নতুন বছরে অস্মিতাপূর্ণ বাঙালিয়ানা
বিশ্বনাথ পাল
একটা নৌকো কতকগুলো যাত্রী নিয়ে এগিয়ে চলেছে তিরতির করে। কারো চোখে পলক পড়ছে না যেন। কেউ কোন কথাও বলছে না। ভাবখানা এই, কথা বললেই যেন ফসকে যাবে সাধের তরী। ও হরি, শিব্রাম তো আরাম করে কবেই খালাস করেছেন, সবার মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা আবেগঘন সেই চরমতম বাস্তবতার কথা। যতই আদিখ্যেতা করো না, ৩৬৫ দিনের বেশী টিকবে না নতুন বছর। মাঝে মাঝে ভাবি হলোটা কি? মাছে ভাতে বাঙালির এই বঙ্গাব্দ শুধু হৈ হুল্লোড় আর ডিজের ডিস্কা ঢিসুম গগন বিদারি শব্দের ঝংকারে আটকে যাবে চিরতরে? না না, বাঙালি এতটা কাঙালী নয়। বোহেমিয়ান জীবনে পায়ে পায়ে সে শুধু পৌঁছে যাবে ১৪৩১ বঙ্গাব্দে। তারপর, সে তরতর করে পৌঁছে যাবে জোড়াসাঁকোর রবীন্দ্রনাথে, চুরুলিয়ার নজরুলে, গীতরসধারা সংসারের ধূলিজালে পড়েও খুঁজবে আবহমানের গল্প। এই করেছ ভালোর নিষ্ঠুর অন্তরায় দাঁড়িয়ে 'আমার মাথা নত করে দাও বলে'ও বাজারের বিক্রেতাদের মধ্যে 'কৃপণের যাশু' হয়ে বাঁচবে। গৃহিনীর পাকা চুলে জ্যোৎস্না চুঁইয়ে পড়লে মনে ভাববে,হায় জীবন এতো ছোট কেনে? এত তাড়াতাড়ি এইসব অঘটন ঘটে কেনে? পায়ে চপ্পল গলিয়ে তবুও সে বাজারে বেরোবে ফিনফিনে পাঞ্জাবির গিলে গিলে খেয়েছে অস্থিচর্মসার এই শরীর।
একটা বাক্য কইতে আগে পিছে বিশুদ্ধ ইংরেজি আর হিন্দী না মেশালে কথা শুধু কথার কথা হয়ে যায় দেখেও আমরা দাঁড়ি কমাতেও দাঁড়াই না। দাঁড়াই শুধু মাত্র আমাদের আভিজাত্যের অঙ্গীকার ও প্রচারসর্বস্ব আমাদের এক এবং অদ্বিতীয় বাঙালিয়ানায়। ধূতি পাঞ্জাবি আর "আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালোবাসি"র কোরাসে গলা মেলানোয়। আমরা সহজ সরল প্রাণবন্ত কথামালার নৈবেদ্য "শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণকথামৃত"দেখি না মনের ধূলো ঝেড়ে, এসএম এসের দৌলতে চিঠি লিখতে ভুলে গেছি বলে স্বামীজির পত্রাবলীর খোঁজ রাখবো না? আত্মবিস্মৃত বাঙালি হয়েই থেকে যাবো? বাঙালি খানা, বাঙালি গানা, মনে মনে আমরাই বা চাই কতখানা? বাঙালির স্বর, বাঙালিরঘর, বাঙালির লটবহর, মোহন বাগান ইস্টবেঙ্গল -- অজয়বসুর ধারাভাষ্য অবশিষ্ট আর কিছু রইল না।
তাই বিন্দুতে সিন্ধু দর্শনের মতো শ্রেণীকক্ষের টেবিলে বইটা রেখে একটি দুটো লাইন তার থেকে পাঠ করে শিক্ষকমহাশয় যদি বলেন,ভালো করে দেখ, এই বইটা গীতাঞ্জলি।সাধারণ মলাট ,কোন ছবিছাবা নেই ,সাদা মাটা এই বইয়ের যত ছবি সব কথা দিয়ে সাজানো,মনের কথা হৃদয়ের অনুভূতির সব রঙের নৈবেদ্য--এই গীতাঞ্জলি।এই বইটাই সাহিত্যের সেরা সম্মান নোবেল পুরস্কার এনেছে তার ইংরাজি অনুবাদ দিয়ে। কৃষকবাবা যেমন করে তার কিশোর ছেলেকে হাতে ধরে দেখায় এইটা বাঁকুরি, ওইটা জোতের সবচেয়ে বড়জমি ,তার উত্তরে মেটেল মাঠ,দক্ষিণে শিয়ালগড়ের মাঠ ঝিঙেশাল আর লালস্বর্ণ ধানের আদত মাঠ, ঠিক তেমনি করেই আমরা গীতাঞ্জলি দেখাবো, পথের দাবী শেখাবো, কপালকুণ্ডল ও আনন্দমঠ চেনাবো। ও আর এসের আবিস্কার কর্তার নাম যে ডাক্তার দিলীপ মহালনবীশ তাও বলবো। প্রথম নবজাতক শিশুর কারিগর বাঙালি বিজ্ঞানী সুভাষ মুখোপাধ্যায়, কিম্বা কালাজ্বরের আবিস্কারক উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী, জগতবিখ্যাত বিজ্ঞানী ও গাছের প্রাণ জানার মহতীপ্রাণ জগদীশ বসু, বিজ্ঞান তপস্বী ও বেঙ্গল কেমিক্যালের প্রতিষ্ঠাতা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, বিজ্ঞানকে বহু মানুষের দরবারে ভালোবেসে পৌঁছে দেওয়ার কাণ্ডারী জগদানন্দ রায় ও গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য,
বহুভাষায় পারদর্শী হরিনাথ দে,যোগীন্দ্রনাথ সরকার, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায়,সুখলতা রাও, কুসুমকুমারী দেবী,অন্নদাশঙ্কর রায়, লীলা মজুমদার, সত্যজিৎরায় থেকে ভবানী প্রসাদ মজুমদার। হাজার চুরাশির মা, অগ্নিবীণা, গোরা, সেই সময়, প্রথম প্রতিশ্রুতি, শ্রীচরণেষু মা, মহাপ্রস্থানের পথে, শিশু ভোলানাথ, শক্তি, সুনীল শঙ্খের পাশাপাশি আমরা হলধর নাগের কথা বলবো,বলবো লোকমাতা রাণী রাসমণির কথা, বলবো বেবী হালদারের নাম, জীবন চুঁইয়ে জীবন ছুঁইয়ে দেখার পাঠ।
বিজয় সিংহের কথা, শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্করের কথা,রাজা রামমোহন রায়,নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু,অগ্নিযুগের ব্রহ্মা নীরালম্ব স্বামীর কথা, প্রথম মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনী গাঙ্গুলির কথা। স্বামীজীর শিকাগো ধর্মসভায় বিশ্বজয়, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা তখন৪ বইয়ের পাতা থেকেসরাসরি চলে আসবে আমাদের মনে। বাংলাটা ঠিক না আসার লজ্জা সেদিন আমাদের আর কুরেকুরে খাবে না।আমাদের পড়শি ঋক বাগ্দীর বোকা হবার বাসনা আমাদের নস্টালজিক করতে পারবে না। এই ঋকরাই আমাদের বিবেক, মানবিকতার বোধে উদ্বুদ্ধ করবে। বাঙালী তুমি পথ হারিও না ,থেমে যেও না। এগিয়ে চলো। চরৈবেতি।
==================
Biswanath pal
Village -Amarpur, PO--Dwarnary PS -Galsi District --Purba Bardhaman
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন