মামা বাড়ি ভারি মজা
মিঠুন মুখার্জী
তিন দিন ধরে অনবরত বৃষ্টি পড়ছে। চারিদিকে জলে পরিপূর্ণ। শহর থেকে গ্ৰাম সব জায়গায় জনজীবন বিপর্যস্ত। পুকুর, নদী, নালা সবই জল আর জল। ছোট্ট মেয়ে দিশা বাবা অনিল মুখার্জীর কাছে মামাবাড়ি যাওয়ার জন্য বায়না করে। বাবা তাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তাকে বোঝানো সম্ভব হয় না। শেষমেষ মেয়ের জেদের কাছে হেরে গিয়ে তিনি তার মেয়েকে মটর সাইকেল করে মামার বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সময়টা যেহেতু বর্ষা কাল , সেহেতু রেইনকোট পড়ে নিয়েছিলেন দুজনেই। বাড়ি থেকে বেরনোর সঙ্গে সঙ্গেই মুষলধারায় বৃষ্টি নেমেছিল। দিশার প্রিয় ঋতু ছিল বর্ষা। তাই বৃষ্টি পড়ার আনন্দ অনুভব করে সে। হাত দিয়ে বৃষ্টির জল ধরে চোখে-মুখে দেয়। বাবা অনিল মুখার্জী তাকে বলেন--- " দিশা মা বৃষ্টির জল এভাবে চোখে - মুখে লাগায় না, জ্বর আসবে। তোর জেদের জন্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে হল আমাদের। এখন কোনো বিপদ ছাড়াই তোর মামার বাড়ি পৌঁছালে হয়। এমন বৃষ্টির মধ্যে কেউ কারো বাড়িতে যায়!" বাবার কোনো কথাতেই সে গুরুত্ব না দিয়ে নিজের কাজ করে যায়। এরপর বৃষ্টির কিছুটা জল সে হাত দিয়ে ধরে খেয়ে নেয়। এবার নিজেকে সংবরণ করতে না পেরে অনিল মুখার্জী তার মেয়েকে জোড়ে বকা দেন এবং মটরসাইকেল এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেন। তারপর দিশাকে বলেন --- " এই ভাবে জ্বালাতন করলে আমি কিন্তু মামার বাড়ি যাব না। এখান থেকেই বাড়ি ফিরে যাব।" দিশা বাবাকে বলে --- " ঠিক আছে আমি আর দুষ্টুমি করব না, তুমি গাড়ি চালাও বাবা। মামা, মামি আর ছোটন দাদাকে আমি কতদিন দেখিনি। আমার ওদের খুবই দেখতে ইচ্ছে করছে। " তার বকা খেয়ে মেয়ের মন খারাপ হয়ে যেতে দেখে এবং দুচোখে জল আসার উপক্রম দেখে অনিল মুখার্জী পুনরায় মটরসাইকেল স্টার্ট দেন। তখনো মুষলধারায় বৃষ্টি পড়ছিল। কিছুটা যাওয়ার পর তারা দুজন দেখে রাস্তায় প্রায় একহাত জল জমে গেছে। রাস্তায় বৃষ্টির কারণে একটা জন প্রাণী নেই। মাঝে মাঝে দু-একটি ট্রাক জল ছিটকে চলে যাচ্ছে। রাস্তায় আলো থাকায় বিপদের মাত্রা কিছুটা কম ছিল। এরপর সেই জল ঠেলে তারা মামার বাড়ির উদ্দেশ্যে এগিয়ে যায়।
জল ঠেলে কিছুটা যাওয়ার পর তারা দেখে রাস্তার পাশে একটি চায়ের দোকান খোলা। এই বৃষ্টির মধ্যে একটু গরম চায়ে গলা ভিজিয়ে নিতে ইচ্ছে করেছিল অনিল মুখার্জীর। তিনি চায়ের দোকানের সামনে মটরসাইকেলটি দাঁড় করিয়ে বেঞ্চে গিয়ে বসেন। তার পাশে দিশাও বসে। দিশা ছোটো হলেও চা খাওয়ার নেশা ছিল তার। দিশার বাবা দুকাপ চা ও দুটো বিস্কুট অর্ডার করেন। দিশার জন্য একটি বড় চিপসের প্যাকেটও অর্ডার দেন। বৃষ্টি ভেজা রাতে ঠান্ডা আবহাওয়ায় খুব মজা করে চা-বিস্কুট খায় তারা। অনিল বাবু চা-ওয়ালাকে বলেন --- " খুব সুন্দর চা বানিয়েছেন দাদা। অনেক দিন বাদে এমন সুন্দর চা খেলাম। মনপ্রাণ একেবারে ভরে গেল। মনে হল চা নয় যেন অমৃত খাচ্ছি।" তার কথায় লোকটি হাসেন আর বলেন--- " সবই হরির কৃপা। আমি চেষ্টা করি মাত্র, ভালো - খারাপ সব তার হাতে। আপনাদের মতো মানুষ ভালো বললে মনটা ভালো হয়ে যায়। আনন্দ পাই। আরও ভালো চা করার চেষ্টা করি।" এরপর চা-ওয়ালার টাকা মিটিয়ে দিয়ে দিশাকে নিয়ে পুনরায় যাত্রা শুরু করেন। কিছুটা যাওয়ার পর বৃষ্টি থেমে যায়। দু-একটি মানুষকে ছাতা মাথায় দিয়ে রাস্তা দিয়ে হেটে যেতে দেখা যায়। একজন লোক রাস্তা পার হচ্ছিলেন। অনিল মুখার্জীর মটর সাইকেলের তলায় পড়তে পড়তে বেঁচে যান। তিনি ভালো গাড়ি চালক হওয়ায় সেই আগন্তুক এযাত্রা রক্ষা পেয়ে যান। তিনি লোকটিকে বলেন--- " এই যে মশাই, চোখের মাথা খেয়েছেন। আর একটু হলেই তো আমার গাড়ির তলায় পড়তেন। নিজের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বাপ-মেয়েকেও বিপদে ফেলার উপক্রম করেছিলেন। দেখে চলুন, নতুবা অকালে ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যাবে।" দিশা কিছুটা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ভয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে খামচে নেয়। বাবা তাকে অভয় দিয়ে বলেন -- " চোখ খোল, দেখ কিছুই হয় নি। ভয় পাচ্ছিস কেন? আমি আছি তো।"বাবার কথা শুনে কিছুক্ষণের মধ্যেই সে স্বাভাবিক হয়ে যায়। দিশা তার বাবাকে এরপর জিজ্ঞাসা করে --- " বাবা মামাবাড়ি এখান থেকে কতদূর? আমার আর ভালো লাগছে না। তাড়াতাড়ি মামার বাড়িতে নিয়ে চলো।" মেয়ের কথা শুনে বাবা বলেন -- " ধৈর্য্য হারালে চলবে। তোর একগুঁয়ে জেদের কারনেই তো এই ঝড় জলের রাতে বিপদের মধ্যে তোকে মামার বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। রাস্তায় তেমন একটা জন প্রাণী নেই। রাস্তা ভিজে থাকার কারণে গাড়ি জোড়ে চালাতে পারছি না। একটু সময় তো লাগবেই। বাড়ি থেকে দশ কিলোমিটার রাস্তাটা একেবারেই কম নয়।"
বৃষ্টি আবার শুরু হয়। তার মধ্যে দিয়েই অনিল মুখার্জী মেয়েকে নিয়ে এগিয়ে চলেন। হঠাৎ দিশা তার বড় মামাকে স্কুটি নিয়ে রাস্তায় দেখতে পায়। আনন্দে মামা বলে চিৎকার করে ওঠে সে। প্রথমে বড় মামা অশোক বুঝতে পারেন নি। কিন্তু দ্বিতীয় বার মামা বলে ডাকতেই তিনি দেখেন দিশা তার বাবার সঙ্গে মটরসাইকেলে বসে তাদের বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি স্কুটি দাঁড় করিয়ে বলেন --- " এই বৃষ্টির মধ্যে কোথায় চলেছিস দিশা?" দিশা বলে --- " তোমাদের বাড়িতেই তো যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরো। তোমার কাছে আমার অনেক দাবি আছে। কাল সকালে বলার সুযোগ পাব না। বাবার অফিস আছে সকালেই বাড়ি ফিরতে হবে। রাতেই চলে যাব ভেবেছিলাম কিন্তু বৃষ্টির কারণে রাতটা থেকে যাব।" মিনিট পাঁচেক পর দিশা তার মামাবাড়ি পৌঁছে যায়। বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে " মামি, ও মামি, বলি দরজাটা খোলো " বলে চিৎকার করে। বৃষ্টির জন্য প্রথমে কেউ শুনতে পান না। পরক্ষণে দরজায় ধাক্কা মারলে মামি এসে দরজাটা খোলেন। দিশা ও তার বাবাকে দেখে মামি খুব অবাক হয়ে যান। তিনি বলেন --- " ওমা তোমরা!এতো ঝড়বৃষ্টির রাতে ! কি খবর? বাড়ির সবাই ঠিক আছে তো?" তার কথা শুনে দিশার বাবা বলেন --- " হ্যা বৌদি, সবাই খুব ভালো আছে। তোমাদের ভাগ্নীর একগুঁয়ে জেদের বিষয়টা তো তোমরা জানো। একবার জেদ ধরলে সেই কাজটা না করা পর্যন্ত ঠান্ডা হয় না। আজ সন্ধ্যা বেলায় জেদ ধরল মামা বাড়ি যাবে। তোমাকে, দাদাকে ও ছোটনকে ওর নাকি খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। তাই ওর জেদ পূরণ করতে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হল। ও রাতটা এখানে থাকুক, সকালে দাদা একটু ওকে পৌঁছে দিয়ে আসবেন।" অনিল বাবুর কথা শুনে বৌদি শর্মিলা বলেন--- " সে হবে ক্ষণ, এখন ঘরে এসে হাত - পা ধুয়ে একটু বসো তো ভায়া। তোমার দাদা একটু দরকারে বাজারে গেছেন, এক্ষুণি চলে আসবে। তিনি আসলেই ঠিক হবে তোমরা থাকবে না বাড়ি যাবে।" মামির কথা মতো দিশা ও দিশার বাবা ঘরে এসে বসে। মামিকে পেয়ে খুব আনন্দ পায় দিশা। মামির কোনো মেয়ে না থাকায় সেও দিশাকে খুব ভালোবাসেন। দিশা মামিকে জড়িয়ে ধরে। কিছুক্ষণ পর মামা ও ছোটন দাদা একসঙ্গে বাড়ি আসেন। ছোটন দাদাকে দেখে দিশা খুব আনন্দ পায়। তাকে জিজ্ঞাসা করে ---"কেমন আছ ছোটন দাদাভাই। এই বৃষ্টিতে কোথায় গিয়েছিলে?" ছোটন দিশাকে পাল্টা প্রশ্ন করে বলে --- " নিশ্চয় পিসাকে জ্বালাতন করে তুই এখানে এসেছিস। এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এতটা দূর থেকে আসতে তোদের কোনো সমস্যা হয় নি? বাড়ির সবাই ভালো আছে তো? তুই ভালো আছিস তো?" দিশা একগাল হাসি নিয়ে বলে 'এতক্ষণ ছিলাম না, তোমাদের দেখে মন-শরীর দুটোই ভালো হয়ে গেল।' মামা বলেন -- " পাগলীটার কথা দেখ । একেবারে পাকা বুড়ি। আমার মায়ের মতো কথা বলছে।" এরপর দিশার মামা দিশার বাবাকে বলেন --- " অনিল জামা-প্যান্ট ছাড়। আজ রাতে তোমাদের আর যাওয়া হবে না। আমি বাজার থেকে খাসির মাংস আনলাম। জমিয়ে খাওয়া হবে রাতে। কাল সকালে বৃষ্টি ধরলে বাড়ি চলে যেও। বোনকে আমি ফোন করে দিয়েছি।" বড় শালার কথার উপরে অনিল মুখার্জী কোনো কথা বলতে পারেন না। সেই রাতটা তিনি দিশাকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে থেকেই যান। রাতে হাত চেটেপুটে খাসির মাংস খেতে ও গল্প করতে করতে রাত একটা বেজে যায়। এমন শ্বশুর বাড়ি খুব কম মানুষের ভাগ্যে জোটে। শ্বশুর - শ্বাশুড়ি না থাকলেও শালা-শালা বউ কোনদিন তাদের অভাব অনিল মুখার্জীদের বুঝতে দেন নি। দিশা তার মামির সঙ্গে সেই রাতে শুয়ে মাতৃসুখ অনুভব করেছিল। পরদিন বৃষ্টি কমলে দিশা ও তার বাবা বাড়ি ফিরে এসেছিল। দিশা সঙ্গে নিয়ে এসেছিল মামাবাড়ির এক রাতের মজাদার ও সুখকর অনুভূতি।
মিঠুন মুখার্জী
C/O-- গোবিন্দ মুখার্জী
গ্ৰাম : নবজীবন পল্লী
পোস্ট+থানা -- গোবরডাঙা
জেলা -- উত্তর ২৪ পরগণা
পিন-- 743252
মোবাইল: 9614555989
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন