আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস পালনের প্রাসঙ্গিকতা ও গুরুত্ব
পৃথিবী জীবজগৎ গাছপালা পশু পাখি পরিবেশ সবকিছু মিলেমিশেই গড়ে উঠেছে জীব বৈচিত্র্য। বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করতে গেলে অবশ্যই জীব বৈচিত্রের সমানুপাতিক গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীটা যেমন সমস্ত জীবকুলের তেমনিভাবে তার বৈচিত্র্য বিপুলা বিস্তৃত সৌন্দর্য দৃশ্যমানতা একে অপরের সঙ্গে অবিচ্ছদ্ধ ভাবে জড়িত আছে। শুধুমাত্র মানুষদের দখলেই নয় এই পৃথিবী সমস্ত জীবকুলেরও একই অধিকার এই পৃথিবীর ওপর। পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা করতে সর্বোপরি বাস্তুতন্ত্র কে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে অবশ্যই জীব বৈচিত্র্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে। প্রাকৃতিক পরিবেশে উদ্ভিদ, প্রাণী ও আণুবীক্ষণিক জীব সমূহের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে যে বাস্তুতন্ত্র গড়ে ওঠে, সেই বাস্তুতন্ত্রে অগনিত নানা ধরনের জীব প্রজাতির সমাহার বা সমাবেশকে জীববৈচিত্র্য বলে।
১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে W. G. Rosen স্কিসােমিয়ান ইনস্টিটিউটের ন্যাশনাল ফোরামে সর্বপ্রথম জীববৈচিত্র্য তথা 'Biodiversity শব্দটি ব্যবহার করেন। পরবর্তীকালে IUCN ও UNEP "Biodeversity" শব্দটি গ্রহণ করে জীববৈচিত্র্যের যে সংজ্ঞা প্রদান করে তা হল—কোনাে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের সমস্ত জিন, প্রজাতি ও বাস্তুতন্ত্রের বৈচিত্র্য ও সমগ্রতাকে জীববৈচিত্র্য বা Biodiversity বলে।
পৃথিবীর জীবমণ্ডলে প্রায় ২.২ কোটি প্রকার জীবের বাস। এর মধ্যে এখনও পর্যন্ত প্রায় ১৬ লক্ষ ৫ হাজার জীব প্রজাতিকে শনাক্ত করা হয়েছে। উদ্ভিদ, প্রাণী ও জীবাণুর প্রত্যেক প্রজাতির মধ্যে যেমন স্বাতন্ত্র্যতা দেখা যায়, তেমনি একই প্রজাতির বিভিন্ন সদস্যদের মধ্যেও গঠনগত বিভিন্নতা দেখা যায়। জীবমণ্ডলের সমগ্র জীবদের মধ্যে এই বিভিন্নতাই হল জীববৈচিত্র্য।আমরা বলতে পারি যে জীববৈচিত্র্য হল প্রাণের রূপ এবং একে অপরের সাথে এবং বাকি পরিবেশের সাথে তাদের মিথস্ক্রিয়াগুলির সংমিশ্রণ যা পৃথিবীকে মানুষের জন্য একটি অনন্য বাসযোগ্য স্থান করে তুলেছে। নিঃসন্দেহে জীববৈচিত্র্য আমাদের জীবনকে টিকিয়ে রাখে এমন বিপুল সংখ্যক পণ্য ও পরিষেবা প্রদান করে।
প্রকৃতি এবং মানুষের জীবনের মধ্যে একটি অবিচ্ছেদ্য সংযোগ রয়েছে। আমরা আমাদের খাদ্য এবং স্বাস্থ্যের জন্য স্বাস্থ্যকর, বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। তাই জীববৈচিত্র্যের বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে ২২মে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস (International Biodiversity Day) হিসেবে পালন করা হয়েছে।
বিশ্ব জীববৈচিত্র্য দিবসের ধারণটির সূচনা হয় ১৯৯২ সালে। রাষ্ট্র, সরকার ও পৃথিবীর বড় বড় সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে ব্রাজিলের রিও তে শীর্ষ ধরিত্রী সম্মেলনে জীববৈচিত্র্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। মূলত ১৯৯২ সালের ২২ মে কেনিয়ার নাইরোবিতে অনুষ্ঠিত জীববৈচিত্র্য বিষয়ক কনভেনশনে দিনটিকে আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।আর তখন থেকেই প্রতি বছর মে মাসের ২২ তারিখ বিশ্ব জীববৈচিত্র্য দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়।
বিশেষত বিশ শতকের ৭০-এর দশক থেকে খাদ্য-বস্ত্রসহ মানুষের নানান ধারার চাহিদার পরিসর বিস্তৃত হওয়ার কারণে লাখ লাখ প্রজাতি বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকির মুখে পড়েছে। ১৫ হাজার তথ্য সূত্র নিয়ে ৩ বছরের গবেষণা শেষে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে 'সামারি ফর দ্য পলিসিমেকার' শিরোনামে প্রকাশিত হয় জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদনের সারমর্ম। ৪০ পৃষ্ঠার সেই সংক্ষেপ হাজির করতে গিয়ে বলা হয়েছে, মানবজাতি কীভাবে নিজেদের 'একমাত্র বাড়ি'-কে ধ্বংস করছে; এটাই তার সবচেয়ে শক্তিশালী দলিল।
প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, স্থল, জল কিংবা আকাশ; সবখানেই মানুষের কারণে বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে বিভিন্ন প্রজাতি। জাতিসংঘের ইন্টার গভর্নমেন্টাল সায়েন্স পলিসি প্ল্যাটফর্ম অন বায়োডাইভারসিটি অ্যান্ড ইকোসিস্টেম সার্ভিসের ১৮০০ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদনে বিশ্বের ১০ লাখ প্রাণী বিলুপ্তির হুমকির মুখে রয়েছে বলে জানিয়েছে। সেখানে বলা হয়, প্রাণী জগতের ২৫ ভাগ প্রজাতিই মানুষের কারণে বিপন্নতার মধ্যে রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, নিজেদের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে প্রাণী জগতের ১০ লাখ প্রজাতিকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে মানুষ। জীব বৈচিত্র্য সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সচেতন করতেই জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি ২২ মে দিনটি বিশ্ব জীববৈচিত্র্য দিবস (International Biodiversity Day) হিসেবে উদযাপন করে আসছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৯৩ সালের শেষ দিকে ২৯ ডিসেম্বর বিশ্ব জীব বৈচিত্র্য দিবস হিসেবে পালন করা হলেও ২০০১ সাল থেকে এটি প্রতিবছর ২২ মে পালন করা হচ্ছে। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সুস্থ ও টেকসই পরিবশে রক্ষার লক্ষ্যেই এ ধরনের একটি দিবস পালন করা জরুরি হয়ে পড়ে।
বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে ধারণা ও সচেতনতা বৃদ্ধি এবং এ ব্যাপারে করণীয় নির্ধারণে দিবসটি গুরুত্বপূর্ণ। জীববৈচিত্র্য রক্ষার সমাধান প্রকৃতিতেই। আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীর সৌন্দর্যের প্রধান অনুসঙ্গই হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। জীববৈচিত্র্যই পৃথিবীর সবুজ জীবের উপযোগিতা বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে জীববৈচিত্র্য চরমভাবে হুমকিতে পড়ে পৃথিবীর বৈচিত্র্যময়তাকেই ধ্বংস করছে। শিল্পের বহুমুখি বিকাশের সাথে সাথে বিভিন্ন দেশে যে হারে জল, বায়ু, মাটি, সবুজ এবং প্রকৃতির অমূল্য সম্পদ সমূহের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে, তা পরিবেশ দূষণের বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্বময়। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশের অবস্থা খুবই করুণ।
জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আমাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। জীববৈচিত্র্য আমাদের অস্তিত্বের সুরক্ষা। এটি অরক্ষিত করে আমরা সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে টিকে থাকতে পারি না। এজন্য আমাদের ঐতিহ্যকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। এটা মনে রাখতে হবে যে, এই মাটি, ভূমি, বাতাস, পানি সবকিছুরই অংশীদার শুধু মানুষই নয় অপরাপর সব প্রাণি ও প্রজাতি। আন্তর্জাতিক জীব বৈচিত্র্য দিবসে আমরা পরিবেশ সম্পর্কে আরও বেশি সচেতন হই বাস্তুতন্ত্র ও ভারসাম্য রক্ষার্থে প্রাণিকুল ও উদ্ভিদজগতের সমন্বয়ে গঠিত জীববৈচিত্র্যকে সংরক্ষণ করে বাঁচিয়ে রাখি আমাদের জীবন ধারণের জন্য।
======================
পাভেল আমান- হরিহরপাড়া -মুর্শিদাবাদ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন