চিরশত্রুতার জন্ম
নিরঞ্জন মণ্ডল
বহুকাল আগের কথা। সে কালে এত বড় বড় শহর ছিল না। যা ছিল তার চারপাশ ঘিরেও ছিল গ্রাম।গ্রামগুলোও ছিল বেশ বড় বড়।একটা গ্রাম থেকে আর একটা গ্রামের দূরত্ব ও অনেক।মাঝে বিশাল বিশাল ফসল খেত।বর্ষায় খেতগুলোতে ফসল চাষ হত।শীতে ফসল কাটা হত।তার পর খেতগুলো ধু-ধু মাঠ।এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রামে যেতে হত মাঠ পেরিয়ে।প্রতিটি গ্রামের ভিতর নিজস্ব মেটে পথ।গ্রামের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় যাওয়ার জন্যে।মাঠগুলোতে মোটা মোটা আল পথ।সেই পথ বেয়েই গ্রামবাসীরা খেতের ফসল তুলে আনত ঘরে।গাঁয়ের গেরস্ত বাড়িগুলোতে গরু ছাগল হাঁস মুরগি পোষা হত। থাকত পোষা কুকুর বেড়াল।গোলা ভরা ধান।পুকুর ভরা মাছ।গোয়াল ভরা গরু।গাঁয়ের লোকেরা ছিল দুধে ভাতে।ফসল তোলা হয়ে গেলে মাঠে চরে বেড়াত গরু ছাগল।সারা দিন মাঠে কাটানোর পর সন্ধ্যেয় তাদের ফিরিয়ে আনা হত গোয়ালে।বাড়ির পোষা কুকুর বেড়ালও খেতে পেত পেট পুরে।তবে কেবল ভাত খেয়ে বেড়ালের পেট ভরলেও মন উঠত না।মাছটাছ খেতে ছটফট করত সে।তাই মাঝে মধ্যে গেরস্ত বাড়িরসাঁঝাল দেওয়া মাছে কামড় বসাত চুরি করে।হয়তো এ জন্যেই বেড়ালের উপর খুব একটা সন্তুষ্ট থাকত না গৃহকর্তা গৃহিনীরা।মাঝে মধ্যে ঝাঁটাপেটা খেত বেড়ালেরা।কিন্তু প্রয়োজন বড় বালাই।ইঁদুরের উপদ্রবে ফসল নয়ছয় বাঁচানো চাই।তাই একেবারে তাড়িয়ে দিতে পারত না তারা বিড়ালকে।এতে বিড়ালের মনে ভারি দুঃখ।কুকুর ভাতেই সন্তুষ্ট। তাই মালিকের বাড়তি যত্ন পেত সে।এটাও বেড়ালের দুঃখের আর একটা কারণ।
এভাবে ভালোয় মন্দে কেটে যাচ্ছিল দিন।গাঁয়ের বেড়ালরা গাঁয়ের কুকুরদের সঙ্গেও মিলেমিশে থাকত।যেমন গাঁয়ের সব লোকেরা রোজ খোঁজ রাখত একে অন্যের।বিপদে সাহায্য করত।আনন্দে অংশ নিত।তেমনি বেড়ালরাও কুকুরদের সঙ্গে খেলত।গাঁয়ের পথ বেয়ে একে অন্যের আস্তানায় যেত।
এক দিন ঘটল এক অঘটন।বলতেই হবে সেটা।না হলে মন শান্ত হচ্ছে না! এক গেরস্ত বাড়ির বেড়াল ক'দিন ধরে বেশ বিরক্ত।কপালে তার জুটছে কেবল ভাত আর ভাত।গাঁয়ের সব লোক ভরা খেতে ফসল কাটায় ব্যস্ত।পুকুরের মাছ ধরার ফুরসুৎ নেই।তাই বেড়ালটার কপালে কাঁটাকোঁটাও জুটছে না।শেষে এক সকালে সে চলে গেল ফসল খেতে।সারা খেতে ধান কেটে মাটিতে শুইয়ে রাখা।সারির পর সারি ধানের গোছা।খেতটি যার সে অন্য খেতে ফসল কাটায় ব্যস্ত।বেড়াল খেতের মোটা আলপথ দিয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে যাচ্ছে খেতের আরও ভেতরে।তার চারপাশের খেতগুলোর মধ্যে বেশ কিছু মেঠো ইঁদুর।তারা সারা বছরের খাবার যোগাড় করছে।ধানের শিষ কেটে কেটে গোছা বানাচ্ছে।তার পর গোছাটা মুখে নিয়ে ঢুকে যাচ্ছে অদূরের আলপথের গর্তের মধ্যে। শিষের গোছা রেখে আবার বেরিয়ে আসছে শিষ কাটার জন্যে।
এমনই একটা হৃষ্টপুষ্ট ইঁদুরের উপর চোখ পড়ল বেড়ালটার।ধরতে পারলে বেশ আয়েশ করেই খাওয়া যাবে।মুখের অরুচিটা কাটবে।পেটও ভরবে।একটু দূরে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ ইঁদুরটাকে লক্ষ্য রাখল বেড়ালটা।দেখল সে শিষ কেটে কেটে একের পর এক গোছা বানাচ্ছে। বেশ কিছু গোছা বানানো হলে হয়তো সেগুলো নিয়ে যাবে। গুছিয়ে রাখবে তার গর্তে।রাখাচ্ছি গুছিয়ে! বেড়াল নিশানা ঠিক করে। নিঃশব্দে এগিয়ে যেতে থাকে ইঁদুরটার দিকে। শিষ কাটায় ব্যস্ত ইঁদুর টের পায় না কিছুই। তার মৃত্যু এগিয়ে যাচ্ছে তার কাছে---আরও কাছে! এটা দেখতে পায় অদূরের আর একটা মেঠো ইঁদুর। আক্রান্ত হতে যাওয়া ইঁদুরকে সতর্ক করতে চেষ্টা করে সে। জোরালো কিচ্-কিচ্ শব্দ করে ওঠে।খেতের অন্য ইঁদুররা সংকেত বুঝে সবাই কিচ্-কিচ্ শব্দ করতে থাকে। আক্রান্ত হতে যাওয়া ইঁদুরের কানে যায় সে শব্দ। শিষ কাটা বন্ধ করে সে।এ যে বিপদ সংকেত! চিরিদিক তাকিয়ে দেখে কোন বিপদ এগিয়ে আসছে কি না। তখনই সে দেখতে পায় বেড়ালটাকে।বুঝতে তার বাকি থাকে না কিছুই। এক দৌড়ে সে ঢুকে পড়ে গর্তে।শিকার হাত ছাড়া হওয়ায় খুব ক্ষেপে যায় বেড়াল।সব রাগ গিয়ে পড়ে খেতের অন্য সব ইঁদুরদের উপর। জোরে দৌড়োতে থাকে সে সারা খেত।যাকে পাবে তাকেই সে সাবাড় করবে আজ। তার এমন শিকার কি না হাত ছাড়া করল ব্যাটারা! খেতের ইঁদুরের দঙ্গল সারা খেত দৌড়োদৌড়ি করতে থাকে প্রান ভয়ে। এদের মধ্যে একটা ইঁদুরের চোখ পড়ে একটু দূরের আল পথে।একটা মোটাসোটা কুকুর আল পথ দিয়ে হাঁটছে।হেলতে দুলতে ফিরছে বোধ হয় গাঁয়ে। ইঁদুরটা দৌড়ে কুকুরটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। হাঁফাতে হাঁফাতে বলে--কুকুর মশাই--পে-ন্না---ম হই। বাড়ি ফিরছেন বুঝি?
--তোর জানার কি দরকার? ধানের শিষ কাটছিস কাট না বাপু গিয়ে।সর বলছি সামনে থেকে,--নইলে----!
--রাগ করবেন না কুকুরমশাই। আপনি হলেন আমাদের রক্ষাকর্তা।শ্রদ্ধার পাত্র। এখান দিয়ে যাচ্ছেন। পেন্নাম না জানালে অন্যায় হবে।
--তোর মতলবটা কি বলতো?--কি চাস-----?
--আজ্ঞে--,আপনি এখানে স্বশরীরে হাজির। আপনাকে কোন সম্মান জানালো না ঐ দুষ্টু বেড়ালটা! উল্টে মুখ ভেঙচালো আপনাকে লক্ষ্য করে!!বললে--আপনাকে ও থোড়াই কেয়ার করে। বড় লাগল কথাটা মনে।আপনি আমাদের শ্রদ্ধার পাত্র। সব জেনেও আমাদের সামনে অপমান করল আপনাকে! তাই----
--তুই সত্যি বলছিস?
--বাবা গণেশের দিব্যি---যা বলেছি সত্যি বলেছি।
--চলতো দেখি কত বড় হুলো সে।তার খেল খতম করে আসি।
বেড়ালটা যে খেতে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল ইঁদুরদের সেখানে পৌঁছোল দুজন। এ দিকে কোন খেয়াল নেই বেড়ালটার।সে দৌড়েই চলেছে ইঁদুরদের পিছে।
ইঁদুরটা বললে--দেখছেন কুকুর মশাই? কোন পাত্তা দিচ্ছে আপনাকে?জাতে গোত্রে আপনি তো বেড়ালটার অনেক উপরে----!
রাগে গরগর করতে লাগল কুকুরটা। হাজির হল দৌড়োতে থাকা বেড়ালটার সামনে।গতি সামলাতে পারল না বেড়ালটা।গিয়ে পড়ল কুকুরের নামিয়ে আনা মাথায়। কুকুর ভাবল--অহঙ্কারী বেড়ালটা তাকে আক্রমণ করেছে। সে বেড়ালের ঘাড়ে বসিয়ে দিল এক মোক্ষম কামড়। যন্ত্রনা কাতর বেড়ালটা মুক্তির জন্যে ছটফট করে উঠল।শেষে সামনের দুই থাবার ধারালো নখ দিয়ে আঁচড়াতে লাগল কুকুরের মুখে।তিক্ষ্ণ নখের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত হল কুকুরের মুখ। যন্ত্রনায় ককিয়ে উঠল কুকুরটা।তার দুই চোয়াল আরও জোরে চেপে বসল বেড়ালের ঘাড়ে। বেড়ালের ঘাড়ের চামড়া ফুটো হয়ে ভেতরে সেঁধিয়ে গেল কুকুরের দাঁত।যন্ত্রনা বৃদ্ধিতে বেড়াল আরও মরিয়া হয়ে গেল। পেছনের পা দুটো দিয়ে কুকুরের গলায় আঁচড়াতে লাগল ক্রমাগত। যন্ত্রনা কাতর কুকুরের চোয়াল একটু আলগা হল।শরীরের মোচড়ে নিজেকে মুক্ত করল বেড়াল।কুকুর ছেড়ে দেবার পাত্র নয়।বেড়ালের পিঠে বসিয়ে দিল কামড়।কিন্তু কামড় জুতসই হবার আগেই নিজেকে মুক্ত করল বেড়াল।দৌড় শুরু করল গাঁয়ের দিকে। তার ঘাড় ও পিঠ বেয়ে অবিরাম বেরোচ্ছে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত।কুকুরটা পিছু ধাওয়া করল বেড়ালটার। তারও মুখ,গলার চারপাশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত।অসম যুদ্ধে দুজনেই গুরুতর আহত। কেবল ইঁদুরগুলো বেঁচে গেল এ যাত্রায় এক জনের বুদ্ধির জোরে।
গাঁয়ে ফিরে বেড়াল পুরো ঘটনাটা বিস্তারিত জানালো তাদের মোড়োলকে। তাদের মোড়োল ধুমসো হুলো সব শুনল মন দিয়ে। তার পর গাঁয়ের সব বেড়ালদের জরুরী সভা তলব করল তখনই। গাঁয়ের দক্ষিণ প্রান্তে বিশাল পুরোনো পাকুড় গাছের তলায় বসল সে সভা। ধুমসো আহত হুলোকে দেখিয়ে সব জানালো সমবেত বেড়ালদের মিয়াও মিয়াও স্বরে।সমবেত সব বেড়াল মিউ মিউ করে বলে উঠল--এটা ঘোর অন্যায়।কুকুরটা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধী।একটা বাচ্চা হুলো দৌড়ে এসে মিউ--উ--উ--মিউ--উ--উ শব্দে জানালো গাঁয়ের কুকুরদের মিটিং হচ্ছে। গাঁয়ের পাঠশালার মাঠে। সেখানে গাঁয়ের সব কুকুর জড়ো হয়েছে।খবর শুনে সমবেত বেড়ালরা গেল রেগে। গোঁ-ও-ও--গোঁ-ও-ও করে তারা ধুমসো কে বলল--বলুন এর বিহিত কি ভাবে করা হবে।ধুমসো কিছুক্ষণ নীরব থেকে কি যেন ভাবল।তার পর বেশ জোরে গ-র-র--গ-র-র স্বরে বলল--এখন থেকে কুকুর জাতটাই আমাদের শত্রু।ওদের যাকে যেখানে দেখতে পাবে আচমকা আক্রমনে আঁচড়ে কামড়ে আহত কর।প্রতিশোধ নেওয়া চলবে যুগ যুগ ধরে।
এদিকে পাঠশালার মাঠে গাঁয়ের কুকুরদের সভা বেশ সরগরম।মাঝ বয়সী গাঁট্টাগোঁট্টা একটা কুকুর তাদের সরদার।ঘেউ-উ-উ শব্দে সে আহত কুকুরের কাছে শোনা সবটা জানালো সমবেত কুকুরদের।সমবেত কুকুররা এক সঙ্গে প্রবল ঘেউ ঘেউ শব্দ করে উঠল রাগে।তাদের শান্ত করে সর্দার বলল--বেড়াল জাতটাই নচ্ছার! আগের থেকেই আমি এটা জানি।ওরা নিজেদের খুব চালাক আর শক্তিশালী ভাবে।ওদের উচিত শিক্ষা দেওয়া দরকার।তাই আমার সিদ্ধান্ত হল--দুনিয়ার সব বেড়াল আমাদের শত্রু।ওদের দেখলেই তাড়া কর।বাগে পেলে কামড়ে রক্ত ঝরিয়ে দাও।
সমবেত কুকুররা ঘেউ-উ-উ-উ--খ্যাঁক----ঘেউ-উ-উ-উ--খ্যাঁক শব্দে সম্মতি জানালো।
সর্দার বলল--বেড়ালদের এই সাজা যেন বন্ধ না হয় কোন দিন।
সেই দিন থেকেই কুকুর আর বেড়াল চিরশত্রু।
____________________________________________________________________________________
নিরঞ্জন মণ্ডল
উত্তর 24 পরগণা,
কোলকাতা--700135 ।
[ছবি: ইন্টারনেট মাধ্যম থেকে সংগৃহীত]
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন