সমীর কুমার দত্ত
সাত বছরের ছেলে নীলু ছোট থেকেই ভূত ভক্ত। ছোট থেকে বড়দের মুখে ভূতের গল্প শুনে শুনে ভূতের প্রতি একটা কৌতূহল জন্মেছে। বাচ্চা ছেলেপুলেরা সাধারণত ডাকাতের, রাক্ষসের , পক্ষীরাজ ঘোড়া ইত্যাদির গল্প শুনতে ও লুকোচুরি খেলতে ভালবাসে জানি। কিন্তু এ ছেলে ভূতের গল্প শুনতে ভালোবাসে । ভূত দেখতে ভালোবাসে। পাড়ার সাথীদের সঙ্গে ভূত ভূত খেলতে ভালবাসে। এই ভূত ভূত খেলতে খেলতে ও নিজেই একদিন ভূত হয়ে গেছে। একদিন ওর এক বন্ধু দীপুর সঙ্গে লুকোচুরি খেলছিলো। কিছুক্ষণ খেলার পর নীলুর আর ভালো লাগেনা বলে," এই ভূত ভূত খেলবি?"
দীপু বললো, " না, আমি ভূত ভয় পাই। আমি ভূত ভূত খেলবো না।"
নীলু বললো, " একবার আমি ভূত হবো, তুই মানুষ হোবি। পরের বার আমি মানুষ হবো আর তুই ভূত হোবি।"
"না, আমি ভূত হবো না।" দীপু বললো।
—বেশ, তাহলে আমিই ভূত হবো। তুই মানুষ হবি। তাহলে হবে তো?
দীপু অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঘাড় নাড়লো, যার অর্থ ঠিক আছে।
—তাহলে আমি ভূত হয়ে লুকিয়ে পড়ি? দীপু , তুই চোখ বুজে থাক। দেখবি না কিন্তু।
নীলু ভূত হয়ে লুকিয়ে পড়লো। চোখ চেয়ে দীপু নীলুকে খুঁজতে গেলো। নীলু এক ঝোপ ঝাড়ের অন্ধকারে লুকিয়ে ছিলো। দীপু খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর ঝোপের মধ্যে থেকে ভূতের গলা শোনা গেলো —হাঁউ-মাঁউ-কাঁউ / মানুষের গন্ধ পাঁউ। দীপু সেই আওয়াজকে অনুসরণ করে ঝোপের দিকে গেলো। গিয়ে দেখলো—সত্যিই এক ভূত! অন্ধকারে চোখ দুটো দেখালো টকটকে লাল,যেন জ্বলছে! এরকম অবস্থা দেখে দীপু দে দৌড়। ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির দিকে ছুটলো। নীলু হাসতে হাসতে ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসে, "এই দীপু, এই দীপু , আমি ভূত নই ।" বলে দীপুকে থামাতে চাইলো। দীপু ভয়ে ততক্ষণে বাড়ি পৌঁছে গিয়ে থাকবে।
দীপু বাড়ি গিয়ে মাকে বলল,"মা, আমি নীলুর সঙ্গে আর খেলবো না।"
দীপুর মা বললেন," কেন রে, নীলু কি তোকে মেরেছে?"
—না, মারেনি। ও ভূত, আমি ওর সঙ্গে আর খেলবো না। সবাই কে বলে দেবো যে নীলু একজন ভূত। তোরা ওর সঙ্গে খেলবি না।"
দীপুর মা ভাবলেন —ছেলের জাত , মনে যা আসে, তাই বলে। এ রকম বলতে থাকলে প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝগড়া লেগে যাবে। তাছাড়া কেউ না খেললে নীলুটা একা হয়ে পড়বে। তাই ছেলেকে বললেন,"দেখ বাবা, এরকম করে বলতে নেই। ও ভূত হতে যাবে কেন?"
দীপু উত্তর দিলো," ওর চোখদুটো অন্ধকারে লাল হয়ে জ্বলছিলো আর বলছিলো, হাঁউ -মাঁউ-কাঁউ /মানুষের গন্ধ পাঁউ। তখন ওকে ভূতের মতো লাগছিলো।"
—ভূত ভূত খেলতে খেলতে ও রকম বলতে হয়। ভূতেরা এ রকম করে কথা বলে তো তাই। ও ভূত না হলে ওর চোখদুটো ভুতের মতো হলো কেনো? ওকে পুরো ভূতের মতো লাগছিলো।
মা মনে মনে ভাবলেন—ও এসব কি বলছে? সত্যিই কি ওকে ভূতের মতো লাগছিলো? বাচ্চা ছেলের জাত, ও তো মিথ্যে বলবে না। দীপুর মায়ের মনটা খচখচ করতে লাগলো। সত্যি হলে তো ভাববার বিষয়। তাহলে নিজের চোখে একবার দেখতে হয়। আর দীপুকে বললেন, "না খেলিস, না খেলবি, কিন্তু কারোর কাছে এ কথা বলবি না। এই বারণ করে দিলাম।
দীপু আর নীলুর সঙ্গে কথা বলে না,খেলে না। পাড়ার অন্যান্য ছেলেপুলে যেমন, নেপু, দানু ,মনু ইত্যাদিরা দীপুকে জিজ্ঞাসা করে," হ্যাঁরে দীপু, তুই নীলুর সঙ্গে আর খেলিস না? ঝগড়া হয়ে গেছে বুঝি? মায়ের কথা ওর মনে পড়ে যায়। মা বলতে নিষেধ করেছে। তাই ঘাড় নেড়ে দীপু জানায়,"না না, আমি এমনিই খেলি না ওর সঙ্গে। ভালো লাগে না তাই।"
নেপু, দানু, মনু যে যার বাড়ি গিয়ে তাদের মায়েদের কাছে বলে। মায়েদের পেটে কথা থাকে না। নিজেদের মধ্যে কথা চালাচালি শুরু করে দেন। সত্য সন্ধানে নেমে পড়েন সবাই। যতক্ষণ না পেট থেকে বের করতে পারছেন,পেট ফুলে মরে যাচ্ছেন কেউ কেউ। একদিন নেপুর মা দীপুর মাকে জিজ্ঞেস করেন, " হ্যাঁ দিদি, নীলুর সঙ্গে দীপু আর খেলে না? কেন?
দীপুর মা কি বলবেন ঠিক করতে পারছিলেন না। বুদ্ধি করে প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে শুধু বললেন," বাচ্চা ছেলে ওদের এই ভাব, এই আড়ি। ওদের কি কোন ঠিক আছে। দুদিন পরে আবার হলায় গলায় হবে। আমি এ নিয়ে মাথা ঘামাই না। এসব নিয়ে মাথা ঘামালে চলে?"
নেপুর মা দীপুর মায়ের কথায় সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। শুধু কথায় সায় দিয়ে বললেন,
" সে তো ঠিক কথা।" কিন্তু ওনার মনটাও খচখচ করতে লাগলো। দীপুরা নীলুদের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। সর্বদা মুখ দেখাদেখি হয়। ওদের সঙ্গে ঝগড়া করে থাকা যায় না। এরা হলো গিয়ে একটু দূরের। আর তাছাড়া এসব কথা চালাচালি ভালো নয়। যে যার জ্বালায় মরছে। কার এতো সময় আছে এসব করার। দীপুর মা এদের থেকে একটু আলাদা। পাশাপাশি থাকার সুবাদে নীলুর সঙ্গে দীপুর খুব ভাব। কিন্তু হঠাৎ দীপুর ওকে এরকম মনে হলো কেন? দীপুর মায়ের হঠাৎ নীলুর মায়ের একটা কথা মনে পড়ে গেলো।। নীলুর মা কথায় কথায় একদিন দীপুর মাকে বলেছিলেন,"জানেন দিদি, নীলু আমার পেটে আসার আগেই আমাকে স্বপ্নে দেখা দিয়েছিলো। চোখ টকটকে লাল। আমার খুব ভয় করছিলো। আমায় যেন বলছে—আমি হোলাম তোর ভাই। ভূত হয়ে তোর পেটে জন্ম নেবো। বলেই কোথায় মিলিয়ে গেলো। ভয় পেয়ে আমি ছুটলাম এক তান্ত্রিকের কাছে। গিয়ে সবকথা খুলে বলি। তিনি একটা কবচ করে দেন। কবচটা কিছুদিন হলো পুকুরে স্বান করতে গিয়ে জলে পড়েগেছে হয়তো। এখানে কোথাও পড়লে পেয়ে যেতাম। আমি আবার গিয়েছিলাম সেই তান্ত্রিকের কাছে। গিয়ে শুনি তিনি মারা গেছেন।"
কথাগুলো শুনে দীপুর মায়ের মনে হলো , দীপু বানিয়ে কিছু বলে নি। ও যা দেখেছে তাই বলেছে। সেই থেকে দীপুর মা নীলুকে এড়িয়ে যেতে বলেছেন।
দীপুর মা নীলুর থেকে ছেলেকে সাবধানে রাখার চেষ্টা করে চলেছেন কিন্তু পাশাপাশি থেকে কতোদিন তা পারবেন তা বলা কঠিন। নীলুর মা সবই লক্ষ্য করছেন কিন্তু কিছুই বলতে পারছেন না। মনে মনে ভাবছেন—কি এমন ঘটলো যে দীপু নীলুর সঙ্গে মুখ দেখাদেখি বন্ধ করে দিলো কথা বলা তো দূরের কথা। নীলু দীপুকে ডাকতে গেলে দীপু বের হয় না,এমন কি সাড়াও দেয় না। দীপুর পরিবর্তে দীপুর মা বেরিয়ে এসে বলেন,
"দীপু এখন পড়ছে। ও খেলতে যাবে না।" নীলু মনমরা হয়ে ফিরে আসে। বাইরে বের হয় বটে আর কৌতূহলী বন্ধুরা জিজ্ঞাসা করে," হ্যাঁরে নীলু দীপু তোর সঙ্গে আর খেলে না?"
নীলু বাচ্চা ছেলে। কতশত বোঝে না। ওর নিজের যে কি হয়,ও নিজেই জানে না, উত্তর দেয়, " একদিন ভূত ভূত খেলছিলাম। ও ভয় পেয়ে আর খেলতে আসে না।"
কেউ কেউ বলে, " তা ভূত ভূত খেলার কি দরকার, ও যখন ভয় পায়? আর কি খেলা নেই?"
—আমার ভূত ভূত খেলতে ভালো লাগে।
—ওর লাগে না। ওর ভালো না লাগলেও খেলতে হবে?
সবাই কিছুটা সন্দিগ্ধ মনে বাড়ি ফিরে গিয়ে যে যার মায়ের কাছে বলে। একদিন নেপু, দানু, মনু ও দীপু রবারের পায়ে বল খেলছিলো। নীলু বেচারী একা একা ঘুরছিলো। দূর থেকে মনু নীলুকে দেখতে পেয়ে ডাকলো,
" এই নীলু, পায়ে বল খেলবি তো আয়।"
খুশি হয়ে নীলু দৌড়ে গিয়ে বললো, "হ্যাঁ খেলবো।"
প্রতিবাদ করে দীপু বললো,
"আবার ওকে ডাকছিস্ কেন? আমি খেলবো না বলে দিচ্ছি।"
অমনি নেপু বললো,"না খেলবি, না খেলবি।"
দীপু দৌড়ে বাড়ির দিকে চলে গেলো।
নীলু বললো,"আমরা তো পায়ে বল খেলছি।ভূত ভূত তো খেলছি না। দেখলি,ও অমনি চলে গেলো।"
"যেতে দে। ও না হলে কি খেলা হবে না।" মনু বললো।
দীপুকে ছাড়া খেলা চলছিলো। খেলতে খেলতে নেপু নীলুকে কী একটা বলতে গিয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে নীলুর চোখ দুটো লাল হয়ে জ্বলছে। নেপু ভয় পেয়ে বলে উঠলো, " কিরে নীলু তোর চোখ লাল হয়ে জ্বলে উঠলো কেন? মুখটা কি বিশ্রী দেখাচ্ছে। আমি স্পষ্ট দেখলুম। বিশ্বাস কর তোরা।"
অমনি দানু আর মনু বলে উঠলো," কোথায় আমরা তো কিছু দেখতে পাচ্ছি না। ও দীপু ভূতের কথা বলছিলো তো তাই বলছে। দেখতে না পাওয়া স্বাভাবিক। কারণ, নীলুর ওই মূর্তি এক একজন করে দেখতে পাবে। সকলে একসঙ্গে দেখতে পাবে না। সকলে একসঙ্গে থাকলে কি ভূতকে দেখা যায়? যায় না। এবার নেপুও দীপুর মতো নীলুর সঙ্গ ত্যাগ করলো।
এদিকে নীলু যে স্কুলে পড়তো সেখানে একজন সহপাঠী নীলুর ভূতের মতো ওই মূর্তি দেখেছিলো। সে অন্যান্য সহপাঠীদের বললো," এই তোরা কেউ নীলুর মুখের দিকে তাকাবি না।"
সকলে বলে উঠলো," কেন? কেন?"
—ভূতের মতো মুখটা করলো!
—'করলো' মানে? ভেঙাচ্ছিলো?
—না, চোখ দুটো টকটকে লাল,যেন জ্বলছিলো।মুখটা ভূতের মতো লাগছিলো।
সকলে বললো,"আর একবার কর দেখি।"
" কী করবো?
—ওই লাল চোখ।
—আমি তো কিছু করিনি। সত্যি বলছি আমি কিছু করিনি। ও কী না কী দেখেছে!
ওই স্কুলে নীলুর পাড়ার বন্ধু মনু পড়তো। মনু বললো," হ্যাঁ ও ঠিক বলছে। আমাদের পাড়ার নেপু, দানু, দীপু ও আমি সকলে দেখেছি। তাই তো আমরা ওর সঙ্গে আর খেলি না। স্কুল থেকেও ওকে বহিষ্কার করা হলো অনেকের সাক্ষ্য সাপেক্ষে। এমন কি হেড মিস্ট্রেস পর্যন্ত প্রত্যক্ষ করেছেন।
এইভাবে এক এক করে সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো নীলু। পাড়ায় ঢি ঢি পড়ে গেলো।নীলু ঘর থেকে আর বের হতে পারে না। নীলুর মা-ও কাউকে মুখ দেখাতে পারেন না। সকলের কাছ থেকে বিতাড়িত হয়ে নীলু ঘরের মধ্যে বসে বসে কাঁদতো। কিছু খেতো না। না খেয়ে খেয়ে ওর শরীর জরাজীর্ণ হয়ে গেলো। ওর জন্য ওর মা ও মুখে কিছু দিতে পারেন না। মায়ের অবস্থা তথৈবচ। কেবল ছেলেকে জড়িয়ে ধরে খালি কাঁদতে থাকেন। প্রতিবেশীরা মর্মাহত হয়ে মাঝে মাঝে এসে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করে তবে বাইরে থেকে। ভূতের সামনে কে আর যেতে চায়? সবারি ভূতের ভয় আছে।
বেশ কদিন এইভাবে কেটে গেলো। চোখে তো ঘুম কারোরই নেই। শরীর দু জনেরই নিস্তেজ। একদিন নীলুর মা তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় স্বপ্নে দেখছেন নীলুর সেই রক্তবর্ণ চক্ষু। নীলু বলছে —মা উঠে পড়। বিদায়কালে আর ঘুমিয়ে থাকিস মা। আমার পরিচয় তোকে দিয়ে যাই। আমি হলুম তোর ছোট ভাই। আমায় জন্ম দিয়ে মা মারা গেলে তুই আমায় বুকে জড়িয়ে ধরেছিলি কিন্তু বাঁচাতে পারিস নি। আমার আত্মা মুক্তি পায়নি। আমি ভূত হয়ে তোর গর্ভে জন্ম নিয়েছি। আমার আত্মা মুক্তি পেয়ে গেছে। আমি চললাম। তোকে আর কষ্ট দিতে চাইনা। তোকে নিয়ে যাবো বলেই তোর কাছে আবার এসে ছিলাম। চল আমার সঙ্গে।নীলুর মায়ের স্বপ্ন ভেঙে গেলো।চোখ চেয়ে দেখলো নীলু নেই। সঙ্গে সঙ্গে ওর আত্মাও মুক্তি পেয়ে গেলো।
______________________________________________________________________________________
সমীর কুমার দত্ত
23/1/A, মোহনলাল বাহলওয়ালা রোড
বালি, হাওড়া -711201
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন