শিউলি
কবিরুল
"বাজলো তোমার........
আলোর বেণু......."
পুজো আসতে দেরী নেই। সবুজের মখমলে শিউলি ফোটা ভোরের বোহেমিয়ান শিহরণ, আকাশের নীল খামে বলাকার চিঠি ভেসে আসা, টলটলে দীঘির জলে শাপলা, শালুকের মিছিল, সবুজের ঘেরাটোপে কাশের সভা, ঢাকের মিষ্টি বন্দিশে শিউলির সজল অভিমান।
পুজো আসলেই ছোট্ট পালকির মনটা বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। পুজোতে সবাই বাবা মায়ের হাত ধরে ঠাকুর দেখতে যায়, বন্ধুদের সাথে দল বেঁধে আনন্দ করে। পুজোর পরে এখানে সেখানে বেড়াতে যায়।
ছোট্ট পালকির জীবনে সেই সবের পাট নেই। দু বছর আগে পুজোর আগেই পালকির মা থ্যালাসেমিয়া বীটা মেজর রোগে আক্রান্ত হয়ে কৈলাসে পাড়ি দিয়েছেন। সেই থেকে পালকি ভীষণ মনমরা। ও নিজেও থ্যালাসেমিয়া বীটা মেজর রোগের শিকার। তবে ঐ রোগ সম্বন্ধে ও কিছুই জানে না। তবে ও জানে ওর মা রক্তের অভাবে মারা গেছে।
পুজোর কটা দিন তাই ও নিজেকে আড়ালে রাখে। আর চোখের কোণ বেয়ে নেমে আসা নিষ্পাপ নোনা শিশিরে নিজেকে ডুবিয়ে দেয়।
পালকির কষ্টটা একমাত্র পিসিমণি বোঝে। মাহারা ভাইজিকে চোখে হারায়। ভীষণ ভালবাসে।
আজ স্কুল থেকে ফেরার পথে পালকি একটা ঘটনা দেখে খুব অবাক হয়েছে। পিসিমণিকে সে কথা বলতে উনিও কষ্ট পেয়েছেন।
"জান পিউমণি, বাচ্চাটা আমার মতন মাহারা হয়ে গেল। ওকে দেখার কেউ নেই।"
"কে বলেছে ওর কেউ নেই? যার কেউ নেই তার মা দুর্গা আছেন। উনি সকলের মঙ্গল করেন।"
স্কুলে যাবার পথে রোজ অসহায় বাচ্চাটাকে দেখে। আর কষ্ট পায়। দুদিন বাদেই পুজোর ছুটি পড়ে যাবে। তখন বাচ্চাটাকে আর দেখতে পাবেনা।
***********
আজ স্কুলের শেষ দিন। ছুটির পর বাচ্চাটাকে কোলে করে বাড়িতে এনে হাজির।
"দেখেছ, মেয়ের কাণ্ড! এতটুকু বাচ্চাকে কেউ ঘরে তোলে? কোথা থেকে কি রোগ ছড়াবে কে জানে?"
"পিউমণি, তুমিই তো বলেছ; যার কেউ নেই তার মা দুর্গা আছেন। মা দুর্গাই তো ওকে দেখভালের জন্যে আমাকে পাঠিয়েছেন।"
"ও রে, আমার পাকাবুড়ি!"
কুকুরের বাচ্চাটার মা কদিন আগেই লরীর চাকার তলে পড়ে স্বর্গে যায়। পালকি তাই ওর অবোধ সন্তানকে নিজের কাছে রেখে সেবা যত্ন করতে শুরু করেছে। পালকি জানে মা হারানোর যন্ত্রণা কি জিনিস! বাচ্চাটার একটা নামও দিয়েছে, "শিউলি"
দুদিনেই শিউলি পালকির বেশ আপন হয়ে উঠেছে। যাকে বলে মা মেয়ের সম্পর্ক। পালকি রোজ ওকে স্নান করায়। তোয়ালেতে গা মুছিয়ে দেয়। নিজের হাতে খাওয়ায়।
********* **************
ঢাকে কাঠি পড়তেই দেখতে দেখতে পুজো চলে এল। ক্যালেণ্ডারের সাদা কালো চৌকো খোপগুলো এক এক করে একে অপরকে টপকে পঞ্চমী পেরিয়ে ষষ্ঠী, তারপর সপ্তমীর নিশা শেষ হতে না হতেই অষ্টমীর ঢ্যাং কুড়া কুড়্ বাজনা বাজা শুরু।
"....শঙ্খ শঙ্খ মঙ্গল গানে
....... জননী এসেছে দ্বারে......."
আজ অষ্টমী। সন্ধিপুজোর ১০৮টা প্রদীপ জ্বলে উঠতেই পালকি শিউলিকে কোলে করে মণ্ডপে এসেছে। ধূপের গন্ধে মাতাল চারিদিক। পালকির চোখে সোনামুগ রোদের হাসি। তার ছিঁটেফোঁটা শিউলির মুখেও।
নবমীর সকাল থেকেই পালকির শরীর খারাপ হতে থাকে। রাতে ওকে নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয়। শিউলির বোবা চোখ ওকে না পেয়ে এদিক সেদিক চেয়ে থাকে। আদরের পালকিকে সারা বাড়ি খুঁজতে থাকে। পালকি নেই। তাই ও কেমন নীরব হয়ে যায়। সেই দস্যিপনাও থেমে গেছে।
দশমীর সন্ধ্যেতে বিসর্জনের ঢাক বাজতেই পালকি বীটা মেজরে বলি হয়ে, বাড়ি পাড়ার সকলকে চোখের জলে ভাসিয়ে মা উমার সাথে কৈলাসে পাড়ি দেয়।
দুদিন কেটেছে। পালকিদের বাড়িটার মতন গোটা পাড়াটাও নিস্তব্ধ। গভীর বেদনার চাদরে ঢেকে আছে।
শিউলিও ভীষণ চুপ হয়ে আছে। তিনদিন ধরে একটা দানাও মুখে দেয় নি। বাড়ির সকলের চোখ মুখ বেশ থমথমে। শোকের ছায়া যেন সর্বত্র রাজত্ব করছে। ত্রয়োদশীর সকাল থেকেই শিউলির সাড়াশব্দ নেই। কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। সন্ধ্যেতে শিউলির নিথর দেহটা সবাই দেখতে পায়। পালকির চলে যাওয়াটা ও মেনে নিতে পারেনি। তাই দুঃখ কষ্টে ও বেচারা মারা যায়।
বাড়ির সকলে দেখল কোজাগরী চাঁদের আলোতে ডুবে আছে ওর সাদা পশমের শরীরটা। ভীষণ অভিমানে শিউলি ফুলগুলো টুপ টুপ করে খসে খসে পড়ছে ওর মৃত শরীরের উপর।
"দুর্গে দুর্গে দুর্গতিনাশিনী.......
....... ........."
_____________________________________________
কবিরুল
ইটাগাছা, কোলকাতা -২৮
উত্তর ২৪-পরগণা।
[ছবি: ইন্টারনেট মাধ্যম থেকে সংগৃহীত]
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন