প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় ৪১ ।। এপ্রিল ২০২৫

ছোট দুই চড়ুই ছানা
আরজু মুন জারিন
ছোট দুই চড়ুই ছানা । চোখ এখনো ফোটে নি ভালো করে। তাও মনে হচ্ছে চেয়ে আছে পিটপিট করে ওর দিকে। চৈতীর তাই মনে হচ্ছে। এই জোড়া চড়ুই পাখিদের আনন্দের সাথে লক্ষ্য করা তার এক প্রাত্যহিক কাজের অংশ হয়ে উঠেছে। বুঝতে পারছেনা কয়দিন হয়ে গেল চোখ ফুটছেনা কেন? এই ছানা দুইটার মা কোথায়। মা চড়ুই কে এখন ও দেখেনি ও। সাবধানে পাখির বাসাটি কার্ণিশ থেকে নামিয়ে আনলো। আস্তে হাতের তালুতে বসিয়ে কিছু শস্যদানা সামনে রাখলো। টুকটুক করে খেতে শুরু করলো। ছোট বাটিতে পানি এনে সামনে রাখলো। চুক চুক করে জল খেতে লাগলো বাচ্চা চড়ুই দুটো।
ছোট চঞ্চল হোমওয়ার্ক নিয়ে বসেছে।ওর বয়স মাত্র পাঁচ বছর। সবে প্লে গ্রাউন্ড থেকে কিন্ডারগার্টেন এ উঠেছে। সে সিনিয়ার হয়ে গিয়েছে। হাবভাব ই অন্যরকম ওর। ছোট বোন অন্জলী এখন ও প্লে গ্রাউন্ড । চার বছর। এই ছোটকে শাসন করে দেয় ও মাঝ মাঝে গাল খিমচে আর চুল টেনে। আসলে শাসনের চেয়ে হিংসায়। অন্জলীকে মামনি সব আদর আর চকলেট দিয়ে দেয়।
অনেকক্ষন ধরে মামনি অংক হিসাব শেখানোর চেষ্টা করছিল চঞ্চলকে। ১+১=১১ চঞ্চল প্রতিবার ১১ লিখে। যোগ একের পরে এক চঞ্চলের মাথায় আসছিলনা। চৈতীকে পাখির বাসা সহ ঘরে ঢুকতে দেখে আনন্দে উত্তেজনায় লাফাতে লাগলো ও। একটা পাখি আরেকটা পাখি দুইটা পাখি। মাম্মি দুইটা পাখি চাই আমার।
হু হু চৈতী বলে মজা করে আগে তোমার ম্যাথ কর প্রোপারলী বাবা। ১+১ =১১। মাম্মীটা বোকা ।কিছু পারেনা। ১ +১ =১১ না দুইটা পাখি মাম্মী। হাত তালি দিয়ে বলতে থাকে। আস্তে আস্তে যোগ অংকের ব্যাবহার কল্পনা করে ছোট চঞ্চল ছোট চড়ুই পাখির হিসেব মিলিয়ে ঠিক ঠিক বলে দেয়।
চু চু চি চি করে ডেকে যাচ্ছে ও চড়ি। ঠোট দিয়ে খোঁচা দিয়ে মড়িকে ঘুম থেকে উঠানোর চেষ্টা করছে। ওদের মা একবার ই শুধু এই নামে ডেকেছিল। ওদের চড়ুইদের চোখ ফোটার আগে কান সজাগ তীক্ষ হয়ে যায়। মা ওদের জিহবায় একটু খাওয়ার ঢুকিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নিয়েছিল আর ফিরে আসেনি। ছোট মড়ি মায়ের অভাবে মূমূর্ষ হয়ে পড়েছে। চড়ির সাথে বয়সের পার্থক্য মাত্র পাঁচ মিনিটের। তাই সে বড় বয়োজেষ্ট এর মত দায়িত্ব অনুভব করে। মড়ির শরীর কাঁপুনী থামাতে নিজের পাখার আড়ালে লুকিয়ে রাখলো সহদরাকে। মড়ি ও একসময়ে উঠে তাকিয়ে থাকলো সহদরের দিকে পিটপিট চোখে। ছোট চড়ুই দুটো চড়ি মড়ি একে অপরকে আগলে রাখার চেষ্টা করছে ছোট পাখা দিয়ে। ছোট চঞ্চল হামা দিয়ে এই দৃশ্য অবলোকন করছে চড়ুই এর খাঁচার সামনে বসে। মা চৈতী বারবার ডাকছে রেডী হতে স্কুলে যাওয়ার জন্য। কয়েকটা চাল এনে ছড়িয়ে দিল চড়ুই পাখির খাঁচায়।
বেশী খাবার দিবেননা বাবা পাখির পেট খারাপ করবো। কাজের মেয়ে এসে সাবধান করে দেয়। নাস্তা খেতে সামনে চড়ুই পাখির খাঁচা চাই। মূহূর্তের জন্য চোখের আড়াল করেনা চঞ্চল চড়ুই পাখির খাঁচাটি। বিছানার পাশের ছোট টেবিলে মা এনে রেখে দিল খাঁচাটি ।আগের দুইদিন শনি রবি বার ছিল। বাসায় ছিল চঞ্চলের অসুবিধা হয়নি। মা বারবার জোর করে উঠিয়ে এনেছেন চঞ্চলকে খাঁচার পাশ থেকে। আজ স্কুলের জন্য রেডী হতে হতে উদাস হয়ে যাচ্ছে বারবার। স্কুলে তো সাথে করে নিয়ে যাওয়া যাবেনা। স্কুলে যাওয়ার ঠিক আগের মূহূর্তে পেট চেপে বসে পড়লো বিছানায়। মা ব্যাস্ত গায়নোকলজিষ্ট। খুব সকালে অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকায় বের হয়ে গিয়েছেন ঘর থেকে। বাবা আছেন ট্যূরে। চঞ্চল থাকে কেয়ারটেকারের তত্বাবধানে। উনি গাড়ীতে বসিয়ে দিয়ে আসেন স্কুলের জন্য। আজ পেট ব্যাথা বলায় চঞ্চল বাবাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে চলে আসতে যাচ্ছিলেন তখন কেয়ারটেকার কাছে স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলো আবার। চড়ুই পাখির খাঁচা সাথে নিয়ে নিল। চাচা এ বন্ধুদের দেখাবো। এ আজ আমার সাথে নিতে পারি? প্রথমে অসম্মতি দিতে গিয়ে পরে সম্মতি দিয়ে দিল সানন্দে। পাশের এক ঘরে তার এক বন্ধু দলের আড্ডা হবে। কার্ড পাশা খেলা হবে আর খানা পিনার আয়োজন ও হবে। চড়ুই পাখি আর চঞ্চল ঘরে থাকলে তাকে ও ঘরে থাকতে হবে। তাই খুশী হয়ে প্রস্তাবটি লুফে নিলো সে। তাছাড়া কর্তা কর্ত্রী দুজনে যখন ঘরে নাই। অবশেষে চঞ্চল আজ চড়ুই পাখির ছানা দুটি সহ স্কুলে এলো।
চিউ ছোট মড়ির ঠোটে মা ডাক শুনতে পেল আজ চড়ি ভাই। বোনকে পাখায় ঢাকতে দেখতে পেল অনেক বড় বড় ছায়া তাদের ঘরের চারপাশে। একজন হাত ঢুকিয়ে মড়িকে স্পর্শ করতে দেখে ভয়ে চড়ি ঠোকর দিয়ে বসলো ছেলেটির আঙ্গুলে। ছেলেটি ভয়ে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে প্রিন্সিপ্যালের রুমের দিকে ছুটলো। প্রিন্সিপ্যাল ছুটে এলেন ক্লাসে। চঞ্চলের হাত থেকে পাখির খাঁচা নিয়ে নিলেন। চঞ্চল হাউমাউ করে কান্না জুড়ে নিলো। অগত্যা চঞ্চলকে প্রিন্সিপ্যালের রুমে বসিয়ে রাখা হল। ফোন করা হলো মা বাবাকে। বাবা ট্যূরে। মা চৈতী সকল জরুরী কাজ ফেলে হন্তদন্ত হয়ে পৌছলেন স্কুলে। প্রিন্সিপ্যালের রুমে ছেলেকে চড়ুই খাঁচার সামনে বসে কাঁদতে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন। ওনার মাথায় এখন ও শেষ রোগীটির কমপ্লিকেশান নিয়ে দুঃশ্চিন্তা চলছিল।
ব্যাপার কি বাবা এসব কি? জায়েদ কোথায়? তুমি পাখি স্কুলে নিয়ে এসেছো কেন? ওরা তো ভয় পাচ্ছে বাবা মানুষের শোরগোলে মা এই বলে সান্তনা দিচ্ছেন ছেলেকে।
প্রিন্সিপ্যাল স্যার ও হাসলেন এবার বিরক্তি ভুলে। চঞ্চল ক্লাসে যেতে চাচ্ছেনা দেখে আপনাকে ফোন করতে বাধ্য হলাম। আচ্ছা বাবা যাও ক্লাস রুম থেকে তোমার ব্যাগ নিয়ে আসো চঞ্চলের দিকে ফিরে মা বলেন এবার। প্রিন্সিপ্যালকে বলে ওর ছুটি নিয়ে নিলো। আমার বার্ড আবার ও ডুকরে উঠলো ভয়ে। ওর মনে হচ্ছিল স্যার ওর বার্ড রেখে রেখে না দেয়। মায়ের দিকে করুন চোখে তাকিয়ে রইলো। মা ওর অবস্থা বুঝে পাখির খাঁচাটা হাতে নিয়ে নিলেন আর চঞ্চল এর হাত ধরে বেরিয়ে এলেন প্রিন্সিপ্যালের রুম থেকে। ড্রাইভারকে পাঠিয়ে চঞ্চলের ব্যাকপ্যাক আনিয়ে নিলেন ক্লাস রুম থেকে। চঞ্চল এখন ফুঁফিয়ে চলেছে মায়ের কোলে মুখে লুকিয়ে। কিছুটা মায়ের বকুনীর ভয়ে কিছুটা পাখী হারানোর দুঃশ্চিন্তায়। বাবা তুমি এ ঠিক করনি বুঝতে পেরেছো মা মৃদু বকুনী প্রশ্রয় দুই স্বরে বললেন তিনি। আর হবেনা মামনি আমার বার্ডকে হাতে দাও আবদারের স্বরে বলে মাকে। এখন না। বাসায় গিয়ে স্নান, খাওয়া দাওয়া বিশ্রাম সেরে বিকালে খেলবে পাখির সাথে।
ছোট মরি নেতিয়ে পড়ছে একটু একটু করে। এখন আর খাওয়ার নিচ্ছেনা মুখে। চড়ি চেষ্টা করে যাচ্ছে ওর ঠোট দিয়ে বোন এর গলা ভেজাতে।
মাম্মি আর্তচিৎকার দিয়ে উঠলো চঞ্চল চড়ুইটির অবস্থায়। বারবার খাঁচার সামনে ছোট ভাতের টুকরা দেওয়ার চেষ্টা করে ই যাচ্ছে পাখিটি নিচ্ছেনা। চঞ্চলের চিৎকার বিলাপের পর্যায়ে পৌছেছে। ওর বাবা ফোন করেছে সেই সময় ট্যূর থেকে। সব শুনে উত্তেজিত হয়ে চেচামেচি শুরু করেছেন তিনি। এখন ই পাখি কোন ও ফেরিওয়ালা বা বনে দিয়ে আস। চঞ্চলের কান্না আর ও সপ্তমে উঠে গেলো তাতে। পাখির খাঁচাটির স্থান হল অবশেষে আবার ব্যালকনিতে পূর্বের মত। এতে কি যাদু হল মা ছেলে বলতে পারেনা পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে চঞ্চল মূমূর্ষ পাখিটি আজ বেশ আনন্দে কিচির মিচির করতে করতে খাঁচার চতুর্পাশ্বে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজ মড়ি বেশ আনন্দে ভাই এর সাথে খেলছে। ভাই এর গায়ে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে। চড়ি যেমন বোন এর আনন্দ উপভোগ করছে তেমনি খাঁচার বাহিরে চঞ্চল. মা আর কেয়ারটেকার চাচা উপভোগ করছে।
দেখছেন আব্বা বাহিরের আলো বাতাস পেয়ে কেমন চাঙ্গা হয়ে গেছে পাখিগুলান। এখানে রাখেন। ঘরে নিয়েন না আর। তাহলে স্যার রাগ করবো না। ওদের সঙ্গে আর ও একজন উপভোগ করছে এই পাখির বাচ্চাগুলোর ছোটাছোটি। সম্ভবত মা চড়ুই। তার মুখে পাখায় কিছু শস্যদানা দেখা যাচ্ছে। সন্তানের রসদ জোগাড় করতে ও উধাও হয়েছিল। মা চড়ুইকে দেখে খাঁচার ছোট বাচ্চার আনন্দ আর ধরেনা। কিচির মিচির করতে করতে খাঁচা ঝাকাতে শুরু করেছে ওরা। মা টি অনুনয়ের চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে উম উম বলে গলা দিয়ে স্বর তুলছে। যেন বলছে এ আমার বাচ্চাগুলোকে মুক্ত করে দাও দয়া করে। মা আর চঞ্চল দুজন ই পাখিটির কথা যেন শুনতে পেল স্পষ্ট।
চঞ্চল বাবা বাচ্চাদের ছেড়ে দিতে হবে খাঁচা থেকে। দেখেছো ওদের মা এসেছে নিতে । হু মা মাথা নাড়লো এবার চঞ্চল। ফোঁফাতে ফোঁফাতে খাঁচার দরজা খুলে দিল এবার। দরজা খোলা পেয়ে বাচ্চা দুইটো ফুড়ুৎ করে বের হয়ে মা চড়ুই এর দুই কাঁধে দুজন বসলো গিয়ে। মা চড়ুই একবার ডানদিকে ফিরে এক বাচ্চার মুখে খাওয়ার তুলে দেয় আবার বামদিকে ফিরে আরেক বাচ্চার মুখে খাওয়ার তুলে দিচ্ছে।
তারপরে উড়ে গেল একটু পরে। এখন চঞ্চলের কান্না থেমে গিয়ে মন ভরে গিয়েছে আনন্দে মা আর বাচ্চাদের মিলনের আনন্দের মূহূর্ত স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে।
___________________________________________________________________________________________আরজু মুন জারিন
৪০ টিসডেল প্লেস
ইউনিট ১৯০৩, স্কারবোরো
অন্টারিও, এম১এল১এল৩, টরন্টো
কানাডা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন