রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিপ্রেম
আরতি মিত্র
বাস্তব জগৎ ও জীবনের মধ্যেই কবি যখন তাঁর চির আকাঙ্ক্ষিত সৌন্দর্যের সন্ধান পেলেন তখন এই জগৎ ও জীবনের একটা অতি প্রবল সৌন্দর্যানুভূতি তাঁকে গ্রাস করলো। তিনি বিশ্বপ্রকৃতি ও বিশ্বমানবের সঙ্গে তাঁর একাত্মতা অনুভব করে ঐ সৌন্দর্য আকন্ঠ পান করতে চাইলেন। তখন তিনি প্রবল সৌন্দর্য পিপাসায় জলস্থল,অন্তরীক্ষে নিজেকে পরিব্যপ্ত করে দিয়ে সৌন্দর্য উপভোগের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন।
এই সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা ও গভীরতর পিপাসা কবির প্রকৃতিপ্রেমের উৎস। বারবার কবির বিভিন্ন কবিতায় কবি তারই পরিচয় দিয়েছেন।
সোনার তরী কাব্যের "বসুন্ধরা " কবিতায় কবি সারাবিশ্বের মধ্যে নিজেকে প্রসারিত ও মিশ্রিত করে দিয়ে জলস্থল , অন্তরীক্ষের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য আকুল হয়েছেন। সৌন্দর্য পিপাসার এ এক অদ্ভুত প্রকাশ।
তৃণগুল্ম গাছপালা নদনদী পাহাড় পর্বত মেঘ বৃষ্টির সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দিয়ে তিনি নিবিড় বৈচিত্র্যময় আনন্দ উপভোগ করতে চেয়েছেন। বিভিন্ন দেশের,বিভিন্ন জাতির অস্তিত্বের মধ্যে প্রবেশ করে সেই পারিপার্শ্বিকের মধ্যে জীবনকে উপলব্ধি করতে সর্বদাই একান্ত উৎসুক থাকতেন। তাঁর কবিতায় তারই প্রমাণ পাওয়া যায় --
" ইচ্ছা করে , বার বার মিটাইতে সাধ
পান করি বিশ্বের সকল পাত্র হতে
আনন্দমদিরাধারা নব নব স্রোতে।।"
কবি বলেছেন, বসুন্ধরার সঙ্গে তাঁর নাড়ীর যোগ, জন্মজন্মান্তরের নিবিড় পরিচয়, একদিন তিনি তার সঙ্গে এক আত্মা, এক দেহ হয়েছিলেন --
" আমার পৃথিবী তুমি
বহুবরষের। তোমার মৃত্তিকা-সনে
আমারে মিশায়ে লয়ে অনন্ত গগনে
অশ্রান্ত চরণে করিয়াছ প্রদক্ষিণ
সবিতৃমন্ডল অসংখ্য রজনীদিন
যুগযুগান্তর ধরি ; আমার মাঝারে
উঠিয়াছে তৃণ তব , পুষ্প ভারে ভারে
ফুটিয়াছে , বর্ষণ করেছে তরুরাজি
পত্রফুলফল গন্ধরেণু।"
যে ঐশ্বর্য, প্রাচুর্য ও সৌন্দর্যের প্রাণরসধারা ধরিত্রীর বক্ষ থেকে নিঃসারিত হয়ে ফুলপুষ্প, তরুলতা, নদনদী, পর্বত, অরণ্যকে নিগূঢ় আনন্দরসে অভিষিক্ত করছে, সেই প্রাণশক্তিকেই কবি সারাদেহমন দিয়ে অনুভব করতেন।
তাঁর মনে হতো , একদিন তিনি জলে-স্থলে-আকাশে পরিব্যপ্ত হয়ে ছিলেন। তাই এই রূপ-রসময় বিচিত্র ধরণী তাঁকে প্রবল বেগে আকর্ষণ করতো। তিনিও তাই তাকে সমস্ত অন্তর দিয়ে ভালোবাসার জন্য ব্যাকুল হতেন।
সেই সৌন্দর্য, প্রাচুর্য , ঐশ্বর্যের ধারা বসুন্ধরার বক্ষে লোকচক্ষুর আড়ালে প্রতিনিয়ত প্রবাহিত হচ্ছে, কবি তার সঙ্গে যুক্ত হতে চাইতেন --
" আমারে ফিরায়ে লহো
সেই সর্ব-মাঝে , যেথা হতে অহরহ
অঙ্কুরিছে মুকুলিছে মুঞ্জরিছে প্রাণ
শতেক সহস্র রূপে , গুঞ্জরিছে গান
শতলক্ষ সুরে ,উচ্ছ্বসি উঠিছে নৃত্য
অসংখ্য ভঙ্গিতে ,প্রবাহি যেতেছে চিত্ত
ভাবস্রোতে , ছিদ্রে ছিদ্রে বাজিতেছে বেণু;
দাঁড়ায়ে রয়েছ তুমি শ্যাম কল্পধেনু ;
তোমারে সহস্র দিকে করিছে দোহন
তরুলতা পশুপক্ষী কত অগণন
তৃষিত পরানী যত ; আনন্দের রস
কত রূপে হতেছে বর্ষণ ,দিক্ দশ
ধ্বনিছে কল্লোলগীতে।"
নিখিলের বিচিত্র আনন্দ কবি সকলের সঙ্গে এক হয়ে আস্বাদন করতে চাইতেন, বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে এক আত্মা , এক দেহ হয়ে জীবনের অন্তহীন রসোপলব্ধির পিপাসা মেটাতে তিনি উৎসুক ছিলেন। কবি কীটপতঙ্গ, পশুপক্ষী, তরুলতা হয়ে যুগে যুগে জন্মে ধরিত্রীর স্তন্যরসসুধা পান করার জন্য ব্যাকুল ছিলেন। নবনব রূপে জীবনের নবনব আস্বাদ তিনি পেতে চেয়েছেন, জ্যেতিষ্কলোকে তারায় তারায় নক্ষত্রে নক্ষত্রে বিচরণ করে তাদেরকে দেখার ও জানার আনন্দও তিনি লাভ করে নব নব রসাস্বাদনের জন্য কবিচিত্তের এটাই ছিল দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা।
===================
Arati Mitra.
267/3 Nayabad,Garia.
Kolkata- 700094
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন