Featured Post
গল্প ।। বাঘের পিকনিক ।। উত্তম চক্রবর্তী
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
উত্তম চক্রবর্তী
"তারপর, তারপর।" ছোট্ট বাবলু মাকে ইশারায় চলে যেতে বলে দাদুর গায়ের সাথে আরও বেশি করে চেপে বসে জিজ্ঞাসা করল কথাটা।
ছেলেকে স্নান করাবার জন্য ডাকতে এসেছিল বাবলুর মা। কিন্তু বাবলু তো এখন দাদুর কাছে বাঘের গল্প শুনতে ব্যস্ত। রিটায়ার্ড স্কুল মাষ্টার শচীন ঘোষ রোজ সকালে তার একমাত্র নাতির আবদার রাখতে রোজই একটা করে নতুন গল্প বানিয়ে শোনান। কত আর গল্প বানাবেন লোকটা, শেষে আজ একটা বাঘের পিকনিকের গল্প শোনাচ্ছেন এখন।
"তারপর তো সে এক বিশাল ঝগড়া শুরু হল। বাঘ, তার বৌ বাঘিনী, ছেলে বাঘা আর মেয়ে বাঘী সবাই মিলে মিটিঙে বসল যে কে কোন ভাগটা খাবে। গভীর জঙ্গলে বিভিন্ন জীব জন্তু শিকার করে খেতে অভ্যস্ত ওরা আজ এই প্রথম একটা মানুষকে শিকার করেছে। লোকটার চেহারা মোটেই অন্য জীব জন্তুর মত নয়। ভোর রাতে ঘুম ভাঙ্গার পর বাঘাই প্রথম দেখেছিল লোকটাকে, এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে জঙ্গলের ভিতরে ঢুকতে। বাঘা ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি ওর মা বাবাকে ডেকে তুলে দেখায় ঐ জন্তুটাকে। ওদের ফিসফিসানিতে বাঘীরও ঘুম ভেঙে যায়। বাঘ নিজেও জীবনে সচক্ষে কখনো মানুষ দেখেনি। কিন্তু ওর বাবার কাছে মানুষের অনেক গল্প শুনেছিল। সোজা গিয়ে দাঁড়াল সেই মানুষটার সামনে।"
"মানুষটা ওখানে গেছিল কেন গো দাদু ? বাঘের জঙ্গলে কেউ বেড়াতে যায় ?" বাবলুর সরল সোজা প্রশ্ন।
"আরে শোন তাহলে। ঐ লোকটা, মানে রাজু গড়াই, গেছিল জঙ্গলে মধুর খোঁজে। ওর গ্রামের সবাই ঐ বন থেকে মধু এনে নিয়ে যায় বাজারে। সবাইর দেখা দেখি রাজুও সেদিন প্রথম গেছে মধু আনতে সেখানে মৌচাকের খোঁজে, কিন্তু একা একাই চলে গেছিল রাজু। পথ হারিয়ে ঢুকে গেছে গভীর জঙ্গলে। ঐ যে "গুপী গাইন বাঘা বাইন" সিনেমায় যেমন জঙ্গলের ভিতর ওদের ভূতের রাজা ধরেছিল, বাঘ এসেছিল, মনে নেই, সেরকম জঙ্গল।"
একটা জানা জিনিষের কথা মনে পড়ায় বাবলু হাততালি দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে আর বলে, "হ্যাঁ, মনে আছে। ভূতটার মুখে লাইট জ্বলত, না গো দাদু ? বাবা কী জঙ্গল, ওখানে কোন মানুষ যায় ? তারপর , তারপর ?"
বাবলুর দাদু হেসে বললেন, "ঠিক বলেছিস। রাজু লোকটা নতুন ব্যবসা শুরু করতে গিয়ে সেই জঙ্গলে অনেকটা ঢুকে গিয়ে হটাত দেখে 'হালুম' করে একটা বাঘ এসে দাঁড়াল ওর সামনে। তাই দেখে রাজু তো সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ল সেখানে। রাজু চোখ বন্ধ করে পড়ে যাওয়ায় বাঘ ভাবল যে এই মানুষটা বোধ হয় মরেই গেছে। আবার একটা 'হালুম' করে ওর বৌ মানে বাঘিনী, ছেলে বাঘা আর মেয়ে বাঘীকে ডাক দেয়। ওরাতো মনের আনন্দে ঝোপের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো। ভাবল আজ ওদের একটা বিরাট বনভোজন, যাকে আমরা 'পিকনিক' বলে থাকি, সেটা হবে। নতুন জন্তুটাকে সবাই মিলে দুই বেলা মহানন্দে সাবাড় করবে। কী জানি কেমন হবে ওকে খেতে ! বাঘিনী তার কত্তাকে জিজ্ঞাসা করল, 'হ্যাঁগা, এটা আবার কী জন্তু গো ? এখানে আগে তো কোনদিন দেখিনি একে ?'
বাঘ সব জান্তার মত বুক ফুলিয়ে উত্তর দিল, 'এর নাম হচ্ছে মানুষ। এরা জঙ্গলের বাইরে থাকে। ওরা ঘর বাড়ি বানিয়ে সেখানে ঘুময়, ছেলে মেয়ে নিয়ে সংসার করে। মাথায় অনেক বুদ্ধি ওদের। কখনো কখনো খুব ভাল দৌড়তে পাড়ে। হাতের কাজে ওস্তাদ হয় আর খুব খায়, দেখোনা কেমন ভুঁড়ি হয়েছে লোকটার। শুনেছি জীব জন্তুদের মধ্যে মানুষ সবচেয়ে বুদ্ধিমান। কিন্তু এই ব্যাটা এখানে এলো কেন বুঝছি না।'
বাঘা এতক্ষণে বাবার গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে বলে উঠল, 'বাবা, আমি তাহলে এই মানুষটার পা দুটো খাব।'
বাবলু এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল। এবার জিজ্ঞাসা করল, 'কেন, বাঘা লোকটার পা খাবে বলল কেন ?'
দাদু হেসে বললেন,'আরে শোনো না দাদু ভাই। বলছি তো সব। চুপ করে শোনো। এরপর বাঘার এই আবদার শুনে বাঘ বুঝল ছেলে বেশ চালাক হয়ে উঠছে। বৌয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, 'দেখলে গিন্নী। বাঘা কেমন চালাক হয়েছে। ঐ যে আমি বললাম মানুষ খুব ভাল দৌড়তে পাড়ে, ব্যস সেটা শুনেই বলে কিনা এই মানুষটার পা খাবে বাঘা। বাঃ বাঃ, বেশ তুই ওর পা খাবি। আর আমার সোনা মা কী খাবে শুনি', বলে বাঘ তার ছোট মেয়েটাকে জিভ দিয়ে চাটতে চাটতে জিজ্ঞাসা করে তার কী আবদার। বাঘী মার দিকে একবার তাকিয়ে লজ্জা নত চোখে বলে, 'মা, এই মানুষটার মাথায় অনেক বুদ্ধি না গো ? আমি তাহলে ওর মাথাটা খাব। বাকি সব তুমি আর বাবা খেয়ে নিও।'
মেয়ে বাপের আদরে বিগড়ে যাচ্ছে দিনদিন। মা মানে বাঘিনী তো রেগে আগুন। চেঁচিয়ে বলে ওঠে, 'তার মানে ! আমি ভাবলাম এই মানুষটার মাথাটা আমিই খাব, তুই খাবি মানে কী ? তার চেয়ে তুই ওর হাত দুটো খা। শুনলি না বাবা বলল মানুষরা নাকি দুই হাত দিয়ে অনেক কাজ করে। মা আমার, তোকেও তো কাজ শিখতে হবে তাই না। না হলে তোর বর তোকে নিয়ে শিকারে বের হলে তুই তো কিছুই মারতে পারবি না। তখন শ্বশুর বাড়িতে তোকে সবাই নিন্দা করবে না মা।' বলে বাঘিনী মেয়ের গায়ে চেটে চেটে আদর করতে থাকে। কিন্তু মেয়ে তো মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয় সে রাজি না। ও মানুষটার মাথা খাবেই।'
'তারপর, ওর মা খুব রেগে গেল না ? যেমন আমি দুধ না খেলে মা রেগে যায়, আমাকে মারতে আসে ?'
দাদু নাতির কথা শুনে হেসে ফেলেন আর বলেন, 'না সোনা। মা তোমাকে খুব ভালোবাসেন। এই তো তুমি আমার কাছে বসে গল্প শুনছ বলে তোমাকে আর বিরক্ত না করে চলে গেল, তাই না ?' বাবলু মাথা নাড়ায়। দাদু আবার গল্প শুরু করেন, 'তারপর ওদের মধ্যে লেগে গেল ঝগড়া। বাঘ তার বৌয়ের দিকে তাকিয়ে বিরাট একটা 'হালুম' করে চেঁচিয়ে বলল , 'হ্যাঁ, তুমিই তো খাবে এই ব্যাটার মাথা। সারা জীবন আমার মাথা খেয়েছ, এখন এই লোকটার মাথা চিবিয়ে খাও। বাঘী যখন বলেছে ও মাথা খাবে ওই খাবে সেটা। তুমি এই লোকটার ভুঁড়ি খাও। দেখো না কি বিশাল ভুঁড়ি বানিয়েছে। দারুণ লাগবে খেতে।''
বাঘের কথা শুনে আরও রেগে গেল বাঘিনী। বলে ওঠে, 'আমি তোমার মাথা খাই ? কি যাতা বকছ ছেলে মেয়েদের সামনে ? শোনো ওই ভুঁড়ি টুড়ি আমি খেতে পারবো না। ওতে অনেক চর্বি থাকে। আর আমি এখন ডায়েটিং করছি। ঐ ভুঁড়ি তুমি খাবে। আমি মাথা খাব বলেছি আমি লোকটার মাথাই খাব।'
বাঘা আর বাঘী বাবা মার ঝগড়া দেখে চুপ করে বসে থাকে। একটা নতুন জন্তু শিকার করবার পর এখনো তাকে একটা কামড় পর্যন্ত লাগাতে পারেনি, এর চেয়ে বড় দুঃখ ওরা কোনদিন পায়নি। ভেবেছিল আজ ওদের পিকনিক, দারুণ জমে যাবে। ওমা, এ দেখছি বাবা মা তাদের ঝগড়া নিয়েই মেতে আছেন। এদিকে মাটিতে পড়ে থাকা লোকটার মাথা খাবার জন্য বাঘী আর দুটো লম্বা লম্বা নাদুস নুদুস পা দুটো খাবার জন্য বাঘার জিভ দিয়ে লোল গড়িয়ে পড়া শুরু হয়ে গেছে। বাবা একবার ইশারা করলেই দেবে এক কামড় বসিয়ে দুজন। কিন্তু বেচারা বাঘা আর বাঘী কী আর করবে।
এদিকে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে থাকা রাজু গড়াইয়ের তখন জ্ঞান ফিরে এসেছে। কিন্তু ওর চার পাশে বাঘের ভীষণ গর্জন শুনে রাজু মরার মত পড়ে রইল। চোখ অবধি খুলল না। ও তো আর জানেনা যে এরা ওর শরীরের কে কোন অংশ খাবে তাই নিয়ে ঝগড়া করছে। ভাবল একটা বাঘ ওকে শিকার করেছে, কিন্তু আরও কতগুলি বাঘ এসে ওকে খাবে বলে ভাগ বসাতে এসে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে। রাজু কী করে জানবে যে এরা সবাই একই পরিবারের বাবা মা ছেলে আর মেয়ে। ওতো চোখ খুলে দেখেনি। যদিও চোখ খুলে দেখলেও রাজু কিছুই বুঝতে পারতো না। সুতরাং বুদ্ধিমানের মত চোখ বুজেই রইল।
বাঘ আর বাঘিনী অবশেষে ছেলে মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে ওদের করুন অবস্থা বুঝতে পেরে ঠিক করল যে ওরা বাঘের বৃদ্ধ বাবা, যে নাকি জঙ্গলের ভিতরে একটা বড় পাহাড়ের গুহায় বাস করে, কোথাও বের হয় না, গিয়ে তার কাছে পরামর্শ চাইবে যে এই মানুষটাকে ওরা কী ভাবে ভাগাভাগি করবে। বাঘের এই প্রস্তাবে বাঘিনী রাজি হয়ে গেল। ছেলে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলল ,'চলো, তোমরাও সাথে চল। শ্বশুর মশাই কী বলেন শুনে আসি। উনি যেটা বলবেন সেটাই ফাইনাল। সবাই সেই মত এই মানুষটাকে কামড়ে ছিঁড়ে ভাগাভাগি করে খাব। আজ আমাদের শীতের পিকনিক একটু বেলায় শুরু হবে। রাজু হটাত লক্ষ্য করল বাঘের গর্জন থেমে গেছে। ও ধীরে ধীরে চোখ খুলে দেখে কেউ কোথাও নেই। রাজু অবাক হয়ে যায় যে ওরা সব গেল কথায় ? উঠে এক দৌড়ে পালিয়ে যায় নিজের গ্রামের দিকে।"
'ওরা তখন সবাই ওদের দাদুর কাছে গেছে না গো ? যেমন তুমি আমার দাদু ঐ বাঘা আর বাঘীর দাদু ঘরে বসে বসে ওদের খুব বকবে আজ না গো দাদু ?' বলেই বাবলু ফোকলা দাঁতে হাসতে থাকে।
দাদু মুচকি হেসে বলেন, 'ঠিক বলেছ দাদু ভাই। বাঘ তো বৌ আর ছেলে মেয়েকে নিয়ে গেছে তার বৃদ্ধ বাবার পরামর্শ নিতে। বাঘের বাবা ছেলের কাছ থেকে সব শুনে রেগে গিয়ে তার একটা থাবা দিয়ে বাঘকে একটা চড় মেরে বললেন, 'অপদার্থ। মানুষটাকে একা ফেলে রেখে সবাই মিলে চলে এলি আমার কাছে ? সে কি আর তোদের জন্য পড়ে থাকবে ওখানে যে এসো বাঘেরা, আমাকে এসে খাও তোমরা। বোকা, গাধা একটা। লোকটা এতক্ষণে দেখ গিয়ে উঠে পালিয়েছে।'
বাঘ বলে ওঠে, 'না বাবা, ও তো মরে গেছে। পালাবে কোত্থেকে ?'
বাঘের বাবা আরও রেগে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, 'ও নিশ্বাস নিচ্ছে কিনা বা ওর বুক ওঠা নামা করছিল কিনা ঠিক করে দেখেছিলি ?'
বাঘ মাথা নিচু করে বলে , 'না বাবা। করিনি। ভাবলাম লোকটা মরেই গেছে।'
তখনই বাঘের টনক নড়ে। এক দৌড় লাগায় বনের ভিতরে যেখানে রাজু পড়েছিল সেদিকে। গিয়ে দেখে কোথায় সেই মানুষটা ! এক জোড়া চটি ছাড়া সেখানে আর কিছুই পড়ে নেই। বাঘ রাগে 'হালুম' 'হালুম' করতে করতে গুহায় ফিরে যায়। বুঝতে পাড়ে ওর বোকামোর জন্যই আজকের শিকার পালিয়ে গেছে, ঐ ব্যাটা আসলে বাঁচা ছিল। ঈশ, ও কী বোকা ! একজনকে বসিয়ে যাওয়া উচিৎ ছিল ওর। আহারে, ওর বাঘা আর বাঘী এখন কী দিয়ে ওদের শীতের পিকনিক করবে ? এই সব হয়েছে ওদের মার জন্য। শুধু শুধু আমার সাথে ঝগড়া করে সব গণ্ডগোল করে দিল।'
___________________________________________________________________________________________________________
উত্তম চক্রবর্তী
কামধেনু নগর, ব্যাঙ্গালোর
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন