ওঠো পিকু স্কুলে যেতে হবে তো , বলে রমলা তাড়া দেন । কিন্তু কোনো লাভ হয় না । পিকু অনড় ভাবে শুয়ে থাকে। মনে মনে বিরক্ত হলেও আদুরে গলায় আবারো ডাকলেন ছেলেকে । এবারে নড়েচড়ে পাশ ফিরে শুতে শুতে পিকু বলে মা প্লিজ আজ যাব না স্কুল।রমলা এবার গলা চড়িয়ে বলে তাড়াতাড়ি ওঠো আজ যেতেই হবে , অনেক আ্যবসেন্ট করেছো । যাকে নিয়ে এতো কান্ড সেও কি কম যায় ! আজ আমার খুব শীত লাগছে মা, মনে হয় জ্বর আসছে। তাহলে তো সাত খুন মাফ -- শুয়েই থাকো , বলে দুদ্দাড় করে বেরিয়ে যান ।
কিছু দিন আগেই পিকু টাইফয়েড থেকে সেরে উঠেছে। শরীর দুর্বল তাই বেশি বকাঝকা করাও যায় না । এমনিতেই পিকু ঘরকুনো আর অসুখে ভুগে বিছানা আঁকড়েই থাকে। এমনকি খেলাধুলাতেও এনার্জি নেই । এদিকে স্কুলের অ্যানুয়াল পরীক্ষার সময়ও এগিয়ে এ আসছে।"পারা যাচ্ছে না আর এই ছেলেকে নিয়ে' '--- বলতে বলতে শ্বশুরের ঘরে ঢুকলেন রমলা এক কাপ চা নিয়ে।
"সবুর করো বৌমা , অধৈর্য হলে চলবে না । বুঝিয়ে সুঝিয়ে করাতে হবে ।' বলেন সুজয়বাবু, পিকুর দাদু। তাছাড়া সবে তো ক্লাস ফাইভে পড়ে সময় হলে ঠিকই লেখাপড়ায় মন দেবে ।
সবই তো ঠিক বাবা, কিন্তু দেখুন কেমন আলসে হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। কোন কিছু তে উৎসাহ নেই --- রমলা বলে চলে , খাওয়া দাওয়া তেও অনিহা।কি যে করি এ ছেলেকে নিয়ে!
তুমি নিজের কাজে যাও বৌমা আমি দেখছি দাদুভাইকে । একটু পরে সুজয়বাবু পিকুর ঘরে এসে ডাকেন , ও দাদুভাই জেগে আছো নাকি? তারপর নিজের মনেই বলেন , ভাবলাম তোমায় গল্প বলবো তা তুমি তো ঘুমোচ্ছ ।এই কথা শুনেই তড়াক করে উঠে দাদুর গলা জড়িয়ে ধরে পিকু । আদুরে গলায় বলে, " গল্প না বলে চলে যাচ্ছো যে '।
না না যাচ্ছি না , গল্প বলবো তবে আগে উঠে ব্রাশ করে ব্রেক ফাস্ট করো । দাদুর কথায় পিকু উঠে পড়ে আর আবদার করে স্কুল না যাবার ব্যাপারটা মাকে বুঝাতে।
দাদু - নাতি ব্রেকফাস্ট সেরে ব্যালকনিতে এসে বসে। দাদু বলেন , " দাদুভাই , প্রত্যেকের বেঁচে থাকার জন্য কিছু না কিছু কাজ করতে হয় '।
"কেন দাদু?" :পিকু বলে
"এটাই পৃথিবীর নিয়ম ; তুমি আমি কেউই এর বাইরে যেতে পারি না '। এমনকি পশুপাখি রাও এর ব্যাতিক্রম নয় '।
তোমাকে একটা গল্প বলছি ,---- এক গ্ৰামে একজন কুমোর থাকতো । ঐ গ্ৰামের বেশিরভাগ লোক চাষাবাদ করতো , দু একজন কামার, তাঁতি থাকলেও কুমোর ঐ একজনই ছিল আর তার হাতের কাজের জুড়ি ছিল না। । মাটি দিয়ে বিভিন্ন জিনিসপত্র বানায় যে সেই কুমোর ।
গ্ৰামের মানুষ অনেক সময় মাটির বাসন ব্যবহার করে। ঐ কুমোর লোকটি ছিল খুব অলস প্রকৃতির , সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমাতো। এদিকে গ্ৰামে আর কোনো কুমোর না থাকায় অসুবিধা হতো মানুষের ।আর ঐ কুমোর কাজ না করায় ওর পরিবারের টাকাপয়সার অভাব ছিল, ঠিক মতো খাওয়াও জুটতো না ।ওর বৌ অনেক বুঝিয়েও কোনো লাভ হয়নি।
ওর বৌ একদিন গ্ৰামের মোড়লের সাথে যুক্তি করে একটা উপায় বের করলো। সেই মতো বৌটি স্বামী ঘুম থেকে উঠলে বললো , " দেখ বটতলার কালিমন্দিরে এক সাধু বাবা এসেছে যাকে যা বলছে সব ফলে যাচ্ছে । আমি তাই গেছিলাম। উনি বলেছেন তুমি খুব তাড়াতাড়ি অনেক ধনসম্পদ পাবে কিন্তু তার জন্য তোমাকে কিছু উপহার দিতে হবে সাধুজি কে ।'
অবাক হয়ে কুমোর বলে আমাদের তো কিছুই নেই কি উপহার দেব?
বৌটি উত্তর দেয় , " মাটির বাসনপত্র বানিয়ে উপহার দাও সাধুবাবাকে । ওনার কাজেও লাগবে।'
কিন্তু বৌ আমার তো কাঁচামাল লাগবে মাটির জিনিস বানানোর জন্য । আমাদের তো টাকা নেই কি করে কাঁচামাল কিনব?
স্বামীর এই প্রশ্ন শুনে বৌটি কুমোরকে কাঁচামাল কেনার জন্য মোড়লমশায়ের কাছে টাকা ধার করতে বলে ।
কুমোর উপায়ান্তর না পেয়ে মোড়লের বাড়ি গেল টাকা চাইতে । এদিকে মোড়ল মশাই তো এটার অপেক্ষাতেই ছিল। তিনি বললেন , "তুই যা কুঁড়ে ! কোনো কাজকর্ম তো করিস না , টাকা দিলে শোধ করবি কি ভাবে ? তোর এই অলসতার জন্য ভিনগায়ে গিয়ে মানুষ মাটির জিনিসপত্র কিনে আনতে বাধ্য হয় । কতো হয়রানি হয় বল তো ।'
"তা শোন বাপু আমি তোকে টাকা দেব তবে আমার একটা শর্ত আছে । যদি রাজি থাকিস তো বল ।'
মোড়লের এহেন প্রস্তাবে কুমোর বলে ,"হ্যা কর্তা আমি রাজি , বলুন কি শর্ত ?'
মোড়লমশায় গম্ভীর ভাবে বললেন ," তোর বানানো মাটির জিনিসপত্র নিয়ে সপ্তাহে একদিন করে আমাদের গ্রামের হাটে বিক্রি করতে হবে যাতে লোকে ইচ্ছে মত কিনতে পারে।'
আচ্ছা কর্তাবাবু , "আপনি যা বলছেন তাই হবে।'
এই বলে মোড়লের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে ।
বাড়ি ফিরলে বৌ কি হলো জানতে চাইলে সবকিছু বলে । আর বৌ কে কাঁচামাল এনে দিতে বলে । বৌটি সব ব্যবস্থা করে দিলে কুমোর কাজ শুরু করে দেয় ।
প্রথম দিন দশটা কলসি বানায় । এদিকে অনেক দিন পরে কুমোর কে চাকা ঘুরাতে দেখে গ্ৰামের লোকেরা খুব খুশি হল ও যা বানানো হয়েছিল সব কিনে নিল ।কুমোর বৌ এর তো খুবই আনন্দ হল দুটো পয়সা হাতে আসায় । কুমোরের মনে কিন্তু আনন্দ নেই সব বিক্রি হয়ে যাওয়াতে। আসলে সে তো মনে করেছিল যে কলসিগুলো সে বানিয়েছে সেগুলো সব সাধুবাবা কে উপহার দেবে ।
যাই হোক কুমোরকে ওর বৌ বুঝালো পরদিন আরও বেশি বানিয়ো । সেই মতো পরদিন কুমোর আগের দিনের থেকে বেশি মাটির বাসন পত্র বানালো । কিছু বাসন লোকে নিয়ে গেল আর কিছু থাকল। এইভাবে প্রতিদিন কুমোর আলসেমি ভুলে মন দিয়ে কাজ করে অনেক মাটির জিনিসপত্র বানিয়ে ফেলল । সপ্তাহের শেষে হাঁট বসে গ্ৰামে ।সে মোড়লকে দেওয়া কথামতো জিনিসপত্র গুছিয়ে হাঁটে গেল । অনেক দিন পরে হাঁটে যাওয়ায় প্রায় সব জিনিসপত্রই বিক্রি হয়ে গেল।
বেশ কিছু টাকা নিয়ে বাড়ি ফেরে কুমোর।ওর বৌ তো খুব খুশি , স্বামী উপার্জন করেছে । এতোদিনে ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন!
কিন্তু কুমোরের স্বস্তি নেই যা বানায় সব বিক্রি হয়ে যাচ্ছে তাহলে সাধুবাবাকে কিভাবে উপহার দেবে -- সেই চিন্তা করতে থাকে । সাধুবাবাকে উপহার দিলেই তো ধনসম্পদ পাবে , তাহলে আর কাজ করতে হবেনা , শুয়েবসে দিন কাটাতে পারবে ।
এইভাবে পু্রো সপ্তাহ কাজ করে হাট বারে হাটে জিনিসপত্র নিয়ে গেল কুমোর । মোড়ল মশাইও সেদিন হাটে এসে কুমোরকে দেখে খুব প্রশংসা করলো ওর কাজের ।এর পরের সপ্তাহেও আগের মতো প্রায় সব জিনিসপত্রই বিক্রি হয়ে গেল ।
এবারে কুমোর বুঝতে পারে " বিধি বাম ' -- কিছুতেই সে শুয়ে বসে কাটতে পারবে না , তাকে কাজ করতেই হবে । ক্রমে সে বুঝতে পারে তাকে কাজ করানোর জন্য এটা একটা কৌশল।এর পিছনে ওর বৌ আর মোড়ল মশাই এর হাত আছে ।
কিন্তু ততোদিনে কুমোর ঐ দৈনন্দিন কাজে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় তার আর আলসেমি লাগত না বরং কাজ করতেই ভালো লাগত ।
এরমধ্যে একদিন মোড়লমশায় তাদের বাড়ি এলে সে ওনার কাছে ধার নেয়া টাকা শোধ করে দিল । এখন তাদের ঘরে আর অভাব নেই । মোড়ল বললেন," এটা কি ধনসম্পদ পাওয়ার থেকে কম '-- " তোমাকে আমরা এটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম '।
দাদু গল্প শেষ করে পিকুকে বলেন , " কি দাদুভাই, কেমন লাগলো গল্পটা? '
খুব ভালো। জবাব দেয় পিকু।
" গল্পটা থেকে কি শিখলে বলো তো দাদুভাই? '
"অলসতা না করে পরিশ্রম করলে ফল পাওয়া যায় -- ঠিক বললাম তো ? '
" এই তো ঠিক বুঝতে পেরেছো , পরিশ্রমের ফল সবসময়ই ভালো হয় ।'
দাদু , তুমি সবার কাজ আছে বললে কেন?
সুজয়বাবু একগাল হেসে জবাব দিলেন , দেখ দাদুভাই এই যে মৌমাছি --কতো ছোট তাও ফুলের মধু সংগ্রহ করে মৌচাকে সংরক্ষণ করে। এটাই ওদের কাজ । পিঁপড়ে কতো ছোট -- মুখে করে খাবার সংগ্রহ করে অসময়ের জন্য ।তারপরে দেখো এই যে আমরা খাবার খাই যদি চাষীরা কাজ না করে খাবার কিভাবে জুটবে ? এই যে বাড়িতে আমরা থাকি এটাও তো রাজমিস্ত্রিরা বানিয়েছে।ধরো তারা যদি কাজ না করতো ?
এই পৃথিবীতে সবার জন্য নির্দিষ্ট কাজ আছে । সবাইকে মেনে চলতে হয় । তুমি তো ছাত্র---তোমার কাজ হলো মন দিয়ে লেখা পড়া করা । তার জন্য নিয়মিত স্কুলে যেতে হবে।
"আচ্ছা দাদু আমি কাল থেকে রোজই স্কুলে যাব আর মন দিয়ে পড়াশুনা করবো।'
এমনসময় পিকুর মা রমলা দেবী হাজির হয়ে শ্বশুর মশাই কে শ্রদ্ধার সাথে বলেন , " আপনি কতো সুন্দর করে পিকুকে বোঝালেন বাবা ! "আমি মা হয়ে যা পারিনি আপনি পেরেছেন।'আপনার মতো দাদু যেন সবাই পায়।' সত্যি সমকালীন বিপন্ন শৈশবের দিনে দাদু দিদা র সান্নিধ্য খুব প্রয়োজন। তারা তাদের ধৈর্য আর অভিজ্ঞতা দিয়ে কতো সহজে ছোটদের ঠিক ভুল বুঝিয়ে দেন।
পরদিন থেকে পিকুর অনেকটা বদল হয়ে যায় , আর স্কুলে না যাবার বায়না করে না । মনোযোগের সাথে পড়াশোনা করে ।
______________________________________________________________________________________
অর্পিতা মল্লিক
৪৬৮ ড্রিম পার্ক, ব্লক-বি১, ফ্ল্যাট-১এ,
সোনারপুর স্টেশন রোড, কলকাতা-৭০০১০৩
[চিত্রঃ: ইন্টারনেট মাধ্যম থেকে সংগৃহীত]
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন