Featured Post
ছোটগল্প ।। বাবুসোনামনি কথা ।। দীপক কুমার পাল
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
দীপক কুমার পাল
|| পর্ব – এক ||
গরমের ছুটিতে দুই ভাই-বোন বেড়াতে গিয়েছিল তাদের মা বাবার সাথে আলাদা আলাদা জায়গায়। বাবুসোনা গিয়েছিল অরুণাচল প্রদেশের রাজধানী ইটানগর ছাড়িয়ে একেবারে জিরো তে। জায়গাটার নাম জিরো। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার ফুট এর ওপরে এক নয়ানভিরাম জায়গায় বাবুসোনারা এক হোটেলে দু তিন দিন ছিল। এখান থেকে আরো ওপরে যাওয়া যায়। সব শুদ্ধ এর উচ্চতা ৮০০০ ফুট। পুরো পাহাড়ের সারি দেখা যায়, আর সেই পাহাড়ের গায়ে গায়ে সাদা মেঘের দল ভেসে বেড়াচ্ছে আবার কখনো কখনো সেই মেঘের দল নিচে নেমে এসে ওদের তিনজনকে একেবারে ঢেকে দিয়ে কোথায় চলে যাচ্ছিল। বাবুসোনার মনে হচ্ছিল মেঘের দল যেন ওদের সাথে লুকোচুরি খেলছে। একথা ভেবে তার ভারী আনন্দ হচ্ছিল। সে দুহাত দিয়ে মেঘেদের ধরতে যাচ্ছে কিন্তু তারা কিছুতেই ধরা দিচ্ছে না। ঠিক তখনই সোনামনির কথা তার মনে হলো। ও থাকলে কি মজাটাই না হতো। দুটো দিন খুব মজা করে ওরা পৌঁছলো ইটানগর। এখানেও অনেক কিছু দেখার আছ, কিন্তু বাবুসোনার সবচেয়ে বেশী ভালো লেগেছে এখানকার তিনটে পার্ক। পার্কে কি না আছে। পার্ক গুলোতে ঢুকে সে কি হুটোপাটাই না করেছে। স্লিপ চড়া, দোলনায় চড়া ইত্যাদি সব। সঙ্গী মা ও বাবা। ওরা তো বড়, তাই ঠিক ওর সাথে পাল্লা দিতে পারছে না। কিন্তু সোনামনি ঠিক পারত। দেখ আবার সোনামনির কথা মনে পড়লো।
ওদিকে গরমের ছুটির শেষ পর্বে সোনামনি ওর মা বাবার সাথে দার্জিলিং বেড়াতে গেলো। এক সই, নাম মিঠাইও অবশ্য ওর মা বাবার সাথে ওদের সঙ্গে গিয়েছিল। সোনামনিরা প্রথম গিয়েছিল মিম টি এস্টেটে। এখানকার হোমস্টেটা অত্যন্ত সুন্দর। এর জানালা অথবা ছাদে উঠলে হিমালয়ের শোভা দেখতে লাগে ভারী মনোরম। কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় বিছানায় শুয়ে শুয়ে। কিন্তু সোনামনি দুবার এসেও তা দেখতে পায়নি। তাতে অবশ্য ওর কিছু আসে যায়নি। আনন্দ ই আনন্দ। সেটা দুই সখি মিলে ভীষন ভীষন ভাবেই করেছে। পুরো চেটেপুটে নিয়েছে আনন্দটাকে। তিন বছর আগে দাদাভাইও এসেছিল এখানে। সেবার তিনজনে মিলে আরও বেশী আনন্দ হয়েছিল। এখানকার চা-বাগানে এসে দাদাভাইয়ের কথা খুব মনে পড়ছিল। সেবার তাগদাতে ভারী মজা হয়েছিল। তারপর লামাহাটাতে কি মজাটাই না হয়েছিল। তবে এবারেও চা-বাগানে মিঠাই এর সাথে অনেক মজা হয়েছে। সবচেয়ে মজা হয়েছে দার্জিলিংয়ের টয় ট্রেনে চেপে ঘুম স্টেশনে যেতে। কিন্তু সোনামনি ভাবলো এমনিতেই তার ট্রেনে চাপলেই ঘুম পায়, কিন্তু এই ঘুমে এসে তো তার একটুও ঘুম পেলনা। বরং বাতাসিয়া লুপে গিয়ে তার ভারী মজা লেগেছে। কিন্তু দাদাভাই এই বাতাসিয়া লুপ দেখতে পেল না। মিঠাইকে বললো,
- 'জানিস মিঠাই, আর তিন দিন পর দাদাভাই আমাদের দুর্গাপুরের বাড়ীতে আসবে। কেন সেটা জানিস? আমার জন্মদিন যে।'
- 'আমি যাবো না তোর জন্মদিনে তোর বাড়ীতে?'
- 'হ্যাঁ, ঠিক আসবি কিন্তু। আমার বন্ধুদের সাথে তোর আর দাদাভাইয়ের আলাপ করিয়ে দেব।'
|| পর্ব – দুই ||
বাবার হাত ধরে বাবুসোনা ক্রিকেট কোচিং করতে গেছে স্কুলের মাঠে। প্রতি শনি ও রবিবার হয় এই ক্রিকেট কোচিং বিকেল চারটে থেকে। মাথার ওপর দাউ দাউ করে জ্বলছে সূয্যিমামা। সারা গা বেয়ে ঘাম গড়াচ্ছে বাবুসোনার। তবু কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তার। সমানে ছুটে চলেছে সারা মাঠ জুড়ে। কবে যেন ভর্তি হয়েছে সে। কিন্তু কোচিং স্যার এখনও কোনো দিন ওকে ব্যাট বা বল করতে ডাকে নি। খালি ফিল্ডিং করায়। কিন্তু তাতেও ওর ভারী উৎসাহ। আজ দুটো টিম করে কোচিং স্যার ওদের খেলিয়েছে। যদিও সে বল বা ব্যাট কিছুই পায়নি, তবুও ওর টিম হেরে যাওয়ায় ওর বুকের ভিতর থেকে ঠেলে কান্না বেরিয়ে এলো। বন্ধুরা সব বললো -
'কিরে তুই কাঁদছিস কেন? তুই কি একা হেরেছিস নাকি, আমরাও তো হেরেছি। আমরা কি তোর মত কাঁদছি? খেলাতে তো হারজিত আছেই।'
পেছন পেছন কোচিং স্যার বল উইকেট সব গুছিয়ে আনছিলেন। তিনি বাবুসোনার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, 'তোমার মাথা একদম দেখছি ঘামে ভেজা, টাওয়েল বা রুমাল নিয়ে আসিনি?' ও পকেট থেকে টাওয়েল রুমালটা বার করতেই স্যার খুব যত্ন করে ওর মাথা মুছিয়ে দিলেন। সবাইকে তিনি লাইন দিয়ে দাঁড়াতে বললেন। তারপর বললেন,
-'দেখো, এই সাইস্পর্শ (বাবুসোনার স্কুলের নাম), নিজের দলকে কি প্রচন্ড ভালোবাসে। টিমের প্রতি প্রত্যেকের ঠিক ওর মতো ভালোবাসা উচিত যেটা ও কান্নার মধ্যে প্রকাশ করে ফেলেছে। তোমরাও নিশ্চই খেলায় ভীষণ ভাবে জিততে চাও। কিন্তু এই ছেলেটার কান্নার মধ্যে একটা হেরে যাওয়ার অপমান বোধ লুকিয়ে আছে। এই জন্যে ও পরের খেলাটা জান-প্রাণ দিয়ে জিততে চাইবে। অথচ দেখো, ভর্তি হবার পর থেকে ওকে খালি ফিল্ডিং করিয়েছি। ব্যাট-বল হাতে দিইনি। অনেকে হতাশ হয়ে খেলা ছেড়ে দেয়, তাই তারা পরীক্ষায় হেরে যায়। কিন্তু সাইস্পর্শ পরীক্ষায় পাশ করেছে। এরপর থেকে ও ব্যাট বল দুটোই পাবে। যাও, এবার সবাই।'
সোনামনি সাঁতারে ভর্তি হয়েছে।ওর মা গাড়ি করে নিয়ে যায় সুইমিং পুলে। বিকেল পাঁচটা থেকে ছটা পর্য্যন্ত। কিন্তু তিনটে থেকে লাফালাফি করে সাঁতার শিখতে যাবার জন্য। আবার যখন সেখানে পৌঁছায় মায়ের সাথে তখন তার চটপটানি থেমে যায়। শক্ত করে মায়ের হাত ধরে থাকে। জলে সে নামতে চায় না সহজে। তার কারণ সাঁতারের ম্যাম ভীষণ রাগী, সবাইকে বকা ঝকা করে। সব তটস্থ। দিদিমণির চোখ সোনামনির দিকে পড়তেই তিনি একদম চোখ পাকিয়ে বলে উঠলেন,
- 'কি ব্যাপার অদৃজা (সোনামনির স্কুলের নাম), মাকে জড়িয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছো কেন? জলে নামার ইচ্ছে নেই নাকি? কেন সব সময় আড়ষ্ট হয়ে থাকো। কি ভাবে সাঁতার শিখবে তুমি?' জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি ওর মায়ের দিকে।
- 'আসলে কি জানেন, আমার মেয়ে আপনাকে খুব ভয় পায়। এমনিতে বিকেল তিনটার আগে থেকে সাঁতারে আসার জন্য ছটফট করে খুব কিন্তু এসে আপনাকে দেখে ভয়ে কুঁকড়ে যায় একদম।'
- 'ওমা তাই নাকি, অ্যাই আমাকে ভয় পাস কেন রে, আমি কি বাঘিনী যে টপ করে তোকে গিলে ফেলব?
ভয়ে ভয়ে দিদিমণির হাত ধরলেও সেদিন থেকে দিদিমণির সাথে ভীষন তার ভাব। তিনি ওকে নিজের হাতে সাঁতার শেখান।
|| পর্ব – তিন ||
বাবুসোনা চুপচাপ বিছানায় শুয়ে আছে। সে শুয়ে শুয়ে জানলা দিয়ে বাইরের সোনাঝুরি গাছের ফাঁকে ফাঁকে ছাই রঙা আকাশটা দেখছে। তার জ্বর কমে গেছে । কদিনের জ্বরে ও গা হাত পা ব্যথায় একদম কাহিল করে দিয়েছে বাবুসোনাকে। পেট ব্যথাও করছিল তার। আজ আর সেই সব কষ্ট নেই, তবুও তার বিছানা থেকে নামতে ইচ্ছে করছে না। হঠাৎ দেখে হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামলো। অমনি সে বলি আন্টিকে ডাকতে গিয়ে থেমে গেলো। দেখে সে জানালার বাইরে কি সুন্দর একটি মেয়ে দুটি শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু বাবুসোনা বুঝতে পারলো না যে ওরা তো থাকে চার তলায়। কিন্তু এই মেয়েটা শিক ধরে বাইরে কি করে দাঁড়িয়ে আছে। আবার ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। মেয়েটি বলে,
- ' তুমি তো বাবুসোনা, আর আমার নাম বর্ষা। কি চিনতে পেরেছো আমায়?'
- ' হ্যাঁ, তুমিতো বসন্ত দাদার ছোট বোন।'
- ' আমার বড়দা প্রখরদার কাছে শুনলাম তোমার খুব জ্বর আর পেট ব্যাথা। অথচ তোমার জ্বর কিন্তু হয়েছে আমার বড়দার জন্যই। কথাটা শুনে অমনি আমি ছুটে এলাম। আসার সময় আমার বড়দাকে আমি ভিজিয়ে দিয়ে এসেছি। বলে কি, এই কি করছিস, কি করছিস। আমি ছুট্টে পালিয়ে আসি। তুমি তো দেখছি ভারী দুর্বল হয়ে পড়েছ। যাই হোক জ্বরটা তো ছেড়েছে, পেট ব্যথাও নেই আর। এবার আসতে আসতে ভালো হয়ে উঠবে। আচ্ছা আমি এখন চলি কেমন। আমি আছি এখন দু তিন মাস।'
বর্ষা দিদি যেমন হঠাৎ এলো, তেমনি হঠাৎ চলে গেলো। বৃষ্টিটাও কেমন থেমে গেলো। সেও উঠে বসলো বিছানার ওপরে। খাট থেকে নেমে পড়লো মেঝেতে। গায়ে যেন জোর ফিরে পেয়েছে সে। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখে দিদা আর বলি আন্টি সোফায় বসে টিভি দেখছে। সে সামনে গিয়ে বলে,
- ' বলি আন্টি, আমার ক্ষিদে পেয়েছে, আমাকে এখুনি স্নান করিয়ে দাও।'
- ' হ্যাঁ আমি তোমাকে স্নান করাই, তারপর আবার জ্বর আসলে তোমার মা বাবা আমাকে কি আস্ত রাখবে? ঘাড় ধরে বার করে দেবে। চলো ভালো করে গরম জলে গাটা মুছিয়ে দিই। তারপর খাবে।'
খাওয়া প্রায় শেষ এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠলো। টেলিফোন ধরে সে বললো,
- 'হ্যালো, আমি সাইস্পর্শ বলছি। কে বলছেন?'
- 'আমি সোনামনি বলছি রে, দাদাভাই। আমার জন্মদিনে তুই আসিসনি বলে আমার খুব রাগ হয়েছিল। তাই ভেবেছিলাম তোর সাথে আর কোনোদিন কথা বলবো না, তোর সাথে কোনোদিন কোথাও যাবনা। কিন্তু জানিস একটু আগে আমি ছাদের বাগানে ঘুরছিলাম কোথা থেকে বর্ষা দিদি আমায় ভিজিয়ে দিয়ে একেবারে সামনে এসে দাঁড়ালো। বর্ষা দিদির কাছে তোর খুব জ্বরের কথা শুনে আমার রাগ একদম জল হয়ে গেলো। বুঝতে পারি তুই আমার জন্মদিনে কেন আসিসনি। আমার মা তোর জ্বরের কথা আমাকে বলেছিল, কিন্তু আমি ভাবলাম মা আমাকে ভোলাবার জন্য বলছে। তুই কিছু মনে করিস নারে দাদাভাই। আই অ্যাম ভেরি সরি। তোর সঙ্গে আমার বেশ ভাব, বল?'
- ' হ্যাঁরে খুব ভাব। আবার একদিন ঠিক দেখা হবে। এখন টা টা।'
- ' টা টা রাখলাম।'
দীপক কুমার পাল
ডিটিসি সাউদার্ন হাইটস,
ব্লক-৮, ফ্ল্যাট-১বি
ডায়মন্ড হারবার রোড,
কলকাতা-700104
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন