কথা না-বলা টিয়া
(মূল লেখা - দ্য প্যারট হু উড নট টক / রাস্কিন বন্ড)
অনুবাদ - সুস্মিতা পাল
" তুই একটা যাচ্ছেতাই! না পারিস কথা বলতে, না গাইতে, না নাচতে।"
রুবিকাকি যখন বেচারা টিয়াটাকে কথাগুলো বলে দ০
বিঁধতে থাকে,সে তখন উত্তরভারতে ঠাকুমার বাংলো বাড়িটার লম্বা বারান্দার এক প্রান্তে কারুকাজ করা খাঁচায় বসে বোকার মতো সবার দিকে চেয়ে থাকত।
তখনকার দিনে, ভারতীয় বা ইউরোপীয়ান- সবার বাড়িতে টিয়া পোষার চল ছিল। ছোটগুলোকে বলা হতো লাভবার্ড।এদের মধ্যে কেউ কেউ দারুণ কথা বলত,অন্যের গলা নকল করত, মন্ত্রপাঠ করতে পারত। কেউ কেউ তো আবার ছোটদের উপদেশও দিত -" পড়ো, বেটা, পড়ো" বা " লোভ কোরো না"। আসলে বাড়ির কাউকে বহুদিন ধরে বলতে শোনার পরেই তারা এসব শিখত।
কিন্তু, আমাদের কপাল মন্দ, টিয়াটা কথা বলতেই চায় না।
পাড়ায় এক পাখিওলার কাছ থেকে রুবিকাকি টিয়াটা কিনেছিল।ওর কাছে রংবেরং-র বাজারিগার,কিচিরমিচির মুনিয়া আবার দামী বিরল জাতের পাখি বলে বেশি দামে বিক্রির জন্য রং করা চড়ুইও থাকত।দাদু ঠাকুমা কেউ খাঁচা বন্দী পাখি পোষা পছন্দ করতেন না, কিন্তু রুবিকাকির বায়না- সামলানো ভয়ানক ব্যাপার ।
যাইহোক, রুবিকাকি টিয়া পুষবে, আবার তাকে কথা বলতেও শেখাবে বলে জেদ ধরল।কিন্তু কেন জানি না, পাখিটা রুবিকাকিকে একেবারেই পছন্দ করত না। সঙ্গত কারণেই কাকির সব তোষামোদ ব্যর্থ হলো।
খাঁচার শিকে মুখ লাগিয়ে কাকি চুমু দিতে বলত।রুবিকাকির সম্ভাব্য চুমুর আশঙ্কায় টিয়াটা সঙ্গে সঙ্গে ছোট চোখদুটো রাগে আরো ছোট করে পিছিয়ে যেত।একবার তো হঠাৎ এগিয়ে এসে এমন ঠোকর মেরেছিল যে কাকির চশমা নাক থেকে নিচে পড়ে গিয়েছিল।তারপর থেকে সব চেষ্টা ছেড়ে রুবিকাকি বেচারা টিয়াটাকে বিষ নজরে দেখতে শুরু করল। যখনতখন মুখ ভেংচে খারাপ খারাপ মন্তব্য করত।
আমার ওপর ওকে খাওয়ানোর দায়িত্ব ছিল। দশ বছরের আমি কাঁচালঙ্কা, পাকা টমেটো হাতে করে দিতাম আর টিয়া ভালোবেসে খেত। তখন আমের মরসুম বলে আমের টুকরো দেওয়ার সময় দু একটা নিজের মুখেও ফেলে দিতাম।
একদিন দুপুরে, সবাই ঘরে ভাতঘুম দিচ্ছে, আমি টিয়াটাকে খেতে দিয়ে ইচ্ছা করে খাঁচার দরজা খোলা রাখলাম।মুহূর্তের মধ্যে পাখি ডানা মেলে আমবাগানে ফুরুৎ!
ঠিক তখনই দাদু বারান্দায় এলেন, " তোমার কাকির পাখি তো পালাল"।
আমি একটু কাঁধ ঝাঁকালাম, " দরজাটা বেশ নড়বড়ে ছিল। মনে হয় না টিয়াটাকে আর দেখতে পাব!"
রুবিকাকি প্রথমে সামান্য মনখারাপ করলেও শাসানি দিলেন যে,আর একটা পাখি কিনবেন।এক বাটি গোল্ডফিশ কিনে দেব কথা দিয়ে তখনকার মতো তাকে থামানো হলো।
" কিন্তু গোল্ডফিশ তো কথা বলে না" ,কাকি প্রতিবাদ করে উঠলেন।
"সে তো তোমার টিয়াও বলে না" , দাদু বলে উঠলেন,
" তাহলে তোমাকে একটা গ্রামোফোন কিনে দেব, সারাদিন লতা মঙ্গেশকরের গান শুনো। সবাই তো তাকে নাইটিঙ্গল বলে।"
আমি ভেবেছিলাম আর কোনোদিন টিয়াটাকে দেখা যাবে না। কিন্তু তার বোধহয় কাঁচালঙ্কার জন্য মনকেমন করছিল। কদিন পরেই বারান্দার রেলিঙে ঘাড় কাত করে দেখি আমার দিকে চেয়ে বসে আছে। আমিও হিংসুটেপনা না করে অর্ধেক আম ওকে খেতে দিলাম।
টিয়াটা আম খাচ্ছে, এমন সময় রুবিকাকি ঘর থেকে বেরিয়ে অবাক হয়ে চিৎকার করে উঠলেন, " দেখো, দেখো, আমার পাখি ফিরে এসেছে! ওর বোধহয় আমার কথা খুব মনে পড়ছিল।"
বলতে না বলতে ক্যাঁও করে এক কানফাটানো ডাক দিয়ে টিয়াটা উড়ে গিয়ে সামনের গোলাপঝাড়ের ওপর বসে রুবিকাকির দিকে তাকিয়ে অবিকল কাকির গলায় বলে উঠল, " তুই একটা যাচ্ছেতাই, না পারিস কথা বলতে, না গাইতে, না নাচতে।"
রুবিকাকি মুখচোখ লাল করে দৌড়ে ভেতরে চলে গেলেন।
কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ নয়।টিয়াটা এরপর প্রায়ই বাগানে, বারান্দায় উড়ে আসত আর রুবিকাকিকে দেখতে পেলেই চেঁচিয়ে বলত, "তুই একটা যাচ্ছেতাই, না পারিস কথা বলতে, না গাইতে, না নাচতে।"
সে যাই হোক , টিয়াটা তো শেষমেশ কথা বলতে শিখল।
---------*--------
সুস্মিতা পাল।
৩৪, আর্য্য বিদ্যালয় রোড
কোলকাতা -৭০০০৭৮
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন