বিশ্ব যক্ষা দিবসে আমাদের অঙ্গীকার
পাভেল আমান
পৃথিবীতে মানুষকে বেঁচে থাকতে গেলে বিভিন্ন রোগ ব্যাধির সঙ্গে নিরন্তর লড়াই করতে হয়। মানুষের শরীরে এভাবেই বাসা বাঁধে নানান রোগব্যাধি। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষকে শরীরে রোগ প্রতিরোধ গড়ে তোলে অস্তিত্ব সংগ্রামের এই পৃথিবীতে টিকে থাকতে হয়। সেরকমই আতঙ্ক সৃষ্টিকারী একটি রোগ যক্ষ্মা। এমন একটা সময় ছিল, যখন যক্ষ্মার নাম শুনলেই আঁতকে উঠতেন মানুষ। যক্ষ্মা রোগীর ধারে কাছে ঘেঁষতেও ভয় পেতেন চার পাশের লোকজন।এক সময় যক্ষ্মা নিয়েও ততটাই ভয়াবহ ছিল দেশের পরিস্থিতি তার পাশাপাশি ছিল অপর্যাপ্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা। কিন্তু ধীরে ধীরে এই রোগের সঙ্গে লড়তে শিখেছে মানুষ। বর্তমানে আধুনিক চিকিৎসার মাধ্যমে সারিয়েও ফেলা যায় এই রোগ। যক্ষ্মা একটি ব্যাক্টেরিয়া বাহিত রোগ। মাইক্রোব্যাক্টেরিয়াম টিউবারকিউলোসিস নামক ব্যাক্টেরিয়া শ্বাসযন্ত্রকে সংক্রমিত করে ফলে যক্ষ্মা রোগ হয়। আমাদের সমাজে প্রধানত চার প্রকার টিবিতে আক্রান্ত মানুষদের দেখা যায় সেগুলো হলো সুপ্ত বা প্রচ্ছন্ন টিবি, সক্রিয় টিবি, পালমোনারি টিবি ও এক্সট্রা পালমোনারি টিবি।এবারে চোখ বুলানো যাক যক্ষার ইতিহাসের পাতায়। ১৮৮২ সালের ২৪ মার্চ ডা. রবার্ট কক, যক্ষ্মা রোগের জীবাণু মাইক্রোব্যাটেরিয়াম টিউবারকিউলসিস আবিষ্কার করেন। যক্ষ্মা রোগের জীবাণু আবিষ্কারের ১০০ বছর পর ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ, জীবাণু আবিষ্কারের দিনটিকে স্মরণীয় করা ও যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে গণসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রতি বছর ২৪ মার্চ বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস পালিত হচ্ছে।২০২৫ সালের বিশ্ব যক্ষ্মা দিবসের প্রতিপাদ্য হল "হ্যাঁ! আমরা যক্ষ্মা নির্মূল করতে পারি: প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, বিনিয়োগ করুন, প্রদান করুন" যা আশা, জরুরিতা এবং জবাবদিহিতার আহ্বান জানায়।বাংলাদেশ, চিন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, ফিলিপাইন এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় এই যক্ষা রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালে, ১০.৬ মিলিয়ন মানুষ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়েছিল, যার মধ্যে ১.৬ মিলিয়ন মানুষকে এই রোগের কারণে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছিল। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে যক্ষ্মা অত্যধিকভাবে আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও, বিশ্বব্যাপী যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা ১৭০ কোটি, যার মধ্যে ৫৮.৭ কোটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাস করে। প্রতি বছর ৪০০০ এরও বেশি ইউরোপীয় এই রোগে মারা যায়। ভারতে, প্রায় ২৫,৯০,০০০ জন যক্ষ্মা রোগে ভোগেন, অর্থাৎ এক লক্ষ ভারতীয় জনসংখ্যার প্রতি ১৮৮ জন আক্রান্ত। বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস বিশ্বব্যাপী জনগণ এবং চিকিৎসা, সামাজিক এবং অন্যান্য সংস্থাকে একত্রিত হওয়ার এবং এই অতিমারিটির বিস্তার এবং এর কারণে প্রাণ হারায় এমন মানুষের সংখ্যা হ্রাস করার চেষ্টা করার একটি সুযোগ প্রদান করে ।টিবি অর্থাৎ টিউবারকিউলোসিস প্রধানত ফুসফুসকে প্রভাবিত করে, তবে এটি কিডনি, মেরুদণ্ড এবং মস্তিষ্ককেও প্রভাবিত করতে পারে। যখন একজন সংক্রামিত ব্যক্তি কাশি বা হাঁচি দেয়, তখন টিবি বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং এটি এমন এলাকায় বেশি দেখা যায় যেখানে কম বায়ুচলাচল এবং জনাকীর্ণ জীবনযাত্রার পরিবেশ রয়েছে। শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় যক্ষ্মার ব্যাক্টিরিয়া শরীরে প্রবেশ করে। কোনও রোগীর কাশী, হাঁচি, থুতু ও বড় মুখ খুলে কথা বলার ফলে শরীরে প্রবেশ করতে পারে যক্ষ্মার ব্যাক্টিরিয়া। এই ব্যাক্টিরিয়া ধুলোয়ও উপস্থিত থাকে। এতে যক্ষ্মা রুগীর লালা, মিউকাস, থুতু মিশে থাকে। আবার সংক্রমিত জল ও খাবার থেকেও এটি শরীরে প্রবেশ করতে পারে। চিকিৎসকদের মতে ডায়াবেটিসের রোগীদের মধ্যে যক্ষ্মা হওয়ার আশঙ্কা থাকে।ক্যান্সারও যক্ষ্মার অন্যতম কারণ।শরীরের কোনও অংশ ট্রান্সপ্লান্টের পর যে সমস্ত ওষুধ খাওয়া হয়, তার কারণেও যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব এই রোগের অন্যতম কারণ। যক্ষ্মা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে এই রোগ হতে পারে।অধিক ধূমপান ও মাদকাসক্তিও যক্ষ্মার আর একটি কারণ।কাশি, বুকে অস্বস্তি, জ্বর এবং ওজন হ্রাস সবই যক্ষ্মার লক্ষণ। আমাদের সমাজে সাধারণ মানুষের মধ্যে যক্ষা নিয়ে বেশ কিছু ভুল ধারণাও রয়েছে। যেমন- শুধু গরীব মানুষদেরই টিবি রোগ হয়।মনে রাখতে হবে, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, বয়স বা লিঙ্গ কোনও বিভেদ মেনে যক্ষা হয় না। যে কারও হতে পারে। যক্ষা হলে চিকিৎসা হয় ঠিকই তবে শরীরে ক্ষয় বেশি হয়৷ ফলে মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকে৷ এটা ঠিকই তবে এখন চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেক উন্নত।যক্ষ্মা একটি প্রাণঘাতী রোগ, প্রাথমিক রোগ নির্ণয় এবং সঠিক ওষুধের মাধ্যমে এটি নিরাময়যোগ্য। পরিশেষে একটি কথা টিবি রোগে আক্রান্ত মানুষের ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই যথাযথ চিকিৎসা বিশ্রাম খাদ্যাভ্যাস ও স্বাস্থ্য বিধানের মধ্যে দিয়েই এই সংক্রামক রোগের হাত থেকে সুস্থ হওয়া যায়। বিশ্ব যক্ষা দিবসে আমরা প্রত্যেকেই অঙ্গীকার করি একে অপরের সচেতনতা সহযোগিতার মধ্যে দিয়েই যক্ষা মুক্ত বিশ্ব গড়ব।
______________________________________________________________________________________
পাভেল আমান
হরিহরপাড়া -মুর্শিদাবাদ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন