ধরিত্রীর সংসার
বিকাশকলি পোল্যে
'দাদু আগে একটা গল্প শোনাও'।
সমস্বরে বলে উঠল ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা।
আমার দাদু মানে ঠাকুর্দা তাঁর মাটির বাড়ির বারান্দায় বসে দুই বেলা ছেলে মেয়েদের পড়াতেন। তারা সব শিশু শ্রেণীর ছেলে মেয়ে ।পড়াশোনা হয়ে গেলে প্রতিদিন দাদু তাদের গল্প শোনাতেন। আজ তারা জেদ ধরেছে আগে পড়বে না। আজ তারা আগে গল্প শুনতে চায়।দাদু তাদের নিরাশ করলেন না।গল্প বলতে শুরু করলেন।
'তবে শোন।পাঁচ ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার ধরিত্রীর। পাঁচ ছেলের যেমন রূপ তেমন তাদের গুণ।মেয়েটিও তাই। যেমনই রূপবতী তেমনই গুণবতী। এক মেয়ে তাই বাবা মায়ের ভীষণ আদরের। পাঁচ ভাইয়ের এক বোন বলে কথা। বোনকে চোখে হারায় তারা। আদর করে তাই তাকে সবাই রানি বলে ডাকে।
ধরিত্রীর বড় ছেলের নাম নিদাঘ। প্রথম সন্তান। ধরিত্রীর স্বামী প্রকৃতি খুবই ভালো,তবে খুব খামখেয়ালী। এই ভীষণ রাগ তো একটু পরে রাগ পড়ে গিয়ে একেবারে শান্ত।নিপাট ভদ্রলোক। নিদাঘ খানিকটা তার বাবার স্বভাব পেয়েছে। রাগলে একেবারে চন্ডাল। তখন তার দিগ্বিদিক জ্ঞান থাকে না। তার সেই রাগত তেজে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে মানুষজন। ধরিত্রী আর প্রকৃতি তখন তাদের সব কাজ ফেলে নিদাঘকে শান্ত করার চেষ্টা করে।সন্তানকে শান্ত করতে গিয়ে মাঝেমধ্যে ধৈর্য হারিয়ে প্রচন্ড ক্ষোভে নিজেই ফুঁসে ওঠে প্রকৃতি। অশান্ত হয়ে ওঠে। দিনকে দিন নিদাঘের যেভাবে তেজ বাড়ছে তাতে খুব চিন্তায় আছে ধরিত্রী আর প্রকৃতি দুজনেই।
--'ওসব নিয়ে অত ভেবো না তো।আমি আছি কি জন্য?' বাবা মাকে বোঝায় রানি। তাদের আদরের মেয়ে। বড় মায়াবতী সে। মেয়ের ভালো নাম বর্ষা। তাই তাকে সবাই বর্ষারানি বলেই ডাকে। বর্ষার কথাতে ভরসা পায় ধরিত্রী আর প্রকৃতি দুজনে।কথাটা খারাপ বলেনি তাদের আদরের মেয়ে। নিদাঘ যখন রেগে আগুন হয়ে ওঠে। ধরিত্রী যখন কিছুতেই তাকে বাগে আনতে পারেনা। প্রকৃতি ও নিদাঘকে নিরস্ত্র করতে না পেরে ধৈর্য্য হারা হয়ে যায়।ঠিক তখন মেয়ে বর্ষাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে প্রকৃতি।
--'চল মা চল, তোর দাদাকে থামাবি চল। একটু শান্ত করবি চল তোর দাদাকে।' বাবার এই ডাকে ছুটে চলে আসে মেয়ে। দাদার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করে সে।
বোন অন্ত প্রাণ নিদাঘের। বোনের কথাতেই শান্ত হয় সে।
--'ঠিক আছে। তুই যা বলবি তাই হবে।তুই হলি আমার আদরের একমাত্র বোন।তোর কথা কি আমি ফেলতে পারি।' এই বলে বোনের কথায় ধীরে ধীরে তেজ কমে আসে নিদাঘের।প্রকৃতিও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় মেয়ের দিকে। তখন ধরিত্রী যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মা ধরিত্রী।
বোনটা তার পাগলি একেবারে।নিদাঘ বোঝে। বোনকে এতটাই ভালবাসে যে বোনের কথা ফেলতে পারে না সে। মা'র যে এত কাকুতি মিনতি শুনছিল না এতক্ষন,সেই নিদাঘই যেই বোন এল, গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দাদা বাছা বলল ওমনি শান্ত হয়ে গেল নিদাঘ।দাদার রাগ কমিয়ে কি খুশি বোন।সেই খুশিতে ছুটে এল তার সখিরা।মায়াবতী মেঘের দল। প্রথমে ঝিরিঝিরি তারপর ঝমঝম শুরু হয়ে গেল বর্ষার নাচ। বাবা মা যে কাজ করতে পারছিল না দাদা নিদাঘকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সে করে ফেলল সেই কাজ । সাফল্যের আনন্দে নাচতে শুরু করে দিল বর্ষা টিপটিপ,টুপটাপ, ঝিরিঝিরি, ঝরঝর, রিমঝিম, ঝমঝম,ঠুঙঠাঙ,টুংটাঙ।আর প্রকৃতিও সেরকম মেয়ের নৃত্য দেখে আনন্দে নিজেও শুরু করে দেয় নৃত্য। গম গম গুড় গুড় শুরু হয়ে যায় বাজনা। তাদের দুজনের এই ছেলেমানুষি দেখে ধরিত্রী তো হেসে লুটোপুটি। তখন তার হৃদয়ে যেন সহস্র সুখের ঢেউ।
মেয়ের প্রতি যেমন বাবার তেমনি বাবার প্রতি ও মেয়ের একটা স্বাভাবিক আলাদা টান থাকে।নিদাঘকে শান্ত করার আনন্দে প্রকৃতি আদরের মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে মেতে ওঠে নৃত্যে। খুশিতে মত্ত হয়ে বাবা মেয়ে একেবারে একাকার হয়ে যায়।ধরিত্রীর হয়েছে এক জ্বালা।যদিও বা বড় ছেলে নিদাঘকে শান্ত করা গেল এখন বাবা মেয়েকে থামাবে কার সাধ্য।সব মুখ বুজে সহ্য করতে হয় ধরিত্রীকে। মা তো! কথায় আছে 'মা হওয়া নয় মুখের কথা'।
প্রকৃতিও হয়েছে তেমন। মেয়েকে শাসন করা তো দূরের কথা মেয়ের কথায় ওঠে আর বসে।মেয়ে তাকে যা বলবে তাই। খামখেয়ালি প্রকৃতি আর বর্ষার যুগলবন্দিতে ধরিত্রীর নাভিশ্বাস উঠতে শুরু করে।ডুবতে থাকে ভাসতে থাকে ধরিত্রীর সংসার।
--'ওরে থাম, ওরে থাম তোরা।সব যে ভেসে গেল।' মায়ের আকুল আবেদনে থামতে শুরু করে বর্ষা।শান্ত হয় প্রকৃতিও। ক্লান্ত হয়ে ধরিত্রী মায়ের বুকে মাথা গুঁজে দেয় মেয়ে। নাচানাচি ঝাপাঝাপি ভাসাভাসির পর শান্ত হয় বাবা ও মেয়ে।ধরিত্রী পায় সবুজ শান্তির সজীবতা।
বর্ষারানি যখন ধরিত্রীর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে তখন গুটিগুটি পায়ে আসে আর একজন। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। খুশিতে টলমল করে ওঠে দিঘির জল। সেই খুশিতে পদ্ম শালুক সই পাতায় নিজেদের মধ্যে। ভোমরা এসে গান গায়। উলুক ঝুলুক মেঘেরা হাসতে থাকে ভাসতে থাকে নীল আকাশের বুকে।খুশিতে তারা ভুলেই যায় তাদের মুলুক। পথভোলা মেঘেদের দেখে মেতে ওঠে কাশ।উতলা হয়ে 'আয়রে ভাই,আয়রে ভাই, খুশি হয়ে গান গায়' বলতে থাকে সবুজ খেত । ধরিত্রীর কোমল সবুজ বুকে ঝরে পড়ে রাতের শিশির।সারাদিন শিউলি ঝরে চুপচাপ টুপটাপ ধরিত্রীর ভেজা আঙিনায়। সে এক আনন্দের সময় বটে ধরিত্রীর।
তখন শরৎ আসে গো শরৎ।ধরিত্রির আর এক ছেলে। শরৎ যেন সাক্ষাৎ আনন্দের দূত ।এত আনন্দ দিতে পারে ছেলেটা।অবাক হয়ে যায় ধরিত্রি আর প্রকৃতি। কুয়াশার চাদর ঢেকে রবির কিরণ মেখে মিটিমিটি হাসে শরৎ।
ধরিত্রীর কাছে বিদায় নিয়ে বর্ষারানি চলে যায় দূর দেশে। বেশ মন খারাপ হয় ধরিত্রীর। মা তো! আনন্দ বিষাদ সমান ভাবে ভাগ করে নিতে হয় তাকে।আদরের মেয়ের বিদায়ে প্রকৃতিও যেন একটু বিষন্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু শরৎ তা বুঝতেই দেয় না কাউকে।শরৎ যেন ম্যাজিক জানে।ঝোলা থেকে বের করে শারদীয়ার আনন্দ। নিজেদের সবুজ বুকে শরতকে দুহাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে ধরিত্রী ও প্রকৃতি।শান্তিতে সবুজ হয়ে ওঠে তারা। বাবা-মা তার সন্তানকে আঁকড়ে থাকে না সন্তান বাবা মাকে জড়িয়ে থাকে তা বোঝা দায়।আসলে পরস্পর পরস্পরকে জড়িয়ে থাকে শরৎ ধরিত্রী ও প্রকৃতি। শান্তির সবুজে জড়াজড়ি হয়ে থাকে।শরতের আগমনে আনন্দে মুখরিত হয়ে ওঠে প্রকৃতি আর ধরিত্রী।
হিম ঝরা রাতের গভীরে কিংবা অমাবস্যার আঁধারে আসে হেমন্ত। শরতের পরের জন । যেন পিঠোপিঠি দুই ভাই ।যমজ বললেও বোধহয় ভুল হবেনা।শরতের স্বভাব চরিত্রের বেশিরভাগটাই পেয়েছে ধরিত্রীর এই ছেলেটা। দাদাভাইয়ের খুব মিল।শরতের শৌর্যে ঢাকা পড়ে থাকে হেমন্ত।তার নিজস্বতা চোখে পড়ে না সেভাবে।শরতের কাছে সে নিতান্তই ম্রিয়মাণ।শরৎ যেমন হাসিখুশি আনন্দমুখর হেমন্ত তেমনটা নয়। সে একটু গম্ভীর প্রকৃতির। মুখচোরা চুপচাপ। গায়ে তার নতুন ফসলের গন্ধ।
হেমন্তের হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে আসে শীতল। ছেলেটি বড় ছেলে নিদাঘের একদম বিপরীত। কি স্বভাবে কি চরিত্রে। বরফ ঠান্ডা সে। এতটুকুও উত্তাপ নেই শরীরে। রুক্ষ শুষ্ক ছেলেটা ভীষণ বার মুখো।ঘরে থাকতে চায়না একদম। বেড়াই বেড়াই ভাব সারাক্ষণ। আজ চড়ুইভাতি তো কাল শুধু টো টো করে বেড়ানো সারাদিন। রাতে জলসা আর খাওয়া দাওয়া। খাওয়া-দাওয়ার বহর আছে খুব ছেলেটার।শীতল এলে ধরিত্রি একেবারে আহ্লাদে আটখানা। হেমন্ত এনে দেয় ধান। নতুন ধান। শীতল এলে সেই নতুন ধানে হয় নবান্ন।শিউলিরা দোরে দোরে হাঁক দেয়'গুড় নেবে গো গুড়,জিরেনকাটের খাঁটি নলেনের গুড়'।বাড়ি বাড়ি চলতে থাকে পিঠে পুলি আর পায়েস খাওয়ার ধুম। আসে পৌষ সংক্রান্তি, গঙ্গাসাগর মেলা। দু'দন্ড বসার জো থাকে না ধরিত্রীর। শীতলের জন্যেই শহরের অলিগলিতে শুরু হয়ে যায় বইমেলা।শীতল দুহাত ভরে টাটকা শাকসবজি উপহার দেয় ধরিত্রিকে।
শীতলের পিছনে ওটা কে? ওরে বাবা! এ তো শান্তাক্লজ। সান্তা আসে শীতলের সঙ্গে নানা উপহার নিয়ে। তবে বড় রুখাশুখা এই শীতল।তাই তাকে পছন্দ করে না অনেকে। তাতে অবশ্য কিছু যায় আসে না প্রকৃতি আর ধরিত্রির।
'ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল, লাগলো যে দোল' রুখাশুখা মেঠো পথ ধরে গান করতে করতে কে আসে? আরে এ তো বসন্ত।প্রকৃতি আর ধরিত্রির আদরের ছোট ছেলে। স্নেহ সবসময় নিম্নগামী। প্রকৃতি আর ধরিত্রী তাদের সমস্ত স্নেহ ঢেলে দিয়েছে তাদের এই ছেলেটার উপর। ঠাটে বাটে সে একেবারে রাজা। তাই তো তার আরেক নাম ঋতুরাজ। চারিদিকেই রঙের ছড়াছড়ি। গাছে গাছে কচি পাতা। বাহারি ফুলের সমারোহ। গাছের ডালে ডালে কোকিলের কলতান। ছেলের সঙ্গে সঙ্গে সেজে উঠে মা ও। আনন্দ উৎসবে মুখরিত হয়ে ওঠে প্রকৃতি ও ধরিত্রী। আসে প্রাণের উৎসব দোল।'আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে' গেয়ে ওঠে প্রকৃতি।
বর্ষা পাঁচ ভাইয়ের একমাত্র আদরের বোন। সব ভাইদের সঙ্গেই তার সখ্য। তাইতো সব ভাই এলেই সে একটুখানি সময়ের জন্যে হলেও এসে দেখা দিয়ে যায়।'
এতক্ষণ পর ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে বলে উঠল, 'ও দাদু তুমি তো আমাদের ছয় ঋতু পড়াচ্ছ।'
ধরা পড়ে গিয়ে হো হো করে হেসে উঠলেন দাদু ।
_____
বিকাশকলি পোল্যে
১৩,উষাপল্লী
২৮০,বোড়াল মেইন রোড
গড়িয়া
কলকাতা ৭০০০৮৪
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন