এক বৃষ্টির সন্ধ্যা
রায়সী চক্রবর্তী
বৃষ্টিটা বেশ জোরেই পড়ছে! বাইরে থেকে একটা হিমেল ঠান্ডা হাওয়া ঘরের ভিতরে আসছে!আমরা চার বন্ধু পড়া শেষ করে বসে আছি। স্যার মিনিট পাঁচেক আগেই পড়িয়ে চলে গেছেন। আমাদের চারবন্ধুর মধ্যে শ্রীপর্ণার বাড়ি একটু দূরে, যদিও তার কাছে ছাতা আছে! তবুও বৃষ্টিটা একটু না ধরলে যেতে পারছে না।আর আছে মানসী ও রিক্তা।মানসীর মা নিতে এলে তবেই মানসী ও রিক্তা যাবে।রিক্তাদের বাড়ি মানসীর বাড়ির কাছেই, যাইহোক! মোটকথা হল এখন সবাই একসাথেই আছি,আর দু-একটা গল্প করছি। মা আজ চপ ভাজছিল। আমরা সবাই আছি দেখে, সবাইকে দুটো করে দিল।আমি চপটাকে কামড়াতে যাব,এমন সময় শ্রীপর্ণা আমাকে বললো,ঋতু তুইতো গল্প-টল্প লিখিস!তবে এই বৃষ্টির দিনে একটা ভূতের গল্প বল দেখি!রিক্তা বলল,না বাবা!আমার ভুতের গল্পে খুব ভয় লাগে। শ্রীপর্ণা বলল ধ্যাত!চুপ করতো রিক্তা!নারে ঋতু তুই ভূতের গল্পই বল!সত্যি কথা বলতে কি, আমিও তখন ভূতের গল্পের কথাই ভাবছিলাম! শ্রীপর্ণা বলতেই আমার মনটা বেশ সায় দিয়ে উঠলো!তাই কিছুক্ষণ ভেবে বলতে শুরু করলাম,৫০ থেকে ৬০ বছর আগেকার কথা এক গ্রামে একটা মধ্যবিত্ত পরিবার ছিল তাদের দোতলা বাড়ি, তিনতলায় একটা চিলেকোঠা ও বাকিটা বড় ছাদ। সেখানে সুরেশবাবু বলে একজন থাকতেন,আর থাকতো তার স্ত্রী জয়ী, তার এক ছেলে রাজেন ও মেয়ে রুপালি। ছেলেটা ফোরে পড়ত, মেয়েটি সেভেনে পড়ত। ছেলেটা ওপরের চিলেকোঠাতে পড়ছিল,ওর দিদিও ওখানে পড়ছিল। বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে,তাই পড়াশোনায় মন বসছে না বললেই চলে! তারই মধ্যে হঠাৎ করে লোডশেডিং!এবার তখনকার দিনেতো কারুর বাড়িতে ইনভার্টার ছিলনা!অগত্যা মোমবাতিই ভরসা! মেয়েটা তাই নীচেতে মোমবাতি খুঁজতে গেল।অগত্যা ভাইটা একাই বসে রইল। চুপচাপ বসে আছে, হঠাৎ সে পাশে থাকা আয়নাটার দিকে তাকালো!যেইনা তাকিয়েছে ওমনি জোর বিদ্যুৎ চমকেছে! গেল যার ফলে ঘরময় আলো হয়ে গেল! আমি যেইনা কথাটা বলেছি, ওমনি আকাশে সত্যিই বিদ্যুৎ চমকে উঠেছে! শ্রীপর্ণা বলল, আরিব্বাস!আর রিক্তাতো ওরে বাবারে!বলে চেঁচিয়ে উঠেছে! যাইহোক আমি আবার গল্প বলা শুরু করলাম,বিদ্যুতের আলোতে ছেলেটা আয়নাতে দেখলো,যে তার পিছনে একটা সাদা রঙের জামা পরা মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। মহিলাটার গাল দিয়ে রক্ত পড়ছে, হাতের শিরা কেটে গেছে,সেখান দিয়ে রক্ত পড়ছে।সে যেন এক বীভৎস চেহারা! আর তার লম্বা দুটো হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ছেলেটার ঘাড়ের কাছে,যেন আরেকটু হলেই তার গলা টিপে ধরবে। সেই দেখে ছেলেটা বেশ ভয় পেয়ে গেছে,আর জোড় চিৎকার করে মাটিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে তারপরে কি হয়েছিল সেটা তার মনে নেই!তার যখন জ্ঞান ফিরল, তখন সে দেখল,যে সে চিলেকোঠার ঘরেরই খাটে সে শুয়ে আছে। আর তার পাশে রয়েছে তার বাবা,মা,দিদি ও পাশের বাড়ির প্রশান্তকাকু। প্রশান্ত কাকু হলেন ডাক্তার, পাশের বাড়িতে থাকেন। রাজনের চিৎকারে ওর বাবা-মা, দিদি ছুটে এসে দেখে, যে রাজেন অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। তারপরেই তার বাবা প্রশান্ত বাবু কে ডাকতে যান। প্রশান্ত বাবু এসে কিছু ওষুধ দিল গায়ে জল ছেটানো হলো তারপর রাজেন এর জ্ঞান ফিরল। জ্ঞান ফিরে সবাই রাজেনকে জিজ্ঞাসা করল যে সে এরকম চিৎকার করেছিলো কেন? রাজেন তার সঙ্গে যা যা হয়েছিল, সবটা খুলে বলল।সবটা শুনে কেউ অবিশ্বাসও করতে পারছে না।কারণ একটু আগেই প্রশান্ত বাবু বলেছেন যে তার ঘাড়ের কাছে একজনের ঘাড় টিপে ধরার মতো হাতের ছাপ আছে! আরেকটু নখের আঁচড়ও আছে। যাইহোক উনি তখন একটা মলম দিয়ে সেখান থেকে চলে গেল। প্রশান্তকে সদর দোর অব্দি ছেড়ে এসে, যখন আবার বাড়িতে ঢুকবে তখন সুরেশবাবু দেখলেন,একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁকে আগে কখনো দেখেছেন বলেতো মনে পড়ছেনা। বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি বলল,আপনার ছেলে এখন ঠিক আছেতো?সুরেশবাবু বলল আপনি কি করে জানলেন? উনি বললেন আপনি যখন প্রশান্তবাবুকে ডাকতে গেছিলেন,তখন আমি একটু আগেই তার চেম্বার থেকে বেরিয়েছিলাম,অন্ধকারে আপনি হয়তো আমাকে খেয়াল করেননি, কিন্তু আমি আপনাদের কথা শুনেছিলাম।তাই জন্যই আমি আপনাকে একটা কথা বলতে এলাম।সুরেশবাবু বললেন কি কথা? উনি বললেন,এই বাড়ির অতীতের ঘটনা। সুরেশবাবু ওনাকে বললেন কিরকম অতীতের ঘটনা? আসুন, ভিতরে এসে বসে বলুন। ভদ্রলোক ভিতরে এসে একটা একানে সোফাতে বসে বললেন, আপনারা হয়তো জানেন না আপনাদের এই বাড়িতে আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগে এক পরিবার ছিল, সেখানে এক মহিলা আত্মহত্যা করেছিল! এই বাড়ির ছাদ থেকে।আগেতে অনেকেই বলতো যে এবাড়ির চিলেকোঠায় তার আত্মাকে ঘুরতে দেখা যায়,আবার তার খিলখিল হাসির শব্দও নাকি শোনা যেত! তবে সে বহু বছর আগেকার কথা, কালেভদ্রে সেই সমস্ত কথা চাপা পড়ে গেছে!আমার মতন দু-একজন বৃদ্ধ লোক ছাড়া কেউই আর এই ঘটনা সম্পর্কে জানে না। হঠাৎ তিনি প্রশ্ন করলেন, যে যদি তাই হয় তাহলে এতদিন মানে বলতে চাইছি যবে থেকে আমি এই বাড়িটা কিনে রয়েছি তবে থেকে আমি ওই মহিলার আত্মাকে দেখলাম না কেন?ওই বৃদ্ধ ভদ্রলোক বললেন, এটা আমি ঠিক জানিনা!তবে আপনার ছেলের সঙ্গে একবার দেখা করা যায় কি? উনি বললেন সুরেশবাবু বললেন, কেন নয়! তারপর সুরেশবাবু ওনাকে নিয়ে দোতলার ঘরেতে গেলেন, রাজেন খাটে শুয়ে ছিল ও তার মা তার পাশেই বসে ছিল। রুপালি তার বাবা ও ওই বৃদ্ধ লোকটার সাথেই ছিল।রাজেনকে দেখে ওই বৃদ্ধ লোক বললেন, এটা তো.........! আমি বিশ্বাস করতে পারছি না! এ কী করে সম্ভব! সুরেশবাবু জিজ্ঞাসা করলেন আপনি কি বলতে চাইছেন? বৃদ্ধ লোকটি বলল, আপনার ছেলের মুখ ওই মহিলার দাদার সাথে মিলে যাচ্ছে, যার জন্য তাকে আত্মহত্যা করতে হয়। ভাই বোনের সম্পত্তি নিয়ে লড়াই চলেছিল । বোন হেরে যায় শেষে ।
উনি আরো বললেন,আমার মনে হয় সেই কারণেই ওই মহিলা আপনাদের ছেলেকে মারতে এসেছিল।এই সমস্ত কথা শুনে সুরেশবাবু কেমন একটা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন বৃদ্ধি লোকটির দিকে , মুখে বললেন আমি যজ্ঞ করবো গৃহ শান্তির , অশুভ শক্তি তাড়াতে। তবে আজ তো হবে না । দু একদিন সময় লাগবে । আর ওই যজ্ঞ তে কোনো অশুভ ছায়া আসবে না বাড়িতে জীবনেও।
কথাটা বলার সাথে সাথেই ঘরে জ্বলা মোমবাতি নিভে গেল! আর ওই বৃদ্ধ লোকটা পরিণত হয়ে গেল ওই মহিলাতে,যে অনেকক্ষণ আগেই রাজেন কে মারার চেষ্টা করেছিল!পুরো ঘটনাটা সবার চোখের সামনে ঘটলো,কারণ মোমবাতি না জ্বললেও চাঁদের আলোতে ঘরের ভিতরে ভালোই দেখা যাচ্ছে। ওই মহিলা আবার রাজেনের গলার দিকে তার হাত বাড়াতে লাগলো, ঠিক তখনই সুরেশবাবু আত্মাকে বাধা দেওয়ার মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগলেন। এই মন্ত্র অনেক আগে তিনি নিজের খেয়াল বশে প্রেত চর্চা করতে গিয়ে শিখেছিলেন গুরুর কাছে । আজ অনেকদিন পর সেটার নতুন করে প্রয়োগ করলেন ।
তিনি ভোলেননি। শুধু চর্চায় ছেদ পড়েছিল ।
তিনি যত মন্ত্রটা উচ্চারণ করতে লাগলেন,ততই আত্মাটা ছটফট করতে লাগলো! আর বলতে লাগলো আমি প্রতিশোধ নেবই, আমাকে কেউ আটকাতে পারবেনা! আমি প্রতিশোধ নেবই, কিন্তু তার প্রতিশোধ নেওয়ার আগেই,সে ছোট হতে লাগলো,আর ক্রমে ক্রমে সে হাওয়ায় মিলিয়ে উধাও হয়ে গেল।ঘটনাটা প্রায় মুহূর্তের মধ্যেই ঘটে গেল। সবশেষে সবাই স্বস্তি পেলো তখন কার মতো
সুরেশ বাবুর স্ত্রী জয়ী বললেন, তুমি কালকেই গৃহশান্তি যজ্ঞ করবে!
এই বলে আমি গল্পটা বলা শেষ করলাম। গল্প শেষে দেখি শ্রীপর্ণা একেবারে থ মেরে গেছিল,আর রিক্তা তো মানসীর হাতটা ভয়ে টিপে ধরেছে। শ্রীপর্ণা বলল বলিহারি গল্প বলেছিস! ভয় খেয়ে গেছি তো! আমি বললাম,তাহলে দেখছিসতো আমি কেমন গল্প বলতে পারি!মানসী বলল, দেখেনিস তুই একদিন রাইটার হবি! এতক্ষণে বাইরে বৃষ্টিটা থেমে এসেছে সুপর্ণা বলল শ্রীপর্ণা বললো তাহলে যাই! আবার মানসীর মাও ততক্ষনে এসে গেছে। মানসীর মা ও আমার মা ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল ,আমার গল্প শুনছিল, আমার গল্প যখন শেষ হলো তখন আমার মা ও মানসীর মা ঘরে ঢুকলো । মা বললো,বেশ ভালো গল্প বলেছিস তো!বৃষ্টির দিনে এরকম ভূতের গল্প বহুদিন পর শুনছি।মানসীর মা বলল, হ্যাঁ ঋত্বিকা খুব ভালো গল্প বলেছ!আমার গল্পের যে এত প্রশংসা হবে সেটা ভেবেই আমার কী আনন্দ হচ্ছে যে কি বলব! কিন্তু যার জন্য এইসব হল সেটা হল এই বৃষ্টির রাত......! বৃষ্টি পড়লে বেশ ভুতের গল্প শুনতে মন হয় ।বলতে মন হয় ।
বৃষ্টির সন্ধ্যা কি রাত যেন তার উপযুক্ত সময় ।
_____________________________________________________________________________________
রায়সী চক্রবর্তী
দশম শ্রেণী
পাল্লারোড গার্লস হাই স্কুল।
[চিত্রঃ: ইন্টারনেট মাধ্যম থেকে সংগৃহীত]
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন