Featured Post

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। ত্রয়োত্রিংশ সংখ্যা ।। জুন ২০২৪

ছবি
  প্রচ্ছদ-চিত্রঃ সুনীত নস্কর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। সম্পাদকীয় কেমন আছো ছোট্ট বন্ধুরা। গরমের ছুটি তো শেষ হয়ে এল। স্কুল খুলে যাচ্ছে। কিন্তু গরমের দাবদাহ কিন্তু এতটুকু কমেনি। এই গরমে  খুবই সাবধানে নিয়ম মেনে চলতে হবে তোমাদের। এখন তো আম, জাম কাঁঠালের সময়। এখন এইসব মৌসুমী ফল খেতে হবে। তাহলে শরীর সুস্থ থাকবে। শরীর সুস্থ থাকলে মন সুস্থ থাকবে। মন সুস্থ থাকলে পড়াশুনো ভালো হবে।           আশাকরি এতদিন বাড়িতে থেকেই মন দিয়ে পড়াশুনো করেছ। সঙ্গে অনলাইন কিশলয়ের পাতায় চোখও রেখেছ। পড়াশুনোর পাশাপাশি গল্প লেখা, ছবি আঁকা ইত্যাদির শখও মনের মধ্যে লালন পালন করতে হবে তোমাদের। পড়াশুনোর চাপে সব ছেড়ে দিলেও চলবে না কিন্তু। স্কুলের পড়া, বাড়ির পড়ার পাশাপাশি গল্প- কবিতা লেখা, প্রবন্ধ লেখা, ছবি আঁকা ইত্যাদি চালিয়ে যাও। তোমাদের প্রতিভার বিকাশ হোক। তোমাদের সৃজনীসত্ত্বার প্রকাশ হোক তোমাদের সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। আর সাথে সাথে তোমার সেই সৃষ্টি অনলাইন কিশলয়ে প্রকাশের জন্য পাঠিয়ে দাও। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাকি বন্ধুরাও জানুক তোমার সৃষ্টি সম্পর্কে। আর কী? সবাই সুস্থ থাকো, ভালো থাকো, আনন্দে থাকো।   শুভকামনাসহ-- প্রিয়ব্রত দত্ত ও কার্

গল্প ।। রূপলু আর রত্নবুড়ো ।। সোমা চক্রবর্তী




রূপলু আর রত্নবুড়ো

সোমা চক্রবর্তী

গ্যাস বেলুন রূপলুর খুব পছন্দ। সেই যে একবার দূর্গা পূজার সময় ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে মা একটা টকটকে লাল রঙের আর একটা ঘন নীল রঙের গ্যাস বেলুন কিনে দিয়েছিল, সেই থেকে রূপলুর গ্যাস বেলুন খুব পছন্দের জিনিস। মা রূপলুর হাতের সঙ্গে বেলুন দুটোকে সুতো দিয়ে বেঁধে দিয়েছিল, যাতে হাত ফসকে উড়ে না যায়। মায়ের ছোটবেলায় একবার নাকি মায়ের হাত ফসকে গ্যাস বেলুন উড়ে গিয়েছিল। আর সেই জন্য মায়ের খুব মন খারাপ হয়েছিল। যাই হোক, সারা রাস্তা বেলুন দুটো হাওয়ায় দুলতে দুলতে আর এ ওর গায়ে ঠোকা লাগতে লাগতে ঊর্ধমুখী হয়ে রূপলুর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি পৌঁছাল। ঘরে এসে মা ওদের ছেড়ে দিল। অমনি ওরা উড়ে গিয়ে কার্ণিশের কাছে অলস ভঙ্গিতে ঝুলতে লাগল। সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠেই রূপলুর চোখ ছাদের দিকে চলে গিয়েছিল। বেলুন দুটো তখনও সেখানেই ঝুলে রয়েছে। তবে, আকারে একটু ছোট হয়ে গেছে, এই যা। আর সেই থেকেই গ্যাস বেলুন রূপলুর খুব পছন্দের জিনিস।

রূপলুর মায়ের ছোটবেলার স্কুলের বন্ধু সুতপা মাসি বেড়াতে এসেছে ওদের বাড়ি। সারাদিন তাই খুব মজা হয়েছে। রূপলু অনেকক্ষণ ধরে মা আর সুতপা মাসির সঙ্গে ক্যারম আর ক্রিকেট খেলেছে। বিকেল বেলা ওরা তিনজন সামনের পার্কে ফুচকা খেতে গিয়েছিল। সেখানে গ্যাস বেলুন বিক্রি হতে দেখে রূপলু একটা গ্যাস বেলুন কিনে নিয়ে এলো বাড়িতে। এবারের বেলুনটা গাঢ় কমলা রঙের। বেশ একটা তেজী, আগুন আগুন ভাব। মা আর সুতপা মাসিরও খুব পছন্দ হয়েছে বেলুনটা। বাড়ি ফিরে মা আর মাসি বিরিয়ানি রান্না করতে গেছে রান্নাঘরে। রূপলু বেলুনটাকে দোতলার বারান্দায় রেলিঙে বেঁধে রেখে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিরিয়ানির গন্ধে সারা বাড়ি একেবারে ম ম করছে। 
এমন সময়, হঠাৎ করেই একটা দমকা ঝোড়ো হাওয়া উঠল আর সঙ্গে সঙ্গেই লোড শেডিং। ইনভার্টারটা কয়েকদিন আগে খারাপ হয়েছে। মিস্তিরি আসেনি বলে এখনো সারানো হয়নি। ফলে নিমেষের মধ্যে ঘরের ভেতরে 'কোথায় দেশলাই', 'কোথায় মোমবাতি' পর্ব শুরু হয়ে গেলো। এদিকে হাওয়ার জোর ক্রমেই বাড়ছে। রূপলুর হঠাৎ ওর গ্যাস বেলুনটার কথা মনে পড়ে গেল। আরে! বেলুনটা তো বারান্দায় বাঁধা আছে। এতো হাওয়ায় উড়ে গেল না তো? অন্ধকারের মধ্যেই বেলুনটা নিতে এক দৌড়ে বারান্দায় চলে এলো রূপলু। এসে দেখে কি, প্রচন্ড হাওয়ায় এলোমেলো দুলছে বেলুনটা। বাঁধা ছিল বলে এখনো উড়ে চলে যায় নি। তবে সরু সুতোর বাঁধন, ছিঁড়ল বলে! রূপলু তাড়াতাড়ি গিয়ে বেলুনটা খুলে নিতে চেষ্টা করলো। বাঁধন খুলে সুতোটা সবে হাতে নিয়েছে, এমন সময় জোরে একটা হাওয়ার ঝাপটা এসে লাগলো আর রূপলু সমেত গ্যাস বেলুন সোজা আকাশে।

বাইরে তখন রীতিমতো ঝড় উঠেছে। তার মধ্যে গ্যাস বেলুনটার সুতো ধরে মাটির থেকে অনেক ওপরে ঝুলে রয়েছে রূপলু। ও বুঝতে পারছে যে, উড়তে উড়তে ক্রমশই অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। ওদের বাড়িটা চোখের সামনে ছোট হতে হতে একসময় মিলিয়ে গেলো। রূপলু দেখলো, এখন আর ঝড়টর কিচ্ছু নেই। হালকা হাওয়ায় ভর করে বেশ সুন্দর উড়ে চলেছে ও। আস্তে আস্তে দিনের আলোর মতো আলো দেখা গেল। নীল, শান্ত একটা সমুদ্রও দেখা যাচ্ছে। একটু দূরেই একটা দ্বীপের মতো জায়গা। সেখানে হলুদ বালি সূর্যের আলোয় চকচক করছে। বালির পরেই ঝকঝকে সবুজ অরণ্য। পাখপাখালির ডাকও শুনতে পেল রূপলু। বেলুন এসে ধীরে ধীরে বালির ওপর নামল। রূপলুর পা বালির ওপর পড়তে না পড়তেই ওর হাত ফসকে বেলুনটা উড়ে চলে গেলো না জানি কোথায়! তাকে আর চোখের সামনে দেখাই গেলো না। "যাঃ। এবার বাড়ি ফিরবো কি করে?", ভেবে তো রূপলুর কান্না পেয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু
রূপলুর কান্না শোনার মতো কেউ আশেপাশে ছিল না কোথাও। তাছাড়া, রূপলু তো খুব সাহসী মেয়ে আর ওর মাথায় খুব বুদ্ধি‌। কেঁদে যে কোনো লাভ নেই, সেটা ও ভালোই বুঝতে পারছে। তাই কান্নাকাটি না করে, সবকিছু চিন্তা করে, ও ঠিক করলো, বেলুনটা উড়ে কোথায় গেলো, সেটাই প্রথমে দেখা দরকার। বেলুনটা খুঁজে পেলে তবেই তো আবার বাড়ি ফেরার কথা ভাবা যাবে। ওদিকে বাড়িতে বোধহয় এতক্ষণে বিরিয়ানি রান্না শেষ হয়ে গেছে। ওকে খুঁজে না পেয়ে মা যে কি করছে কে জানে!

রূপলু বালি পেরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে চলে এলো। কোত্থাও ওর বেলুনটা নেই। বড়ো গাছে আটকে গেছে কিনা দেখার জন্য, উঁচু গাছগুলোর মাথাগুলো দেখতে দেখতে চললো ও। নাঃ। নেই। হঠাৎ গাছপালার ফাঁকে একটা পাহাড়ের চূড়া দেখতে পেলো রূপলু।  তাড়াতাড়ি ঝোপঝাড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে দেখে, জঙ্গলের ভেতর একটুখানি জায়গা একেবারে ঝকঝকে, তকতকে পরিষ্কার। একটা পাতা, এক টুকরো কাঠকুটোও পড়ে নেই কোথাও। আর সামনেই ঠিক খেলনা পাহাড়ের মতো একটা ছোট্ট পাহাড়। ঠিক যেন পূজোর প্যান্ডেল বানিয়ে রেখেছে কেউ। কিন্তু রূপলু দেখলো, বানানো নয়, একেবারে আসল পাহাড়। গাছপালা, ছোট্ট একটা ঝরণা- সব কিছু আসল। একটু ওপরে একটা গুহা মতো দেখতে পেলো রূপলু। আর এই প্রথম গুহার সামনে একজন লোককে দেখতে পেলো। রূপলু তাড়াতাড়ি পাহাড়ে উঠতে শুরু করলো। এই পাহাড়ে ওঠা বেশ সহজ। কেমন পাথরের ধাপ ধাপ সিঁড়ির মতো করে সাজিয়ে রাখা আছে। সেই ধাপে ধাপে পা ফেলে রূপলু তো চটপট করে গুহার সামনে পৌঁছে গেল। দেখলো, যেই লোকটাকে নীচ থেকে দেখতে পেয়েছিল, সে একজন খুনখুনে বুড়ো। একেবারে আদ্যি কালের বদ্যি বুড়ো যাকে বলে! বুড়োর হাতে গাছের ডালপালা, পাতা লতা দিয়ে বানানো একটা অদ্ভুত দেখতে ঝাঁটা। সেই ঝাঁটা দিয়ে গুহার ভেতর থেকে রাশি রাশি ময়লা আবর্জনা ঝাঁট দিয়ে বুড়ো বাইরে জড়ো করছে। রূপলু অবাক হয়ে দেখলো, ঝাঁট দিয়ে আনা জিনিসগুলো আলোয় ঝলমল করছে। কোনোটাই ময়লা কিছু নয়। ধূলোর মতো ছোট ছোট রাশি রাশি সাদা, সোনালী, রূপালী পাথর। চট করে দেখলে অবশ্য মনে হয় যেন ধূলো। তার মধ্যে আবার লাল, নীল, হলুদ, সবুজ রঙের বড়ো বড়ো অনেক পাথর। সব কিছু ঝাঁট দিয়ে এনে জড়ো করে রাখছে বুড়ো। একেকটা স্তূপ হয়ে গেছে সেগুলো দিয়ে।
- এগুলো কি?
জিজ্ঞেস করে ফেললো রূপলু। বুড়ো এবার তাকালো রূপলুর দিকে। মাথা ভরা মস্ত টাক, সারা মুখ তুলোর মতো সাদা দাড়ি গোঁফে ভর্তি। চোখে গোল গোল চশমা। গায়ে একটা সাদা আলখাল্লা। বুড়ো খুব সুন্দর করে হাসলো ওর দিকে তাকিয়ে। রূপলুর মনে হলো, এমন হাসি যেন যে কেউ হাসতে পারে না। বুড়ো ওকে বললো,
- এগুলো সব ধূলো আর ময়লা। দেখো না, যতোই আমি পরিষ্কার করি, এগুলো ততোই শুধু বেড়ে যায়। আমার আর খাটুনির অন্ত নেই।
- কিন্তু এগুলো তো ধূলো ময়লার মতো দেখতে নয়।
- তা ঠিক। অনেকেই এগুলোকে মূল্যবান বস্তু মনে করে ভুল করে। কিন্তু আসলে এগুলো ধূলো ময়লাই।
- তুমি কি এখানে একা থাকো?
বুড়ো একটু চুপ করে থেকে বললো,
- একাও বলতে পারো। আবার একা নয়, তাও বলতে পারো।
- মানে?
- মানে, এখানে থাকে তো আরো অনেক লোক। কিন্তু আমি এখানে একেবারেই একা। ইচ্ছে করলে তুমিও থাকতে পারো এখানে।
- এমা। মা'কে ছেড়ে আমি এখানে থাকবো কেন?
- থাকতেই পারো। এখানে থাকলে তোমার কোনো কিছুর অভাব থাকবে না। এখানে সবাই যা চায়, তাই পায়। কারোর কোনো ইচ্ছে এখানে অপূর্ণ থাকে না।
- এখানে আমি মায়ের সঙ্গে থাকতে পারবো?
- তোমার মা যদি তোমার মতো নিজে নিজে এখানে আসতে পারে, তাহলে থাকতে পারবে। কিন্তু তুমি চাইলে হবে না।
রূপলু ভালো বুঝতে পারলো না বুড়োর কথা। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ও বললো,
- এখানকার বাকি লোকেরা কোথায়?
- সবাই থাকে পাহাড়ের ওই পাশে।
- তুমি এইখানে একা থাকো কেন?
- কারণ, ওরা বড্ড ময়লা হয়ে থাকে। আমার আবার ময়লা থাকতে একদম ভালো লাগে না। দেখো না, সারাদিন আমি এই ধূলো বালি সাফ করি। অথচ, যতো পরিষ্কার করি, ততোই কেবল বেড়ে যায়।
- এরকম হয় কেন?
- এটাই তো মজা। যারা এগুলোকে মূল্যবান মনে করে, ব্যবহার করতে চায়, তাদের কাছে এগুলো কেবলই ফুরিয়ে যায়। আর আমার এসবের কোনো দরকার নেই। আমি খালি ঝাঁট দিয়ে আমার ঘর পরিষ্কার করতে চাই। আমার কাছেই রোজ রোজ এগুলো দ্বিগুণ, চারগুণ হয়ে ওঠে। কি মুস্কিল বলতো?
- আচ্ছা, তুমি তো তোমার এই জিনিসগুলো যাদের দরকার, তাদের দিয়ে দিতে পারো। তাহলে, তোমার ময়লাও কমে যায়, আর ওদের বেড়ে যায়।
রূপলুর কথা শুনে হা হা করে হেসে উঠলো বুড়ো। বললো,
- ঠিক বলেছো। একমাত্র ছোটদের কাছেই এতো সুন্দর সমাধান থাকতে পারে। তা তুমি নেবে নাকি এর মধ্যে থেকে কিছু?
একটুও না ভেবে রূপলু মাথা নেড়ে বললো, "না"।
- কেন? এই ধনরত্ন, মণিমুক্তা নিলে তোমাদের তো আর কোনো কিছুর অভাব থাকবে না। যা চাও, তাই পাবে। তোমার, তোমার মায়েরও আর কোনো কষ্ট থাকবে না। নেবে?
- না। 
বুড়ো ঝকঝকে সাদা পাথর গুলো দেখিয়ে বললো, "এই দেখো, এগুলো হলো হিরে"। অন্য পাথরগুলো চিনিয়ে দিয়ে বললো,
"এগুলো মুক্তো, লাল রঙের চুনি, সবুজ পান্না, আর বাকি গুলোও সব অনেক দামী পাথর। এই ধূলোর মধ্যে মিশে আছে সোনা আর রূপো। এসবের অনেক দাম। তাও নেবে না?"
- না।
- এসব নিলে এক মুহুর্তের মধ্যে তোমাদের সব দুঃখকষ্ট দূর হয়ে যাবে। তাও না?
রূপলু বললো,
- আমার মা বলে, নিজেদের দুঃখকষ্ট নিজেদেরই দূর করতে হয়। তাছাড়া, অন্যের জিনিস কখনো নিতে নেই।
- এগুলো তো কারোরই না। যে কেউ নিতে পারে।
- কিন্তু এগুলো তো আমাদেরও না। তুমি বরং এগুলো তাদের দিয়ে দাও, যারা এগুলো চায়।
- যারা এগুলো চায়, তাদের অবস্থা দেখবে?
- কোথায় তারা?
- এদিকে এসো।
বলে বুড়ো রূপলুকে পাহাড়টার আর এক পাশে নিয়ে গেলো। এদিকেও পাহাড়ের নীচের জায়গাটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, ফাঁকা। শুধু সেখানে অনেক... অনেক লোক। তার মধ্যে মহিলা, পুরুষ বুড়ো, বুড়ি, ছেলে, মেয়ে সবাই আছে। তারা কেবলই কি যেন খুঁজছে আর রাশি রাশি ধূলো ময়লা কুড়িয়ে নিয়ে প্রত্যেকে এক একখানা করে ঝুড়িতে ভ'রে ভ'রে রাখছে। আর কোনো দিকে তাদের তাকিয়ে দেখার ফুরসত নেই। বুড়ো বললো,
- কতকাল যে এরা এখানে এসেছে, তার ঠিক নেই। এদের মধ্যে অনেকের বাবা, মা, ভাই, বোন, পরিবার, সবাই এখানেই আছে। কিন্তু ওদের সেসব কথা আর মনে নেই। ধনরত্নের লোভ ওদের সব ভুলিয়ে দিয়েছে।
- ওরা আর বাড়ি ফিরে যেতে পারবে না?
- এই লোভ না ভুললে পারবে না। এখানেই থেকে যেতে হবে চিরকাল। সেই জন্যই তো বলছিলাম, আমি একা, আবার একা নইও।
- আমি বাড়ি যেতে পারবো তো?
রূপলু তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করলো। বুড়ো বললো,
- তুমি যেহেতু এখানকার কিচ্ছু নিতে চাওনি, তাই তুমি চাইলেই বাড়ি ফিরতে পারবে। যখন ইচ্ছে তখন।
- আচ্ছা, তোমার নিজেরও তো এই সব জিনিসের ওপর কোনো লোভ নেই। তবে তুমি কেন এইখানে থাকো? তুমি কেন এখান থেকে চলে যাচ্ছো না?
- আমি যে এই রত্নদ্বীপের মালিক, রত্নবুড়ো। এই দ্বীপে যারা থাকে, তাদের খেয়াল রাখা হলো আমার কাজ। যতক্ষণ পর্যন্ত এই দ্বীপে একজন মানুষও থেকে যাবে, ততক্ষণ কোথাও যেতে পারবো না আমি।
- সবাই যদি চলে যায় এখান থেকে?
- তখন আমিও যেতে পারবো, আমার যেখানে মন চাইবে। কিন্তু এই দ্বীপ কি কোনদিন ফাঁকা হবে? কে জানে! 
- আর একদিন সত্যিই ফাঁকা হয়ে গেলে?
- তাহলেও আমার তো যাবার কোনো জায়গা নেই। আমার কোনো পরিবারও নেই। এই দ্বীপের বাইরে গেলেই আমার ধনরত্ন সব ধূলো আর ময়লা। আমি কেমন করে অন্য কোথাও যাবো? আমাকে এখানেই থেকে যেতে হবে চিরকাল!
রূপলুর খুব দুঃখ হলো রত্নবুড়োর জন্য। ও বুড়োর গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
- তাতে কি হয়েছে? যদি কখনো এই দ্বীপ ফাঁকা হয়ে যায়, তুমি আমাদের বাড়িতে চলে এসো। জানো তো, আমাদের বাড়িতে আমার দাদু আছে। ঠিক তোমার মতো। তোমরা দুজনে বন্ধু হতে পারবে। আর তোমাকে একা একা থাকতে হবে না। আচ্ছা, তুমি দাবা খেলতে পারো?
- কেন বলতো?
- আমার দাদু খুব ভালো দাবা খেলতে পারে। কিন্তু খেলার বন্ধু পায় না। তুমি থাকলে তোমরা দুজনে মিলে খেলতে পারবে।
বুড়োর চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। ধরা গলায় বললো,
- এতকাল এখানে যারাই এসেছে, তারা সবাই আমার কাছে কিছু না কিছু চেয়েছে। তারা সবাই ভেবেছে, আমার কাছেই পৃথিবীর সবচেয়ে দামী জিনিসগুলো আছে। আমিও সেই কথাই বিশ্বাস করতাম এতকাল। এই প্রথম দেখলাম, আমাকেও কেউ কিছু দিতে চাইছে। এই প্রথম আমাকে কেউ বুঝিয়ে দিল যে, তার কাছে আমার চেয়েও বেশী দামী জিনিস রয়েছে। পরিবার, আপনজন আর তাদের ভালোবাসা। সত্যিই যদি কোনদিন ছুটি পাই আমি, তখন যাবো তোমার কাছে। তুমি মনে রাখবে তো আমায়?
- মনে রাখবো। আর এই কথাও মনে রাখবো যে, তোমার খুব দুঃখ।

কথাটা বলে রূপলু চুপ করে রইল। বুড়োর জন্য ওর খুব মন খারাপ হয়ে গেছে। বুড়োও চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর এক সময় ধীরে ধীরে বললো,
- আমার ইচ্ছে করছে, তোমাকে কিছু উপহার দিতে। কিন্তু আমি যা কিছুই দেবো, এই দ্বীপ ছেড়ে চলে গেলেই তো সব ধূলো ময়লা হয়ে যাবে।
- কেন? এই যে গাছের ফুল, এগুলোও কি ধূলো ময়লা হয়ে যাবে?
রূপলু একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে আঙুল তুলে দেখালো। ফুলে ফুলে গাছটা ভ'রে আছে। বুড়ো হেসে বললো,
- না। এগুলো ধূলো ময়লা হয়ে যাবে না।
- তাহলে তুমি ওই ফুল পেড়ে দাও আমাকে।
- ঠিক বলেছো।
বুড়ো অনেক ফুল পেড়ে এনে রূপলুর হাতে দিল। রূপলু বললো,
- এবার আমি বাড়ি যেতে পারবো?
- তুমি চাইলেই পারবে।
- কিন্তু আমি কিভাবে বাড়ি যাবো?
- যেভাবে এসেছিলে, সেই ভাবে।
- কিন্তু আমার বেলুনটা যে হারিয়ে গেছে।
- কে বলেছে? ওই দেখো তোমার বেলুন।
রূপলু দেখলো, বুড়োর গুহার পাশে একটা গাছের ডালে বেলুনটা বাঁধা রয়েছে। বুড়ো বললো,
- ওকে আমিই পাঠিয়েছিলাম তোমার কাছে, তোমাকে এইখানে নিয়ে আসার জন্য?
রূপলুর হঠাৎ মনে হলো, পার্কের সেই বেলুনওয়ালার সঙ্গে বুড়োর মুখের কোথায় যেন খুব মিল রয়েছে। ও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
- তাই? তুমিই কি সেই বেলুনওয়ালা?
বুড়ো মিটিমিটি হাসছে দেখে রূপলু আবার জিজ্ঞেস করলো,
- আমাকে আনতে চেয়েছিলে কেন? আমি কি করেছি?
- কিছু করার জন্য নয়। বলতে পারো, এটা আমার কাজ। মাঝে মাঝে নতুন নতুন মানুষকে পরীক্ষা করে দেখা। এই দ্বীপে নতুন লোক নিয়ে আসা।
- বাঃ। একদিকে বলছো, এই দ্বীপে লোক থাকলে তোমার ছুটি হবে না। আবার নিজেই এখানে লোক বাড়াতে চাইছো?
রেগে গিয়ে বললো রূপলু। বুড়ো হাসলো। বললো,
- আমি বাড়াতে চাই না। আমার ওপর কিছু নির্ভরও করে না। নির্ভর করে, মানুষ কতোটা লোভী, তার ওপর। মানুষের মন থেকে লোভ না মিটলে, এই দ্বীপ কোনদিন একেবারে ফাঁকা হবে না।
বুড়োর কথা শুনে রূপলু কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর একসময় বললো,
- এবার আমি যাবো।
বুড়ো ওর মাথায় হাত রেখে বললো,
- এসো। আশা করবো, তুমি চিরকাল এই রকমই থাকবে।

রূপলু এগিয়ে গিয়ে বেলুনের সুতোটা চেপে ধরলো। অমনি বেলুন রূপলুকে নিয়ে আকাশে উড়ে গেল। বুড়ো ওর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়তে লাগলো। আস্তে আস্তে বুড়ো, তারপর সেই খেলনার মতো পাহাড়, জঙ্গল, বালি, সমুদ্র সব ছোট হতে হতে ঝাপসা হয়ে এলো রূপলুর চোখে। দিনের আলোর মতো আলোটাও ধীরে ধীরে কমে এলো। আবার সেই রাত। ঝড়ের শোঁ শোঁ শব্দ শুনতে পেলো রূপলু। চারিদিকে নিকষ কালো অন্ধকার। তারই মধ্যে রূপলুর কমলা রঙের গ্যাস বেলুন নিওন আলোর মতো আলো ছড়াতে ছড়াতে উড়তে থাকলো। ওদের বাড়ির দোতলার বারান্দাটা দূর থেকে দেখা যাচ্ছে এখন। চারদিক অন্ধকার। কারেন্ট এখনো আসেনি। ধীরে ধীরে গ্যাস বেলুন রূপলুকে ওদের বারান্দায় নামিয়ে দিয়ে, ঝোড়ো হাওয়ায় কোন্ দিকে যে উড়ে গেলো, রূপলু বুঝতেই পারলো না। বিরিয়ানির গন্ধ ভেসে এলো নাকে। এতক্ষণ পরে রূপলুর মনে পড়লো, ওর ভীষণ খিদে পেয়েছে। শুনতে পেলো, রান্নাঘরে সুতপা মাসি মা'কে বলছে, আর দশ মিনিট ঢাকা দিয়ে বসিয়ে রাখলেই হয়ে যাবে। মা বললো, "রূপলুটার অনেকক্ষণ কোনো সাড়াশব্দ নেই। ঘুমিয়ে পড়লো নাকি?"
"আমি দেখছি", বলে সুতপা মাসি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে শোবার ঘরে গেলো। সেখানে নেই দেখে বারান্দায় এসে, ওকে দেখতে পেয়ে বললো,
- একি রূপলু রাণী, এতো ঝড়ের মধ্যে তুমি বারান্দায় বসে কি করছো?
- গ্যাস বেলুনটা...
- গ্যাস বেলুনটা উড়ে গেছে বলে মন খারাপ করে এখানে বসে আছো? পাগলী একটা। শিগগিরই ঘরে চলো। বৃষ্টি নেমে গেছে। 
বলেই মাসি রূপলুকে হাসানোর জন্য ওকে কাতুকুতু দিতে লাগলো। আর তখনই মাসির চোখ গেলো কৃষ্ণচূড়ার গুচ্ছটার দিকে। সুতপা মাসি ফুলটা নিয়ে মা'কে দেখাতে ছুটলো। রূপলু শুনতে পেলো মাসি বলছে, "কি কান্ড দ্যাখ্, ঝড়ে একগোছা টাটকা কৃষ্ণচূড়া পাশের গাছটা থেকে তোর বারান্দায় উড়ে এসে পড়েছে।" মা কৃষ্ণচূড়া ফুল খুব ভালোবাসে। খুশী হয়ে বললো, "টেবিলের ওপর ফুলদানিটা আছে, ওখানে সাজিয়ে রাখ্।" ঘরে চলে আসার আগে আর একবার রূপলু বাইরে তাকালো। ঝড়ের তান্ডব দ্বিগুণ হয়ে গেছে হঠাৎ করে। নিকষ কালো অন্ধকার ছেয়ে আছে চারদিকে। এর মধ্যে ঠিক কোন দিক দিয়ে যে রত্নদ্বীপে উড়ে গিয়েছিলো ওর বেলুন, তা এখন আর বুঝতে পারলো না রূপলু। শুধু ওর মনে হলো, অনেক দূরের কোনো এক নির্জন, সুন্দর একটা দ্বীপে একা দাঁড়িয়ে রত্নবুড়ো এই দিকেই তাকিয়ে আছে!

__________________________________________

সোমা চক্রবর্তী।
Kalikapur, Taki Road,
Barasat, North 24 Pgs,
Pin- 700124.

[ছবি: ইন্টারনেট মাধ্যম থেকে সংগৃহীত]

মন্তব্যসমূহ

সপ্তাহের পছন্দ

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। ত্রয়োত্রিংশ সংখ্যা ।। জুন ২০২৪

ছোটোদের আঁকা ।। মনামি মন্ডল, রায়সী চক্রবর্তী ও নিশান্তিকা নস্কর।

ছড়া ।। একটা খুশি ।। তীর্থঙ্কর সুমিত

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 32nd issue: May 2024

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় - ১২ ।। সেপ্টেম্বর ২০২২

ধারাবাহিক উপন্যাস ।। তিতলির বিশ্বভ্রমণ ।। ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়

ছড়া ।। ও জোনাকি ।। কান্তিলাল দাস

দুটি ছড়া ।। গোবিন্দ মোদক

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। আত্মপ্রকাশ সংখ্যা ।। অক্টোবর ২০২১

মাসের পছন্দ

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। ত্রয়োত্রিংশ সংখ্যা ।। জুন ২০২৪

কবিতা || মর্যাদা || অবশেষ দাস

ছোটোদের আঁকা ।। মনামি মন্ডল, রায়সী চক্রবর্তী ও নিশান্তিকা নস্কর।

নিবন্ধ ।। কোনারক মন্দিরের ভয়াবহতা ।। সুজয় সাহা

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 32nd issue: May 2024

ছোটর কলম ।। বইপড়া ।। উন্নীত কর্মকার

গল্প ।। রবীন্দ্রজয়ন্তী ।। কুহেলী ব্যানার্জী

ছড়া ।। একটা খুশি ।। তীর্থঙ্কর সুমিত

অণুগল্প ।। পুরস্কার ।। চন্দন দাশগুপ্ত

বছরের পছন্দ

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। ত্রয়োত্রিংশ সংখ্যা ।। জুন ২০২৪

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচীপত্র ।। 29th Issue: February

প্রচ্ছদ ও সূচীপত্র ।। 24th issue: September 2023

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 31st issue: April 2024

প্রচ্ছদ ও সূচীপত্র ।। 25th issue: October 2023

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 32nd issue: May 2024

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 30th issue : March 2024

প্রচ্ছদ ও সূচীপত্র ।। 23rd issue: August 2023

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচীপত্র ।। 26th issue: November 2023

অতি প্রিয়

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। আত্মপ্রকাশ সংখ্যা ।। অক্টোবর ২০২১

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। দ্বিতীয় সংখ্যা ।। নভেম্বর ২০২১

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 4th issue: January 2022,

নিবন্ধ ।। শিশু-কিশোর সাহিত্যবলয়ে শিশুরাই যেন ব্রাত‍্য না থাকে ।। অরবিন্দ পুরকাইত

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 7th issue: April 2022

নিবন্ধ ।। দেশীয় উদ্ভিদ কেন গুরুত্বপূর্ণ ? ।। ডঃ চিত্তরঞ্জন দাস

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় - ১০ ।। জুলাই ২০২২

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় - ১১ ।। আগস্ট ২০২২

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র : 8th issue: May 2022

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় - ১২ ।। সেপ্টেম্বর ২০২২