অষ্টমীর দিন দুপুরে দাদু ঠামমীর বাড়ী গিয়েছিল ব্যারাকপুরে আবার দ্বাদশীর দিন সকালে দুর্গাপুরে ফিরে এসেছে। ঐ কটাদিনই যা একটু মজা হয়েছে। ঐ দিনগুলোতে দাদাভাই যদি সাথে থাকতো তবে আরো মজা হতো। কিন্তু জোকাতে দাদাভাইদের যে নিজেদেরই দুর্গাপুজো হয় ও সেই পুজোয় খুব আনন্দ করেছে। এছাড়া দাদাভাই কলকাতার অনেক ঠাকুর দেখেছে মা-বাবা আর দাদু-দিদুনের সাথে। ও শুনেছে মিষ্টি মামীর কাছে যে ওদের নিজেদের পুজোর প্যনডেলের মধ্যেই কি কি প্রতিযোগিতায় দাদাভাই পুরস্কার পেয়েছে। আরো বলেছে কালী পূজোর পরে কিছু দিনের জন্য দুর্গাপুরে আসবে। এখন থেকেই তাই সোনামনি দিন গুনছে সেই দিনটা জন্য।
এদিকে দেওয়ালীর পরের দিন রাতে মানে সন্ধ্যার ঠিক পরে বাকি বাজীগুলো বাবুসোনা বাবা-মার সাথে ছাদে উঠে সেগুলোকে পুড়িয়ে ফেললো। তারপর নিচে নেমে এসে কিছু বাকি থাকা গোছগাছ গুলোও করে ফেললো চটপট সবাই মিলে। কাল খুব ভোরেই ওদের বেরোতে হবে।হাওড়া স্টেশনে গিয়ে সকাল ছটা পাঁচ মিনিটের শতাব্দী এক্সপ্রেস ধরে ওরা দুর্গাপুর যাবে। রাত চারটে সময় মায়ের ডাকে ধড়মড় করে উঠে বসল বাবুসোনা ওর হাতে পেস্ট লাগান ব্রাশ দিয়ে মা বললো, ' যা চটপট দাঁত মেজে মুখটা ধুয়ে আয়, আমরা এখুনি বেরবো। বাবুসোনা ব্রাশ নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো। ঠিক সাড়ে চারটেয় ওরা সব রেডি হয়ে নিচে নেমে ওদের জন্য দাঁড়ান গাড়ীর ডিকিতে মালপত্র তুলে দিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। হাওড়া স্টেশনে ওরা পৌছল সাড়ে পাঁচটায়। সামান্য পরে ট্রেন দিতেই ওরা ট্রেনে উঠে সিট দেখে বসে পড়লো। কিছু পরে ট্রেন ছেড়ে দিল।
সকাল সাড়ে আটটার পরেপরেই বাবুসোনারা ঢুকে পড়লো সোনামনিদের বাড়ীতে। এর পরেই শুরু হয়ে গেল দুই ভাই-বোনের দৌড়া দৌড়ি লাফা লাফি নাচা নাচি আর তাদের নিয়ে সবার চেঁচামেচি বকাবকি। একেবারে হৈ হৈ কান্ড বাড়ীতে। অনেকদিন পর দেখা হলে যা হয় আরকি। কিছুক্ষণ পরে অবস্থা একটু শান্ত হলে মলি হাঁক পড়লো, ' এই বাবুসোনামনি খালি খেললেই হবে, কিছুকি খিদে পায়নি তোদের, আয় খাবি আয় তাড়াতাড়ি। কল্পনাদি টেবিলে ব্রেকফাসট সাজিয়ে দিয়েছে । বৌদি তুমিও দাদাভাইকে নিয়ে এসে বস টেবিলে। ' সবাই একে একে এসে বসলো ব্রেকফাসট টেবিলে। সঞ্জয় ও সোমারা তখনও পোষাক পাল্টায়নি। বাবুসোনাতো নয়ই। আসলে অনিরুদ্ধ ও মলিরাতো হসপিটাল ডিউটিতে যাবে তাই ওদের ভীষণ তাড়া ডিউটিতে যাবার। আজকে ওরা এক ঘন্টা দেরীতে বেরোচ্ছে। অনিরুদ্ধের আজ বেশী পেসেনট
নেই সে চারটের পর যে কোন সময়ই ফিরতে পারে। মলি সন্ধে ছটা সাড়ে ছটার আগে ফিরতে পারবে না।
ব্রেকফাসট করতে করতে গল্প হতে লাগলো। সবচেয়ে ভাল খবরটা অনিরুদ্ধ পেশ করলো। ' কাল রবিবার সবাই মিলে শ্রীনিকেতন হয়ে
শান্তিনিকেতনে যাবে। শ্রীনিকেতনে বিখ্যাত একান্ন সতী পীঠের এক পীঠ কঙকালীতলা মন্দিরে দেবী দর্শন ও পূজা দিয়ে কোপাই নদী ঘুরে ফিরে
একদম সোজা সোনাঝুরির কাছে এক গেস্ট হাউসে গিয়ে থাকবে। গেস্ট হাউসে স্নান খাওয়া দাওয়া করে সোনাঝুরিটা একটু ঘুরেফিরে ওখান থেকে সোজা শান্তিনিকেতনে। ওখানে বেশ কিছুটা সময় লাগবে পুরোটা দেখতে। তারপর এদিক সেদিক ঘুরে সন্ধের পর গেস্ট হাউসে ফিরবে।
তারপরদিন সকালে চা টা খেয়ে সোজা দুর্গাপুর ও হসপিটাল ডিউটি। ' কথা শেষ করে অনিরুদ্ধ উঠে পড়লো। মলিও উঠে পড়ে বললো, ' আমিও
চলিরে দাদা, বৌদি চললাম ফিরতে ফিরতে সাড়ে ছটা বাজবে। অনিরুদ্ধ তাড়াতাড়ি ফিরবে। ' ' আমি আসছি এবার। ' বলেই অনিরুদ্ধ বেরিয়ে
গেল। একটু পরে মলিও বেরিয়ে গেল। দুজনেরই গাড়ী আছে।
ওরা বেরিয়ে যাবার পর সঞ্জয় ও সোমা পোষাক পাল্টে নিল আর বাবুসোনার পোষাকও পাল্টে দিল। সঞ্জয় খবরের কাগজটা নিয়ে আরাম করে সোফায় বসলো। সোমা রান্নাঘরে ঢুকলো যদি কল্পনাকে কিছু সাহায্য করতে হয়। এই সুযোগে সোনামনি বাবুসোনার হাত ধরে দরজা খুলে সোজা বাগানে পা রাখলো। বাবুসোনা দেখলো কিছুই পালটায়নি। সেই দুটো কলাগাছ, গাছে কলার কাঁদি ঝুলছে। লেবু গাছ, লজ্জাবতী, গন্ধরাজ, কাঁঠালীচাঁপা, লিলি ফুলগাছ ইত্যাদি প্রায় সব আগের মতই আছে। শুধু গতবার আগাছা অনেক দেখেছিল, এবার কিন্তু সব পরিস্কার করা হয়েছে। তাই বাগানটাকে আরো সুন্দর দেখাচ্ছে। মনে হয় নতুন কিছু গাছ লাগানোর হয়েছে। হঠাৎ সোনামনি ' দাদাভাই ' বলে ডাকতে বাবুসোনা ওর কাছে যেতে ও আবার বললো, ' জানিস দাদাভাই এই চাপা গাছের নিচে তোকে লেখা সেই চিঠিটা রেখেছিলাম। পরেরদিন সকালে এসে দেখি সেই চিঠিটা নেই। বসন্ত দাদা সেই চিঠিটা ঠিক তোর কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। আর দেখ ঐ দিকের পাঁচিলে হেলান দিয়ে শীত বুড়ি, ফড়িং আর প্রজাপতিদের সাথে আমাদের খেলা দেখছিল আর মিটি মিটি হাসছিল। মনে আছে তোর?' বাবুসোনা বললো, ' হ্যাঁ মনে আছে। তুইতো খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলি।'
হঠাৎ কোত্থেকে একটা হালকা ঠান্ডা বাতাস বাগানের সব গাছেদের দুলিয়ে দিয়ে কে যেন বলে উঠলো, ' আমার বড়দির কথা হচ্ছে বুঝি? জানতো আমার বড়দির ডাক নামও বুড়ি। বড়দির অনেক বয়স হয়েছে কিন্তু কোন অসুখ বিসুখ নেই। কিন্তু ডাক নামটা এখন বেশ মিলে গেছে।' সোনামনি বললো, ' কিন্তু তুমি কে?' ' তবে শোন, আমার নাম হেমন্ত। আমি এই বাংলার বাতাসে নতুন চালের গন্ধ আর নলেন গুড়ের সুবাস বয়ে নিয়ে আসি। এরপরে পিঠে পুলির গন্ধে আকাশ বাতাস ভরে উঠবে। এবার যাই কেমন।' বাবুসোনা বলে ওঠে, ' শোন হেমন্ত দাদা, শরৎ দাদা তো আসেনি। ওদিকে বর্ষা দিদি সেই কবে দেখা করে গেল আর কিন্ত এলো না।' হেমন্ত দাদা বলে, ' আর কি বলবো তোমাদের, আমাদের বর্ষা বোন সবার খুব আদরের। ও সেই সুযোগটা নেয়। শরত ওকে বারবার ডাকলে ও খালি বলে আর কটাদিন থাকি। শরতও কিছু বলে না। এই করে বর্ষা এক মাস বেশী কাটিয়ে দিল। শরৎ তারপর এসে জোর করে ওকে বাড়ী পাঠিয়ে দিল। শরৎ এসে দেখে অতি বৃষ্টির জন্য বহু জায়গায় বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। কত মানুষ ঘর ছাড়া এই বৃষ্টির মধ্যে। তাদের মাথা গোঁজার একটু সংস্থান হলেও খাওয়া জুটছেনা ঠিকমত। কখনো কখনও খিচুড়ি জুটেছে একটু আধটু। দুর্গাপুজোর খবর ওরা রাখেনা। শরতের মনটা ভারী নরম তাই খুব দুঃখ পেল। চতুর্দিকে জল আর জল । কাশফুল কোথাও চোখে পরেনা। প্রতিবছর শরৎ এসে আবহাওয়ার কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করে দেয়। এবারে সে দিশেহারা হয়ে দশদিন বেশী থেকে গেল। তাই আমারও আসতে দশদিন দেরী হলো। যাই হোক, এবার তোমাদের কথা বলো। সোনামনি বলে, ' জান হেমন্তদাদা, দাদাভাইরা আজকে সকালেই আমাদের বাড়ী এসেছে। ' ' ও তাই নাকি? তবে আমার ভাগ্য ভাল বলো? একসাথে দুজনের সাথেই দেখা হলো। কবে ফিরবে বাবুসোনা তুমি?' ' বাবা বলেছে আমরা মঙ্গলবার সকালে ফিরবো। পোপো বলেছে কাল খুব সকালে আমাদের সবাইকে শান্তিনিকেতন বেড়াতে নিয়ে যাবে। ' সঙ্গে সঙ্গে সোনামনি বললো, ' আমরা ওখানে একদিন থাকবো তারপর কঙকালীতলায় যাব আর অনেক কিছু দেখবো সেখানে জান।' ' বা বা বাঃ, তোমরা খুব মজা করে বেড়াবে সেখানে বেশ বেশ খুব ভাল। এবার আমি চলি।' বলে সে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল কোথায়। ঠিক তক্ষুনি সোমার ডাক শুনতে পেল ওরা, কিরে বাবুসোনামনি তোরা আর কত দেরী করবি, এবার আয় তাড়াতাড়ি স্নান খাওয়া দাওয়া করতে হবেতো।' ওরা চটপট বাগানের দরজা বন্ধ করে ফিরে এলো।
পরের দিন খুব সকাল সকাল উঠে ওরা সবাই গাড়িতে চড়ে রওনা দিল প্রথমে কঙকালীতলা মন্দিরের উদ্দেশ্যে। গাড়ী চালাচ্ছে অনিরুদ্ধ। গাড়ী পৌঁছল একেবারে মন্দিরের কাছে। যতক্ষণ গাড়ী চললো ততক্ষণ বাবুসোনামনি বাকি ঘুমটা প্রায় ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিল। গাড়ী থেকে নেমেই আবার তারা ছোটা ছুটি শুরু করে দিল। মলি ও সোমা পুকুর থেকে জল নিয়ে ফুল টুল যা আগে কিনেছিল সেসব নিয়ে ভক্তি ভরে মায়ের পূজো দিল। তারপর যে দোকান থেকে পূজোর ডালি নিয়েছিল সে দোকানে রাখা জুতোগুলো পড়ে একটা খাবার দোকানে গিয়ে কিছু খেয়ে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে উঁচু নিচু মাটির রাস্তা পেরিয়ে একেবারে কোপাই নদীর ধারে চলে এলো। ওদিকে সর্ষে ফুলের খেত হাওয়ায় দুলছে। ভারী সুন্দর লাগছে দেখতে। কোপাই এর দিকে তাকিয়ে বাবুসোনামনি একসাথে আবৃত্তি শুরু করলো, ' আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে.....' পুরো কবিতাটা বলার পর বড়োরা সবাই হাততালি দিতেই ওরা একসাথে নেচে উঠলো।
এরপর সবাই গেস্ট হাউসে এসে ঢুকলো। স্নান খাওয়া দাওয়া সেরে ওরা ফের বাইরে এসে প্রথমে সোনাঝুরিটা ঘুরে ঘুরে দেখলো তারপর সোজা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতনে গিয়ে পৌঁছল। কিন্তু বন্ধ থাকায় আসলটাতেই ঢুকতে পারলো না। ঘুরে ঘুরে দেখে আর এদিক সেদিক বেরিয়ে টেরিয়ে সন্ধের পরে গেস্ট হাউসে ফিরলো। পরের দিন সোজা দুর্গাপুর। অনিরুদ্ধ আর মলি ওদের বাড়ীতে নামিয়ে দিয়ে ডিউটিতে চলে গেল। বললো তাড়াতাড়ি আসার চেষ্টা করবে। তারপর বাবুসোনামনির সারাদিন দুষ্টুমি লাফালাফি ঝাঁপাঝাঁপি আবার ঝগড়াঝাঁটিও। একেবারে অতিষ্ঠ সবাই। আবার বাবুসোনা যেদিন সকালে চলে গেল সেদিন বাবুসোনা আর সোনামনির দুজনের চোখেই জল।
----------------------------------------------------
Address :-
----------‐------
Dipak Kumar Paul,
DTC. Southern Heights,
Block-8, Flat-1B,
Diamond Harbour Road,
Kolkata- 700104.
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন