সুন্দরবনের বিপিনহাটের পোস্টমাস্টারের চাকরি পেয়েছি। কলকাতা থেকে যাতায়াত সম্ভব নয়। পিওন সাগর বললো, একটা বাড়ি আছে। কিন্তু সেখানে নাকি ভয়ংকর আওয়াজ হয় রাতে।
রাখোবাবু জঙ্গলের ধারের বাড়িতে একাই থাকেন। কেষ্ট রান্না, ঘরের কাজ করে বাড়ি চলে যায়।
থাকতে চাই শুনে আমার জন্য ওপরের ঘর বরাদ্দ হলো। ভাড়া থাকবেন, তবে রাতের বেলা নীচে নামবেন না। জঙ্গলের ধারে ঘর তো!
আমি খুশি।
জামাকাপড় ছেড়ে, হাতমুখ ধুতেই কেষ্ট চা দিল। রাতে রুটি তরকারি দেবে। আমি নিশ্চিন্তে বাড়িতে মাকে ফোন করলাম।
গ্রামের সন্ধ্যা তাড়াতাড়ি নামে। চারপাশে আঁধার। সাড়ে সাতটার সময় কেষ্ট খাবার দিলে খেয়ে শুয়ে পড়লাম, দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে। আর কিছু না হোক, সাপখোপ থাকতে পারে।
সারাদিনে ক্লান্ত। বেশ শীত লাগছিল। চাদরটা জড়িয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করলাম। ঘুম আসে না।
গভীর রাত। খাটে এপাশ ওপাশ করছিলাম। হঠাৎ যেন মেঝে থেকে উঠে এল আওয়াজটা। হাড় হিম করা।
বুকের ভেতর যেন দামামা বাজল। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলাম।
আওয়াজটা কিন্তু দুবার হয়েই থেমে গেছে। চারপাশ নিঝুম। কোনও আওয়াজ নেই। বাইরে গাঢ় অন্ধকার। ভয়ে বাইরে বেরোতে পারলাম না। জড়োসড়ো হয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি।
পরদিন ঝকঝকে সকাল। কোনও অস্বাভাবিকতা নেই।
কেষ্ট বললো, রাখোবাবু বাড়ি নেই। কাজে শহরে গেছেন।
কেষ্ট কাজকর্ম করছে। আমি বাড়ির চারপাশে ঘুরে দেখতে গেলাম। বাড়ির চারপাশে বাগান জঙ্গল হয়ে আছে। নীচে তিনটে ঘর। একটা ঘরে তালা দেওয়া। কেষ্ট বললো, ওই ঘরটা খোলা হয় না। বাবুর দরকারি জিনিস আছে। ঘরের কাছে খুব বাজে গন্ধ।
আমি খেয়েদেয়ে অফিস গেলাম। আমার মাথা থেকে ব্যাপারটা যাচ্ছিল না।
অর্চিদাকে ফোন করে সব বললাম। অর্চিদা, আমার মাসতুতো দাদা। দাদা কম, বন্ধু আসল। ও আই পি এস। ভবানী ভবনে পোস্টেড। বললো, দাঁড়া, আমি আসছি।
বিকেলের ট্রেনে অর্চিদা এলো। রাখোবাবু অর্চিদাকে দেখে খুব একটা খুশি হলেন বলে মনে হলো না।
রাতে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম দুজনে। চারপাশ নিঝুম হলে অর্চিদা আমাকে ঠেলা দিয়ে বললো, ওঠ বুড়ো। দুজনে কালো চাদর মুড়ি দিয়ে পা টিপে টিপে বাইরে এলাম। চুপিচুপি নীচে এসে অবাক কান্ড! রাখোবাবু আর দুজন ষন্ডাগন্ডা লোক সেই বন্ধ দরজার সামনে। ছোট এমারজেন্সি লাইটটা দিয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে দেখি কি কান্ড! ভেতরে ডাঁই করা পশুর চামড়া। সাথে একটা জ্যান্ত বাঘ। খাঁচায়। আর কয়েকটি হরিণ।
রাখোবাবু বলছেন, দ্যাখো, আর দরাদরি কোরোনা। বনবিভাগ খুব কড়াকড়ি করছে। কালই টাকা দিয়ে মাল নিয়ে যাও। লোকদুটি বললো, বেশ, কাল রাজাবাবু নিজে আসবেন। ওরা চলে গেলে আমরাও ওপরে চলে এলাম।
অর্চিদা বললো, বুঝতে পারছিস? এখানে পশু আর চামড়ার চোরাচালান হয়। কাল হাতেনাতে ধরবো।
পরদিন সারাদিন উত্তেজনা। অর্চিদা সারাদিন ফোনে ব্যস্ত থাকলো। সন্ধ্যায় রাখোবাবু যেন বিরক্ত। আজও কি আপনার দাদা থাকবেন? যাহোক, রাতে যেন বাইরে বেরোবেন না। কাল রাতে একটা চিতা গ্রামে ঢুকেছিল। অর্চিদা অবাক যেন।
রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে শোয়ার ভান করলাম। রাত গভীর হতেই আবার সেই ভয়ংকর আওয়াজ।
অর্চিদা দরজা খুলে বাইরে এলো। নীচে আজ বেশি আলো। কালো চশমা পরা এক ভদ্রলোক রাখোবাবুকে টাকা দিচ্ছেন। একটা জাল দেওয়া গাড়ি দাঁড়িয়ে।
হুইসিল বাজলো। রাইফেল হাতে পুলিশেরা চারিদিকে ঘিরে ধরেছে। রাজাবাবুর হাত পকেটের দিকে যেতেই অর্চিদা তার দিকে রিভলবার তাক করে হ্যান্ডস্ আপ। খাঁচার বাঘটা ভয়ংকর হুংকার দিয়ে উঠলো। রাজাবাবুর চোখ থেকে কালো চশমাটা থানার বড়বাবু টেনে খুলে নিলেন। একি! এযে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টারমশাই!
ইনিই চোরাচালানের মাথা ? আশ্চর্য!
অঞ্জনা মজুমদার
চাঁদপুর পল্লী বাগান
পোঃ রাজবাড়ি কলোনী
কলকাতা৷ ৭০০০৮১
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন