মায়া সভ্যতার শহরের খোঁজে
শ্যামল হুদাতী
মায়া সভ্যতা দক্ষিণ-পূর্ব মেক্সিকো এবং উত্তর মধ্য আমেরিকার অন্তর্ভুক্ত একটি বিস্তৃত অঞ্চল দখল করেছিল। এই অঞ্চলে সমগ্র ইউকাটান উপদ্বীপ এবং বর্তমানে গুয়াতেমালা এবং বেলিজের আধুনিক দেশগুলির পাশাপাশি হন্ডুরাস এবং এল সালভাদরের পশ্চিম অংশের সমস্ত অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
প্রত্নতত্ত্ববিদরা জানিয়েছেন ক্যাম্পেচে শহরের কাছে অবস্থিত এই প্রাচীন মায়া শহরটিতে পিরামিডের অস্তিত্ব মিলেছে। মন্দির,খেলার মাঠ, জলাশয় সহ আরও নানা স্থাপত্য রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
ঘন অরণ্যের পুরু চাদরের তলায় বহু শতক ধরে যে এক আস্ত শহর ঢাকা পড়েছিল, সে কথা অনুমানের স্তরে ছিল এত দিন। আমেরিকার টুলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক লুক অল্ড-টমাস কিছুটা অপ্রত্যাশিত ভাবেই মেক্সিকোয় প্রাচীন মায়া সভ্যতার একটি বিশাল শহরের ধ্বংসাবশেষের খোঁজ পেয়েছেন সম্প্রতি। এই খোঁজে যেমন তিনি আপ্লুত, তেমনই তাঁকে ভাবিয়ে তুলছে শহরটির ধ্বংসের প্রকৃত কারণ। ওই জঙ্গলের কাছে থাকা একটি উপহ্রদের নামে 'ভ্যালেরিয়ানা' নাম রাখা হয়েছে শহরটির।
মায়া পতনের কারণ হিসেবে ধরা যায় - অতিরিক্ত জনসংখ্যা, বিদেশী আক্রমণ, চাষি বিদ্রোহ এবং বিশেষ বাণিজ্য পথের পতন। পরিবেশগত অনুমানের মধ্যে পরিবেশগত দুর্যোগ, মহামারী রোগ এবং জলবায়ু পরিবর্তন রয়েছে। মায়া জনগোষ্ঠীরা কৃষি সম্ভাবনাময় অবসাদ ও অতিরিক্ত প্রাণী শিকারের মাধ্যমে পরিবেশের বহন ক্ষমতা অতিক্রম করেছিল বলে প্রমাণ রয়েছে।কিছু পণ্ডিত সম্প্রতি অনুমান করছে যে ২০০ বছরের একটি তীব্র খরা মায়া সভ্যতার পতনের কারণ। খরা তত্ত্বটি ভৌত বিজ্ঞানীরা লেক তলদেশ, প্রাচীন পরাগরেণুএবং অন্যান্য তথ্য অধ্যয়নের গবেষণা থেকে অনুমান করেছেন, প্রত্নতাত্ত্বিক সম্প্রদায়ের থেকে উৎপত্তি তথ্য থেকে নয়। ২০১১ সাল থেকে নতুন গবেষণায়, উচ্চ-রেজল্যুশনের জলবায়ু মডেল এবং অতীতের প্রাকৃতিক দৃশ্য নতুন পুনর্গঠন ব্যবহারের মাধ্যমে বিবেচনা করা যায় যে, তাদের বনভূমিকে কেটে চাষাবাদের ভূমিতে পাল্টানোর ফলে বাষ্পের হ্রাস পায় এবং পরে বৃষ্টিপাতের হ্রাস ও প্রাকৃতিক খরা বাড়ে । ২০১২ সালে বিজ্ঞান প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, মাঝারি বৃষ্টিপাতের হ্রাস, বার্ষিক বৃষ্টিপাতের হার পূর্বের মাত্র ২৫- ৪০% পরিমাণ যা মায়া পতনের কারণ হতে পারে বলে চিহ্নিত করেছে। মায়ার প্রধান শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকার হ্রদ এবং গুহার তলানি উপর ভিত্তি করে, গবেষকরা অঞ্চলে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ নির্ধারণ করতে পেরেছে । ৮০০ এবং ৯৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সংঘটিত হালকা খরা দ্রুত খোলা জলের জোগান যথেষ্ট কমে যায়।
আরও জানা যায় যে, ৪৪০ এবং ৬৬০ খ্রিস্টাব্দে উচ্চ বৃষ্টিপাতের ফলে মায়াকে বিকাশের কারণ এবং পরবর্তীকালে হালকা খরার সময় ব্যাপক যুদ্ধবিগ্রহ ও মায়া সভ্যতার পতন নিয়ে আসে। ১০২০ এবং ১১০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে একটি দীর্ঘায়িত খরা হয় যা ছিল চরমভাবে প্রাণঘাতী।
প্রত্নতত্ত্ববিদেরা জানিয়েছেন, ক্যামপেচে শহরের কাছে অবস্থিত এই প্রাচীন মায়া শহরটিতে পিরামিডের অস্তিত্ব মিলেছে। মন্দির, খেলার মাঠ, জলাশয়-সহ আরও নানা স্থাপত্য রয়েছে বলেও মনে করা হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত পাওয়া তথ্য থেকে অনুমান করা হচ্ছে যে, প্রাচীন শহরটিতে ৩০ থেকে ৫০ হাজার মানুষের বসবাস ছিল। বর্তমানে যে সংখ্যক মানুষ সেখানে বসবাস করেন, তার চেয়ে বেশ কয়েক গুণ বেশিই এই সংখ্যা। অর্থাৎ বলা চলে, শহরটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল মায়া সভ্যতার মানুষজনের কাছে। এ-ও অনুমান করা হচ্ছে যে, তাঁরা একাধিক বিচ্ছিন্ন গ্রামে থাকতেন না। একটা বড় শহরে পর্যাপ্ত পরিকাঠামোর সাহায্যেই জীবনযাপন করতেন।
অল্ড-টমাস জানিয়েছেন, আনুমানিক ১৫০০ বছর আগে যে সভ্যতার বাস ছিল এই শহরগুলিতে, তা সবই আজ মাটির তলায় বা ঘন জঙ্গলের আস্তরণের তলায় চাপা পড়ে রয়েছে। এক কালে চেষ্টা করা হলেও পায়ে হেঁটে এতটা এলাকা কোনও ভাবেই খোঁজা সম্ভব ছিল না। তাই তিনি আরও উন্নত প্রযুক্তি দিয়ে করা সমীক্ষার খোঁজ চালাচ্ছিলেন। ইচ্ছে ছিল যাতে লিডার (লাইট ডিটেকশন অ্যান্ড রেঞ্জিং) প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই গবেষণা চালানো যায়। কিন্তু তা বেশ খরচ সাপেক্ষ। এমনই সময়ে হঠাৎই অল্ড-টমাসের হাতে আসে ওই এলাকার বন পর্যবেক্ষণের একটি গবেষণার কাজ। ২০১৩ সালে লিডার প্রযুক্তির ব্যবহারে করা ওই গবেষণাটি নিয়ে পরিবেশবিদেরা কাজ করলেও, প্রত্নতত্ত্ববিদের হাতে সেই সমীক্ষা আসেনি। অল্ড-টমাস সেই সমীক্ষাটি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আবিষ্কার করেন শহরটির অস্তিত্ব।
______________________________________________________________________________________
শ্যামল হুদাতী
357/1/13/1, প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড,
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন