নাম বিভ্রাট
সুমিতা চৌধুরী
বোধ হয় শোলের দ্বারা ব্যাপক প্রভাবিত হয়েছিলেন রাম খিলাবন ও তাঁর স্ত্রী। স্বাস্থ্যবান ছেলের জন্মের পর তাই গব্বর নামটাই জুতসই মনে হয়েছিল তাঁদের। রাম খিলাবন একরকম বংশ পরম্পরায় কর্মসূত্রে ছিলেন পাহারাদার। কিন্তু তাঁর সিরিঙ্গে চেহারাটা ঠিক পাহারাদারের পক্ষে উপযুক্ত ছিল না। সবাই আড়ালে আবডালে হাসি তামাশা করতো তাঁকে নিয়ে।তখনই ছেলেকে ভবিষ্যতের পাহারাদার রূপে এক্কেবারে মানানসই লেগেছিল তাঁর। তাই সেই অনুযায়ীই নাম রাখতে কসুর করেননি তিনি। যাতে তাঁর গব্বরের নামেও দূর দূর পর্যন্ত ভয়ের নিস্তব্ধতা বিরাজ করে। বাচ্চারা বায়না করলে তাদের মায়েরা গব্বরের নামেই ভয় দেখিয়ে তাদের চুপ করাতে পারে। এরকম কত কি ভবিষ্যতের স্বপ্ন আঁকা ছিল তাঁর চোখে।
এহেন গব্বর দিনে দিনেই দশাশই চেহারা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করতে লাগল। আর রাম খিলাবনও তার যত্নে কোনো ত্রুটি রাখল না। নিজে না খেয়ে দুধ, কলা, ফলমূল, ঘি সবকিছু দিয়ে তার শরীর মজবুত করার সাধনায় লিপ্ত হল। রাম খিলাবন গর্ব করে তার চেনা-জানা সবাইকেই গব্বরের সাথে পরিচয় করাতে লাগল। আর মনে মনে আনন্দিত হতে লাগল এতোদিনে ছেলের মাধ্যমে নিজের শরীরের বদনাম ঘুচিয়ে।
এরই মধ্যে রাম খিলাবনের এক কুস্তিগির বন্ধু, বন্ধুর স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে তাঁকে পরামর্শ দিলেন তাঁর কুস্তির আখড়ায় গব্বরকে নিয়ে আসতে। যাতে খাওয়া-দাওয়া করে শরীর গড়ার সঙ্গে সঙ্গেই পালোয়ানের মতো তাতে বলও থাকে। যাতে সত্যিই গব্বর নামটা স্বার্থক হয়। রাম খিলাবনও দ্বিগুণ উৎসাহে তাঁর এই প্রস্তাব লুফে নিলেন। কিন্তু, বাড়ি গিয়ে সেকথা জানাতেই গব্বর গিয়ে মায়ের পিছনে লুকালো। মাও আদর করে ছেলের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, "আভি তো হামারা গব্বর বাচ্চা হ্যায় জি। আভি উসকা মন নেহী হ্যায় তো ছোড় দিজিয়ে। থোড়া বড়া হোনে দিজিয়ে, খুদ বো খুদ জায়েগি। এয়সে ভি পলেলবান তো হ্যায় হি আভিসে। আপ চিন্তা মত কিজিয়ে।"
এ হেন গব্বরের এক সময় মোছও যোগ হল। তাতে তা দিয়ে পাকিয়ে গুছিয়ে বেশ পালোয়ানের মতোই করে ফেলল সে। কিন্তু তখনও রাম খিলাবন যতবারই কুস্তির আখড়ার কথা তুলতেন, ততবারই গব্বরের মন হতো না সেখানে যাওয়ার। মায়ের পিছনে লুকোনোর মতো তার আর শরীর ছিল না তখন, অসুস্থ রুগ্ন মাও ছেলেকে আর আড়াল করতে পারতেন না। তাই বোধ হয়, মায়ের ছত্রছায়ার বাইরে তার তখন আখড়ার কথা শুনলেই হয় বেঘোরে জ্বর আসতো, নয় আমাশয় দেখা দিত। কি আর করা অসুস্থ ছেলেকে তো কুস্তির আখড়ায় নিয়ে যাওয়া যায় না। তাই রাম খিলাবন আবারও পিছিয়ে যেতেন। এভাবে চলতে চলতে গব্বরকে পালোয়ান রূপে দেখার অসমাপ্ত স্বপ্ন বুকে নিয়েই রাম খিলাবন একদিন চোখ বুঁজলেন চিরতরে।
নামেই গব্বর, স্বভাবে জব্বর ভিতু। পাড়ার রুগ্ন বিড়ালটাও ওর সামনে নিজেকে চিতাবাঘ ভাবে। তবুও বাবার কাজেই তাকে বহাল হতে হয়েছে এখন অগত্যা। তাই তার পুঁটলিতে এখন সবসময় হাফ ডজন ধুতি তাকে রাখতেই হয়। খাবার-দাবার থাক বা না থাক। খাবার নাহলে গাছের কলাটা মূলোটা ছিঁড়ে নিয়েও খাওয়া যাবে, নিদেনপক্ষে জল খেয়েও কাটানো যাবে। কিন্তু, কোনো বেয়াদপ কুকুর যদি ঘেউঘেউ করে ওঠে, বা কোনো বেড়াল যদি হঠাৎই লাফ দেয়, বা কখনো কলা পাড়তে গিয়ে কেউ গলা খাঁকারি দেয়, কেউ যদি একটু উঁচু গলায় কথা বলে, তবে তো তার একের পর এক ধুতি নষ্ট হতে থাকে, তখন না পাল্টিয়ে উপায় কি?
পাড়ার বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখন তাকে দেখলেই একটা অদ্ভুত ছড়া কাটে, "গব্বর, তেরা নাম বড়া হ্যায় জব্বর, বিল্লি ভি তেরা আগে শের য্যায়সা বব্বর।" তখন মনের দুঃখে গব্বর ভাবে, এতো নাম থাকতে তার বাবা মা কেন ওরকম একটা ভয়ঙ্কর লোকের নামেই তার নামটা রাখতে গেল? আদর করে একটা মিষ্টি নামও তো রাখতে পারতো, যেমন "রসগুল্লা"। তার কত প্রিয় খাবার এটা, আর তার চেহারার সাথেও বেশ মানানসই ছিল, আর সবাইই রসগোল্লাকে ভালোবাসে, বেশ সুন্দর আদরের ডাক হতো সেটা। আর এখন এই নামের গণ্ডগোলেই তার জীবনটা জেরবার হয়ে গেল।
Sumita Choudhury
Liluah, Howrah
Ph/Wa- 7003299023
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন