প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় ৪৫ ।।আগস্ট, ২০২৫

ডানপিটে রফিক
রানা জামান
আব্দুল মজিদ বাড়ির পেছনের জঙ্গল থেকে একটি বাঁশির কঞ্চি কেটে ছেটে ছোট ছোট কঞ্চি ফেলে একটি ছিটকি বা বেত বানালেন। বেতটা নাড়াতে নাড়াতে বাড়ি এসে ঘরের বারান্দার সাত বছরের ছেলে রফিককে না দেখে ওঁর রাগ গেলো আরো বেড়ে। স্ত্রী হালিমা বিবি শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছেন বারান্দায়। ছিটকিটা আগের মতো নড়াতে নড়াতে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, কই গেলো পাজিটা?
হালিমা বিবি না জানার ভান করে বললেন, কেডা?
রফিক্যা! তোমাকে না কইছিলাম পাজিটাকে ধইরা রাখতে?
একটু হেসে আঁচলে মুখচাপা দিয়ে হালিমা বিবি বললেন, আমি কি পোলাটার হাত ধইরা রাখবার পারি! এক মুচড়ান দিয়া হাত থাইকা ছুইট্টা চইলা গেলো!
কুনদিকে গেলো পাজিটা?
আমি ক্যামনে কয়াম!
আমি আইজকা ওর পিঠে এই ছিকটিটা ভাংবাম।
আব্দুল মজিদ রাগে গজগজ করতে করতে বের হয়ে এলেন বাড়ির বাইরে। এদিকে ওদিক তাকাচ্ছেন। কোনদিকে যাবেন ছেলেকে খুঁজতে? বাবার দৃষ্টি থেকে নিজেকে লুকিয়ে খেলা ও দুষ্টুমি করার অনেক জায়গা আছে রফিকের।
এবার রফিককে জানা যাক। ওর নাম রফিক হলেও ওর খেলার সাথি এবং গ্রামের ছোট বড় কেউ ওকে রফিক ডাকে না- ডাকে রফিক্যা। ওর বাবাও রেগে গেলে রফিক্যা ডাকে! বাঙলার প্রত্যন্ত গ্রামে এমনটাই হয়ে থাকে। বৃটিশ আমল হতে এমনটা হয়ে আসছে; স্বাধীনতার পরে গ্রাম পর্যায়ে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাবার সাথে সাথে নাম বিকৃত করে ডাকার স্বভাব কমে আসছে। সেসাথে ছেলেমেয়েদের ডাক নামের সাথে একটি চমৎকার আসল নামও রাখা হচ্ছে যা বিদ্যালয়ের রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করা হয়।
আব্দুল মজিদের বাড়ি মধ্যপাড়ায়। এ পাড়ায় পাঁচটি বাড়ি আছে; সকলেই সচ্ছল কৃষক। এই পাড়ার পশ্চিমে একটি কাঁচা হাঁটা রাস্তার পরে একটি পোড়ো বাড়ি আছে। এই বাড়িতে এক সময় ঘর থাকলেও এখন আর কোনো ঘর নেই- পতিত ভিটে পড়ে আছে; পেছনে একটা বড় জঙ্গল আছে। জঙ্গলটা বেশ বড়। এই জঙ্গলে শেয়াল, সাপ বেজি থেকে শুরু অনেক রকমের জন্তু ও পাখি আছে। অনেকেই একা এই জঙ্গলে ঢুকতে ভয় পায়। হঠাৎ তক্ষক ডেকে উঠলে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যেতে চায়!
চারজন খেলার সাথি নিয়ে রফিক এখন এই জঙ্গলের ভেতরে আছে একটি গাবগাছের উপরে। ওর বইগুলো গাবগাছের নিচে রাখা আছে নিতান্ত অবহেলায়। বইখাতা নিয়ে স্কুলে যাবার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়েছিলো রফিক। কিন্তু এই চার বন্ধুকে একসাথে পেয়ে জিজ্ঞেস করলে ওরা বললো পাকা গাব খাওয়ার জন্য ওরা জঙ্গলে যাচ্ছে। তখন রফিক স্কুলে যাওয়া বাদ দিয়ে সাথি হয়ে গেলো ওদের।
গাছটায় বেশ কয়েকটা গাব পেকে কমলা বর্ণ ধারন করেছে। এই পাঁচ বন্ধুর মধ্যে একমাত্র রফিক তরতরিয়ে যে কোনো গাছে উঠতে পারে। একটি পাকা গাব ছিঁড়ে নিচ থেকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকা বন্ধুদের দেখিয়ে রফিক খেতে শুরু করলে ওরা শুরু করে দিলো হৈচৈ। রফিক ওদের হাত নেড়ে অপেক্ষা করতে বলে খেতে থাকলো গাব। গাবের বিচিগুলো বন্ধুদের দিকে থু থু করে ছুঁড়তে থাকলে ওরা এদিক ওদিক সরে নিজেদের রক্ষা করতে লাগলো। উপরের একটি ডালে দুটো গাব পেকে আছে।
রফিক উপরের ডালে উঠে গাব দুটো পেড়ে নিচে ছুঁড়ে দিয়ে বললো, তোরা এই দুইটা ভাগ কইরা খা। আরো পাকনা গাব বিছরাইতাছি। পাইলে দিয়াম নে।
ডালে ডালে পাকা গাব খুঁজতে গিয়ে দুই ডালের সংযোগস্থলে একটি পাখির বাসা দেখতে পেয়ে চোখ দুটো চকচক করে উঠলো অন্য রকম একটা খুশিতে। সে খুব সাবধানে পাখির বাসার কাছে গিয়ে আফোটা চক্ষুর দুটো বাচ্চা দেখে ওর আনন্দ ছাড়িয়ে গেলো সীমা। সে বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললো, পাখির ছাও পাইছি রে! দুইটা।
নিচ থেকে মজনু চিৎকার করে বললো, লইয়া আয়! অনেক মজা করবাম ছাও দুইডারে লইয়া।
তখন একটা কোক্কা (স্থানীয়ভাবে কাউক্কা বলে) পাখি পাশের গাছ থেকে ক্যা ক্যা করে ডাকতে ডাকতে উড়ে এলো এই গাছে। বাসার কাছাকাছি একটা ডালে বসে অনবরত চিৎকার করে যেতে থাকলো।
চিৎকার করে মিণ্টু বললো, কীরে! আনতে পারবি ছাও দুইটা? ঠোকর মারবে না তোরে?
রফিক বললো, একজন উইঠ্যা আয় উফরে। তাইলে পারবাম।
মজনু তরতরিয়ে উঠে গেলো গাছে। ও একটা ডাল ভেঙে হাই হুস বলে ডাল নেড়ে পাখিটাকে তাড়াতে লাগলো। ওদিকে রফিক ছানা দুটোকে আলতে করে তুলে বাম হাতের তালুতে রাখলো। ছানা দুটোকে ওভাবে বাম হাতের তালুতে রেখে ডান দিয়ে গাছ ধরে আস্তে ধীরে নেমে এলো নিচে। ওর পরপরই মজনু নেমে এলো নিচে। সাথে সাথে পাখিটাও ডাকতে ডাকতে নিচে নেমে ওদের থেকে খানিকটা দূরে মাটিতে বসে ডেকে যেতে থাকলো।
একে একে সবাই পাখির ছানা দুটো হাতে নিয়ে দেখতে লাগলো। চোখ না ফুটায় ছানা দুটো তাকাতে না পারলেও দুই চঞ্চু খুলে বিরাট হা করে 'চিহিচি!' করে নিম্ন স্বরে ডেকে যাচ্ছে।
রতন ছানা দুটো হাতে নিয়ে বললো, মনে অয় খিদা লাগছে। তাই কানতাছে।
রফিক বললো, অহন খুদ পায়াম কই?
মিজান বললো, আমার বাড়ি কাছে আছে। আমি খুদ আনতে যাইতাছি।
বিলম্ব না করে মিজান শুরু করলো ছুটতে।
ওদিকে কাউক্কার অনবরত আর্তনাদে ওর জোড়া কাউক্কা কোথা থেকে উড়ে ওর পাশে এসে আর্তনাদ করতে থাকলো। দুটো ছানা রফিকের বাম হাতের তালুতে চিঁহি করে যাচ্ছে। রফিক সহ চার বন্ধু তাকিয়ে আছে ছানা দুটোর দিকে। খুদ নিয়ে ফিরে আসতে মিজানের বিলম্ব হচ্ছে।
রফিক ব্যথিত কণ্ঠে বললো, মিজান্যা খুদ নিয়া আইতে দেরি কতরাছে।
মজনু বললো, আমার মন কইতাছে চাচি ওরে আইতে দিতাছে না।
রফিক ফের বললো, মনে হইতাছে ছাও দুইটার খিদা পাইছে। চল, এইডিরে বাসায় রাইখ্যা আসি।
মিণ্টু বললো, চল, তাই করি।
রফিক একটা ছানা মিণ্টুর হাতে দিয়ে বললো, রতন আগে উইট্ঠা গাছে থাকবি। মজনু আর আমি উঠবাম ছাও নিয়া গাছে। ছাও দুইটারে বাসায় রাখনের সময় কাউক্কা দুইটা ঠোকর দিতে আইলে রতন ডাল দিয়া ওদের ভাগাইতে থাকবো।
রতন গাছে উঠে একটা ডাল ভেঙে ছোট ছোট ডাল ও পাতা ফেলে লাঠি বানিয়ে বসে থাকলো একটা মোটা ডালে। রফিক ও মজনু ছানা নিয়ে উঠে এলো গাছে। সাথে সাথে ডাকতে ডাকতে দুটো কোক্কাও উড়ে পাশাপাশি একটি ডালে বসে ওদের দিকে তাকিয়ে তারস্বরে চিৎকার দিতে থাকলো। রতন ডাল নেড়ে পাখি দুটোকে ভাগাতে থাকলো এবং রফিক ও মজনু ছানা দুটোকে বাসায় রেখে দ্রুত সরে এলো দূরে। মা ও বাবা পাখি দুটো বাসায় এসে ছানা দুটোর হা করা মুখে নিজ মুখ থেকে খাবার বের করে খাওয়াতে আরম্ভ করলো।
চার বন্ধু গাবগাছ থেকে নিচে নেমে হাঁপাতে লাগলো। কোক্কা পাখি দুটোর আর্তনাদ নেই; দুই ছানার খাবারের জন্য চিঁহি চিৎকার নেই। চারিদিকে শান্ত, শুকনো পাতা পতনের শব্দও শোনা যাচ্ছে না।
রতন বললো, অহন কী করবাম?
মজনু রফিকের দিকে তাকিয়ে বললো, তুই ইস্কুলে যাইবি না রে রফিক্যা?
রফিক মাটি থেকে বই-খাতা তুলে বললো, অহন ইস্কুলে গেলে পণ্ডিত মশাই পিটনা দিবো!
মণ্টু বললো, তাইলে চল কাশেম চাচার পুস্করিণীতে সাতরাইতে যাই।
মজনু বললো, আইজ দেখবাম কেডা আগে লম্বালম্বিভাবে পার হইতে পারে।
পাঁচ ডানপিটে বন্ধু ছুটতে শুরু করলো। জঙ্গল পার হয়ে এক বাড়ি পরেই কাশেম ভূইয়ার বাড়ি। বাড়ির সামনে বিরাট পুকুর। এই পাড়াতে একটিই পুকুর। পাড়ার সবাই এই পুকুরে গোসল ও কাপড় কাঁচতে আসে। বেশ বড় একটি ঘাট আছে পুকুরে। কোনো সান-বাঁধানো ঘাট নয় সেটা- তাল, আম ও আরো বিভিন্ন ধরনের গাছের গুঁড়ি ও মোটা ডাল দিয়ে ঘাটটি বাঁধা হয়েছে। ঘাটের পাশের লিচুগাছের গোড়ায় বই-খাতা রেখে ওরা পুকুরের লম্বালম্বি দিকের এক পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালো। এক দুই তিন বলার সাথে সাথে পাঁচ জন পানিতে ঝাঁপ দিয়ে চলে গেলো নিচে। দম আটকে রেখে যতক্ষণ পারা যায় পানির নিচে সাঁতার কাটতে কাটতে একসময় এক স্থানে ভুস ভুস করে একে একে পাঁচ জন ভেসে উঠে কাটতে থাকলো সাঁতার। তখন সেই কঞ্চির বেতটা হাতে নিয়ে আব্দুল মজিদ এসে দাঁড়ালেন পুকুরের উল্টোদিকের পাড়ে, যেখানে ওদের সাঁতার প্রতিযোগীতা শেষ হবে।
রফিক এগিয়ে আছে সাঁতারে। ও বাবাকে দেখতে পেয়েও প্রতিযোগীতা থেকে সরে গেলো না বাবার হাত থেকে পালিয়ে যাবার জন্য। সবার আগে রফিক পাড় স্পর্শ করে হাঁপাতে লাগলো ভীষণ।
আব্দুল মজিদ জোরে কয়েকবার হাততালি দিয়ে বেতটা ছুঁড়ে ফেলে ছেলের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, আমার হাতটা ধইরা উফরে আয় বাপ।
বাবার হাত ধরে রফিক পাড়ে উঠে এলে আব্দুল মজিদ ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। সাথে সাথে ওঁর দুই চোখের কূল ছাপিয়ে বের হতে থাকলো অশ্রু। ধরা গলায় আব্দুল মজিদ বললেন, তুই আইজ ইস্কুলে যাস নাই ক্যান?
রফিক বাবার কাঁধে মাথা রেখে বললো, পড়া না পারলে পণ্ডিত মশাই মারে বাবা! খুব মারে!
______________________________________________________________________________________________
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন