Featured Post
গল্প ।। সামার ক্যাম্প ।। তপন তরফদার
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
সামার ক্যাম্প
তপন তরফদার
কলকাতা এখন ফ্যাশান হয়েছে গরমের ছুটিতে বা পরীক্ষার পরে ক্যাম্পে নাটক শেখানো অথবা সমাজসেবার ট্রেনিং দেওয়া হয়। আমরা গলফগ্রিনের তিন কামরার ফ্ল্যাটে থাকি। দাদু মারা গেছেন। ঠাকুমা মনে করেন ওই সামার ক্যাম্প ট্যাম্প না করে এই ছুটিতে প্রকৃতির কোলে থেকে, প্রকৃতিকে বুঝতে পারাই আসল কাজ। শরীর ও মন ভাল হবে গ্রামে থাকলে। আমাদের গ্রামের বাড়ি আড়ংঘাটা স্টেশন থেকে পাঁচ কিলোমিটার ভিতরে। প্রায় ইচ্ছামতী নদীর ধারে।গ্রামের নাম আবদালপুর। ইচ্ছামতী নদীটা এখানে একদম সরু হয়ে গেছে। শ্যওলা, ঝাঁজরি, পানা নদীকে গ্রাস করেছে। নদীর জল বর্ষাকাল ছাড়া নড়াচড়া করে না। নদীতে জল ও পানা সমান সমান। আমার জ্যাঠা ওখানেই থাকেন। জ্যাঠা কি করেন এখনও পযর্ন্ত তা আমি জানতে পারিনি। উনি সব কাজই করেন, সব কাজেই আছেন, যাকে বলে সর্বঘটে কাঁঠালি কলা। জ্যাঠা এক ক্লাবে যান দাবা,তাস খেলতে, অন্য ক্লাবে নাটক যাত্রা থিয়েটারের রিহার্সালে। খুব শিঘ্রি কোন টিভি সিরিয়ালে চান্স পাবেন বলে আশা করে আছেন।
জ্যাঠার দুই ছেলে। কানাই আর বলাই।যমজ ছেলে। দু'জনেই লেখাপড়ায় দিগগজ। দু'জনের ভিতর কম্পিটিশন হয় কে কত কম নম্বর পাবে। একই ক্লাসে কে কত বেশীবার থাকতে পারে। জ্যাঠার মনোভাব, এক ক্লাসে যত বেশি সময় থাকা যায় তত ভাল।যত বেশি পড়বে, পরে ভাল ফল পাবে। যত বেশী রিহার্স্যাল দেবে, নাটক তত বেশী পোক্ত হবে। আমি স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছি। নিয়ম অনুযায়ী চার বছর আগে ওদের এই পরীক্ষা দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু স্লো সাইকেল রেস দিতে দিতে এত পোক্ত হয়ে গেছে ক্লাসে ওঠার ক্ষেত্রে ওরা ওই স্লো চলার নীতিতে বিশ্বাসী।
পরীক্ষা শেষ। আমাকে পেয়ে তো ওদের খুশির শেষ নেই। যত রকমের শিক্ষা আমাকে দেওয়া যায় তার ব্যবস্থা করল। একেবারে পাকা হাতের সামার ট্রেনিং। গাছে চড়া, গদী খেলা, ডাংগুলি খেলা,আর ও কত কি, গ্রামের সব জিনিস আমার মত জিনিয়াসকে শিখিয়েই ছাড়বে।
গরম কালে ওদের রাত্রে শোওয়ার ব্যবস্থা করা হয় ছাদে। চুন সুরকির পেটাই করা ছাদ। রাতে ওই ছাদে শুলে পাখার দরকার হয় না। কানাইদা বলাইদা ওই ছাদের সঙ্গী আমাকেও করে নিল। আমার অভ্যাস নেই খোলা জায়গায় শোওয়ার। মাথার ওপর ছাদ নেই। পাশে দেওয়াল নেই,একেবারে খোলা ছাদে একটা পাটির উপর শোওয়া। মাথার বালিশ অবশ্য আছে। ওরা দু'জনেই আমাকে সাহস জোগালো বলল 'কোন ভয় নেই।' বলাইদা বলে 'শহরে থেকে তুই খুব ডরপুক হয়ে গেছিস।' ওদের কাছে হার মানা মানে,নিজের ইজ্জত নিয়ে টানাটানি।শহরের বদনাম, তা আমি হতে দেব না। খুব সাহস দেখিয়ে আমি শুয়ে পড়লাম। জ্যেঠিমা রাত এগারোটায় এক জগ জল দিয়ে চলে যান নিচের তলায়। তখন থেকেই ছাদ কানাইদা ও বলাইদার দখলে চলে আসে, আর কেউই সকালের আগে ছাদে আসবে না। অবশ্য ভূত আসলেও আসতে পারে। জ্যাঠাইমার পায়ের আওয়াজ সিঁড়িঘর দিয়ে আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। নিচের ঘরের খিলটায় খটাং করে আওয়াজ হল, কানাইদা বালিশ থেকে মাথাটা তুলে বলে 'আজকের নৈশ যাত্রার কি হবে।'
আমার তন্দ্রা এসেছিল, প্রথমে যত ভয় পেয়েছিলাম সেটা ভেবেই এখন লজ্জা পাচ্ছি। কি সুন্দর হাওয়া। বাতাসে কি সুন্দর গন্ধ মেশানো আছে। সারা আকাশ জুড়ে ছোট ছোট তারা। কোন ও তারা সেই উড়ন্ত তুবড়ি বাজির মত ছুটে চলেছে। কোনও তারা দপ দপ জ্বলছে নিভছে। আমি কোন তারাই চিনি না। রাতে চিত হয়ে শুয়ে খোলা আকাশেই দেখিনি। তারা চেনার সুযোগ আর কি করে হবে? বিড়লা তারামন্ডল গিয়ে তাড়াহুড়ো করে তারাদের সংসার দেখেছি। তখন কালপুরুষ কে ও দেখেছি, এখন কিছুই চিনতে পারিনা। বুঝতে পারিনা। আজকের চাঁদটা গোল নয়। একটু খানি চাঁদ - এই চাঁদকে ওরা বলে একাদশীর চাঁদ।
আমার দাদাদের অবশ্য আকাশের তারাদের খোঁজ খবর রাখার ফুরসত মিলত না। কোন গাছে কোন তারা ফুটে আছে বা কখন ফুটবে তার সুলুক সন্ধান তাদের নখদর্পনে। ওই নৈশ যাত্রা শুনে আমি ধরে নিয়েছিলাম ওরা হয়ত ছাদে সারা রাত ধরে জ্যাঠার মত যাত্রাপালা করবে। বলাইদা আমাকে বুঝায়, 'ওরে এ যাত্রা সে যাত্রা নয়- আমাদের যাত্রা সারা পাড়া জুড়ে। আমাদের যাত্রা সবার যন্ত্রণা দূর করে দেয়। ' জন্ম সময় অনুযায়ী কানাইদা দশ মিনিটের বড়, তাই সে দাদা। কিন্তু দাদাগিরি বলাইদার উপর করতে পারে না। কে কখন কার উপর দাদাগিরি করবে তার ঠিক ঠিকানা নেই। কানাইদা অবশ্য এই নৈশ যাত্রার দাদা। কানাইদা বলে উঠল - 'ধুর্জটি নাগের কাঁঠালগুলো সরেস হয়ে উঠেছে, ওদের স্বর্গ প্রাপ্তির ব্যবস্থা করতে হবে।' কানাইদা মাঝে মাঝে বাংলা পাঠ্যের বিশুদ্ধ শব্দগুলো নিজের পান্ডিত্য বোঝাবার জন্য বলে, সেই শব্দগুলো বুঝে নিতে হয়। কাঁঠালের স্বর্গপ্রাপ্তি আজকের নৈশ যাত্রার যাত্রাপালা।
আমাকে বলে এই ছাদের কার্নিশ থেকে নিম গাছের ডাল ধরে গুড়ি বেয়ে নিচে নামতে হবে। যদি নিচে নামতে পারি তবেই নৈশ যাত্রায় আমাকে পাঠ দেওয়া হবে, নয়ত এই ছাদেই শুয়ে থাকতে হবে যতক্ষণ না ওরা ফেরে। খোলা ছাদে ভালই লাগছে। কিন্তু ভূত আসলে আমিতো একা মোকাবিলা করতে পারবো না। ভেবে দেখলাম ওদের যাত্রায় যোগদান করাই ভাল। নাইট সামার - ক্যাম্পেই যোগদান করব বলে মনস্থির করলাম। নতুন অভিঞ্জতা হবে। ওরা তো গাছের ডাল ধরে কাঠবিড়ালীর মতো নেমে গেল। আমি চাঁদের আলোয় ধাতস্থ হয়ে আস্তে আস্তে সাবধানে কোন রকমে নিচে নামলাম। চটি দুটো প্যান্টের ভিতর গুঁজে নিলাম।
সেনদের বাড়ির পিছন দিয়ে রাস্তা ধরল ওরা। রাস্তা মানে পতিত জমির উপর দিয়ে শর্টকার্টে লোক জন যাতায়াতের ফলে ঘাস গজায়নি। ঘাসের মাঝখান দিয়ে মাটি দেখা যাচ্ছে । আবছা আলোয় মাটির রাস্তায় মৃদু আলোর বিচ্ছুরণ হচ্ছে, বেশ ভাল ভাবেই রাস্তা দেখা যাচ্ছে। কোন অসুবিধা হল না, বোসদের পুকুরপাড় ছাড়িয়ে ডান দিকে একটা ছোট্ট বাঁশবাগান। বাঁশবাগানে ঢুকে আমি আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা। শুধু বাঁশের পাতার আওয়াজ। ওই খচমচ আওয়াজ লক্ষ্য করে হাঁটতে লাগলাম। ছাদ ছেকে নামার সময় ভাগ্গিস আমি চটিটা সঙ্গে নিয়েছিলাম, পায়ের তলায় কিছু ফুটবেনা। কানাইদা ও বলাইদার চটির দরকার হয় না।পায়ের তলার চামড়া ব্যবহার করে করে জুতোর সুকতলার মত পায়ের চামড়া করে ফেলেছে, একটা কঞ্চির কাঁটা পায়ের নিচে খোঁচা লাগল। আমি উঃ বলে বসে পড়লাম। কানাইদা বলে , ' কিরে কানার মত চলছিস কেন - আমার পিছনে পিছনে আয়। নৈশ যাত্র করবি আর গায়ে আঁচড় লাগবেনা, এ কখনও হয়। জলে নামব আর চুল ভিজবেনা, এ কখনও হয়। সহ্য করতেই হবে, যুদ্ধে সৈনিকদের কত কষ্ট করতে হয় ইতিহাস বই এ পড়িসনি।'
বাঁশবাগান পার হয়ে এক ছোট খেতে পড়লাম। এই খেতে ফুটি লাগিয়েছে। গরমের সময় ,কিছু ফুটি বেশ বড় হয়েছে, হলুদ রং ধরেছে, আলো - আঁধারির ভিতর ঢোকেই কানাইদা একটা বড় ফুটি ফটাস করে ফাটিয়ে একটা টুকরো মুখে চেপে ধরেছে খাওয়ার জন্য। সেই সময়েই দুটো শিয়াল তারস্বরে হুক্কাহুয়া আওয়াজ করতে করতে আমাদের ফেলে আসা বাঁশ ঝাড়ের ভিতর ঢুকে গেল। আমার পাটা কাঁপছে। শেষে শিয়ালের খাবার চুরি করতে এসে শিয়াল রাজার কামড় খাব। কুকুরে কামড়ালে জলাতঙ্ক রোগ হয়। র্যাবিশ ইনজেকশান নিতে হয়। শিয়ালে কামড়ালে কি হবে? শিয়াল ফ্লু হলে কে বাঁচাবে, কি ইনজেকশান নিতে হয় কে জানে। বলাইদা বলে ' তোপসে ভয় পেয়েছিস নাকি, কিছু ভয় নেই আমরা চলে গেলে শিয়ালরা ডিনার খাবে। ওদের ডিনারে আমরা ভাগ বসাচ্ছি না, আজকে আমাদের যাত্রা বিখ্যাত ধুর্জটি নাগের পনস ভক্ষন।'
ধুর্জটি নাগ। নামটাই বেমানান, বাগানে - নাগ নাম হলেই সঠিক নামকরণ হত। কত কম জায়গায় কত বেশী গাছ লাগান যেতে পারে এ বিষয়ে এই নাগ রেকর্ড করেছে। ঝোপঝাড় থাকার ফলে নাগে সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। সব বড়গাছ একদম সীমানার ধারে ধারে। ছোট গাছগুলো জমির মাঝখানে। একটা খড়েরঘরে নাগ-নাগিনী বসবাস করে। বয়স হয়েছে, ছেলেপুলে নেই নগনাগিনীর। তিন কুলে কেউ আছে কিনা পাড়ার লোকেরা সঠিক বলতে পারে না। গাছের ফল বিক্রি বাটা করে দেয়, পাড়ার ছেলে ছোকরার কোন দিন চেখে দেখার সুযোগ পায় না। হাটের ফড়েরা নাগের বাড়ি থেকেই আম,জাম, লিচু, কাঁঠাল সব নিয়ে যায়। বলাইদা খোঁজ পেয়েছে আগামী সপ্তাহে কাঁঠালগুলো চালান হবে। এই বাগানের কাঁঠালগুলো খাজা আর খুব রসালো। হাত বদলের আগেই দু'চারটে কাঁঠাল খেতেই হবে। কাঁঠাল নিয়ে কোথায় লুকিয়ে রাখবে তার জায়গাও ঠিক করে রেখেছে।
এই নৈশ যাত্রা নিরুপদ্রব যাত্রা হয়,যদি গৃহকর্তাকে ও বন্দি করে রাখা যায়। মালিককে যদি দরজার বাইরে শিকল লাগিয়ে দেওয়া যায়। মালিক চিলচিৎকার করার সুযোগ পাবে, কিন্তু নিশি কুটম্বের সাক্ষাৎ পাবে না। অপারেশনের সুসমাপ্তির পর বদান্যতা হিসাবে চলে যাওয়ার আগে শিকলটা খুলে দিয়ে যায়। ধুর্জটি নাগের কঞ্চির বেড়ায় এক জায়গায় ছোট একটু ফোকর আছে। দিনের বেলাতেই ইনস্পেকশন করে এসেছিল কানাইদা, এই আধা অন্ধকারে কানাগলিটা খুঁজে পেল না কানাইদা। অগত্যা হাইজাম্প দিয়ে বেড় ডিঙিয়ে বাগানে ঢোকা হল। হাত পা একটু ছড়ে গেল, সে তো যাবেই। বলাইদা প্রথমেই নাগের দরজায় শিকল টেনে দিল। আর যাইহোক ধুর্জটির নাগ পাশে বন্দি হতে হবে না। নিশ্চিত মনে জয় মা মনসা বলে কাজ শুরু হল।
বলাই একটা মনের মত কাঁঠাল মট্ করে ভেঙে নিচে ফেলল। কানাই একটা পাকা ছোট কাঁঠাল আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলে, ধর। একদম খাজা কাঁঠাল। আমি বাস্কেটবল খেলি, ও রকম ভিবে বল ধরতে অভ্যস্ত, কিন্তু কাঁঠাল নয়। বলের থেকে কাঁঠাল বেশ ভারী মনে হল, তবে শক্ত করে ধরে থাকলাম। হঠাৎ বেড়ার প্রান্ত থেকে হুঁক্কার, 'কোন ছোকরারে? আমাগো বাগানের লগে চুরি করতে আসছস।' আমার দিকে তেড়ে আসছে, হাতে সাধারণ লাঠির থেকেও লম্বা একটা লাঠি। আমি বাস্কেট বল যেমন পাশ দেয়, তেমন ভাবে কাঁঠালটা লুফে পাশ করে দিলাম বলাইদাকে। নাগ গিন্নি ওরফে নাগিনীর মুখও লগিটার দিক, ঘুরে গেল বলাইদার দিকে। কানাইদা গাছ থেকে নেমে এসেছে। বলাইদাও বাস্কেটবলের মত কাঁঠালটা কানাইদার দিকে ছুঁড়ে দিল। আমি কি করব ভেবে পাচ্ছিনা। কানাইদা কাঁঠালটা লুফে নিয়ে বাঁ দিকে ঘুরে দৌড়াতে গিয়েই পা হড়কে পড়ে গেল। বাইচুং ভুটিয়া যেমন বৃষ্টিভেজা মাঠে বল নিয়ে স্কিড করে ডিফেন্ডার কে বোকা বানিয়ে এগিয়ে যায়, ঠিক সেই রকমভাবে সড়াৎ করে তিন হাত এগিয়ে গেল। কোমরটা মাটিতে ভর করে এগিয়ে চলেছে। কিছুটা যাওয়ার পর সম্পুর্ণ দেহটা ঘড়ির কাঁটার মত গোলাকার হয়ে ঘুরে গেল। দম বলতে হবে কানাইদার, সেই অবস্থাতে ও উঠে দাঁড়িয়ে ভুল করে ওদের ঘরের দরজার দিকেই দৌড়াতে লাগল। নাগিনীও কানাইদার পেছনে লগা হাতে, গামছা পরে দৌড়াচ্ছে। চাঁদের আবছা আলোয় সে এক ভুতুড়ে দৃশ্য। ছায়া নাটকের দৌড় চলছে, আবোল তাবোলের দৃশ্য ভেসে উঠেছে। বলাইদাকে দেখতে পাচ্ছি না। আমি কি করি, মরণপণ হাইজাম্প দিয়ে বেড়া ডিঙিয়ে দৌড়ে ফুটি খেতে। যেই না ফুটি খেতের ভিতরে ঢুকেছি আবার শিয়ালের হুক্কহুয়া, হুক্কাহুয়া করে চিৎকার। আমি ছুটতে লাগলাম। হঠাৎ একটা কুকুরের আওয়াজ শুনলাম -ভৌ-ভৌ ভৌম - ভৌম, সে ও আমার পিছনে ছুটে আসছে। হাঁটু ছড়ে গেছে, হাতের অনেক জায়গায় নুনছাল বেরিয়ে গেছে। বাঁশ বাগানে ঢুকে, উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করি। আমার নতুনদার কথা মনে পড়ে গেল। কানাইদা বলাইদা, আমাকে নতুন দা ভাবছে না তো। আবার ভাবছি কানাইদার ভাগ্যে কি ঘটল। আমার উচিৎ হয়নি কানাইদাকে ওই নাগিনীর কাছে ছেড়ে আসা। আমরা সবাই মিলে নাগিনীকে তাড়া করলে হয়ত নাগিনী নিজের গর্তে ঢুকে যেত। আমাদের উচিৎ ছিল নাগিনীর বিষ দাঁত থেকে কানাইদাকে উদ্ধার করা।
আবার কুকুরের ডাক। আমার পায়ের তলায় মনে হচ্ছে বাঁশ কাঁটা ফুটে গেছে। চটি কখন পা থেকে টা টা করে দিয়েছে, তা ভুলেই গেছি। কুকুরটাও ওই ফুটি খেত থেকে দৌড়ে এদিকেই আসছে, তবে আস্তে আস্তে দৌড়াচ্ছ। কুকুরের আওয়াজটাতো ভৌউক ভৌউক নয়, কুঁই কুঁই কোঁ কোঁ, এ আওয়াজটা আমি জানি। যুদ্ধে হেরে গেলে, পরাজিত কুকুররাই এই আওয়াজ ছাড়ে। তাকিয়ে দেখি আরে ওটাতো একটা আস্ত মানুষ। মুখে দুহাত দিয়ে কুঁই- কুঁই কোঁই কোঁই ডাকছে আর ছুটে আসছে। সেই প্রবাদটা আমার মনে পড়ে গেল,সব শিয়ালের একরা, আমি ও হুক্কা-হুয়া-হুক্কা-হুয়া করে চিৎকার শুরু করে দিলাম। পশুপাখিদের ডাক নকল করার ট্রেনিং আমি পেয়ে গেছি। ফুটির খেত থেকে কুঁই কুঁই চিৎকার করতে করতে আমার দিকে ধেয়ে আসল। আমি যেই হুক্কা-হুয়া করেছি, পেটে একটা রাম চিমটি দিয়ে বলে - 'কোঁই-কোঁই। ' এবার আমি বুঝতে পারলাম কানাই- বলাই এর সাংকেতিক কথাবার্তা ওই কুকুরের ডাক দিয়ে। অন্ধকারে চিনতে পারছি না বলাইদা না কানাইদা আমি বলি ' তুমি কে? 'চুপ কর, আমি বলাইদা, আমি আবার প্রশ্ন করি কানাইদার কি হল। বলাইদা বলে চুপ কর, কুঁই -কুঁই -কৈ-কৈ ও চিৎকার। আমি ও হাত দুটো মুখের সামনে চোঙা করে কুঁই কুঁই কৈ কৈ আওয়াজ করলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভৌ বৌ কুঁই কুঁই আওয়াজ শোনা গেল পুকুর পাড় দিয়ে।
আমরা সিধে পুকুর পাড়ে গিয়ে হাজির। পুকুরের ধারে বসে কানাইদা। এই আধো অন্ধকারে ও দুটো বড় মাছি ভনভন করে ওর মাথার চারদিকে ঘুরছে। কানাইদা বলে উঠল - 'ঠিক ম্যানেজ করে নিয়েছিলাম, ওই কেঁচোর মাটিতে পা পিছলে পড়ে গেলাম, মাটিটা কেমন চটচটে, বিশ্রী গন্ধ।' এতক্ষণ খেয়াল করিনি মাছি গুলো ভন্ ভন্ করে ঘুরে কানাইদার মাথাতেই বসেছে। দমকা বাতাসটা আমার নাকে লাগাতেই নাকটা কেমন করে উঠল। একটা চেনা গন্ধ। হ্যাঁ; মনে পড়েছে, আমার যখন আমাশা হয়েছিলো, ওই গন্ধ বাথরুমে গেলেই পেতাম। আমি ওয়াক থুঃ বলে বমি করতে যাব। কানাইদা বলে ' গন্ধটা কেমন কেমন না। ' বলাইদা বলে বুঝেছি, ওই নাগ নাগিনীর জন্যই আমাদের গ্রামকে নির্মল গ্রাম বলে ঘোষণা করা যায় নি। পঞ্চায়েত লাখ টাকা পুরস্কার পেতো, সেটাও মাটি করে দিয়েছে ওই নাগ- নগিনী। ওই কাঁঠালতলা, খোলা বাগানেই প্রাতঃকৃত্যসারে। ওই বলে ' আমাদের সার আমাদের বাগানের গাছকেই খাওয়াবো।'
কানাইদা হাতটা মাথা থেকে একবার নাকের কাছে এনেই -' এঃ মাগো বলেই পুকুরে ঝাঁপ দিল।'
সামার ক্যাম্পে এখনও সাঁতার শেখা হয়নি, আমি পুকুরে ঝাঁপ দিতে পারলাম না।
==================
তপন তরফদার।
প্রেমবাজার (আই আই টি) খড়্গপুর 721306
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন