Featured Post
গল্প ।। ভুতোর ভুতুড়ে কাণ্ড ।। স্তুতি সরকার
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
স্তুতি সরকার
ভুতো ঘুরতে ঘুরতে সেই বাগান বাড়িটাতে এসে পৌঁছল।যেখানে সে বেঁচে থাকতে গাছ থেকে পড়ে গিয়ে মরে ভূত হয়ে গিয়েছিল। সেখানে সে রোজকার মতন হাত দুটো লম্বা করে উঁচু মগডাল থেকে কয়েকটা আম পেড়ে ফেলল। পা দুটো লম্বা করে লিচু গাছের মগডালে ফুটবল খেলার ভঙ্গিতে গাছের মাথা ঝাঁকিয়ে গাদা গুচ্ছের লিচু ফেলে ছড়িয়ে দিল বাগানময়। তার জ্বালায় আর মানুষরা তিষ্ঠতে পারেনা। হঠাৎ পুকুরে মুখ ডুবিয়ে একেবারে নিচ থেকে গাদাখানিক মাছ মুখের মধ্যে জল শুদ্ধ উঠিয়ে এনে কুলকুচি করার মতন করে ছড়িয়ে দিল বামুন বাড়ির উঠোনে। সকালে ঘুম থেকে উঠে বামনী দরজা খুলে উঠোনে মাছ ছড়ানো দেখে চেঁচাতে থাকল। আর ভূতেদের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ উদ্ধার করতে লাগলো। স্নান করে মন্ত্র পড়তে পড়তে বামুন ঠাকুরের উঠোনে এসে চক্ষুস্থির! " কি! আঁটকুড়োর ব্যাটা আজও মাছ ফেলে গেছে! জাতজম্ম কিছু আর রাখলে না গো"...সারাদিন পুজো আচ্ছা করে তবে নিস্তার পেলেন তিনি।
ভুতো এখন কদিন এ তল্লাটে আসবেনা। সে জানে মন্ত্র পড়ে এ পাড়ায় তার আসা বন্ধ করে দেবেন তিনি। কি আর করা যায়। প্যাঁকাটিসার হাতদুটো দুলিয়ে ডিগবাজি খানিক খেয়ে নিয়ে সে চিন্তা করতে লাগল, কোথায় যাওয়া যায?
আজ আবার হাট বসেছে গঞ্জে। এমনি দিন হলে ভুতো খুশি হয় হাট ভণ্ডুল করতে। সবাই তখন হিমশিম খেতে খেতে দৌড়য়। আলু, পটল, ঝিঙে, কুমড়ো, শসা ছড়িয়ে, লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে দুদ্দাড় করে হুড়মুড়িয়ে দে ছুট, দে ছুট। এর পা তার ঘাড়ে দিয়ে পড়িমড়ি করে দৌড় লাগায় মানুষগুলো। একদিকে ডাঁই করে রাখা মাটির হাঁড়ি কলসি সেগুলোও নিস্তার পায় না। পায়ের চাপে হাঁড়ি ভেঙে খান খান হয়ে হাটের সমাপ্তি ঘটায়।আজ কিন্তু তার মন ভালো নেই। কাল রাত্রের দৌরাত্ম্যের পর আজ সকালে ভুতো যখন দিনেও অন্ধকার হয়ে থাকা ঘন জংলা জায়গায় সেই মস্ত গাছটির মগডালে উঠে ঘুমোতে যাবে তখনই তো এসব অলক্ষুণে কান্ড ঘটে গেল। কাজেই তারও সারা দিনের মত ঘুম গেল ছুটে। আসলে দৌরাত্ম্য করলে কি হবে সে তো একটা বাচ্চা ভূত। সেও খুব ভয় পায়। কিন্তু অল্প বয়সের জন্য একটু এদিক ওদিক করে ফেলে আর কি। মন খারাপ করে সে হাটের রাস্তা না ধরে নির্জন রাস্তাটা ধরে হাঁটতে থাকল। শ্মশান পার হয়ে গোরস্থানও পেরিয়ে গেল।এদিকে সে আগে কোনওদিন আসেনি।
এবার ঝিঁঝিঁ ডাকতে থাকা ভীষণ নির্জন একটা জায়গায় এসে সে উপস্থিত হল। বাড়িঘরও বিশেষ নেই এদিকে। ছোট ছোট মাটির বাড়ি, পুকু্র, ডোবা। সোঁদা সোঁদা গন্ধ ওঠা জায়গাটায় সে এসে পৌঁছলো। একেতো সারাদিন ঘুমের বারোটা বাজল। রাত্রে তো আবার ভূতেরা ঘুমোতে পারে না। এতটা রাস্তা চলে আসল, কিন্তু কোন মানুষ চোখে পড়ছে না। মড়া পোড়াতে কয়েকজন এসেছিল সেটা সে দেখেছে।আর গোরস্থানে বোধহয় একজনকে গোর দিতেও এসেছে কয়েকজন। এবার তার গা ছমছম করে উঠল। এতো ফাঁকা জায়গায় যদি তাকে এবারে ভুতে ধরে! ভুত হওয়ার পর থেকে তো সে মানুষের মধ্যেই নিজের গা বাঁচিয়ে থাকত। কাজেই এখন প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেল ভুতো। চিৎকার করে "রাম রাম" বলতে গিয়ে সরু কান্না ভেজা গলায় "মড়া মড়া" বলে খানিক চেঁচিয়ে নিল। এবার তো আসল ভয়। বিশাল বিশাল গাছ হাঁ করে যেন বাচ্চা ভুতোকে ভয় দেখাতে তাদের শাখা-প্রশাখা দোলাতে লাগল। খানিক বসল। খানিক কাঁদলো সে। তারপর ক্লান্ত হয়ে আবার পথ চলতে শুরু করল। কতটা চলেছে সে বলতে পারবে না। বেশ কিছুটা যাবার পর পেল্লায় বড় একটা বাড়ির সামনে এসে উপস্থিত। তখন কটা হবে সন্ধ্যে সাতটা বেজেছে কি বাজে নি। দেখে বাড়ির ভেতরে একটা দাওয়ায় একটুখানি যেন লম্ফের আলো। আলো দেওয়ার চেয়ে সেটা বেশি ধুম উদগীরণ করছে। একটা বুড়ি মা তার কাঁপা কাঁপা হাতে একটা কুপি নিয়ে বাড়ির বাইরে নিত্যকর্ম করতে বেরিয়ে এসেছিলেন। এখন তিনি ভেতরে ঢুকে যাচ্ছেন। মানুষ দেখতে পেয়ে ভুতো সোল্লাসে মানব জন্মের মত বহুবার পেন্নাম করল। ভুতোর চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ল । বুড়িমা বললেন,"এ বাবা এ যে বৃষ্টি এল দেখছি" । বুড়ি তাড়াতাড়ি বাড়ীর ভেতর ঢুকে দরজা বন্ধকরার ফাঁকেই ভুতো সুরুৎ করে সেঁধিয়ে গেল বাড়ির ভিতরে।মনে মনে বলল, "ভয় নেই গো বুড়িমা আমি এসে গেছি, আর আমি কোন দুষ্টুমি করব না। দয়া করে আমাকে তোমার আশ্রয় থেকে তাড়িয়ে দিও না।" সারারাত বুড়ির পায়ের কাছে বসে পায়ে হাত বুলিয়ে দিল। বুড়ি ঠিক কিছু বুঝতে পারার আগেই আরামে দুচোখ বুজে এলো।
এদিকে হয়েছে কি যে বাড়িতে ভুতো আশ্রয় পেয়েছে সেটা ছিল একটা বনেদি জমিদার বাড়ি। বিরাট বড়। তার বিভিন্ন অলিন্দে গাছ-গাছড়া গজিয়ে উঠে তাকে একটা পোড়াবাড়ি করে তুলেছে । ভূতেদের একদম আদর্শ স্থান। সেখানে একটা ভূত দম্পতি থাকত। তাদের ছেলেপিলে ছিল না। সন্ধ্যে হতেই সারাদিন ঘুমের পর কর্তা-গিন্নি ভূত বেড়াতে বের হত সারা রাতের জন্য। ফিরত সেই কাকভোরের একটু আগে। ওদের যাতায়াত বাড়ির সম্পুর্ন উল্টো দিক দিয়ে। যেদিকে বুড়িমা থাকে তার উল্টোদিকে। ভোররাতে বাড়ি ফিরেই কিন্তু ভূত গিন্নি কিছু একটা গন্ধ পেল। সোঁদা সোঁদা, বাচ্চা ভূত বাচ্চা ভূত গন্ধ। ঠিক ঠাহর করতে পারল না গন্ধটা কী। ভুরিভোজ সেরেই ফিরে ছিল ওরা। সোজা বাড়ির ভেতরের ছাদ থেকে ঝুলে থাকা একটা ঝাঁকড়া বড়ো গাছ ধরে ঝুলতে ঝুলতে ঘুমিয়ে পড়ল।
এদিকে সকাল হয়ে আসতে ভুতোও বুড়িমাকে ছেড়ে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে কাছাকাছি একটা ঝাঁকড়া গাছের অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। একে আগেরদিন সারাদিন ঘুমোতে পারেনি, তার ওপর মনে হয় একটা আশ্রয় পাওয়ার ভরসায় খুব গাঢ় ঘুমে ঘুমিয়ে পড়ল সে। ঘুম ভাঙে সেই সন্ধ্যার মুখে মুখে। তখন ভুত দম্পতি আবার পাড়া চরতে বেরিয়ে গিয়েছে। খিদে পাওয়ায় পাশের বড় দিঘী থেকে কিছু মাছ খেয়ে ভুতো ফিরে আসল ঠাকমার কাছে।
বুড়ি তখন খাওয়া-দাওয়া সেরে আগের দিনের মতো কুপি জ্বালিয়ে ঘরের বাইরে গিয়ে নিত্যকর্ম সেরে দরজা দিয়েছে। আগের দিনের মতই ভুতো বুড়ির পায়ে মালিশ করে দিল তার প্যাঁকাটি হাতে, পাখির পালক দিয়ে। আজ আবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। বুড়ির তো খাসা ঘুম হল সারারাত। তারপর ভুতো ভোররাতে ঘুমোতে গেল আগের দিনের মতোই। সেই শুরু। বুড়ি প্রায়ই ভাবে কে তার পায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়ায়? পাকা কলা, আমটাম, উঠিয়ে এনে রেখে যায়? কিছুই ঠাহর করতে পারে না বুড়ি।
ভুতো একদিন হঠাৎ ধরা পড়ে গেল ভূত দম্পতির কাছে। সদ্য পাওয়া ছেলেকে এক মিনিটও কাছ ছাড়া করতে চায় না ভূত দম্পতি। ভুতো নতুন বাবা-মা পাওয়ার পরেও বুড়িমার কাছে রাত্তিরে যাওয়া বন্ধ করেনি।দিনের বেলায় অবশ্য এখন ভুতো তার নতুন বাবা-মার কাছে থাকে। ভুতো এখন সারা বাড়ির এই ঘর ও ঘর আনাচ-কানাচ সব ঘুরে ঘুরে দেখে। চোখ বড় বড় হয়ে যায় তার এত্তো বড় বাড়ি দেখে। সেদিন এরকম ভাবেই ঘুরতে ঘুরতে বুড়িমার সামনের ধপ করে পড়ে গেল। সে বেচারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই বুড়ি মার কাছে ধরা পড়ে গেল। ভুত হবার পরেও ভুতো কখনো মানুষের এত কাছে যায়নি। গুটি গুটি পায়ে জড়োসড়ো হয়ে এসে অবাক চোখে চেয়ে রইলো বুড়ি মানুষটার মুখের দিকে । বুড়িমা জিজ্ঞেস করলেন এই ছানা তোর নাম কী? ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে থেকে প্রথমে বোঝবার চেষ্টা করল কে এটা?
তারপর গুটি গুটি পায়ে এসে বলল, "আমি ভুতো" । তুমি কে গো? ঠাকমা নাকি? সেই থেকে বুড়ি ঠাকমা আর ভুতো খুব বন্ধুত্ব গড়ে উঠল । মাঝেমাঝেই গাছের পাকা ফলমূল এনে দিয়ে যায় ভুতো তার ঠাকমাকে। ঠাকমা ও ভুতোকে কত গল্প বলে। মাঝে মাঝে গরমের দিনে ভুতো মিষ্টি বাতাসকে ছুটিয়ে নিয়ে এসে বাড়ির মধ্যে ঘুরিয়ে মারে। গরমের দুপুরে ঠাকমা আরামে নিদ্রা যান । এভাবেই চলছিল। একদিন কিছু মানুষ বুড়ির বাড়ির সামনে ইয়াব্বড় পেল্লায় একখানা গাড়ি চেপে এসে নামল । দুটো বাচ্চা ছেলে মেয়ে বুড়িকে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলো। পড়ি কি মরি করে বুড়ি ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল সবাইকে। ভুতোর একটু মন খারাপ হয়ে গেল। কয়েকদিন পরে তারা আবার গাড়ি হাঁকিয়ে ফিরে গেল । বাড়িটা আবার শূণ্যপুরি হয়ে রইল। এই কদিন আর ভুতো বুড়িমার কাছে ঘেঁষতে সাহস পায়নি। আজ যেই গাড়িটা চলে গেল তখনি টুক করে ভুতো বুড়িমার কাছে এসে বসে পড়ল । কত গল্প করল বুড়ি। কিন্তু মন খারাপ হয়ে যাবে বলে আসল কথাটাই ভুতোকে বলল না বুড়িমা।
তারপর তাদের সুখের দিন ফুরালো। একদিন অনেক লোকজন ইয়াব্বড় বড় মেশিন নিয়ে এসে হাজির হলো। শোনা গেল ১৫০ বছরের পুরনো বাড়িটা ভেঙে শপিংমল গড়া হবে। বুড়িমার ছেলে আসল বুড়ি মাকে শহরে নিয়ে যেতে। এদিক-সেদিকে বুড়িমা কাকে যেন খুঁজল। ছেলে পিছন ফিরে তাড়া লাগাল মাকে গাড়িতে ওঠার জন্য। কখন যেন ভুতোও তার বাবা-মার সঙ্গে বাড়ির অলিন্দ ছেড়ে চলে গেছে অন্য কোন ডেরার সন্ধানে। এখন এখানে ঝাঁ-চকচকে শপিংমল। কচিকাঁচা বড়দের ভিড়। হুহু করে ছুটে চলেছে গাড়ি ।আলো ঝলমলে এক মায়াবী পৃথিবী।
_______________________________________________________________________________________
স্তুতি সরকার
নিউটাউন, কলকাতা।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন