সুচন্দ্রা বসু
রবীন্দ্রনাথ তখন ভীষণ অসুস্থ। বলা যায় একরকম শয্যাশায়ী। দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন পরিবারের সবাই । তার মধ্যেই চার বছরের শিশুটি এসে তাঁর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গল্প করত।সে দাদুকে বলত কবির লেখা সব কবিতা সে মুখস্থ করে ফেলেছে। ওই অসুস্থ মানুষটা বাঁচার রসদ ফিরে পেয়েছিল শিশুর সাথে গল্প করে। কিন্তু শিশু যুবরাজের চোখের সামনেই তার নিত্য খেলার সাথী দাদু যেন কেমন একটু একটু করে নিস্তেজ হয়ে যেতে থাকল।দাদুকে নিস্তেজ শরীরে পড়ে থাকতে দেখে কখনও গুটিগুটি পায়ে ঘরে ঢুকে চুপচাপ বেরিয়ে যেত। তারপর একরাশ বহু প্রশ্ন নিয়ে বাইশে শ্রাবণ শান্ত হয়ে গেছে সেই ছটফটে শিশুটি। বাইশে শ্রাবণ দুপুরবেলা সব জাগতিক বন্ধন ছেড়ে পাড়ি দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ অমৃতলোকে।ঘরে ভিড় উপছে পড়ছে।ভিড়ের ভিতরই বিদ্যুতবেগে এসে দাঁড়িয়েছিল ছোট্ট শিশু সাদা চাদরে আবক্ষ ঢাকা রবিদাদুর নিথর দেহ ঘেঁষে। দাদুকে দেখে সে স্তব্ধ।কোন কথা ছিল না তার মুখে।সেদিন সে আর বাপ মানি খোকন এই অদ্ভুত অঙ্কের তিন লজেন্স চায়নি।সে দেখেছিল অপারেশনের আগে তার হাতে লজেন্স না দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছিল রবিদাদু। আজ দাদু শান্ত হয়ে শুয়ে।তারপর যখন ফুলে ঢাকা গুরুদেবের দেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নীচে ।
তখন সে চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিল।হাজার লোকের ভিড়ের মাঝে বলেছিল, __ দাদুকে কোথায় ওরা নিয়ে যাচ্ছে? অমন করে নিয়ে যাচ্ছে কেন?দাদুর যে কষ্ট হবে।
হ্যাঁ কষ্ট তার হয়েছিল।সে চেয়েছিল শান্তিনিকেতনের শান্তছায়ায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে।
ছোট্ট শিশু বুঝে গেল তাকে আর 'যুবরাজ' বলে ডেকে দাদু লজেন্স দেবে না। কিন্তু কে এই শিশু যুবরাজ?
যুবরাজ হল তাঁর প্রিয়তম অভিজিৎ চন্দ।রবীন্দ্রনাথের সচিব অনিল চন্দ ও রাণী চন্দের একমাত্র পুত্র।অভিজিতের জন্ম কলকাতায়।প্রথমবার যখন সে শান্তিনিকেতনে আসে,তাকে স্নেহভরে কোলে তুলে আদর করে বলেছিলেন নাম রইল অভিজিৎ। তখন শান্তিনিকেতনে অভিজিৎ একমাত্র শিশু। তখনও সে চলতে শেখেনি। মায়ের কোলে চড়ে বাইরে এসে সে আগে রবীন্দ্রনাথের মুখ দেখত। ভোরে উঠে তাঁর কাছে আসা অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। সে এলেই দাদু লেখার টেবিলের উপরে রাখা কাঁচের বয়াম খুলে তার সামনে ধরতেন।সে হাত ডুবিয়ে একমুঠো লজেন্স তুলে নিত।তারপর হাতের তালুতে তা মেলে ধরে গুণত।বাপ মানি খোকন বলে তিনটি লজেন্স তালুতে রেখে সে বাকি লজেন্স বয়ামে ফেলে দিত।এই তিনটির বেশি লজেন্স সে কোনদিন নিত না। তাই দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে সবাইকে ডেকে বলতেন শিশু বয়সে এতো নির্লোভ আমি কাউকে দেখিনি। এইভাবে অভিজিতের দিন শুরু হত।প্রতিদিন ভোরের এই প্রাপ্তি থেকে তাকে বঞ্চিত করল বাইশে শ্রাবণ। সেই দিন থেকে বন্ধ হয়ে গেল তার নিজের গণনা পদ্ধতি বাপ মানি খোকন। নির্লোভ যুবরাজের রবি সেদিন অস্তাচলে।আর তার লজেন্স খাওয়ার ইচ্ছাটুকুও তলিয়ে গেল অতলে।হারিয়ে গেল তার বন্ধু রবিদাদু।
____________________________________________________________________________________
সুচন্দ্রা বসু
২৬৭/৫ জি.টি.রোড
পানপাড়া শ্রীরামপুর হুগলি।
পিনকোড ৭১২২০৩
[ছবি: ইন্টারনেট মাধ্যম থেকে সংগৃহীত]
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন