
শহীদ বালক রুদ্র শর্মা
সমীর কুমার দত্ত ভারতের কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল জন্মু জেলায় কাশ্মীরী বাঙালি হিন্দু পরিবারের রাজপুত সন্তান রুদ্র শর্মা নামের ছেলেটি একটি বিখ্যাত অ্যাংলো -বেঙ্গলি মাধ্যম স্কুলে দশম শ্রেণীতে পাঠরত। ছোটবেলা থেকেই দেশের সৈনিকদের প্রতি একটা দুর্বলতাই বলো আর সহানুভূতি যাই বলো তার মধ্যে তৈরি হয়েছে। তার কারণ অবশ্যই আছে। ছোটবেলা থেকে সৈনিকের পোশাক পরিহিত নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর ছবি তাকে বেশ আকৃষ্ট করে। সিভিক্সের ক্লাসে শিক্ষিকার দেশ ভক্তির যে পাঠদান পর্ব চলে,তা সে মনোযোগের সঙ্গে শ্রবণ করে। দেশমাতৃকা যে নিজের মায়ের সমতূল্য তা সে বুঝতে শেখে। দেশ এক সময় ব্রিটিশ শাসনাধীনে ছিলো। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে বহূ মানুষ শহীদ হয়েছেন। এই মহাণ ব্রতে তাদের এই আত্মাহূতি রুদ্র শর্মাকে উদ্বুদ্ধ করে। ক্লাসের শ্রেণী শিক্ষিকা সুলক্ষণা পন্ডিত পাঠ দিচ্ছেন দেশপ্রেমের— "তোমরা এখন স্বাধীন ভারতের নাগরিক। একদিন এই দেশ ছিলো পরাধীন। ব্রিটিশ শাসনাধীনে ছিলো। দেশ আমাদের কাছে মাতৃতূল্য। আমাদের মা কে আমরা যেমন ভালোবাসি, তেমনি দেশকে । সুতরাং দেশের সম্মান রক্ষার দায়িত্বও আমাদের। আমরা যেমন মাতৃদুগ্ধ পান করে, মাতৃক্রোড়ে লালিত পালিত হয়ে বড়ো হই, তেমনি দেশমাতৃকার শস্য খেয়ে ও আলো, বাতাস পেয়ে মাতৃক্রোড় রূপী ভূমির উপর অবস্থান করে লালিত পালিত হই। তাই দেশমাতৃকার কাছে আমাদের মাতৃঋণ থেকেই যায়। আর এই মাতৃঋণ আমাদের অবশ্যই রক্ত দিয়ে শোধ করতে হবে। সেইজন্য কতো মহান মানুষ দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনে। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু, ভগৎ সিং, বিনয়, বাদল, দীনেশ, মহাত্মা গান্ধী, কতো শত সহস্র নির্ভীক সৈনিক প্রমুখ। তাঁদের রক্তের বিনিময়ে দেশমাতৃকা অবশেষে স্বাধীনতা লাভ করেছে। এই স্বাধীনতা কষ্টার্জিত আর তাই মূল্যবান। এই স্বাধীনতা রক্ষা করার দায়িত্ব দেশে বসবাসকারী প্রতিটি নাগরিকের।"
রুদ্র শর্মা যতো শোনে,ততোই অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ হয়। তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে ওই সমস্ত মহান মানুষের মুখ। তার শরীরে বয়ে চলেছে রাজপুত রক্ত। রাজপুতরা কখনও প্রাণ বাঁচিয়ে শত্রুর মুখোমুখি না হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করে না। রুদ্র মনে মনে ভাবে এ দায়িত্ব তারও। সে বড়ো হয়ে একজন সৈনিক হবে।
সুলক্ষণা ম্যাডাম আরও পাঠদান করেন একটা স্বাধীন দেশের জাতীয় পতাকার গুরুত্ব প্রসঙ্গে—
"দেশ স্বাধীন হলে, তার ধ্যান ধারণাকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠে তার জাতীয় পতাকা। একটা দেশের জাতীয় পতাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মাননীয়। পতাকা সর্বদা উড্ডীন ও উন্নীত রাখা উচিত। কখনো কখনো পতাকা অর্ধ নমিত রাখা হয় যদি দেশ কোন মহান সন্তান বা কোন রাষ্ট্রীয় মর্যাদাসম্পন্ন মানুষকে হারায়, তার শোক প্রকাশের জন্য। কখনও এই পতাকা ভূলুণ্ঠিত বা অগ্নিদগ্ধ করা যায় না। কারন একটি জাতীয় পতাকা সেই দেশের সার্বভৌমত্ব প্রকাশ করে।"
রুদ্র শর্মা আর পাঁচটা ছেলে মেয়েদের মতো না হয়ে, সর্বদা দেশের কথা চিন্তা করে, দেশের শহীদদের কথা চিন্তা করে। পনেরোই আগষ্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে । তাই আগের দিন রাতে পতাকা তৈরি করে পরেরদিন সারা বাড়িতে পতাকা লাগায়। সৈনিকের পোশাক পরে স্কুলে হাজির হয়। তার দেখাদেখি অন্য ছাত্ররাও সৈনিকের পোশাক পরে। প্রধানা শিক্ষিকা যখন পতাকা উত্তোলন করেন রুদ্র তাকে স্যালুট করে। 'সারে জাঁহা সে আচ্ছা---------' সঙ্গীতের সঙ্গে সঙ্গে পা মেলায়। অর্থাৎ পতাকার সামনে দিয়ে মার্চ পাস্ট করে। পতাকাকে সম্মান জানানোর জন্য।
তখন সে নিজেকে একজন সৈনিক ভাবে।
তার বয়সী ছেলেরা যখন খেলাধূলা করে, ও তখন শহীদদের জীবনী পাঠ করে। শহীদ ক্ষুদিরাম,ভগৎ সিং এর জীবনী পাঠ করতে করতে তার চোখে জল এসে যায়। আবার নিজেই চোখের জল মুছে মনে মনে বলে—" ছিঃ! ছিঃ! আমি অশ্রু বিসর্জন করছি। একজন রাজপুত হয়ে এতো দুর্বল হয়ে পড়ছি। এদের এই আত্ম বলিদান আমি ব্যর্থ হতে দিতে পারি না। তারা দেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের।"
গভীর মনোযোগের সঙ্গে সে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস পড়তে থাকে। তার দেশ ও পাকিস্তান একই সঙ্গে স্বাধীনতা লাভ করেও শান্তিতে থাকতে পারছে না। তার কারণ পাকিস্তান অর্থাৎ পাকিস্তানের আগ্রাসী মনোভাবের জন্য উগ্রপন্থী কার্য কলাপ। কাশ্মীরের ওপর দখলদারীর উদ্দ্যেশ্যে মুহূর্মুহূ কাশ্মীরের ওপর হামলা এবং যুদ্ধের বাতাবরণ তৈরি করা। ইতিমধ্যে দু দুবার যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। ভারত তার যোগ্য জবাব দিয়েছে। একই সঙ্গে স্বাধীনতা লাভ করে ভারত আজ বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। আর পাকিস্তান পড়ে আছে কতো পিছনে। দেশটার না আছে কোন কালচার, না আছে উন্নয়ন। আছে শুধু ধর্মের গোঁড়ামি আর ধ্বংসাত্মক , উগ্রপন্থী কার্যকলাপ। কালক্রমে উগ্রপন্থীদের আস্তানা হয়ে উঠেছে। যা হোক, সে আলোচনা আমাদের এক্তিয়ার বহির্ভূত। এখন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে যে প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তানকে নিয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের চিন্তা ভ্রম- বাতুলতা। কঠোর হাতে যোগ্য জবাবই হলো ওদের উগ্রপন্থী কার্যকলাপ বন্ধ করার উপায়। ভারতে উগ্রপন্থী হামলা চালানোর জন্য ইতিমধ্যেই সারা বিশ্বের কাছে পাকিস্তানের মুখ পুড়েছে। তথাপি নির্লজ্জ পাকিস্তান থামার মনোভাবই প্রদর্শন করতে অসমর্থ।
নিত্য কতো নিরপরাধ মানুষ শহীদ হয়ে চলেছে। রুদ্রের তাদের জন্য বড়ো কষ্ট হয়। তার মনে হয় এভাবে শত্রুকে দুর্বল ভেবে হাত গুটিয়ে বসে না থেকে শত্রুর মোকাবেলা করা উচিত শক্ত হাতে। তার মনে হচ্ছে সে নিজেই যুদ্ধে যোগ দিয়ে শহীদ হয়ে যায়। কিন্তু ভারত যুদ্ধ চায় না। কারণ একটা যুদ্ধ অনেক ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে। একটা দেশকে অর্থনৈতিকভাবে অনেকটা পিছিয়ে দেয়। কিন্তু প্রতিবেশী যদি না বোঝে,তাকে তো যুদ্ধ করেই বোঝাতে হবে।
পাকিস্তান চকিত আক্রমণ সানাচ্ছে। একদিন হঠাৎই অনিবার্যভাবে যুদ্ধ শুরু হয়েগেলো। পাকিস্তান হঠাৎ জম্মু কাশ্মীরে আক্রমণ চালালো। তীব্র বোমা বর্ষণে চারিদিকে আগুন লেগে গেলো। সেই আক্রমণে রুদ্রের মা প্রাণ বাঁচাতে দৌড়ে পালাতে গিয়ে আক্রান্ত হয়ে শহীদ হলো। মায়ের মৃত্যু তাকে প্রতিশোধ পরায়ণ করে তুললো। সেই সময় রুদ্র দেখতে পেলো ভারতের জাতীয় পতাকা আগুনের গ্রাসের কবলে। তার মনে পড়েগেলো সুলক্ষণা ম্যামের কথা — সবার অলক্ষ্যে দৌড় দিলো পতাকাকে আগুনের হাত থেকে বাঁচাতে। সেই অগ্নিগ্রাসের চক্রব্যূহ ভেদ করে ঢুকে পড়লো পতাকাকে অক্ষত রাখতে। পতাকা হাতে নিয়ে দৌড়তে লাগলো। মায়ের অগ্নিদগ্ধ লাশ পড়ে থাকতে দেখে মনে মনে বললো — "শত্রু পক্ষের হাত থেকে তোমায় বাঁচতে পারলুম না মা। দেশ মাতার পতাকাকে বাঁচাতে আমি শহীদ হতে হলে হবো। আমি তো দেশ মাতার কনিষ্ঠ সন্তান মাতৃভূমির ঋণ শোধ হোক এই ভাবেই। পতাকা হাতে ছুটতে দেখে শত্রুপক্ষ তীব্র বোমা নিক্ষেপ করলো। পতাকা উঁচিয়ে রেখে মুখ থুবড়ে পড়লো রুদ্র শর্মা। শুধু মুখ দিয়ে উচ্চারিত হলো — "ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা। বন্দে মাতরম্।" এমতাবস্থায় ভারতীয় জোয়ানরাও চুপ করে বসে নেই। তারাও পাল্টা আক্রমণ সানাতে লাগলো। শত্রু পক্ষ পিছু হটতে বাধ্য হলো।
______________________________________________________________________________________\
সমীর কুমার দত্ত
পুনে, মহারাষ্ট্র
[চিত্রঃ: ইন্টারনেট মাধ্যম থেকে সংগৃহীত]
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন