Featured Post
গল্প ।। শাবক ।। অশোক দেব
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
শাবক
অশোক দেব
আজও অভি'দের বাড়ি থেকে এসেই সায়ন বলল, বাবা ওদের মত একটা কুকুর ছানা এনে দেবে আমাকে । কি সুন্দর বাচ্চাটা ! সায়ন অভিদের বাড়িতে যায় প্রাইভেট পড়তে । ওখানেই মাষ্টারমশাই আসেন । চারজনের ব্যাচ ওদের । সবাই এবছরের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ।
অভিদের লোমস আর ছোটখাটো চেহারার ভূটিয়া প্রজাতির কুকুরটির নাম ডকি । সায়ন ওদের বাড়ি গেলেই ডকি লেজ
নেড়ে আর লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে ওকে অভ্যর্থনা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে । সায়নের খুব ভালো লাগে ডকিকে । ও ভাবে । ওর বাবাও যদি ওরকম একটা কিনে আনত ওর জন্য । কি দারুন হোতো ।
সায়নের আবদার শুনে নারায়ণ বাবু বললেন কি হবে ওসব কিনে । সামনেই তোর মাধ্যমিক এখন দিনরাত পড়াশোনা করতে হবে তোকে।
এবারই প্রথম নয় । এর আগেও একবার বলেছিল বাবাকে । তখনও ঐ একই কথা শুনতে হয়েছিল । বাবার উপর খুব রাগ হোলো সায়নের ।
এর কদিন পর স্কুল থেকে ফেরার পথে সায়ন দেখল । চৌমাথার মুদির দোকানের পাশে চারটি কুকুরছানা শুয়ে রয়েছে তাদের মায়ের সঙ্গে । ও কাছে যেতেই বাচ্চাগুলো লেজ নাড়তে নাড়তে ওর চারপাশে ঘোরাঘুরি শুরু করল । তা দেখে সায়ন খুব মজা পেল ।
সে দোকান থেকে কটা বিস্কুট কিনে এনে ছড়িয়ে দিতেই বাচ্চাগুলো মহানন্দে খেতে শুরু করল ।
দোকানের মালিক ঐসব দেখে সায়নকে বলল, কুকুর তোমার খুব ভালো লাগে বুঝি ? ও বলল হ্যাঁ । ভী-ষ-ণ ।
তাহলে নিয়ে যাও একটা । এগুলো আমার কুকুর ।
সায়ন এক কথাতেই রাজি হয়ে গেল।
ভদ্রলোক বাদামি রঙের একটা বাচ্চা ওর হাতে তুলে দিল । সায়নের মনে হোলো ও যেন মহামূল্যবান কোন সম্পদ পেয়েছে ।
মনে
মনে ভাবল । হোক না
দেশি কুকুর । একেই
সে যত্ন করে পালবে
। সে মহানন্দে
বাচ্চাটাকে কোলে করে বাড়ি
নিয়ে এল ।
সায়নের মা বললেন, কোত্থেকে নিয়ে এলি এটা । কার কুকুর ? সায়নের মুখে সব শুনে তারপর বললেন , জানিস তো তোর বাবা এসব পছন্দ করে না। তবুও নিয়ে এলি ? এখন এটাকে রাখবি কোথায় !
সে তুমি ভেবো না । এই বলে নাইলনের এক টুকরো দড়ি দিয়ে বারান্দার গ্রিলের সাথে বাচ্চাটাকে বেঁধে সে ছুটল বাজারে।
ফিরে এল গলার বেল্ট, শিকল , কাঠের বাক্স আর থার্মোকলের বোর্ড নিয়ে । প্রথমেই বেল্ট আর শিকল পড়িয়ে দিল বাচ্চাটার গলায় । তারপর বাক্সের মাপে থার্মোকল কেটে নিয়ে তার ভিতরে বসিয়ে দিলো ।
রাতের দিকে এখনও বেশ ঠাণ্ডা । বাক্সের তলার দিকটা বেশ পাতলা । বাচ্চাটা অসুস্থ হয়ে যেতে পারে । থার্মোকলের টুকরোটা অনেকটা ম্যাট্রেসের কাজ করবে ।
সায়ন নিজেই নিজ বুদ্ধির তারিফ করতে লাগল । রাতে বাড়ি ফিরে ছেলের কান্ডকীর্তি দেখে নারায়ণবাবু খুব বকাবকি করলেন ।
সায়নের মা ছেলের পক্ষ নিয়ে দুকথা বলতেই নারায়ণ বাবু বললেন । তোমার প্রশ্রয়েই ছেলেটা গোল্লায় যাবে । সামনেই পরীক্ষা । এখন এসব নিয়ে মাতামাতি করলে চলে ? এতসব কেনার পয়সা পেল কোত্থেকে ?
ওর মা বললেন, জমানো টাকা দিয়ে কিনেছে ।
রাত বাড়তে থাকলো বাচ্চাটার কুঁই কুঁই করা আওয়াজও বেড়ে চলল । সদ্য মাকে ছেড়ে এসেছে তার উপর অপরিচিত জায়গা । সব মিলিয়ে ও হয়তো নিরাপদ মনে করছে না নিজেকে । আপন মনেই কথাগুলো ভাবল সায়ন ।
মা-বাবা শুয়ে পড়েছে । পড়ার টেবিল থেকে মাঝে মধ্যেই উঠে এসে সে বাচ্চাটাকে দেখতে থাকলো । ওকে দেখতে পেলেই চুপচাপ হয়ে যায় বাচ্চাটা। তখন সায়নের দিকে তাকিয়ে শুধু লেজ নাড়াতে থাকে ।
সায়ন ওর নাম রাখল ভুলু ।
দিনকয়েক পর প্রাইভেট টিউটর রমেনবাবুর সাথে কথা বলে নারায়ণ বাবু জানতে পারলেন । সায়ন আজকাল আশানুরূপ পড়াশোনা করছে না ।
সায়ন পড়াশোনায় যথেষ্ট ভালো । কিন্তু নারায়ণবাবু চান অতি ভালো । রাজ্যে না হলেও অন্তত জেলায় এক নম্বর হোক তার ছেলে । এই তার প্রত্যাশা ।
বাড়ি ফিরেই তিনি যাচ্ছেতাই বকাবকি শুরু করলেন । কিন্তু পরবর্তী কয়েকদিনেও সায়নের কোনো পরিবর্তন হোলো না । আসলে এবয়সে যা হয় আর কি । এই কদিনে অবলা এই প্রাণিটির সাথে বন্ধুত্ব এতটাই জমে উঠেছে যে একমূহূর্ত ছেড়ে থাকতে পারে না । বাচ্চাটাও ওকে না দেখতে পেলেই চিৎকার জুড়ে দেয় ।
একদিন টিউশনি থেকে বাড়ি ফিরে সায়ন দেখল ভুলু নেই । খালি শিকল ঝুলছে বারান্দার গ্রিলে । এঘর ওঘর কোথাও না দেখতে পেয়ে সে চিৎকার করে মাকে ডাকল । ওর মা বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই জিজ্ঞেস করল । ভুলু কোথায়?
-তোর বাবা এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে রেখে এসেছে ।
-কেন ?
-তুই ঠিকমতো পড়াশোনা করছিস না তাই ।
কথাগুলো শুনেই সায়নের মন গভীর দু:খে আচ্ছন্ন হয়ে গেল । সে পড়ার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে কাঁদতে শুরু করল । ভুলুর সঙ্গে তার কাটান মূহূর্তগুলি জীবন্ত হয়ে চোখের সামনে দিয়ে ভেসে বেড়াতে লাগলো ।
সন্ধ্যার মুখে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এল সায়নের । নারায়ণ বাবু ভাবলেন সিজন চেঞ্জের সময় একটু আধটু শরীর খারাপ,জ্বর, ইনফ্লুয়েঞ্জার মত অনেকেরই হয় । তিনি পাড়ার ফার্মাসি থেকে ওষুধ এনে খাওয়ালেন ।
রাতটা কোনমতে কাটলেও । সকাল হতেই আবার জ্বর এল সঙ্গে বমি ।
নারায়ণ বাবু ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। কয়েকটা ওষুধ আর পরীক্ষা নিরীক্ষার কথা লিখে ডাক্তারবাবু বললেন রিপোর্ট গুলো না দেখা পর্যন্ত কনফার্ম কিছু বলা যাচ্ছে না । আপাতত ওষুধগুলো চলুক।
সায়নের অবস্থা ক্রমশঃ খারাপ হতে লাগল ।
দুদিন পর রিপোর্ট দেখে ডাক্তারবাবু বললেন,খারাপ কিছু তো দেখতে পাচ্ছি না ।
তারপর বললেন কোনো কারণে মনে আঘাত পেয়েছে মনে হচ্ছে । ওকে কি বকাঝকা করেছিলেন কোন ব্যপার নিয়ে ।
নারায়ণবাবু বললেন, না । তবে ও একটা কুকুর পুষত ।
তারপর পুরো ঘটনাটা ডাক্তারবাবুকে বললেন ।
উনি বললেন আমি তেমনই কিছু আন্দাজ করছিলাম । ছেলেকে তাড়াতাড়ি সুস্থ করতে চাইলে শিগগির ফিরিয়ে
আনুন ওটাকে ।
ভুলু ফিরে এল ।
ওকে দেখা মাত্রই সায়ন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। তারপর পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে ধরল ।
নারায়ণবাবু অন্তরাত্মা দিয়ে অনুভব করলেন, ভালবাসার বস্তুকে চোখের বাইরে সরিয়ে নিলেও মনের বাইরে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় না ।
__________________________________________________________________________
অশোক দেব
নেতাজি রোড বাইলেন,
নিউটাউন,
কোচবিহার ।
[ছবি: ইন্টারনেট মাধ্যম থেকে সংগৃহীত]
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন