বৃন্দা-এক উড়ন্ত মানবী
আরজু মুন জারিন
।।এক।।
অজয় এক ঠেলার মালিক। বয়স পঁয়তাল্লিশ। গরীবের ঘরে রোগে শোকে অভাবে আর ও বেশী দেখায়। সকাল থেকে রাত অব্দি ওর ঠেলায় মাল সওয়ারী আনা নেওয়া করে। এতে তার পরিবার চলে কষ্টে। তার ঠেলার নীচে এক ছোট বাঁশের চোঙা সংযুক্ত করেছে সে সম্প্রতি। এখানে প্রতিদিন চেষ্টা করে একশ দুইশ রুপী জমা করে। প্রতিদিন জমা করে আবার পরের দিন এর থেকে কিছু নিয়ে খরচ করে ফেলে প্রতিদিন। পরের সপ্তাহে পূজো। অন্তত বউ ছেলেমেয়েদের হাতে ছোট এক জিনিস হাতে তুলে দিতে চায় ও এই পূজোয়। আজ এই দ্বিপ্রহরে ও বউ ছেলেমেয়ের কথা অমান্য করে ঠেলা নিয়ে বেরিয়ে এসেছে রাস্তায়। গায়ে ধুম জ্বর। গ্রীষ্মের প্রখর রোদে প্রকৃতি তেতে আছে। তার শরীর ও ক্ষুধা তেষ্টায় অবসন্ন হয়ে আছে। এর মধ্যে অন্যমনস্কতায় ঠেলার পিছনের এক চাকা আটকে গেছে ম্যানহোলে। দুইবার চেষ্টা করে হাঁপিয়ে বসে পড়ে রাস্তায়। চোখে মুখে অন্ধকার দেখতে থাকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে কান্না জড়িত স্বরে বলে
ভগবান আমাদের কোন মানুষ নাই তুমি ও নাই। এতগুলো মানুষ দেখে কেউ সাহায্য করতে আসেনা।
অজয়ের কথা শেষ হওয়ার আগে নেমে আসে এক মানবী না মেয়ে ওর পাশে। আপাদমস্তক কালো আচ্ছাদনে আবৃত।
আমি আছি তোমার পাশে চাচামিয়া। একহাতে চাকাটি তুলে ধরে
জয় হনুমান গুনগান সাগর চিৎকার দিয়ে বলে উঠে।
।।দুই ।।
কাল থেকে শুরু অর্ণব এর বার্ষিক পরীক্ষা। প্রতি পরীক্ষার কাছাকাছি আসলে রহস্যময় ভাবে তার জ্বর হয়। যার জন্য ও অসহায় বোধ করে। মা বাবার দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখ দেখে সে আর ও অসুস্থ হয়ে পড়ে।মা বাবাকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করতে থাকে এ তার ইচ্ছাকৃত নয়।অসহায় অর্ণব জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে থাকে। তখন মনের ভুলে কিনা দেখে আকাশে এক বড় পাখীর মত এক মানুষ! হা উড়ে যাচ্ছে। এবার বড় পাখীটি আস্তে আস্তে জানালার কার্নিশ ধরে ঝুলে দাড়িয়ে থাকে।
হাই/নমস্কার কেমন আছো অর্ণব? দিব্যি মানুষের গলায় কথা বলে উঠলো। চমকে অর্ণব শোয়া থেকে উঠে বিছানায় বসে পড়লো। "তুমি মানুষ" হ্যাঁ। অর্ণবের মাথায় হাত রেখে চোখের পলকে পাখি মানুষ টি উধাও হয়ে গেল তৎক্ষনাত।
মা এলেন তখন। গরম আদা পানি খাইয়ে মাফলার পরিয়ে জিভে থার্মোমিটার দিয়ে চলে যান। জ্বর দেখে মায়ের চোখ কপালে। জ্বর ত নাই। আনন্দে চিৎকার দিয়ে উঠলেন তিনি। মা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। অর্ণব উঠে এল শোয়া থেকে। সব বই খাতা খুলে পড়তে বসে গেল। মা আবার ও এসে দেখে গেলেন ছেলেকে। যাক মা খুশীতে নিশ্চিন্তের শ্বাস ছাড়লো। অর্ণবের পছন্দের খাওয়ার রাঁধতে গিয়ে জানালা দেখে দিয়ে কি যেন উড়ছে। লাল পাখা না আলখেল্লা পরে আছে। পরে আলখেল্লা উঠিয়ে হাত নাড়িয়ে শুভকামনা জানালো। মা দৌড়ে জানালার কাছে এসে ভালো করে দেখলেন। কিছু দেখতে না পেয়ে দেখার ভুল বলে আবার অন্য কাজে মনোনিবেশ করলো।
সায়ন, সমর শংকর তিনজন ভাল বন্ধু। তিনজনের গলায় গলায় ভাব। খাওয়া, পরা উঠা সব ওদের একসাথে। সামনে ওদের স্নাতক পরীক্ষা। তিনজনের রসায়ন প্র্যাকটিক্যাল শেষ করতে করতে প্রায়দিন ই সন্ধ্যা হয়ে যায়। আজ প্র্যাকটিক্যাল শেষ করে পাশের রাস্তা থেকে বাদাম কিনে খেতে খেতে গঙ্গার পার বরাবর হাটতে লাগলো ওরা। ওদের তিনজনকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল ওদের বয়সী এক মেয়ে। মেয়েটার চোখের পাওয়ারফুল চশমা। সাইকেল চালিয়ে চলছিল আস্তে পাশাপাশি। ওদের ওইপাশে একটা হোন্ডায় যাচ্ছিল তিনটা দুষ্ট ছেলের দল। এরা উড়ন্ত কমেন্টস পাস করছিল একজনকে লক্ষ্য করে। এই মেয়েটা যে ওদের লক্ষ্য তা বেশ বুঝতে পারছিল সায়নদের দল। মেয়েটি একবার নিস্পৃহ চোখে দুষ্ট ছেলেগুলির দিকে তাকালো যেমন এদিকে ও পাশ ফিরে ওদের কে দেখলো। এবার ওরা বুঝতে পারলো মেয়েটি ছেলেদের কোন ও কমেন্টস শোনেনি তাই ওর দৃষ্টিটি নিস্পৃহ। মেয়েটি কানে হেড ফোন লাগিয়ে রেখেছে। মেয়েটি না শুনলে ও আশেপাশের মানুষ শুনছে তা থেকে মজা নিচ্ছে। দেখে শুনে সায়নদের তিনজনের তালু জ্বলে উঠলো রাগে। তাদের পাড়ায় এ নিষেধ একেবারে। শেষবার এরকম এক বিকালে একমেয়ের পিছনে এক হিরোকে মাস্তানীর শিক্ষা দিয়ে দিয়েছে সমরদাদের গ্রুপ। তারা কিছু করতো বা বুঝে নিতো তার আগে খেয়াল করলো মেয়েটি রাস্তায় নাই। ট্রাফিক সিগন্যাল আসতে তিনজনে রোড ক্রস করতে যাচ্ছিল। সামনে এক অভাবনীয় দৃশ্যে তিনজনে হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে রইলো এবার। একজন মানুষকে দেখলো তাদের মাথার উপরে অনেকটা মুখ বাদ দিলে বাদুরের মত বড় পাখা যা তার পোষাকের অংশ বলে মনে হচ্ছে। ভাল করে দেখতে এক মানব এক মেয়ের মুখ মনে হল। এই উড়ন্ত মানুষটি তার জালে তিন বদ ছেলেকে তাদের হোন্ডা সহ শূন্যে তুলে নিয়ে নিল। রাস্তার সবাই হা হয়ে তাকিয়ে রইলো। এরপর পাশের হাটার রাস্তায় অবতরন করলো এদের নিয়ে। হোন্ডাটা নিয়ে হাতকড়া ধরনের এক লক এ পাশের বাইসাইকেল ষ্ট্যান্ড এ বেধে নিল। তিনবদকে একহাতে পেল্লায় চড় কষিয়ে দিয়ে আবার দ্রুত উধাও হয়ে গেল শত কৌতুহলী উম্মুখ জনতার দৃষ্টির সামনে। ছেলে তিনটি হতভম্ব হয়ে রাস্তায় বসে রইলো। ওদের হাতে একটা নোট।
"ভালো পথ সোজা পথ
মনে থাকে যেন
নাহলে পুলিশে দেওয়ার আগে
হাটবে আমার পথে"।
।।তিন।।
রাত বাজে দশটা। মা বাবা ভাই ঘুম। আস্তে পা টিপে লিভিং রুমের জানালার কাছে দাড়ালো বৃন্দা। খুব দ্রুত তার পাতলা স্বচ্ছ কালো রঙের বাদুড় পোষাক পরে নিল। এ অনেকটা ব্যাটম্যান এর পোষাকের মত। এই পোষাকটি বানিয়েছে ওর পদার্থবিদ্যার শিক্ষক অমরজিৎ পাল। এই পরীক্ষামূলক মানবী সসারটি যে এত নিখূত হবে দুজনের কল্পনার অতীত ছিল। প্রথমদিন উড্ডয়নের পরে বৃন্দা সফলতার সাথে অবতরনে সমর্থ হল যখন দুজন আনন্দে চিৎকার করে উঠলো।
"অভিনন্দন স্যার অজেয় বিজ্ঞানী অমরেশ পাল এই পৃথিবী অভিনন্দন জানাচ্ছে আপনায়। আপনার এই আবিস্কার পৃথিবী তে হৈচৈ ফেলতে যাচ্ছে স্যার।
"সে তো আমি চাইনা বৃন্দা। এ হৈচৈ পুরস্কার পাওয়ার এর জন্য করিনি। এ অন্যের কল্যানের কথা মাথায় রেখে বানানো। আর এ যদি পাবলিসিটি করা হয় তাহলে কি হবে? এ অর্থবান ধনাঢ্যদের বাহন হবে। তারা এ খেলনার মত ব্যাবহার করবে।
জি স্যার এ তো ঠিক।বৃন্দা ভাবনায় পড়ে যায় এখন।
আমি বলি কি আপাতত এ তুমি ব্যাবহার কর। একটা ই থাকুক। সব কাজ ঠিকমত হলে আমি আরেকটা বানাব আমার জন্য।
আরেকটা কথা বৃন্দা এ ব্যাবহার এর সময় তোমার মুখ কভারে থাকতে হবে। অর্থাৎ পরিচয় কাউকে জানানো চলবেনা। বুঝতে পারছ এ তে তোমার নিরাপত্তার ব্যাপার জড়িয়ে আছে।
সেই প্রথম দিন থেকে আজ ও বছরখানিক বৃন্দা এতে ভ্রমন করে। একে তার কাজ অপারেশন এর অংশ হিসাবে। কোন ও ব্যাক্তিগত কাজে এ ব্যাবহার করেনা। এ ব্যাবহার করে তখন ই যখন আর কোন উপায় থাকেনা বা কাউকে অসহায় অবস্থা থেকে উদ্ধার এর প্রয়োজন হয়ে পড়ে।এই যানটি দেখতে আলখেল্লা পোষাক এর মত। ভিতরে কমপিটার এর কিবোর্ড এর মত লাগানো আছে যাতে পাওয়ার অন অফ করা যায়। ছোট এক ফ্যান যাতে ভিতরের গরম হাওয়া ফিল্টার হয়ে বেরিয়ে ভিতর শীতল থাকে। তার বয়স এবার বিশ পড়েছে। সামনে তার স্নাতক পরীক্ষা। আজ ও যথারীতি সকল পড়াশোনা শেষ করে রাতের গভীর অন্ধকারে স্যারের ল্যাবে চলে এলো। এর পরে আর ও ঘন্টাখানিক স্যারকে ল্যাব এর কাজে সাহায্য করে। আর ঘন্টা সে রাতের আকাশে উড়ে দেখে কোথাও কোন অসহায় মানুষ ভগবান এর কাছে সাহায্য কামনা করছে। এইভাবে প্রায় ই পেয়ে যায় অজয় অর্ণব এই ধরনের অসহায় মানুষদের। একই সময়ে তার সামনে পড়ে যায় দূর্বৃত্তের দূর্জনের দল ও। এদের সে আচ্ছাসে ধোলাই করে। এর জন্য ও কুংফু কারাতে অনুশীলন শিখছে। এইবয়সে সে শিখে গিয়েছে এই দেশ, বিশ্ব তার ই পরিবার।সবার ভালো রাখার চেষ্টায় তার ও সমান দায়িত্ব আছে। জোর যার মুল্লক তার এ সে ভালো অর্থে সমাজ রাস্তা থেকে প্রতিবন্ধকতা সরাতে এই শক্তির ব্যাবহার করে। দূর্বল অসহায়ের কাছে সে বিনয়ের অবতার হিসাবে এগিয়ে আসে।
।।চার।।
আজ এভাবে আকাশে উড্ডয়ন কালে দুরের কোথাও থেকে ক্রন্দনের শব্দে থেমে পড়ে। একটু নীচে নেমে এসে দেখে দিল্লীর এক অভিজাত হোটেল এর পাশে হৈচৈ হট্টগোল। ট্রলার, ক্রেন মানুষে জমায়েত। পাশের বস্তি ভেঙ্গে এখানে আরেক হোটেল নাকি হবে। মাস্তান, গুন্ডারা বস্তির সব ঘর থেকে জিনিসপত্র ছুড়ে ছুড়ে মারছে। শিশু, বুড়ো সব ঘরহারা হয়ে রাস্তায় দাড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। এইসব দেখলে বৃন্দা জ্ঞানশূন্য হয়ে যায় সবসময়। আস্তে ক্রেন এর উপরে দাড়িয়ে পড়ে।
না এইভাবে না। এদের পূনর্বাসন করা হোক আগে। ওর ভিতরে স্পিকারে কথা বলে সবাইকে সচকিত করে।
এই সর ক্রেন এর ড্রাইভার ধমকে বলে।বলে স্পিড বাড়ানোর চেষ্টা করে ক্রেন এ। বৃন্দা এক হাতে ঠেলে ধরেছে ক্রেন এর হাতল। আর এক ইঞ্চি ও নড়ানো সম্ভব হলনা ক্রেন এর পাল্লা। চারিদিকে হৈ হল্লা শুরু হল। সাইরেন বাজিয়ে সিটি পুলিশরা চলে এল। টিভি, মিডি নিউজ ক্যামেরা সব চলে এল। ক্যামেরা দেখে একটু আড়ালে চলে এল বৃন্দা। হঠাৎ একটা দুই বছরের শিশু ক্রেন এর সামনে দাড়িয়ে আত্মচিৎকার শুরু করলো। অগত্যা বৃন্দা লাফ দিয়ে নীচে নামতে বাধ্য হল। শিশুটিকে কোলে করে এনে মায়ের কাছে দিয়ে দিল। টিভি,মিডিয়ার ক্যামেরার শাটার পড়তে লাগলো দ্রুত। অবশেষে কর্পারেশন আর পুলিশের সহায়তায় ব্যাপারটির মধ্যস্থতা হল। ওরা বস্তি না ভেঙ্গে ফেরত যেতে বাধ্য হল। বস্তির সবাই বৃন্দাকে ঘিরে নাচতে থাকে আনন্দে ও খুশীতে।
।।পাঁচ।।
আজ দূর্গা পূজা। চারিদিকে ঘরে, পাল্লা, মহল্লায় উৎসব, শোরগোল এর আমেজ। ছেলে, বুড়ো, পাড়া আনন্দে মাতোয়ারা। কিন্তু দূর্গার মনটা একটু আটো হয়ে আছে। ঠিক কেন যেন আনন্দে মিলতে পারছিল না ও আজ। থেকে থেকে ও ছোট দুই বছরের শিশুটির মুখ টানছিল। মায়ের মিষ্টি একটু মুখে দিয়ে বেরিয়ে পড়লো। সামনে হোটেল এ আজ চলছে বিরাট পূজো উদযাপন পার্টি। এ এই এলাকার কমিশনার এর আয়োজনে হচ্ছে। বড় বড় পাতিলে রান্না চলছে দমে। কিচেনের পিছনের ঘরে রান্না দেওয়া খাওয়ার গুলো ঢাকা আছে। একটা ড্রাম খুঁজে তাতে প্রথমে এক পাতিল বিরিয়ানী আর তার উপরে এক পাতিল ফিরনী নিয়ে উড়ে গেল পশ্চিমাকাশে। রাধুনীর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল ক্ষনিকের জন্য। পরে মনে হল এ দেখার ভুল তার। এ কিভাবে কেন কোন মানুষ উড়তে পারে বা খাওয়ার নিয়ে চম্পট দিতে পারে। অনেক সতর্কতায় উড়তে উড়তে সেই বস্তির কাছে এসে নামলো।
"বস্তিয়ালো" ডাক দিল জোরালো যান্ত্রিক স্বরে। ছেলে, মেয়ে, মা বাবা বুড়ো সবাই বেরিয়ে এলো বস্তির সব ঘর থেকে। সবাই এমনভাবে দেখতে লাগলো ওকে যেন মহাদেবী। ওকে ঘিরে ধরলো সবাই।
"আজ আমাদের ফিষ্ট, বলে ওর মজার যান্ত্রিক স্বরে। পাতিলের খাওয়ার সবাই এবার খেতে লাগলো তৃপ্তি সহকারে।
____________________________________________________________________________________
হোসনে আরা আরজু
৪০ টিসডেল প্লেস
ইউনিট নং - ১৯০৩
স্কারবোরো, অন্টারিও, টরন্টো।
[চিত্রঃ: ইন্টারনেট মাধ্যম থেকে সংগৃহীত]
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন