর সুন্দর। সবচেয়ে সুন্দর পাতা আর ফুল। এর নাকি ফলও হয়। বানুভাই বলেছে। তবে বেতগাছে খুব কাঁটা তাই কাছে যাওয়া যায় না। আবার এ গাছে নাকি ফলও হয়।
এরপর এক জায়গায় দেখল আরও অনেক সুন্দর সুন্দর গাছ। প্রায় চারপাঁচ তলা বাড়ির সমান উঁচু। গাঢ় খয়েরী রঙের কান্ড আর ছোট ছোট পাতা। তাতে ফুটে আছে অজস্র হলুদ রঙের ছোট ছোট ফুল। তিতলি আর পুচকি দুজনেই লাফিয়ে উঠল হাততালি দিয়ে, কি সুন্দর কি সুন্দর!
-সুন্দর তো হবেই গো দিদিরা। এ গাছের নামই যে সুন্দরী গাছ। এই গাছের নামেই যে গোটা বনটার নাম সুন্দরবন। সকলে ভালবেসে একে সুঁদরী গাছ বলে ডাকে।
চোখ একেবারে বড় বড় হয়ে গেল দুজনের। এই তবে তাদের স্বপ্নের সেই সুন্দরবনের সুন্দরী গাছ? এই সুন্দরী গাছের নামেই এই বন যে বনে থাকে তাদের আদরের বাঘুমামা বা বাংলার রাজা দি রয়েল বেঙ্গল টাইগার?
গর্বের সঙ্গে মাথা উঁচু করে দেখছে তারা দুই বোন। অনেকক্ষণ ধরে দেখে বলল, গাছও তো আমাদের আত্মীয় হয়। এই সুঁদরি গাছ এও তো আমাদের আত্মীয় কি বলিস পুচকি? আজ থেকে আমি সুঁদরি মাসি বলব। ইস দাদুকে দেখালে হত।
কিচকিচ করে হাসল বানরের দল। তিতলি বলল, হাসলে কেন বানুভাই?
-হাসলুম কি আর সাধে? হাসলুম এই জন্যে যে এই সুন্দরী গাছ এই বনের সর্বত্র আছে। এই গাছ যে মস্ত ছায়া দেয়। সুন্দর দেখতে বলেই তো এই গাছের নাম সুন্দরী। শুধু তোমাদের নয় এ আমাদেরও মাসি হয়। আমরা এই গাছের ওপর উঠে কত লাফালাফি খেলা করি। কত স্নেহ-ভালবাসার সম্পর্ক এই গাছের সঙ্গে আমাদের।
একটু চুপকরে থেকে সে আবার বলল, আর এই গাছ বিরল নয়। তোমাদের মামা মানে আমাদের রাজার ডেরার কাছেপিঠেও আছে অনেক। হয়ত দেখেছ কিন্তু তখন খেয়াল নেই।
তিতলি কিছু একটা ভাবতে ভাবতে বলল, মনে পড়েছে। তবে নাম তো জানতুম না। দাদুও তবে দেখেছে।
কিচকিচ করে আবার হাসল বানুভাই, আমাদের দাদু কত বড় বল তো? সে তো আমাদের থেকেও অনেক কিছু জানে।
তা বটে। ভেবে ঘাড় নেড়ে দিল দুই বোন।
চিত্রাদিদির কথা
এরপর আরও অনেক গাছ দেখল তারা। গোলপাতা, গরান আর নলখাগড়ার গাছ। এবার আবার একটা ঘাসজমিতে সবাই এসে বসেছে। চারপাশে সবুজ বন। কত সুন্দর সুন্দর লতাপাতা। পুচকির মনটা গান গান করছিল। দুই বোন নাচতে নাচতে গান করতে লাগল। সে গান শেষ হতেই দেখল বানুভায়ের বিশ্বস্ত অনুচরেরা কোথা থেকে সোনালী রঙের পাকা কলা এনে হাজির করেছে। অজস্র কলা। তাদের একটা কাঁদি ধরিয়ে দিয়ে বাকি কাঁদিগুলো নিজেরা খেতে লাগল গপাগপ করে।
একটা কাঁদি রেখে দিতে বলল দাদু আর হাতিদাদার সঙ্গে। বানুভাই বলল, দাদুর জন্যে এককাঁদি কলা তারা নিয়ে যাবে কিন্তু হাতিদাদার কি আর এক কাঁদিতে হয়? ওর জন্যে তো গোটা একটা কলা বাগানই দেখান আছে।
খেতে খেতে চোখ পড়ে গেল পাশের ঝোপের দিকে। ঝোপ থেকে চোখ বার করে দেখছে ওটা কে গো? মাথাটা বেরিয়ে আছে। সেই মাথায় কি সুন্দর বিরাট বড় সিং। পুচকি আনন্দে বলে উঠল, আমাদের কাজলনয়না দিদি।
তিতলি তার হাতের কলার ছড়াটা এগিয়ে ধরল। ধীরে ধীরে এগিয়ে এল কাজলনয়না। সারা শরীর বাইরে বেরিয়ে এল। এত সুন্দর হরিণ আগে কখনও দেখে নি এরা। গাঢ় বাদামী গায়ে সাদা ফুটকি। গাছের ডালের মত লম্বা বাঁকানো শিং। গাছের ডালের মত শাখা প্রশাখা বেরিয়ে আছে।
-দেখ দেখ পুচু কি সুন্দর।
বানুভাই বলল, আরে এ তো আমাদের চিত্রাদিদি।
-চিত্রাদিদি মানে?
-একে আমরা বলি চিত্রা হরিণ। এত সুন্দর হরিণ আর কোথাও নেই। এ আমাদের এই সোদরবনের গর্ব।
চিত্রাদি এগিয়ে এসেছে। একবার করে তিতলির হাত থেকে আবার আর একবার পুচকির হাত থেকে কলা খাচ্ছে। আর সারা গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে দিচ্ছে দুই বোন। পুচকি জিজ্ঞেস করল, আমাদের বাড়িতে যাবে চিত্রাদি? আমরা খুব আদর করব।
খুব লজ্জিত হয়ে চিত্রাদি বলল, আমাদের যে এখান থেকে নড়ার উপায় নেই গো দিদিরা।
তিতলি বলল, কেন?
চিত্রাদি মুখ চুন করে বলল, আমরা যে এই বনের গর্ব। আমরা যদি এক এক করে চলে যাই তবে সুন্দর বন কি আর ততটা সুন্দর থাকবে বল?
কথাটা স্বীকার করল দুজনেই। তিতলি বলল, খুব ভাল কথা বলেছ চিত্রাদি। তুমি না থাকলে সুন্দরবন আর সুন্দর থাকবে কি করে?
পুচকি চটপট বলে ফেলল, এই যেমন ধর আমরা বাড়ি থেকে চলে এসেছি। আমাদের বাড়ি আর এখন সুন্দর নেই। তাই না রে দিদি?
চিত্রাদি বলল, ঠিক। তোমরা যেমন তোমাদের মায়ের কাছে সবচেয়ে সুন্দর তেমনি আমিও আমার মায়ের কাছে সবচেয়ে সুন্দর। এই সুন্দরবনই যে আমার মা গো। (ক্রমশ...)
_________________________________________________________________________________________
(ডাঃ) অরুণ চট্টোপাধ্যায়
DR. ARUN CHATTOPADHYAY
181/44 G.T.ROAD (GANTIR BAGAN)
P.O. BAIDYABATI
DIST. HOOGHLY (PIN 712222)
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন